পবিত্র সরকার
বাংলা সন (‘সন’ কথাটা আরবি, যেমন ‘সাল’ কথাটা ফারসি) কীভাবে তৈরি হল তা নিয়ে মতভেদ আছে, বা পরে তৈরি করা হয়েছে। পরের একটা ‘দেশপ্রেমিক’ তথা হিন্দুত্ববাদী মত হলে তা রাজা শশাঙ্ক চালু করেছিলেন তাঁর রাজত্বের কোনও একটা স্মরণীয় ঘটনার স্মারক হিসেবে, কিন্তু কী সে ঘটনা, তা নিয়ে ঐতিহাসিকেরা অন্ধকারে আছেন, তাই আমরাও আলোকিত হইনি। ‘দেশপ্রেমিক’ ইত্যাদি কথা প্রয়োগ করছি এই জন্য যে, এঁরা বাংলা সনের সঙ্গে মুসলমান-সংস্পর্শ আছে তা স্বীকার করতে চান না, ‘সন’ কথাটা সত্ত্বেও।
যে মতটা বেশিরভাগ মানুষ মোটামুটি স্বীকার করেন, এমনকি পঞ্জিকাও বর্জন করতে সাহস করে না, সেটা হল যে, মোগল সম্রাট আকবর এই বাংলা সনের বা অব্দের বর্তমান রূপ দেন। ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় হিজরি সন, হজরত মুহম্মদের মক্কা থেকে মদিনা গমন উপলক্ষ্যে। আকবরের রাজ্যলাভ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে, অর্থাৎ সেটা ৯৬২-৩৩ (১৫৫৬-৫৯৪ = ৯৬২) হিজরি সাল। কিন্তু সে সাল ছিল চন্দ্রকলার বাড়া-কমা অনুসারে, অর্থাৎ চান্দ্রমাস অনুসারে। একটা মাস কৃষ্ণ আর শুক্ল এই দুই পক্ষে ভাগ ছিল, প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমা বা অমাবস্যাতে পক্ষ শেষ হত। কিন্তু আকবর তাকে সৌরমাসের হিসেবে আনেন, তিনি, অথবা তাঁর সভার জ্যোতির্বিদরা, তাঁদের যিনি প্রধান তাঁর নাম ফতেউল্লাহ শিরাজি — দিন-রাত্রির অর্থাৎ সূর্যোদয় অনুসারে মাস গণনা হতে শুরু করার নির্দেশ দেন। পারস্যে নাকি আগেই একটা সৌরবৎসর প্রচলিত ছিল, পারস্যের লোক শিরাজি তাতে প্রভাবিত হয়ে থাকবেন। সেখানে (‘সাল’ কথাটা ফারসি আগেই বলেছি) নববর্ষের দিনটির নাম ‘নওরোজ’ — সে ছিল উৎসবের দিন। শোনা যায় বাঙালি ব্রাহ্মণদের অনুরোধে আকবর এটা করেছিলেন। ধরে নেওয়া যাক যে ৯৬২-৬৩ হিজরি ৯৬২-৬৩ বাংলা সন হয়ে গেল, কিন্তু তার কিছু চরিত্রগত পরিবর্তনও ঘটল আকবরের হস্তক্ষেপে। সেগুলি এই—
আগে বছর শুরু হত অগ্রহায়ণ মাসের পয়লা, যে জন্য অঘ্রান মাসের নাম ‘মার্গশীর্ষ’। তখন খেতের ফসল তোলা হত, তাই তার নামই ছিল ‘ফসলি’ সন। তাতেও নাকি হিসেব এবং শুল্ক ইত্যাদি গণনার অসুবিধে দেখা দেয়, ফলে আকবর বৈশাখ থেকে নতুন বছর শুরুর ব্যবস্থা করেন। ফলে বাংলা সনের ভিত্তি হিজরি সন। তবে চান্দ্রমাসে থেকে সৌরমাসে বদল হওয়ায় তার সঙ্গে হিজরি সনের এখন কিছুটা তফাত হয়ে গেছে। তাই সৌরমাস এবং ১ বৈশাখ — এই দুয়ের জন্যই আমরা সম্ভবত আকবরের কাছে ঋণী।
এই ইতিহাস যাই হোক না কেন, এখন শহুরে বাঙালির কাছে বাংলা সনের বিশেষ কোনও মূল্য নেই, এক হিন্দুদের পুজো-আচ্চার মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠান আর কিছু আধা-ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়া। বিবাহ, উপনয়ন, অন্নপ্রাশন, সাধভক্ষণ, হালখাতা, পিতৃপুরুষের তর্পণ ইত্যাদি। পাঁজিতে আরও কিছু ব্রতের কথা পাওয়া যায়, আর এখনও পঞ্জিকাতে একাদশীতে বেগুন খাওয়া, নবমীতে লাউ, বা রবিবারে পূতিকাভক্ষণ বা পুঁইশাক খাওয়া নিয়ে নানা নিষেধনির্দেশ থাকে, কিন্তু সেগুলো এখন গ্রামের বিধবারাও মানেন কি না সন্দেহ। তবে পুজো আর সামাজিক ক্রিয়াকর্ম পাঁজি মেনেই হয়। আর পয়লা বৈশাখ এলে আমরা হইহই করে বাঙালি হয়ে পড়ি। হিন্দু বাঙালির চেহারাটাই কাগজে বিজ্ঞাপনে বেশি দেখা যায়, কিন্তু নববর্ষ তার সমস্ত ধর্মমুক্ত মহিমা নিয়ে দেখা দেয় এ বাংলায় নয়, ও বাংলায়, ঢাকায়, না — শুধু ঢাকায় নয়, সারা বাংলাদেশে। প্রায়ই আমাদের নববর্ষের একদিন আগে। বাংলাদেশ একটা বিজ্ঞানসম্মত পাঁজি মেনে চলে, সেটা মেঘনাদ সাহার মতো মানুষেরা তৈরি করেছিলেন, ভারত সরকারের নির্দেশে। বাংলাদেশ সেটা গ্রহণ করেছে — তাই তাদের কোন্ মাস কত দিনে তা চিরকালের মতো ঠিক হয়ে গেছে। আমরাই পিছিয়ে আছি, আমরা সে সুপারিশ গ্রহণ করতে পারিনি। আমাদের পাঁজি বিজ্ঞানসম্মত করার চেষ্টা পঞ্জিকাওয়ালাদের বাধায় ভেস্তে গেছে। এখনও আমাদের কোন্ মাসে কত তারিখ হবে তা স্বঘোষিত জ্যোতিষীদের গণনার উপর নির্ভর করে, কোনও মাসের তারিখ প্রত্যেক বছর এক থাকে না।
নববর্ষের দিনটিকে ধর্মমুক্ত ও নান্দনিক চেহারা দেন রবীন্দ্রনাথ, তাকে ঋতুচক্রের আবর্তনের মধ্যে স্থাপন করে, তার জন্য কবিতা গান আর নাচ ইত্যাদি অভিকরণের সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে সেটা যেমন বিশাল আকার নিয়েছে আমাদের এখানে ততটা এখনও নেয়নি, কিন্তু আমরা তাকে আস্তে আস্তে ধরবার চেষ্টা করেছি। এক সময় হয়তো এই নববর্ষ সমস্ত বাঙালির এক মহৎ ধর্মমুক্ত উৎসব হয়ে উঠবে।