সব্যসাচী দাস
নিহত ২১। আহতদের গুনে দেখার কষ্ট সেভাবে কেউ করেনি বলে ঠিক সংখ্যা অজ্ঞাত। বাড়িঘরে আগুন, বোমা গুলি ইত্যাদি।
ইদানীং আমরা সাম্প্রদায়িক হানাহানির খবরে অভ্যস্ত হয়েছি। ফলে মনে হতে পারে এ কোনও দাঙ্গার খবর। না, দাঙ্গা নয়।
ঘোষিত কোনও যুদ্ধও নয়। কোনও চকিত বিমানহানা… নয়!
কোনও জঙ্গি হানা? না। তার অভিঘাত তাৎক্ষণিক। হতাহত হয় তাতে, কিন্তু বাড়িঘরে আগুন লাগানো, বোমা বন্দুক নিয়ে দৌড়োদৌড়ি জঙ্গি হানার বৈশিষ্ট নয়।
এটা ভোট। নির্বাচন। গণতন্ত্রের মহোৎসব। আর আমরা এখন পশ্চিমবঙ্গের ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে কথা বলছি। প্রথম বাক্যের ওই ২১ জন নিহত, এ খালি ভোট এবং তারপরের দুদিনে। যদি গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়া ধরা হয় তবে সংখ্যাটা ৪০ ছুঁই ছুঁই। বিস্তার, রাজ্যের এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো, নামখানা থেকে কোচবিহার পর্যন্ত।
ডিজিমশাই বলছেন, আগের বছরগুলির তুলনায় কমই তো হয়েছে। মৃত্যু। মাননীয় কুইজমাস্টার সাংসদ পূর্ববর্তী জমানার খতিয়ান দিয়ে ৫৮০০০-এ ৪০ কত শতাংশ হয় বলে পাটিগণিতের অংক কষতে দিয়েছেন। ৪০ হিংসাত্মক ঘটনা। ৫৮০০০ ভোট বুথ।
যৌক্তিক বিচারে কথাগুলো হয়তো সত্যি। কিন্তু সে যুক্তি যে সাফাইজাতীয় সেই সত্যটাও উল্লিখিত হোক। সাফাই, দিচ্ছেন সরকারি প্রতিনিধিরা, নির্বাচিত এবং অ-নির্বাচিত, মৃত্যুর, হত্যার।
তবে আবারও, সত্যি বলতে কি, এও কি নতুন? চুরাশির শিখনিধনের সময় আমরা কি শুনিনি মহীরুহ পতনের গল্প? বা দুহাজার দুইয়ে মুসলিম নিধনের সময় নিউটনের তৃতীয় সূত্রের কথা? ‘পুলিশের বন্দুকে কি নিরোধ লাগানো আছে? তাহলে নকশালরা মরছে না কেন?’– এই অনন্যসাধারণ উক্তিটিও কি আমরা বিস্মৃত হয়েছি?
অতএব, এ যাবতীয় তুমুল গণতান্ত্রিক অনুশীলন দেখে দেখে অভ্যস্ত আমাদের পিঠে কুলো, কানে তুলো এবং হাতে, না পেনসিল নয়, রক্ত।
দুটো বিষয় আলোচনা করতে হচ্ছে।
প্রথমত, বাংলার ভোটে এমন হিংসা হয় কেন? আর কোথাও তো হয় না! এমনকি, এই পঞ্চায়েত ভোটের আগের দিনই ঘটে যাওয়া কর্ণাটক বিধানসভা ভোটে কোনও রক্তপাতের খবর নেই? তবে? গণতন্ত্র হত্যার এই বৈশিষ্ট কি বাংলার কেবল? বাংলার শাসক দলগুলিই যত নষ্টের গোড়া?
আজ্ঞে না। তাহলে ওপরে ওই তিনটে ঘটনার উল্লেখ করতাম না। ওগুলোর কোনওটাই নির্বাচনী কীর্তি ছিল না। এবং গণতন্ত্র খালি ভোটের দিনই খুন হয় না।
এই যে গুরগাঁওতে মুসলিমদের নামাজ পড়ার অধিকারকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে, সে কি গণতন্ত্র? না ভোট হচ্ছে ওখানে?
