Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বিচারপতি তোমার বিচার করবে কারা : আশারাম বাপু মামলা এবং কিছু খতিয়ান

প্রিয়ক মিত্র

 

“… “আর একজন জজ থাকে, সে বসে বসে ঘুমোয়।”

প্যাঁচা বলল, “কক্ষনো আমি ঘুমোচ্ছি না, আমার চোখে ব্যারাম আছে তাই চোখ বুজে আছি।”

হিজি বিজ বিজ বলল, “আরও অনেক জজ দেখেছি, তাদের সক্কলেরই চোখে ব্যারাম।”…”

‘হ য ব র ল’-র এই আপাতসরল রসিকতা আসলে এক নির্মম সত্যের দিকে ইঙ্গিত করেছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের বিচারব্যবস্থা আমাদের দীর্ঘদিন যাবৎ প্রহসনের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছে, রাখছে। সম্প্রতি দীর্ঘদিন ধরে চলা একটি মামলার অবসান ঘটল ভারতে। পাঁচবছর ধরে মামলা চলে অবশেষে যোধপুর কোর্টের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হলেন ধর্ষক ধর্মগুরু আশারাম বাপু। বিজেপি সরকারের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকা এই বাবাজির নামে পাঁচটি গুরুতর অভিযোগ ছিল। নাবালিকাদের ধর্ষণ তো আছেই, এছাড়াও আশারাম বাপু যৌন নিগ্রহ, আই পি সি ৩৪০ ধারায় মহিলাদের অন্যায়ভাবে আটক করে রাখা, আই পি সি ১২০এ ধারায় অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র এবং আই পি সি ৫০৩ ধারায় ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগে অভিযুক্ত। এইসব অভিযোগের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট অপরাধী আশারাম বাপু এতদিন পর ৩৭৬ ধারায় ও পকসো আইনে দোষী সাব্যস্ত হলেন এবং আমৃত্যু যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেন। অনেকেই এই রায়ের পরে বিচারব্যবস্থার প্রতি খানিক আস্থাশীল হবেন কি না ভাবছেন, কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতিটা কী একটু খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

২০১৩ সালের আগস্ট মাসে আশারাম বাপুকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। তারপর থেকে মামলা চলাকালীন এই কেসের বহু গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী নিহত হয়েছে। আশারাম বাপুকে নির্দোষ প্রমাণ করার বহুবিধ চেষ্টা হয়েছে, সব চেষ্টা ব্যর্থ হল অবশেষে। কিন্তু একইভাবে যদি আমরা প্রশ্ন তুলি মায়া কোদনানি নির্দোষ প্রমাণ হলেন কী করে, সেই বিষয়ে?

গোধরার ট্রেন দুর্ঘটনার পর যে গুজরাট গণহত্যা গোটা দেশকে আলোড়িত করেছিল সেই গণহত্যার কাণ্ডারীদের মধ্যে মায়া কোদনানি অন্যতম। আহমেদাবাদের নারোদা পাটিয়া এলাকায় হেট স্পিচ মারফৎ জনতাকে উত্তেজিত করে মোট ৯৭টি হত্যা ঘটিয়েছেন মায়া কোদনানি, অভিযোগ এমনই। ২৮শে ফেব্রুয়ারি ২০০২, গোধরা ট্রেন বিস্ফোরণে হত দশজন করসেবকের দেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল হটকেশ্বরের শ্মশানে। নারোদার কাছে ঘটে যায় এই রক্তক্ষয়ী হত্যালীলা, যার শিকার হয় গুলবার্গ সম্প্রদায়। ওই এলাকায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে উস্কানি দেওয়া, সঙ্ঘ পরিবারের কর্মীদের হাতে তলোয়ার তুলে দেওয়া এই সমস্ত কর্মকাণ্ডে যে মায়া কোদনানির প্রধান ভূমিকা ছিল তা প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে এবং এস আই টি-র রিপোর্টে স্পষ্ট। ২০০৮ সালে এস আই টি-র বিশেষ কোর্ট দ্বারা প্রাক্তন বিজেপি মন্ত্রী, গাইনোকোলজিস্ট মায়া কোদনানি সহ এগারোজন দোষী সাব্যস্ত হন এই ঘটনায়। ২৮ বছরের হাজতবাসের সাজা ঘোষণা হয় তার। ওই একই দিনে ঘটে নারোদা গামের ঘটনা। এই ঘটনায় জড়িত ছিলেন আরেক সঙ্ঘী নেতা জয়দীপ প্যাটেল। সম্প্রতি নারোদা পাটিয়া মামলায় গুজরাট হাইকোর্ট ক্লিনচিট দিয়েছে মায়া কোদনানিকে। বিচারপতি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এই বলে যে এত অল্পসংখ্যক লোক এই ঘটনা ঘটায় কী করে!

