Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

খানে কে লিয়ে, দিখানে কে লিয়ে

অভীক ভট্টাচার্য

 

কাঠুয়া, উন্নাও, সুরাট – শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন-অপরাধের একের পর এক নৃশংস ও মর্মান্তিক ঘটনায় দেশজোড়া প্রতিক্রিয়া ও ধিক্কারের বাঁধভাঙা ঢেউ সামাল দিতে অবশেষে বড়সড় পদক্ষেপ করল কেন্দ্রীয় সরকার। শিশু যৌন-নির্যাতন প্রতিরোধ আইন (প্রোটেকশন অফ চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেজ অ্যাক্ট ২০১৩, সংক্ষেপে পকসো) সংশোধনের লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে, মৃত্যুদণ্ডকেই ১২ বছরের কমবয়সি শিশুদের যৌন-নির্যাতনের ঘটনায় অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে নীতিগতভাবে মেনে নেওয়া হল। প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফর থেকে ফিরতেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা বিশেষ বৈঠকে মিলিত হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিলেন, এবং এই মর্মে অধ্যাদেশ জারির সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিলেন। অধ্যাদেশটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে, এবং বলা বাহুল্য, পত্রপাঠ রাইসিনা হিল্‌সের চূড়ান্ত সম্মতি পেতে কোনও সমস্যা হয়নি।

কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে কতদূর ফলপ্রসূ হবে, শিশুদের বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে ঘটে চলা যৌন-অপরাধের ঘটনা-পরম্পরায় রাশ টানতে সক্ষম হবে কি না, সেসব অত্যন্ত বিতর্কিত প্রশ্ন। কিন্তু সেই বিতর্কে ঢোকার আগে, আপাতদৃষ্টিতে যেটুকু সহজেই বোঝা যাচ্ছে – এই পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে আমজনতার মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ নিরসনে সরকার অনেকটাই সফল হতে পেরেছে। এতে একদিকে যেমন শিশুসুরক্ষার প্রশ্নে সরকারের দায়বদ্ধতার বিষয়ে জনমানসে ইতিবাচক বার্তা দেওয়া গেল, তেমনই এ-কথাও প্রমাণ করা গেল যে সরকার নীতিপঙ্গুত্বে ভুগছে না এবং প্রয়োজনে কড়া সিদ্ধান্ত নিতেও পিছপা নয়। এককথায়, অধিকাংশ সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার নিরিখে সরকারকে যে ভূমিকায় দেখতে চান, সরকারের সেই নীতিপরায়ণ ও সর্বার্থসাধক ভাবমূর্তিটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

এরই পাশাপাশি আরও কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে বই কী। নোটবন্দি, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ, বেরোজগারির মোকাবিলা, কালাধন পুনরুদ্ধার, নানাবিধ আর্থিক দুর্নীতির ক্রমোন্মোচন ও তাতে কেন্দ্রের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা প্রকাশ্যে আসা প্রভৃতি বহুতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইতিমধ্যেই সারা দেশে জনসমর্থন হারানোর মুখে এসে দাঁড়িয়েছে সরকার। উপরন্তু অস্বস্তিকর যে কোনও প্রশ্নে দীর্ঘ মৌনাবলম্বন প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তায় মস্ত ধাক্কা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশংসা ও সমর্থন আদায় – যা বরাবরই প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় অ্যাজেন্ডার তালিকায় ওপরের দিকে থেকেছে এবং বিভিন্ন সময়ে তাঁকে বিপুল রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড দিয়ে এসেছে, তাতেও সম্প্রতি ভাটার টান। শিশু-অপুষ্টি প্রতিরোধ, বাল্যবিবাহের মোকাবিলা ইত্যাদি সামাজিক উন্নয়নের একাধিক খাতে ভারত গ্রহণযোগ্য দিশানির্দেশ দিতে ব্যর্থ, এমন একটি আন্তর্জাতিক ভাষ্য ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে। তাতে আরও ইন্ধন জুগিয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের প্রধান ক্রিস্টিনা ল্যাগার্দের একেবারে সাম্প্রতিক মন্তব্য। ভারতে শিশু ও মহিলাদের সুরক্ষার প্রশ্নটি যে ধারাবাহিকভাবে উপেক্ষিত ও অবহেলিত, আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে পাশে বসিয়েই তিনি সে-কথা প্রকাশ্যে জানিয়েছেন ও সে-বিষয়ে যৎপরোনাস্তি উদ্বেগ ব্যক্ত করেছেন। ২০১৯ যেহেতু ভোটের বছর – দ্বিতীয় দফায় দেশ চালানোর জনাদেশ পেতে গেলে যে এখনই কিছু পদক্ষেপ করা প্রয়োজন, তা প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই অনুধাবন করেছেন। ফলে, ক্রিকেটের পরিভাষা ধার করে বলতে গেলে, ডেথ ওভারে আস্কিং রেট যখন ক্রমোর্ধ্বমুখী তখন শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন-নির্যাতন বন্ধে সরকারের দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠায় তিনি যে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে এসে বড় শট খেলতে চাইবেন, তা একপ্রকার প্রত্যাশিতই ছিল। হাতির প্রকাণ্ড দাঁতদুটি, খাবার চিবনোর কাজে না-লাগুক, বিজ্ঞাপনের প্রচারে তো লাগেই…

