তাপস দাস
আমার কাছে এক টুকরো লেলিন আছে। কালোমতো কী একটা ধাতুর খুব ভারি একখানা চাকতি হরলিক্সের বোতলের ঢাকার মাপের, তার ওপরে খোদাই করা — সেই টাক আর ছুঁচোলো দাড়ি। পিছনে একটা সই। যখন কলেজে পড়ি, সুকোমলকাকু এনে দিয়েছিলেন। মস্কো থেকে। ‘মস্কোভা নদীর তীরে অবস্থিত বলিয়া শহরটির নাম মস্কো’ — পড়াতেন বসাকবাবু, মস্কোউউ বলে একটা টান দিয়ে বলতেন, কালাচাঁদে। আড়িয়াদহ কালাচাঁদ উচ্চ বিদ্যালয়। আমি পা দোলাতে দোলাতে অন্যমনস্ক হয়ে শুনতাম — আচ্ছা, মস্কোভা নদী কি খুব চওড়া? আড়িয়াদহ ঘাটের গঙ্গার চেয়েও?
লেলিন। লেনিন নয়। লেলিন। লেলিনদাদা। কালিয়াগঞ্জ ইস্কুলপাড়ায় আমাদের একটেরে মাটির বাড়ি, গোবর নিকানো বারান্দা। পাশে পরপর তিনঘর আধপাকা ইস্কুল কোয়ার্টার। তারপর নতুন পুকুর, তা পেরিয়ে বাঁশতলা ইস্কুল। আমি অবশ্য সেখানে যেতাম না। আমি পড়তাম পার্বতী সুন্দরী ইস্কুলে। টিনের একটা স্যুটকেস ছিল। মার বুনে দেওয়া আসন। গুটিয়ে বগলে করে নিয়ে যেতাম। পেতে বসতাম।
তিনঘরের মাঝের ঘরে লেলিনদাদা থাকত। সুধাময়বাবু ইস্কুল মাস্টারের তিন ছেলে রাজু, লেলিন, রিঙ্কু। চোখে মোটা কাঁচের চশমা, খেঁকুরে মার্কা চেহারার সুধাময়কাকুর পাঁজর দু একটা ভাঙা ছিল। পুলিশ মেরেছিল। লাল পতাকা নিয়ে মিছিলে হাঁটার সময়, ধর্মঘটের সময়, আরও নানা সময়ে। তার মেজছেলে লেলিন। লেনিন নয়। লেলিন। গণ্ডগ্রামের মানুষ, উচ্চারণে এলিটিয় শুদ্ধতা ছিল না। তাই লেলিন। সেই লেলিনদাদা দিয়ে ডাক শুরু করায় সারাজীবন আমার কাছেও লেলিন। অশুদ্ধ উচ্চারণ। এলিটিয় নয়। তাতে কি। নামটা জিভে নয়। নামটা মস্তিষ্কে। হৃদয়ে। তাই আজও লেলিন।
সেই আমার জীবনে প্রথম লেলিন। নাক দিয়ে শিকনি গড়াত। এদিকে আবার ঢোলা হাফপ্যান্টে বোতাম নেই, নেবে নেবে যেত। দু হাতে ধরে রাখতে হত কোমরে, খেঁচকে তুলতে হত মাঝেমাঝেই। নাকের শিকনি মুছতে গিয়ে প্যান্টুল নেবে এসে লেংটু বেরিয়ে পড়ত কখনও কখনও। চট করে আবার টেনে তুলতে তুলতে পনপন করে দৌড় জম্বুরা (বাতাবী লেবু) লাথাতে লাথাতে। লেলিনের সাথে এভাবেই ফুটবল খেলা জমে উঠত আমার।
কমরেড লেলিন কি ফুটবল খেলতেন কখনও?
‘কমরেড লেলিনের আহ্বান, চলে মুক্তি সেনা দল…’
হারমোনিয়াম বাজিয়ে রিহার্সাল হত আমাদের বাড়িতে। পার্টিঅফিসের লোকজন মিলে। পথসভা হবে, তার প্রস্তুতি। আড়াল থেকে শুনতাম দরজার পাল্লা ধরে দাঁড়িয়ে। সব গুটিয়ে নিয়ে ‘আসি বৌদি’ বলে সবাই বিদেয় হলে মাকে ধরতাম ‘মুক্তি সেনা কারা মা? আমি মুক্তি সেনা হব!’
‘ওই যে তোর পাশে বসে চারমিনার টানছে? ঘরের লোককে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারে আর বাইরে মোষ তাড়িয়ে বেড়ায়, ওই হল মুক্তি সেনা! তোর মুক্তি সেনা হাওয়ার খবরদার দরকার নেই! এক মুক্তি সেনাকে যা দেখছি! ছেঁড়া লুঙ্গি গিঁট দিয়ে পরতে হবে এবারে! এই তো দশা। যা যা পড়তে বস! মুক্তি সেনা হবে!’