এই মামলায় বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন মায়া কোদনানির পক্ষে। মায়া কোদনানির যে অ্যালিবাই তিনি তৈরি করেছেন তা রীতিমতো সুচিন্তিত। সকালের দুটি বিশেষ সময় তিনি সোলা সিভিল হাসপাতালে ছিলেন, এই সাক্ষ্য দিয়ে অমিত শাহ প্রমাণ করতে চান মায়া কোদনানি নারোদা পাটিয়ায় ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন না। ‘ফিকশন অফ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং : মোদী অ্যান্ড গোধরা’ বইয়ের লেখক মনোজ মিত্তা সম্প্রতি ‘দ্য ওয়্যার ডট ইন’-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে দেখিয়েছেন কীভাবে সরকারি তৎপরতায় এই কেসের সাক্ষ্য ওলটপালটের চেষ্টা হয়েছে, একের পর এক তদন্তকারী পুলিশ অফিসার কীভাবে বদলি হয়েছেন।

রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রঘনিষ্ঠ কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বিচারব্যবস্থার আলোয় যখনই দাঁড়াতে হয়, তখনই স্পষ্ট হয় ভারতীয় জুডিসিয়ারির আসল রূপরেখা। গোরক্ষপুরের হাসপাতালের কুখ্যাত শিশুমৃত্যুর ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন ডঃ কাফিল খান, যিনি নিজের পেশাগত এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে কিছু শিশুর প্রাণরক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী, তার বিরুদ্ধে কোনও ফৌজদারি মামলা করতে হলে বিশেষ কিছু পদ্ধতি অনুসরণের প্রয়োজন, কিন্তু তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো অসম্ভব নয়। অথচ যোগী আদিত্যনাথের আমলে ভারতের যে কোনও গণতান্ত্রিক সরকারের নিয়মমাফিক খানিক অলৌকিকভাবেই তার বিরুদ্ধে যা যা অভিযোগ ছিল সব প্রত্যাহৃত হতে শুরু করল।

যোগী আদিত্যনাথের সরকার মুজফফরনগর দাঙ্গার ১৩১টি কেস প্রত্যাহার করার উদ্যোগ নিয়েছে, যার মধ্যে ১৩টি সরাসরি খুনের মামলা। ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এর একটি রিপোর্টে দেখা যায় আই পি সি ১৫৩এ ধারায় সর্বমোট ১৬টি মামলা এবং ২৯৫এ ধারায় ২টি মামলা রয়েছে, এই মামলাগুলি মূলত সাম্প্রদায়িক অশান্তি ছড়ানোকে কেন্দ্র করে। এই মুহূর্তে উত্তরপ্রদেশের মন্ত্রী সুরেশ রানা, সাংসদ ভরতেন্দু সিং, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সঞ্জীব বাল্যান, বিধায়ক উন্মেষ মালিক, সঙ্ঘের নেতা সাধ্বী প্রাচী এদের প্রত্যেকের নামেই অভিযোগ দায়ের রয়েছে। জানা গেছে মুজফফরনগরের জেলাশাসকের কাছে সরকারি তরফে পাঠানো একটি চিঠিতে এই মামলাগুলির প্রত্যাহার বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বাল্যান নিজে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন, মুজফফরনগর এবং শামলি জেলায় দায়ের হওয়া মামলাগুলিতে সব মিলিয়ে ৮৫০ জন হিন্দু অভিযুক্ত, বাল্যান নিজে যোগী আদিত্যনাথের কাছে দরবার করেছেন মামলাগুলি প্রত্যাহারের বিষয়ে। জানিয়ে রাখা ভালো, ২০১৩ সালের এই মুজফফরনগর দাঙ্গায় নিহতের সংখ্যা ৬৩ এবং এই দাঙ্গার ফলে ৫০০০০ মানুষ গৃহহারা হয়েছেন।