কিন্তু সেসব থাক। যে-কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, ফেরা যাক সেই বিতর্কিত প্রশ্নমালায়। পকসো আইনটিকে ‘যথোচিত শক্তিশালী’ করে তুলতে চেয়ে অধ্যাদেশে যে মৃত্যুদণ্ডের বিধান সংযোজিত হয়েছে, তা কি সত্যিই জরুরি ছিল? বাস্তবে শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন-অপরাধে রাশ টানতে তা কি সত্যিই ফলপ্রসূ হবে?

এ-কথা অনস্বীকার্য যে, এমন স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল একটা বিষয়ে সরকারকে, আজ হোক বা কাল, পদক্ষেপ করতেই হত। শুধু পদক্ষেপই নয়, তা হতেই হত যথেষ্ট কড়া, এবং গুরুতর। জাতীয় অপরাধ নথিভুক্তীকরণ সংস্থা এনসিআরবি-র (ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড্‌স ব্যুরো) খতিয়ান থেকেই পরিষ্কার, গত এক দশকে শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন-অপরাধ কীভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। তথ্য বলছে, শিশুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ বেড়েছে গত ১০ বছরে ৫০০ শতাংশ, এবং তার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই যৌন-অপরাধ। এ-কথা সত্যি যে, গত কয়েকবছরে এধরনের ঘটনা নথিভুক্ত করার ব্যাপারে পুলিশের উদ্যোগ ও সক্রিয়তা বেড়েছে, সাধারণ মানুষের মধ্যে এ-বিষয়ে সচেতনতাও বেড়েছে, যৌন-হয়রানি বিষয়ক তথ্য গোপন না-করে আগের তুলনায় তাঁরা অনেক বেশি করে এগিয়ে আসছেন, ফলে রিপোর্টিং বাড়ছে। তবে এনসিআরবি যেহেতু তথ্য সংগ্রহ করে রাজ্যগুলির পুলিশ-দফতর থেকে, ফলে যৌন-নিগ্রহের যে অপরাধগুলি পুলিশের খাতায় নথিবদ্ধ হয়, কেবল সেগুলির ভিত্তিতেই এই পরিসংখ্যান। অথচ সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা জানি, প্রত্যন্ত এলাকায় ঘটে চলা এধরনের কত ঘটনাই পুলিশের নজরের আওতার বাইরে থেকে যায়। কিংবা অভিযুক্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে প্রভাবশালী বলে পুলিশ সে অপরাধ নথিভুক্ত করতে গড়িমসি করেছে এমন উদাহরণও কম নয়। অর্থাৎ ধরে নেওয়াই যায়, এনসিআরবি-র তথ্যভাণ্ডারে যে ছবি ধরা পড়েছে বাস্তব তার চেয়েও বেশি ভয়াবহ। সেই প্রেক্ষাপট থেকে দেখতে হলে, সরকারকে বিষয়টির গুরুত্ব অনুসারে কড়া অবস্থান নিতেই হত।

