Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্রতিষ্ঠান ও বিরোধী আন্তর্জাল

আন্তর্জাল

সুমন গুণ

 

এই সময়ের বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠান শব্দটির মধ্যে অনেকগুলো ক্ষত তৈরি হয়েছে। চওড়া আর আত্মবিষময় কিছু  ক্ষত যা অন্তত বাংলা কবিতার পুরো এলাকাটিকে প্রকাশ্যে চিহ্নিত করছে। এমন নয় যে বাংলা কবিতায় আগে সমান্তরাল ধারা বলে কিছু ছিল না। ছিল। বিশেষ করে আটের দশক ধরে, তার ঈষৎ আগে-পরেও গনগনে কিছু উদ্যোগ ছিল নানা জায়গায়, যা ওপর থেকে চাপানো কোনও চক্রান্তকে সরবে অস্বীকার করে চলত। নৈহাটি থেকে, পুরুলিয়া থেকে, কৃষ্ণনগর থেকে এমন সব স্বর ধেয়ে আসত শিল্পচর্চার দাপুটে কেন্দ্রের দিকে, যে, সেসবই একেকটা সদর্থে প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পেরেছিল। বাংলা কবিতা এখনও থমকে যায় দেবদাস আচার্যর নতুন একটি কবিতার ভাষায়, রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরীর সেই কবে লেখা একটা কবিতা নতুন করে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। ‘ক্ষ্মা’ নামে একটি কবিতাকাগজের হিলহিলে সংখ্যা হাতে এলে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। ‘আজকাল’ নামে একটি   আত্মগৌরবময় ছোটকাগজ আমাদের চর্চার শুরুতে কদম শক্ত করে চলতে শিখিয়েছিল। এসব ছিল, কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই অন্য পক্ষের ছোবল ছিল অনেক বেশি জোরালো, স্পষ্ট, সর্বগ্রাসী। প্রচারের জোরে।

এখন কিন্তু এই প্রচারের জায়গাটাই ঘুরে গেছে। আন্তর্জাল-এ হাত এখন সবার। বহুস্বরের সমান অধিকার প্রকাশ্য হওয়ায় যার বৈভব বেশি, তার সামনে এগিয়ে আসতে আর কোনও বাধা নেই। কখনও একেবারে ব্যক্তিগত উদ্যোগে, কখনও কয়েকজন মিলে, কখনও একজন-দুজন এমন সব কাজ করছেন, সংকলন করছেন, সংখ্যা করছেন ওয়েবে, যা মুহূর্তে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। এর সুফল যে কতটা, তা পুরো আন্দাজ করা মুশকিল। ত্রিপুরার প্রত্যন্ত গ্রামে এক নিঃশব্দ তরুণী মশাল তুলছেন কবিতায়, সারা বিশ্বের পাঠক তা লহমায় পড়ে ফেলতে পারছেন। পাঠকের হাতে এখন অনেক সম্পদ। শুধু বাছতে হবে। সেটা কিছু কঠিন কাজ নয়। পাঠকের গড় বিচক্ষণতাও বেড়েছে।

সারা পৃথিবীতেই নিজস্ব উদ্যোগের এখন স্বর্ণযুগ। আমাজনের বিশেষ ওয়েবসাইট হয়েছে নতুন লেখকদের জন্য। আন্তর্জাল-এ বেশ কিছু ওয়েবসাইট নতুন লেখকদের লেখা প্রচার ও বিক্রি করছে। লেখকরা নিজে ওয়েবসাইট বানাচ্ছেন, মার্ক ডসনের মতো অনেক লেখক ফেসবুকে বইয়ের বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। অনেক ছোট প্রকাশক তরুণ লেখকের বই নিয়েই ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। ‘দ্য অ্যাড্রয়েড জার্নাল’-এর মতো আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় জার্নালের উত্থান ও প্রতিষ্ঠা তো এভাবেই। উনিশেরও কম বয়সী কিছু ছেলেমেয়ে চাহিদা-মেনে-ছাপা পদ্ধতিতে প্রকাশনার কাজ শুরু করেছিল। একটা হিসেব বলছে, ফেব্রুয়ারি ২০১৪ থেকে মে ২০১৬ পর্যন্ত ইরেজি ভাষার বড় প্রকাশকদের বিক্রি ৪৫ শতাংশ থেকে কমে নেমে গেছে ২৫-এর নিচে। ঠিক উল্টোটা হয়েছে ছোট প্রকাশকদের বেলায়। একই শতাংশ বেড়েছে তাদের। গত কয়েক বছরে ইংরেজি ভাষার উল্লেখযোগ্য কিছু বই এভাবে ছাপা হয়েছে। একই ব্যাপার ঘটেছে এখানেও। তরুণ, তরুণতর কত ছেলেমেয়ে কত মহৎ কাজ করে চলেছেন। মজার ব্যাপার, সেসব তথাকথিত প্রতিষ্ঠানের কাছে মান্যতাও পাচ্ছে। বলা যায়, যাদের বিকল্প প্রকাশনা বলা হচ্ছে, তারাই এখন নিয়ন্ত্রণ করছে মূল প্রতিষ্ঠানকে। এটা মারাত্মক ব্যাপার। আর একটা বিষয় তো এতদিনে স্পষ্ট হয়েছে যে বই বিক্রি ক্রমশ উহ্য হয়ে উঠবে বলে যে ভয় প্রচার পাচ্ছিল, অনেকদিন ধরে, তা কাটছে। সারা পৃথিবীতেই এমন অনেক লেখক আছেন, যাঁদের লক্ষ লক্ষ বই বিক্রি হয়, অনেক সময় কিনতে চেয়েও পাঠক হাতে পান না, অপেক্ষা করতে হয়। জাপানের একটি বইয়ের দোকানের মালকিন বই বিক্রির ক্রমবর্ধমান রমরমায় ব্যাতিব্যস্ত হয়ে ঠিক করেছেন প্রতি সপ্তাহে একটিমাত্র বইয়ের অনেকগুলো করে কপি রাখবেন দোকানে, যাতে নানা বইয়ের পাঠকের ভিড় সামলানো যায়।

বাংলা বইয়ের বাজার কিন্তু খুব ছোট নয়। আমার এমন বন্ধুর সংখ্যা কম নয়, যারা সবচেয়ে বেশি খরচ করেন বই কিনে। এমন সব বই, যা হয়ত এক বা দু ফর্মার, ছাপা হয় দুশো বা তিনশো। এইসব বইয়ের খোঁজ পাওয়া যায় কোথায়? ছোট প্রকাশনার মেল-এ, ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে। আমার নিজেরই টেবিল, তাক, চেয়ার সব ভরা এমন ভাবে কেনা বা পাওয়া বইয়ে। কফিহাউস নয়, অবধারিত নামী পত্রিকাও নয়, আন্তর্জাল-এর অপূরণীয় আয়োজনের শরিক আমরা। সারা ভারতেই অশ্লীল আর অশুভ আক্রমণের দাঁতনখ যেভাবে থাবা বসাচ্ছে, তার মোকাবিলাও কিন্তু করতে হচ্ছে এইসব মাধ্যম দখল করেই। এদিক থেকে বরং বলা যায়, আমাদের সাহিত্যচর্চার দায় ও দরবার আদল পাচ্ছে এখন নতুন নতুন গণমাধ্যমের সূত্রে। প্রতিষ্ঠান আজ আর নিছক কোনও গোষ্ঠী, পত্রিকা বা প্রকাশনা একেবারেই নয়, তার প্রবলতর প্রকোপ মোকাবিলার ভূমিকাও নিতে হচ্ছে ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী’ সব পক্ষকেই।