‘বসছি বসছি! কিন্তু কমরেড কাকে বলে মা?’
মা মুখ খোলার আগে আমার ডান পাশ থেকে গভীর, গম্ভীর ব্যারিটোন ভেসে আসে ছ ফুট দু ইঞ্চির বিশাল কাঠামোটা থেকে ‘তোর মা আমার যা, তাকেই বলে কমরেড। বুঝলি?’
‘ব্যাস ব্যাস, অনেক হয়েছে! চাল ফুরিয়েছে সে খেয়াল আছে কি? রাতে কিন্তু মুড়ি আজকে।’ মা উঠে যেত। গালদুটো লাল হয়ে উঠেছে দেখতে পেতাম, লজ্জায় না ভালো লাগায়?
আর এ সবকিছুরই সাক্ষী ছিলেন কমরেড লেলিন। দেওয়াল থেকে দেখতেন, দেখতেন আর মৃদু মৃদু দুলতেন, পচ্চে হাওয়ায় (পশ্চিম দিক থেকে আসা হাওয়া। গ্রামের টার্ম।) ক্যালেন্ডারটা দুলে দুলে মাটির দেওয়ালে আঁচড় কাটত খসখস খসখস।
এই ক্যালেন্ডারটা অনেক দিনের পুরনো। পাল্টানো হয়নি। বছর পেরিয়ে গেলে ক্যালেন্ডার বিভিন্ন কাজে লাগত আমার। এক হল পেছনে ছবি আঁকা। ছেলেকে আর্ট পেপার কিনে দেওয়ার পয়সা ছিল না মুক্তিসেনার, আর তার কমরেড চাকরি করত না, পেয়েছিল একটা যদিও সরকারি চাকরি, ইস্কুলের, কিন্তু করা হয়নি, অঞ্চলের মুক্তিসেনাদের অন্নদা আর ধাত্রী হয়ে দিন কাটাত। সকাল থেকে রাত অবধি কত যে ‘হাড় হাভাতের দলের’ (‘মুক্তিসেনা’দের মা এভাবেই বর্ণনা করত) কত বিচিত্র ধরনের উৎপাত যে সহ্য করতেন মহিলা, ভেবে আশ্চর্য লাগে এখন। তার এক শতাংশ উৎপাতও আমাদের বাড়ি এসে করে যদি এমনকি আমার খুব চেনা লোকও, সোজা খেদিয়ে দেব, ধৈর্য রাখতে পারব না। কতখানি ক্ষমতা আর ভালোবাসা থাকলে কমরেড হওয়া যায় তা নিজের ঘরে বসেই শিখেছি। কোলনতাই বা জেটকিন না পড়লেও জীবনে খুব কিছু মিস করতাম বলে তো মনে হয় না ফলত। ঘটনাচক্রে এই মহিলা পরে নিজেও সরাসরি মুক্তি সেনা হয়েছিলেন — কামারহাটি আড়িয়াদহের অলিতে গলিতে, বস্তিতে, জুটমিলে।
ক্যালেন্ডার নিয়ে দ্বিতীয় কাজ ছিল দাঁড়িপাল্লা বানানো। কাগজটা আঁকার জন্য ছিঁড়ে নিয়ে, টিনের যে স্ট্রিপটা থাকত ক্যালেন্ডার টাঙানোর, সেটার দুদিকে সুতো বেঁধে, আমূলের টিনের ঢাকনা ফুটো করে তা সেই সুতোয় বেঁধে দাঁড়িপাল্লা বানানো হত। কিন্তু এই ক্যালেন্ডারটায় হয়নি। ‘শোন বাবু’ — বলেছিল বাবা — ‘দাঁড়িপাল্লার দুদিকটা যাতে পৃথিবীর সবার জন্য সমান থাকে, তার চেষ্টা করে গেছে সারাজীবন ঐ লোকটাই। তার ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডারটা তাই নাই বা ছিঁড়লি?’
