রৌহিন ব্যানার্জী
আমাদের গর্বের ভারতীয় গণতন্ত্র যে সব শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আজ এতগুলো বছর অতিক্রম করে ফেলল, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হল তার ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা — যা একদম প্রান্তিকতম মানুষদেরও গণতন্ত্রের প্রক্রিয়ায় সামিল হবার সুযোগ দেয় নিজের নিজের মতদান-এর মাধ্যমে, এবং একই সঙ্গে নিজেদের স্থানীয় সমস্যার সমাধানে নিজেদেরই অংশগ্রহণের মাধ্যমে। সারা দেশের জন্য যেমন লোকসভা, সারা রাজ্যের জন্য বিধানসভা, তেমনই নিজের নিজের জেলা, ব্লক বা গ্রামের জন্যও মানুষ পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচন করে নিতে পারেন নিজেদের প্রশাসক — গ্রামসভার মাধ্যমে প্রত্যেকের মত পৌঁছে যেতে পারে প্রশাসনের উপরের স্তরে।
এ বছর, ২০১৮ পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনের বছর। ৩৪ বছরের বামপন্থী সরকারকে সরিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর এটি দ্বিতীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন (মাঝের খুচরো উপ-নির্বাচনগুলি হিসাবে নিচ্ছি না)। এই মুহূর্তে বিধানসভার মতোই পঞ্চায়েতেও তৃণমূল কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠ তিনটি স্তরেই। এ রাজ্যে মোটামুটি সাড়ে সাতশোর কিছু বেশি জেলা পরিষদ (১৭টি জেলায়), ন হাজারের কাছাকাছি পঞ্চায়েত সমিতি এবং প্রায় ছত্রিশ হাজার গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে শতকরা আশি ভাগই এই মুহূর্তে তাদের দ্বারা পরিচালিত — বিরোধীরা প্রায় কোথাও সেভাবে নেই বললেই চলে। এমতাবস্থায় এই বছরের নির্বাচনের ছবিটা কেমন হতে পারত এবং আমরা কী দেখছি, আসুন একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
গতকালই কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের জেরে শেষ অবধি নির্বাচন স্থগিত রাখা হয়েছে — কারণ হাইকোর্টের মতে রাজ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিস্থিতি নেই। বহু জায়গায় বিরোধীরা মনোনয়ন পর্যন্ত পেশ করতে পারেননি। নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না। পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে বিরোধী রাজনীতি বলে কিছু প্রায় নেই বললেই চলে। লোকসভা, বিধানসভা এবং পঞ্চায়েত অথবা পৌরসভা, সর্বস্তরেই শাসকদল প্রায় একচ্ছত্র — সম্প্রতি যে কটা নির্বাচন হয়েছে, কোথাও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বামপন্থী আন্দোলন দিশাহারা অবস্থা কাটিয়ে সংগঠন মজবুত করে উঠতে পারেনি প্রায় সাত বছর কেটে যাবার পরেও, দক্ষিণপন্থী বিজেপি একটু একটু করে জায়গা ভরাট করার চেষ্টা করলেও সেভাবে এখনও নির্ণায়ক শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। কংগ্রেস বহুদিনই এ রাজ্যে নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক করে রেখেছে। এমতাবস্থায় এই পঞ্চায়েত নির্বাচনেও অন্যরকম কিছু হবার সম্ভাবনা আছে বলে অতি বড় বিরোধীও আশা করছেন বলে মনে হয় না। অথচ তা সত্ত্বেও শাসকদলের অতি-সক্রিয়তা চোখে পড়ার মতো। সাম্প্রতিক বেশ অনেকগুলি নির্বাচনের মতোই এই নির্বাচনেও এটা অনেকের কাছেই একটা ধাঁধার মতো — এই সক্রিয়তার কারণ কী? কেন বিরোধীদের মনোনয়ন পর্যন্ত পেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না বহু জায়গায়? কেন নির্বাচন কমিশনকে এভাবে হাতের পুতুল বানিয়ে রাখার চেষ্টা? কেন প্রশাসনকে দৃষ্টিকটুভাবে সর্বত্র ব্যবহার করা হচ্ছে?
