মৃদুল দাশগুপ্ত
প্রথমবার বাংলাদেশ যাচ্ছি সেবার। পার্ক সার্কাসে বাংলাদেশের উপদূতাবাস থেকে ভিসা করিয়ে অতি উচ্ছ্বাসে বন্ধুবান্ধবদের সে কথা বলেছি। রওনা হওয়ার দিনকয়েক আগে ধর্মতলার মোড়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা। সিগারেটের দোকান থেকে সিগারেট কিনছিলেন। দেখা হওয়া মাত্র বললেন, ও মৃদুল, ঢাকা যাচ্ছ! জানো তো, বেলাল নাকি বিয়ে করেছে! — বিরস বদন তাঁর। — যেন বিয়ে করে বেলাল চৌধুরী অতি গর্হিত কাজ করে ফেলেছেন। এরপর শক্তি বলে চললেন, কী কাণ্ড! কী কাণ্ড! দেখো তো বেলাল ঠিকঠাক ঘর গেরস্থালি করছে কিনা!
লেখালিখির সূচনাকালে, সেই ১৯৬৭-৬৮ সালে যখন আমি কিশোর, তখন, যে দু-চার জনের নামে কিংবদন্তি জড়িয়ে গিয়েছিল, বেলাল চৌধুরী তাঁদেরই একজন। ডানাওয়ালা মানুষ একজন। তৎকালে সুনীল-শক্তি-সন্দীপন-তারাপদ-শরৎকুমারের ওড়াউড়ির যে সব কাহিনী প্রচলিত ছিল, তাতে বেলাল চৌধুরীর বিশেষ অধ্যায়, অধিক উড়ন্ত। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাহাজের নাবিক হিসেবে খিদিরপুরে নেমে বেলালদা কলকাতায় থেকে যান। কবিতার আকর্ষণে। জড়িয়ে পড়েন সে সময়ের কৃত্তিবাস-এর কবিদের মাতামাতিতে। তাঁর বোহেমিয়ান স্বভাবে রামধনুর রঙ লাগে। বয়সে কয়েক বছরের ছোট বেলালকে ভ্রাতৃস্নেহে বাঁধেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সমবয়সী ভাস্কর চক্রবর্তী, নিমাই চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে জমে যায় বেলালদার বন্ধুত্ব। সাহিত্য ক্ষেত্রে সেসময় নবীন লেখক কবিদের ভেতর হই হই তুলে শুরু হয়েছে হাংরি জেনারেশন সাহিত্য আন্দোলন। তুষার রায়, ফাল্গুনী রায়ের সাথেও ঘনিষ্ঠতা হয় বেলালদার। সে সময় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কৃত্তিবাস সম্পাদনার ভার দিয়েছিলেন বেলালকে। বেলাল চৌধুরী আর নিমাই চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত কৃত্তিবাসের ১৬ নং সংখ্যাটি হই হই ফেলে দেয়।
তো, ১৯৮৬ সালের আগস্টে ঘোর বর্ষায় আমি ঢাকা-বরিশাল ঘুরে বেড়াই। ঢাকায় গিয়ে শুনি বেলাল চৌধুরী মস্ত বড় চাকরি করছেন। ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনে তিনি ‘ভারত বিচিত্রা’ নামের পত্রিকাটির সম্পাদক। সেখানে গিয়ে দেখি বেলালদাকে। সেই প্রথম দেখা। আমাকে দেখে খুশি হন বেলালদা। সুদর্শন মানুষটিকে দেখে আমার মনে হয় এঁর শরীরময় খেলে বেড়াচ্ছে হর্ষ। শক্তি তাঁর বিবাহে হতাশ হয়ে পড়েছেন শুনে হো হো করে হেসে ফেলেন বেলালদা। আমার কাছে শক্তি, সুনীল, ভাস্কর, দেবারতি — সবার খবর নেন বেলালদা।
সেবার ৭ দিনের ভিসায় বাংলাদেশ গিয়েছিলাম। আমার বন্ধুরা একমাস আমাকে রেখে দিয়েছিল। ভারতীয় হাইকমিশন থেকে বেলালদা বাংলাদেশ বিদেশ দপ্তরে তাঁর বন্ধু অফিসারের কাছে আমাকে পাঠিয়ে বারবার আমার ভিসা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। নোবেল পুরস্কার পেয়েই সুইডেন থেকে সরাসরি ঢাকায় এসেছিলেন অমর্ত্য সেন। আমি সেবার অমর্ত্য সেনের ঢাকা সফরের খবর করতে গিয়েছিলাম।
বেলালদাদের ‘ঢাকাইয়া’ সংস্থাটি ড. সেনের সম্বর্ধনা দিয়েছিল। বেলালদা সেসময় খবরের ব্যাপারে আমাকে খুবই সহযোগিতা করেন। ড. সেনের সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল ঢাকার বলধা গার্ডেনে।
ষাটের দশকে কলকাতায় কবিতা ক্ষেত্রটি মাতিয়ে বেলালদা স্বদেশ স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে যান ১৯৭৪ সালে। যতদূর মনে পড়ছে কলকাতায় কৃত্তিবাস থেকেই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘স্বীয় ঘোটকীর গন্ধ’ বের হয়। ওই বইটি আমি পড়েছি। বেলালদার কবিতা স্ফূর্ত, তেজি, টগবগে — তাঁর স্বভাবগত গুণাগুণে ভরা। ষাট-সত্তর দশকীয় সময়দীপ্তিতে ঝলমল। তবে এর বেশি কবিতা আমি পড়িনি।
আমি বারবার বাংলাদেশ গিয়েছি। বেলালদার সঙ্গে দেখা করেছি, কলকাতাতেও দেখা হয়েছে। আমার কাছে ভাস্করদার মৃত্যুর খবরে বড়ই ব্যথিত হয়েছিলেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যেবার মারা যান দুর্গাপুজোর ভেতর গভীর রাতে, ভোরের বিমানেই ঢাকা থেকে বেলালদা কলকাতা চলে আসেন। আমি সকালবেলা রবীন্দ্রসদনে গিয়ে দেখি ভিড় থেকে দূরে একাকী একটি গাছের তলায় বেলালদা দাঁড়িয়ে। কেউ তাঁকে চেনে না। আমি কাছে গিয়ে দেখি দু চোখ সজল, ফোঁপাচ্ছেন। আমি যেতেই আমার হাত দুটি ধরে ভেঙে পড়েন। আমি তাঁকে নিয়ে সিঁড়ির ভিড় ঠেলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মরদেহের সামনে নিয়ে যাই। সেখানে অর্পিতা, চৈতালি, আরও কেউ কেউ বেলালদাকে চিনতে পেরে সামনে নিয়ে যায়। কাঁদছিলেন বেলালদা।
বাংলাদেশের তরুণ অভিনেতা মারজুক রাসেল বেলালদার খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল। মারজুকের মাধ্যমে বেলালদার অসুস্থতার খবর পেতাম। আর পাব না।
এখন বেলালদা নীরোগ, ঝকঝকে, দামাল। ওই আকাশে উড়ছেন। ৮০ নয়, তাঁর বয়স এখন যুবককাল।