এ-ক্ষেত্রে একটি প্রচলিত ধারণা এই যে, কড়া সাজার সংস্থান থাকলেই বুঝি অপরাধ কম হয়। সেই ধারণাকেই সম্প্রসারিত করে সচরাচর ধরে নেওয়া হয়, অপরাধীর মনে যদি কোনওভাবে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তা তাকে অপরাধ থেকে নিবৃত্ত করতে সক্ষম। প্রসঙ্গত মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে কয়েকবছর আগে দিল্লির নির্ভয়াকাণ্ডের কথা। মর্মান্তিক সেই ঘটনার পরেও দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। জনরোষ এমন জায়গায় পৌঁছয় যে, তা প্রশমিত করতে সরকারকে তড়িঘড়ি আইন পালটাতে হয়। সংশোধিত আইনে নারীদের বিরুদ্ধে যৌন-অপরাধের ক্ষেত্রে কঠোর সাজার সংস্থান হয়, এমনকী জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট-এও ১৬ বছরের বেশি কিন্তু ১৮ বছরের কমবয়সি কিশোর অপরাধীদের জন্য গুরুতর বিচারপ্রক্রিয়ার বিধান সংযোজিত হয়। কিন্তু তার পরিণামে নারীদের বিরুদ্ধে যৌন-অপরাধের মাত্রা কমেছে, তথ্য দিয়ে এমন দাবি করা যায় না। উলটে গত তিন বছরে, এনসিআরবি-র দেওয়া তথ্য অনুসারেই, দেশজুড়ে নারীদের যৌন-হেনস্থার ঘটনা উল্লেখযোগ্য রকমের বেড়ে গিয়েছে। অর্থাৎ শাস্তির মাত্রাবৃদ্ধি যে অপরাধ হ্রাসের পূর্বশর্ত – অপরাধীর মনে ভয় ধরিয়ে দিতে পারলেই যে সে অপরাধের রাস্তা থেকে সরে আসবে – এমন ধারণা তাই কোনওমতেই তথ্যের দ্বারা সমর্থিত নয়।

তার চেয়েও বড় আশঙ্কার জায়গা অন্যত্র। পকসো আইনে ১২ বছরের কমবয়সিদের বিরুদ্ধে যৌন-অপরাধে প্রাণদণ্ডের সংস্থান ঘটানো হলে তা যে কার্যত রিপোর্টিং কমিয়ে দেবে, তা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। যদি স্মরণে রাখা যায় যে, দেশে শিশুদের যৌন-নিগ্রহের একটা বড় অংশই ঘটে তাদের পরিচিত বৃত্তের মধ্যে, কাজেই মৃত্যুদণ্ডের আশঙ্কায় বাড়ির বড়রা অপরাধগুলি লুকিয়ে ফেলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন, এ আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাতে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিশুরাই। চার-দেওয়ালের মধ্যে ঘটে চলা অপরাধে যেখানে শিশুটির কাকা বা মামা বা অন্যান্য আত্মীয়-পরিজনরা জড়িত কিংবা অভিযুক্ত, সেখানে ফাঁসির সাজার ভয় থাকলে অভিযোগকারীকে প্রভাবিত করার আশঙ্কা থেকে যাবে অনেক বেশি। ফলে এধরনের অভিযোগের যেটুকু অংশ পুলিশের নজরে আসতে শুরু করেছিল, সেগুলি হয়তো অতি দ্রুত কার্পেটের নীচে চালান করে দেওয়া হবে। পারিবারিক চাপের মুখে আদালতে যদি শিশুরা তাদের প্রাথমিক বয়ান বদলও করে ফেলে, তাতেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। আর, যে কথা আগেও উল্লেখ করা হয়েছে, অভিযুক্ত যদি হন প্রভাবশালী ব্যক্তি তা হলে তো আর কথাই নেই। ভয় দেখিয়ে অভিযোগকারী অথবা সাক্ষীদের বয়ান বদলের ঘটনা তো আমাদের দেশে কম ঘটেনি। একটি শিশুকে ভয় দেখানো আর কী এমন শক্ত কাজ! বরং শিশুদের বয়ান বদল অনেক বেশি সহজ। এমনিতেই একেবারে ছোটদের কাছে বিষয়টির গুরুত্ব অনেক সময়েই স্পষ্ট থাকে না। যৌনতা বলতে তারা বোঝেই বা কী! তাদের স্মৃতিতে গোটা ঘটনাটি কেবলমাত্র একটি তীব্র ব্যথার অনুভূতি হিসেবে রয়ে যায়। এমন একটি মেয়েকে ধমক দিয়ে বা খেলনা কিনে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে বয়ান পালটে ফেলা আর বেশি কথা কী?

এমন কখনও শোনেননি যে, মা মেয়েকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে শাসাচ্ছেন, “শোনো, উনি তোমার মেসোমশাই হন। তুমি ওঁর মেয়ের মতোই। উনি তোমার গায়ে হাত দিয়ে একটু আদর করতেই পারেন। এসব নিয়ে যেন কখনও হইচই করতে না-শুনি…” এই যেখানে পরিস্থিতি, সেখানে ফাঁসির সাজা! কে কাকে ফাঁসি দেবে?

সে ফাঁসি হোক চাই না-হোক, আপাতত সাধারণ মানুষের মন তো রাখা গেল। স্বাতী মালিওয়াল অনশন তো ভাঙলেন। ওই যে বলছিলাম হাতির দাঁত… খাবার জন্য একটা, দেখাবার জন্য আর একটা…