২০০৮-এর মালেগাঁও বিস্ফোরণে অভিযুক্ত সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর, লেফটেনান্ট কর্নেল প্রসাদ পুরোহিত সহ সাতজনকে ইউ এ পি এ ধারায় গ্রেফতার করে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি বা এন আই এ। অদ্ভুতভাবেই ২০১৬ সালে একটি চার্জশিটে এন আই এ আদালত দোষী সাব্যস্ত করে অ্যান্টি টেররিজম স্কোয়াডকে, বলা হয় আর ডি এক্স-এর ট্রেস ঘটনাস্থলে রাখা হয়েছিল সাধ্বী প্রজ্ঞার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্য।

মনে রাখবেন, ধারাটা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতার। সরাসরি সন্ত্রাসের অভিযোগ ছিল সাধ্বী প্রজ্ঞাদের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক উস্কানি ইত্যাদিও নয়। যে রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী সন্ত্রাস ঠেকাতে মণিপুরে লাগাতার ধর্ষণ চালিয়ে যেতে পারে, কাশ্মীরে পেলেটগানে বিদ্ধ করতে পারে শিশুকিশোরদের, বস্তারে আদিবাসীদের ওপর চালাতে পারে নারকীয় অত্যাচার, যখন তখন এনকাউন্টার ঘটিয়ে নিকেশ করতে পারে মাওবাদীদের; সেই রাষ্ট্রের প্রশাসন, তদন্তকারী সংস্থা, বিচারবিভাগ কয়েকজন হিন্দু সন্ত্রাসীর বিষয়ে কতটা রক্ষণাত্মক ভূমিকা নিতে পারে তার জলজ্যান্ত নিদর্শন এই মামলা। সন্ত্রাস মানেই সেখানে জড়িত হয় মুসলমানরা, নয়তো মাওবাদীরা, উঠতি হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের চোখের মণি স্বয়ংসেবকরা যদি এইধরনের সন্ত্রাসে জড়িত বলে প্রমাণিত হয়, তাহলেই সমূলে সর্বনাশ।

মালেগাঁও বিস্ফোরণের উদ্দেশ্য ছিল একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে কালিমালিপ্ত করা, এখন রাষ্ট্রীয় বিচারবিভাগ এই অ্যাজেন্ডাকেই খানিক ইন্ধন জোগাচ্ছে, আসল অপরাধীদের আড়াল করে। অথচ বিচার পায় না ইশরাত জাহান। ‘আউটলুক’ পত্রিকার একটি লেখায় রানা আইয়ুব বলেছেন জাতীয়তাবাদের হুজুগ ইশরাত জাহানের রক্ত ধোবে না। হেডলির জবানবন্দি দিয়ে ইশরাতকে লস্কর-ই-তৈবার জঙ্গি প্রমাণের প্রভূত চেষ্টা হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে নরেন্দ্র মোদীর আমলের সমস্ত ফেক এনকাউন্টারের মামলাকে জনমানস থেকে মুছে দেওয়ার। শোহরাবুদ্দিন, কাউসার্বিদের অপহরণ এব‌ং হত্যায় অভিযুক্ত অমিত শাহ ক্লিনচিট পেয়ে যান। জাস্টিস লোয়ার হত্যা মামলার আসল সত্য মনে মনে কি আমরাও জানি না? কংগ্রেস সাংসদ এহসান জাফরি, গুজরাট গণহত্যার সময় যাকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়, তার স্ত্রী জাকিয়া জাফরি পিটিশন এনেছিলেন তৎকালীন গুজ‍রাটের মুখ্যমন্ত্রী এবং অধুনা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সহ ৫৯ জন পুলিশ অফিসার ও আমলার ক্লিনচিট পাওয়ার বিরুদ্ধে। তার সেই পিটিশন ভারতীয় আইনব্যবস্থার চোখবাঁধা টোটেমের সামনে ধুলোয় মিশে গেছে। নন্দিতা দাশের ‘ফিরাক’ সিনেমাটি শেষ হয় দাঙ্গাধ্বস্ত গুজরাটের একটি শিশুর মুখের ওপর ক্যামেরা স্থির হয়ে। সেই আতঙ্কিত, অসহায় বালকটি কোনও বিচার পায়নি শেষত।