ফলে তিনি রয়ে গেলেন। আমাদের দেওয়ালে রয়ে গেলেন। মৃদু মৃদু দুলতেন। নজর রাখতেন আমাদের পরিবারের ওপর। মুক্তি সেনা আর তার কমরেডের যৌথ লড়াই আর ভালোবাসার সাক্ষী থেকে রয়ে গেলেন কমরেড লেলিন। লেলিন। লেনিন নয়। লেলিন।
লেলিনের ক্যামিও মেডেলটা সুকোমলকাকু দিয়েছিলেন আমি কলেজে পড়ার সময়। তারপরে এমএসসি — কালিয়াগঞ্জ বিস্মৃতির অতলে প্রায়, আড়িয়াদহ গঙ্গার ঘাট দিয়ে বহু কিউসেক জল বয়ে গেছে ততদিনে। মস্কোভা নদীর তীরে শহরটি মস্কোউউ — সেখানে যাওয়ার যে সাধ ছিল তাও প্রায় মুছে গেছে। বাবার পরপর দুটো হার্ট এটাক, মার ইউটেরাস ক্যান্সার।
চারিদিকে বড় বড় বাড়ি, প্রোমোটাররা তুলে ফেলেছে। মুক্তি সেনা খুঁজে পাই না, কমরেডরা পার্টি অফিসে বিরিয়ানি খায় এল সি মিটিঙে। একমুখ দাড়ি, ছেঁড়া লুঙ্গি পরা, টালির চালের দিকে তাকিয়ে নির্জীব শুয়ে থাকে বাবা, যে কিনা একদিন সেন্ট্রাল কমিটিতে ছিল, তাও সত্তর দশকের সেই উত্তাল ক্রান্তিকালে। বেচারার দেওয়ালের লেলিন তার মস্তিষ্কে ঢুকে গেছিল বরাবরের মতো — দাঁড়িপাল্লায় কারিকুরি করে দুই পাল্লা এদিক ওদিক কীভাবে করতে হয় শিখে উঠতে পারেনি তাই।
সপ্তাহে ছ’ দিন টিউশন করি পাগলের মতো। মুক্তি সেনা, কমরেড, অমলকান্তি, রোদ্দুর, কিছুই হতে পারিনি, হওয়ার কথা ভাবতেও সাহস করি না। শুধু স্বপ্নে মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে দেওয়ালে ঝোলা একটা ক্যালেন্ডার। কারা সব গায় — কমরেড লেলিনের আহ্বান, চলে মুক্তি সেনা দল…
তার মধ্যে একদিন বর্ধমান যাচ্ছি, বাবার অফিসে, একটা কাজে। বাবার কিছু টাকা আটকে আছে। আটকে রেখেছে বাবারই হাতে ধরে রিক্রুটেড হওয়া এক কমরেড। অনুনয় বিনয় করে যদি সেই টাকাটা বার করতে পারি তাহলে গোটা দুয়েক টিউশন ছেড়ে দিতে পারব আগামী মাস ছয়েক, সেটা হলে খুব ভালো হয় কারণ আমার ইউনিভার্সিটির ফাইনাল পরীক্ষা শুরু মাস দুয়েকের মাথায়। মেন লাইনের ট্রেনে বসে আনন্দবাজার খুলে চমকে উঠলাম। পাতাজোড়া গোর্বাশফ-এর ছবি। সেদিনের সেই সোভিয়েত পতনের বিবরণ আমার বুকে শেলের মতো বেজেছিল। এটাই না লেলিনের দেশ? লেলিনের? হ্যাঁ? লেলিনের?
আরও অনেক পরে এরকম ধাক্কা খেয়েছিলাম একদিন। যেদিন রেড স্কয়ারে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম ক্রেমলিনের সামনে শিশিতে করে জর্ডনের পবিত্র জল বিক্রি হচ্ছে। কেনার জন্য বিরাট লাইন। একটু দূরে, ম্যাসোলিয়ামে শুয়ে আছেন সেই ভদ্রলোক। উনি দেখছেন কি? তাঁর আহ্বানে মুক্তি সেনার দল আসছে কি ঠেকাতে এসব? হতভম্ব, অসহায়, ব্যথায় নীল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম রেড স্কয়ারে সেদিন।
ওয়ারশ’র গলিতে, প্রাগের ওল্ড সিটি স্কয়ারে, ভিয়েনা ইউনিভার্সিটির সামনের চত্বরে, অনেকবার জামা টেনে ধরেছেন কেউ পিছন থেকে, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেছি একমুখ দাড়ি ঝুলঝুলে ছেঁড়া ওভারকোট বা গ্রেটকোট — ‘ওনলি তু দলার, সার!’ — বাড়িয়ে ধরেছেন লেলিনের সেই ক্যামিও মেডেল, বা রেডব্যাচ। হয়তো ইনিও মুক্তি সেনাই ছিলেন?
কিন্তু ভদ্রলোক দুলছেন। আমাদের সেই টিনের চাল মাটির দেওয়াল, সেই গভীর, গম্ভীর ব্যারিটোন ভয়েস নিয়ে মুক্তি সেনা আর তার লজ্জায় আনন্দে লাল হয়ে যাওয়া গালের কমরেড, সবাইকে নজর রাখছেন, সবাইকে পাহারা দিচ্ছেন।
কমরেড লেলিনের আহ্বান, চলে মুক্তি সেনা দল
ভেদি অনশন মৃত্যু তুষার তুফান, প্রতি নগর হতে গ্রামাঞ্চল
কমরেড লেলিনের আহ্বান, চলে মুক্তি সেনা দল …
আমার এক টুকরো লেলিন আছে। সব মূর্তি ভেঙে দিয়েছে, নিজের দেশেও। নিজের বাড়িতেও ঢুকতে পারেন না ভদ্রলোক। কিন্তু আমার এক টুকরো লেলিন আছে।
মেয়েকে দিয়ে যাব। ওরও এক টুকরো লেলিন থাকবে।
থাকবেই।