Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্রাণকৃষ্ণ দত্ত প্রণীত ‘বদমায়েস জব্দ’-র পুনর্বীক্ষণ

সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়

 

প্রায় দেড়শো বছর পরে প্রাণকৃষ্ণ দত্তের এই প্রহসনটির সটীক ও সচিত্র পুনর্মুদ্রণ বর্তমান বাঙালি পাঠকদের কৌতূহল উদ্রেক করবে। উনিশ শতকের ষাটের দশকে ইংরেজ সরকার, কলকাতা অঞ্চলের বারবনিতাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন আইন তৈরি করে — মূলত নিজেদের সৈন্যদের যৌনরোগ থেকে বাঁচাবার তাগিদে। প্রথম আইনটি পাশ হয় ১৮৬৪ সালে — Act XXII of 1864, যা ক্যান্টনমেন্ট অ্যাক্ট নামে পরিচিত। দ্বিতীয় আইনটি প্রণীত হয় ১৮৬৮ সালে, যেটি সেই সময় শোরগোল তুলেছিল শুধুমাত্র কলকাতার বারাঙ্গনাপল্লীতে নয়, ব্যাপক বাঙালি সমাজে। ‘Contagious Diseases Act XIV’ নামের এই আইনটি সে যুগে ‘চোদ্দ আইন’ নামেই বহুল প্রচারিত হয়েছিল। এই আইন, বারবনিতাদের উপর নানা অপমানমূলক শারীরিক উৎপীড়ণ অনুমোদন করে — যৌনরোগের চিকিৎসার নামে। এর প্রতিবাদে সে যুগের নারীবাদী ও পুরুষ সমাজসংস্কারকেরাও (এ দেশে ও বিদেশে) প্রচার অভিযান শুরু করেছিলেন — যার ফলে ইংরেজ সরকার বাধ্য হয়ে এই কুখ্যাত ‘চোদ্দ আইন’ প্রত্যাহার করেন ১৮৮৮ সালে।

‘বদমায়েস জব্দ’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ সালে — ‘চোদ্দ আইন’-এর চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। লেখক প্রাণকৃষ্ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার হাটখোলার অভিজাত দত্ত পরিবারের — যাঁদের বাসস্থান ছিল তদানীন্তন বিখ্যাত বারাঙ্গনা পল্লী ‘সোনাগাছি’র (সে সময়ে সোনাগাজী নামে পরিচিত) পাশাপাশি। তাই তাঁর প্রতিবেশীদের উপর ‘চোদ্দ আইন’-এর অভিসম্পাত উনি চাক্ষুষ দেখেছিলেন, এবং তারই বিবরণী পাই এই চটি বইটিতে। লেখক প্রাণকৃষ্ণ অবশ্য চোদ্দ আইনের শিকার বারবনিতাদের দেখেছিলেন ভিন্ন চোখে। সহানুভূতির বদলে তাদের ভীতিপ্রদ বলেই মনে করেছিলন। তাই আইনটিকে তিনি সম্ভাষণ জানান তদানীন্তন বাঙালি সমাজের উপকারস্বরূপ। যে ‘বদমায়েসরা’ ‘জব্দ’ হবে — তারা এই বারবনিতারা ও তাদের পুরুষ খদ্দেররা। সুতরাং এদের প্রাপ্য বিদ্রূপ ও ব্যঙ্গ — যে হাসি-মস্করার সুরে এই প্রহসনটি রচিত হয়েছে। এই পক্ষপাতপূর্ণ বিরোধীমনোভাবাপন্ন ঝোঁক থাকা সত্ত্বেও প্রাণকৃষ্ণের প্রহসনটি সে যুগের এক প্রধান সামাজিক রাজনৈতিক ঘটনার নিখুঁত দলিল হিসাবে স্বীকৃত হবে।