হেট স্পিচ আমাদের জাতীয় ভায়াগ্রা। শয়ে শয়ে হেট স্পিচ দিয়েও আইনের কবলে পড়তে হয় না আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের। আমরা এখনও জানি না গৌরী লঙ্কেশের আসল হত্যাকারী ধরা পড়বে কি না, নাজিব হত্যা মামলার সমাধান কোনওদিন হবে কিনা। আসিফা ধর্ষণ এবং হত্যা মামলার লড়াকু উকিল দীপিকা সিং রাজাওয়াতকে ঠেকানোর জন্য এবং আসল অপরাধীদের‍ বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা করতে না দেওয়ার কী ব্যাপক প্রচেষ্টা করলেন জম্মুর আইনজীবীরা। আইনরক্ষকদের এই ভূমিকা সমস্ত শাসকের আমলেই সমানভাবে দেখা গেছে। একটি লাইভ অনুষ্ঠানে কবীর সুমন প্রশ্ন তুলেছিলেন অর্চনা গুহ-র বিচার নিয়ে, বাম আমলেও কী করে রুনু গুহনিয়োগী মাত্র দেড়বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে পার পেয়ে যান সেই প্রশ্ন তিনি সপাটে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। সোনি সোরির রাষ্ট্রীয় ধর্ষক এই দেশে শৌর্য চক্র পুরস্কার পান আর তিহার জেলে গোপনে মৃত্যুবরণ করতে হয় মকবুল ভাটকে। ব্যাপম মামলা ডুবে গেছে অজানিত অন্ধকারে। দস্তয়েভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’-এর নায়ক রাসকোলনিকভ প্রশ্নের মুখে দাঁড় করান গোটা আইনব্যবস্থাকে, কমলাকান্ত গীতা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করতে অস্বীকার করে; আইনের চোখে প্রশ্ন তোলা, অস্বস্তি দেওয়া ইত্যাদি ব্লাসফেমিসমান অপরাধ হয়ে থেকে যায়, অথচ রাষ্ট্র কখনওই কাঠগড়ায় দাঁড়ায় না। চৈতন্য তামহানে নির্দেশিত ‘কোর্ট’ চলচ্চিত্রে একজন নির্দোষ শিল্পীকে অভিযুক্ত করা হয় একজন শ্রমিককে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে, অথচ যে ব্যবস্থা সেই শ্রমিককে আত্মহননে বাধ্য করে তার দিকে আইন আঙুল তোলে না। এই ছবির শেষ দৃশ্যে ঘুমন্ত বিচারপতিকে কয়েকজন বালক চমকে দিয়ে চলে যায়, ওই চমকে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে আসলে নগ্ন করে দেওয়া হয় বিচারব্যবস্থার একপেশে রাষ্ট্রীয় চেহারাকে।

তাই, দিনের শেষে, আশারাম বাপু একটি ব্যতিক্রম হিসেবেই গণ্য হবেন অন্তত এখনও। এখন দেখার নাবালিকা ধর্ষণে মৃত্যুদণ্ডের অর্ডিন্যান্সের জন্য যে আইটি সেল মোদীর জয়ধ্বনি করে ফাটিয়ে দিচ্ছিলেন, তারা আশারাম বাপুর মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে একটা মোমবাতি মিছিল করেন কিনা!