বস্তুত এই প্রশ্নগুলিই এবারের পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের কেন্দ্রীয় উপপাদ্য — শাসকদলের এই অতি-সক্রিয়তা। এই মুহূর্তে ভারতের কেন্দ্রের শাসক দল এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যের শাসক দল — ভাজপা এবং তৃণমূল কংগ্রেস, জাতীয় রাজনীতিতে একে অন্যের বিরোধী হলেও, উভয়েই মূলত দক্ষিণপন্থী দল, এবং এদের রাজনৈতিক চরিত্রে প্রভূত মিল দেখা যায়। কিন্তু এই মিলটা বাইরে থেকে খুঁজতে গেলে আমাদের ঠকতে হবে। বাইরে বরং আমরা উলটো ছবিই পাব — পরের পর হারে হতাশ বামপন্থী দল (সিপিএম এবং অন্যান্য) এবং যে কোনও মূল্যে জমি দখলের প্রত্যাশী বিজেপির নিচুতলার কর্মীরা বহুক্ষেত্রেই অলিখিত বোঝাপড়ায় চলে গেছেন — তাদের নেতারা যতই রোজ পরস্পরের মুণ্ডপাত করে থাকুন না কেন। এদের সকলের মধ্যে একটাই মিল — এরা তৃণমূল দ্বারা অত্যাচারিত — এবং শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু, এই নীতিতে পরস্পরের হাত ধরে চলেছেন। তাই তৃণমূলকে হারানোর জন্য আর এস পি সমর্থক বিজেপিকে বা বিজেপি সমর্থক সিপিএমকে ভোট দিতেও পিছপা নন।
চিত্রটা নতুন কিছু নয় — বছর পনেরো আগে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধেও এই মানসিকতা কাজ করতে আমরা দেখেছি — এবং তা একই কারণ প্রসূত (কে বেশি কে কম, সে প্রসঙ্গে আপাতত যাচ্ছি না)। ফারাক একটা অবশ্যই আছে — সেটা হল, এবারের এই জোট বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পশ্চিমবঙ্গে ঢোকার রাস্তা করে দিচ্ছে — তাদের শক্তি ক্রমশ বাড়ছে। কেন্দ্রে সরকারে থাকা এই অগ্রগতিকে আরও ত্বরাণ্বিত করতে সাহায্য করেছে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে ঢোকার আগে আমরা আগের একটা বক্তব্যের মীমাংসা করব — জোট যদি বাম-বিজেপিতেই হয়, তৃণমূলের বিরুদ্ধে, তবে কেন বলছি যে বিজেপি এবং তৃণমূলের রাজনৈতিক চরিত্রে মিল আছে? কেনই বা সম্পূর্ণ গরিষ্ঠতা নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও শাসকদল এভাবে বিরোধীদের ন্যূনতম স্বরটুকুও চেপে দিতে চাইছে? এই দুটো প্রশ্নের উত্তর কিন্তু লুকিয়ে আছে একই জায়গায় — কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই শাসকদলের রাজনৈতিক চরিত্র।
ভারতীয় রাজনীতিতে (সারা পৃথিবীর ক্ষেত্রেই এটা মোটামুটি প্রযোজ্য) বিভিন্ন দলগুলিকে মোটামুটি পাঁচভাগে ভাগ করা যায় — অতি বাম, বাম, মধ্যপন্থী, দক্ষিণপন্থী এবং অতি দক্ষিণপন্থী। মাওবাদী এবং কিছু নকশালপন্থী দল আমাদের দেশে অতি-বাম হিসাবে পরিচিত, এবং সংসদীয় বামদলগুলি, যেমন সিপিআইএম, আর এস পি, সি পি আই প্রমূখেরা শুধু বাম। অন্যদিকে ভাজপা বা শিবসেনা ঘোষিতভাবেই অতি দক্ষিণপন্থী, আর এস এস এর মতো দক্ষিণপন্থী সংগঠনের রাজনৈতিক মুখ। কংগ্রেস, এনসিপি, ডি এম কে ইত্যাদিরা দক্ষিণপন্থী — কিন্তু নেহরুর আমল থেকেই কংগ্রেস কিছুটা মধ্যপন্থী হয়ে পড়ে। এই মধ্যপন্থী দলগুলির মধ্যে আছে জনতা দল, রাজদ, সপা, বসপা, এ আই ডি এম কে বা হালের আম আদমি পার্টির মতো দলগুলি। এখন প্রশ্ন হল, তৃণমূল কংগ্রেস এদের মধ্যে কোন ভাগে পড়বে? কারণ তা দিয়েই তাদের রাজনৈতিক চরিত্র নির্ধারণ হবে শেষ অবধি। বহু লোক মনে করেন তৃণমূল মূলত দক্ষিণপন্থী দল, আবার অনেকে তাদের “প্রকৃত বামপন্থী” দল হিসাবেও আখ্যা দেন (অর্থাৎ সি পি এম প্রমূখ এখন আর বামপন্থী নেই, টি এম সি তাদের জায়গাটা নিয়েছে)। কিন্তু তৃণমূলের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডাগুলি কী কী?