সুরজিৎ সেনের ভূমিকাটি সুলিখিত ও উনিশ শতকের কলকাতার সুপরিচিত গবেষক দেবাশিস বসুর সঙ্গে ওঁর সাক্ষাৎকারের বিবরণী পাঠকদের কাছে খুবই মূল্যবান এবং প্রাণকৃষ্ণ দত্তের লেখক জীবনীর উপর আলোকপাত করে। অদ্ভুত ধরনের উৎক্রমণ এঁর জীবনে। সতেরো বছর বয়সে লেখা এই প্রহসন ‘বদমায়েস জব্দ (১৮৬৯)’ যা প্রকাশিত হয়েছিল সে সময়ের বাংলা প্রান্তিক বা underbelly বটতলা ছাপাখানা থেকে। তারপর চল্লিশ বছর বয়সে, উনি এক সম্পূর্ণ নতুন রূপে হাজির হন বাঙালি পাঠকদের সামনে। ১৮৯০-এর দশকে সে যুগের অভিজাত ‘নবভারত পত্রিকা’তে উনি লিখতে শুরু করেন কলকাতার ইতিহাস। গভীর গবেষণাপ্রসূত এই লেখাগুলি কালজীর্ণ ঐ পত্রিকাতেই ধূসরাবৃত হয়ে থাকত, যদি না কিছু তরুণ গবেষক ১৯৮০-র দশকে ওগুলিকে পুনরুদ্ধার ও সংকলিত করে ‘কলিকাতার ইতিবৃত্ত’ নামে বার করতেন পুস্তক বিপণি প্রকাশনার উদ্যোগে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক, প্রয়াত নিশীথরঞ্জন রায়ের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্বলিত বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। সুরজিতের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে (২০০৭ সালে), দেবাশিস বসু প্রাণকৃষ্ণ ও তাঁর বংশধরদের সম্বন্ধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করেছেন।

সুরজিতের ভূমিকাতে উল্লিখিত দুটি তথ্য নিয়ে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। প্রথমত উনি লিখেছেন — “… ব্রিটিশ সরকার কলকাতায় জরুরি ভিত্তিতে কতকগুলো হাসপাতাল খুলেছিল। ডা. লকের নাম অনুসারে যেগুলোর নাম ছিল লক হাসপাতাল। প্রসঙ্গত ডা. লকই এই আইনটির (CDA XIV) প্রস্তাব রাখেন সরকারের কাছে।” এই তথ্যটির সূত্র কি জানতে পারি? আমার গবেষণা সূত্রে আমি জানতে পাচ্ছি যে ১৭৬৫ সালে কলকাতার তৎকালীন ইংরেজ কলেক্টর George Gray শহরের বারাঙ্গনাদের উপর কর আরোপ করেছিলেন Lock Hospital নামে চিকিৎসালয় স্থাপনের উদ্দেশ্যে (দ্রষ্টব্য — Raja Binaya Krishna Deb: The Early History and Growth of Calcutta. 1917. পৃঃ ১১৬)। বস্তুত প্রথম ‘লক হাসপাতাল’ স্থাপিত হয় লন্ডন শহরে ১৭৬৪-এ। ‘লক’ শব্দটির সূত্র ফরাসি ‘loques’ থেকে — যার অর্থ ন্যাকড়া বা কাপড়ের পট্টি যা দিয়ে কুষ্ঠরোগীদের শরীরের ক্ষতস্থান আবৃত থাকত, অর্থাৎ আজকের পরিভাষায় bandage। লন্ডনের প্রথম ‘লক’ হাসপাতালটি তৈরি হয় একটি পুরনো বাড়ির জমিতে, যেখানে একদা কুষ্ঠরোগীদের বন্ধ করে রাখা হ’ত (দ্রষ্টব্য — Kenneth Ballhatchet : Race, Sex, Class under the Raj, 1980 পৃঃ ১১)।

দ্বিতীয়ত, সুরজিৎ জানাচ্ছেন — “’চোদ্দ আইন’ নিয়ে প্রাণকৃষ্ণ দত্তর প্রহসনটিই প্রথম বই।” কিন্তু দেখতে পাচ্ছি ‘বদমায়েস জব্দ’ প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা ১২৭৫ সালে, আর তার আগের বছর ১২৭৪ সালে কলকাতার চিৎপুর রোডের বিজয়রাজ যন্ত্রে মুদ্রিত হয়েছে গিরীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘বেশ্যা গাইড’ অর্থাৎ মুর্শাক্রামক রোগ নিবারণার্থে ১৮৬৮ সালের ‘চোদ্দ আইন’ সংক্রান্ত অফিস বন্দোবস্ত ও কার্য্যবিধি বিষয়ক।

বইটির বিশেষ আকর্ষণীয় অঙ্গ সম্বরণ দাসের অনবদ্য চিত্রায়ণ। কালো কালিতে আঁকা কলমের আঁচড়ে black humour-এর প্রথম নিদর্শন ইদানীং বাঙলা চিত্রকলায় দুর্লভ। এই তরুণ শিল্পীর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছি। বীভৎস রসের এমন কৌতুককর অভিব্যক্তি সত্যিই আশ্চর্যজনক বর্তমান চিত্রকলা জগতে।