বাংলার এই বৈশিষ্টের কৃতিত্ব সিপিএমের। ব্রিটিশরা ভারতে ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসির প্রবক্তা। তারা চলে যাওয়ার পর দেখা গেল তাদের উত্তরসূরিরা এই বিদ্যেটা ভালোই রপ্ত করেছে। ধর্ম, জাত, ভাষা… জনগণকে বিভাজিত করে রাখার হরেক কৌশল আমাদের শাসকদের জানা। এখন বাংলায় নিজেদের দীর্ঘ রাজত্বকালে সিপিএমের নিজস্ব রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণেই উপর্যুক্ত কৌশলগুলি জোরালোভাবে ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। এদিকে জনগণকে বিভাজিত রাখাও অবশ্যকর্তব্য। ফলে সিপিএম পশ্চিমবাংলায় পার্টি-পার্টি বিভাজনকে তীব্রতর করে তোলে। ভাতে মারার নানান পদ্ধতি প্রয়োগ করে নিজেদের শিবিরে ঢুকতে বাধ্য করে তারপর তাদের দিয়েই তাদের সেই দাদাটার ওপর হামলা চালানো যাকে নাকি নানা কৌশলেও বশে আনা যাচ্ছে না, এ তো আমরা শহরেই দেখেছি। আর গ্রাম? হুগলি-মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলের মানুষকে ঘরছাড়া হতে হত শুধুমাত্র বিরোধী রাজনীতি করার অপরাধে। যারা ঘরে তাও থাকত তাদের ধোপা নাপিত বন্ধ করে একঘরে করে রাখার মধ্যযুগীয় ব্যবস্থাও চলত রীতিমতো প্রকাশ্যেই। এই অঞ্চলের কথা জানি বলে বললাম, কিন্তু এটুকু বলাই যায়, সব অঞ্চলেই কমবেশি একইরকম অভিজ্ঞতা মানুষের হয়েছে। এবং এই সমস্তটাই ছিল ভ্রাতৃঘাতী হানাহানি। কোনও শ্রেণিসংগ্রামের গল্প নয়। শুধু বিরোধীই বা বলি কী করে! বালুরঘাটে আরএসপিকে সংগঠন রাখতে হত, পুরসভা বা পঞ্চায়েত ভোটে জিততে হত রীতিমতো সিপিএমের সঙ্গে মারামারি করে। দিনহাটা সহ কোচবিহারে ফরওয়ার্ড ব্লককেও একই কাজ করতে দেখেছি। ফলে, আজ এই মুষল পর্বের দায় থেকে সিপিএম কোনওভাবেই হাত ঝেড়ে ফেলতে পারে না।
তৃণমূল এ ব্যাপারে একদম গুরুমারা বিদ্যে আত্মস্থ করেই মসনদে বসেছে। আর তার সাথে ফিরিয়ে এনেছে সিপিএম আমলের নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকা শাসকদের প্রিয় বিভাজন কৌশলগুলিকেও। যথা, ধর্ম। যথা, জাতপাত। ফলে আমাদের হাতে এখন দুবেলাই ভ্রাতৃঘাতী রক্ত। ভোট তো উপলক্ষ মাত্র।
“মানুষ মেরেছি আমি/পৃথিবীর পথে সেই নিহত ভ্রাতার ভাই আমি…”
দ্বিতীয় বিষয়টা কিছুটা রহস্যপূর্ণ। এই ভোটে তৃণমূলের এইমাত্রায় মরিয়া হওয়ার প্রয়োজন ছিল কি আদৌ কোনও? পদস্খলনের আশঙ্কা? কোথাও? কোনওভাবে? তৃণমূল এই ভোটে হেরে যাবে এমন কি তাদের খুব বড় বিরোধীরাও ভেবেছিল? যদি কিছু বা আশঙ্কা থেকেও থাকে সেটাও তো মনোনয়ন পর্বতেই নিকেশ করা হয়েছিল বেশ সুচারুভাবে। যার ফল ৩৯ শতাংশ আসনে একতরফা জয়। ইলেকশন নয়, সিলেকশন। তবে?
একটা তত্ত্ব বাজারে ভাসছে। পঞ্চায়েত এবং পুরসভা টাকা লুঠপাটের আখড়া। বিজেপি আমলে সামাজিক এবং পরিকাঠামোগত স্তরে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ হু হু করে কমলেও এখনও কেন্দ্রীয় অনুদান যা আসে এগুলিতে তা নেহাত কম নয়। আর টাকাপয়সা হাতানোর জন্য তৃণমূলীরা যে পরিমাণের দিকে তাকায় না, সেও আমরা অতীতে দেখেছি। ফলে, শাসক দল চেয়েছে পঞ্চায়েতগুলিতে নিরঙ্কুশই নয়, নির্বিরোধী দখল। যাতে একটা অন্ততও বেসুর না শুনতে পাওয়া যায় কোনও কোণা থেকে।
হতে পারে। আবার এও হতে পারে, নিখাদ শাসকের চিরন্তন ভীতি। যত প্রবল প্রতাপই থাকুক না কেন, যে ভীতিটা হঠাৎ হঠাৎ সকালে ঘুম থেকে উঠে চোঁয়াঢেঁকুরের মতো ভুসভুসিয়ে বেরিয়ে আসে।
আর তার সঙ্গেই বাংলার চরিত্র অনুযায়ী পার্টি-পার্টি দ্বন্দ্ব তো আছেই।
কর্ণাটকে শান্তিপূর্ণ ভোটের পর এখন ঘোড়া কেনাবেচা চলছে। মানুষ যাকে ভোট দিয়ে জিতিয়েছিল, যে দলের প্রতিনিধিকে, অবাক হয়ে সরকার হওয়ার আগেই দেখবে সে অন্য দলে চলে গেছে।
সব মিলিয়ে, ভো গণতন্ত্র, এই সত্তর-পেরনো বৃদ্ধ বয়সে, আছে কি বলার কিছু, তোমার? এটুকু অন্তত বলবে কি — তুমি কি আদৌ আছ? কোথাও?
RIP!