একটু স্মৃতি হাতড়ালেই দেখা যাবে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল কংগ্রেস নামক দলটির জন্ম, কর্ম এবং শেষে উল্কার গতিতে উত্থান একটি এবং একটিই মাত্র ইস্যু ধরে — সি পি এম বিরোধিতা। সেই সময়ে সি পি এম ছিল শাসকদল এবং ক্ষমতাশালী, ফলে তাদের বিরুদ্ধে লড়াইটাকেই বিপ্লব বলে আখ্যা দিতে বহু বুদ্ধিজীবিরও অসুবিধা হয়নি — কিন্তু এখন হচ্ছে। হচ্ছে কারণ একটা রাজনৈতিক দল, যাদের কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা নেই একটা নির্দিষ্ট দলের বিরোধিতা করা ছাড়া, তাদের রাজনৈতিক সংজ্ঞা নিয়ে ধোঁয়াশা থাকতে বাধ্য। সেই ধোঁয়াশা আরও বাড়ে যখন বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিকভাবে তারা সম্পূর্ণ স্ববিরোধী অবস্থান নেন। যে রাজ্য সরকার গ্রামের মানুষের স্বার্থে জমি অধিগ্রহণ বা সেজ বে-আইনি ঘোষণা করেন, সেই রাজ্য সরকারই আবার যখন বেঙ্গল মীনস বিজনেস বলে আদানি আম্বানিদের সাদরে আমন্ত্রণ জানাতে থাকেন, যে রাজনৈতিক দল মাওবাদীদের সঙ্গে জোট করে অত্যাচারী সিপিএম জমানার অবসান ঘটাতে, সেই দলই যখন ক্ষমতায় এসে কিষাণজীকে হত্যা করে নির্দ্বিধায়, তখন তাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে বসে দেখা যায় হাতে একটিই পেনসিল পড়ে আছে — সুপ্রিমো। “জননেত্রী”। তাঁর যেমন ইচ্ছা, যেমন চিন্তা-ভাবনা, মেজাজ-মর্জি, হিসাব নিকাশ, তার হিসাবেই চলবে পুরো দল — সেই অনুযায়ী ঠিক হবে অ্যাজেন্ডা। অন্য কে কী বললেন, কী ভাবলেন, আদৌ ভাবলেন বা বললেন কি না, কিছুই আসে যায় না — নেত্রীই শেষ কথা বলবেন। তাই মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্য জনসভায়, নির্বাচনী প্রচার সভায় বারবার বলে আসেন — “আমাকে ভোট দিন। কে প্রার্থী দেখার দরকার নেই – রাজ্যের সবকটি কেন্দ্রে আমিই প্রার্থী”। এবং প্রার্থী, কর্মী, নেতৃত্ব সকলে একথা নির্দ্বিধায় মেনে নেন। এই একনায়ক নির্ভরতাই দিনের শেষে স্থির করে দেয় তৃণমূলের রাজনৈতিক চরিত্র — অতি দক্ষিণপন্থী হিসাবে।
এবং এখানেই বোঝা যায় কেন তারা কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রশ্নে একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে — উভয়েই অতি দক্ষিণপন্থী দল হিসাবে স্বভাবতই গণতন্ত্রের মূল তত্ত্ব, বৈচিত্রে বিশ্বাস রাখেন না। শক্তিশালী কেন্দ্র (বা রাজ্য), শক্তিশালী সরকার — বিরোধীশূন্য হলেই ভালো — এই মানসিকতাতেই এরা সম্পূর্ণ অনুকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেও কাজে লাগাতে চান বিরোধীদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেবার প্ল্যাটফর্ম হিসাবে। এই মানসিকতাই বহন করেন অনুব্রত মণ্ডল থেকে অমিত শাহ, মমতা থেকে নরেন্দ্র মোদী, মুকুল রায় থেকে শোভন চাটুজ্জে। এবং এই কারণেই রাজনৈতিকভাবে ভাজপা এবং তৃণমূল পরস্পরের স্বাভাবিক মিত্র (যা স্বাভাবিক, তা সবসময়ে দেখা যায় না — বলাই বাহুল্য)।
তাহলে বাকি রইল বাম-বিজেপির নিচের তলার জোট — এবং তার সম্ভাব্যতা ও অসম্ভাব্যতার প্রশ্ন। ওয়াকিবহাল ব্যক্তিমাত্রই জানেন যে পশ্চিমবঙ্গে নিচুতলায় এই ধরণের জোট খুব অসম্ভব কিছুই নয়। কারণ সেখানে, প্রত্যন্ত পঞ্চায়েতে, রাজনৈতিক মতাদর্শ নয়, বেঁচে থাকার সংগ্রামটাই রাজনীতি। এবং সেখানে যে আমাকে মারছে, সে আমার শত্রু আর যে তার বিরুদ্ধে, সে আমার বন্ধু, এর বাইরে আর কোনও সমীকরণ নেই — সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট। বিরোধী রাজনীতিকে টিঁকে থাকতে হলে সক্ষম হয়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে, আর কোনও দ্বিতীয় পন্থা নেই — এবং ঐ জোট বাম বা দক্ষিণ, কোনও রাজনীতিকেই শেষ অবধি এগিয়ে বা পিছিয়ে দেবে না। কিন্তু টিকিয়ে রাখবে। স্ট্রাগল ফর একজিস্ট্যান্স। আসুন আমরা লক্ষ রাখি, ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচন আমাদের কী কী রঙ্গ দেখায়। ফল হয়তো আমরা জানি, কিন্তু পরিবর্তনশীল প্যাটার্নগুলি দেখতে এবং চিনতে ভুলবেন না — কারণ, কখন কী ঘটে যায়, কিচ্ছু বলা যায় না।