স্বাতী মৈত্র
শোনা যায়, ১৮২৫-২৬ নাগাদ কলকাতা শহরে গঙ্গার তীরে যখন প্রথম ধানভাঙা আর গমপেষা কল বসানো হয়, তখন সেই আশ্চর্য যন্ত্রদানবকে দেখতে জনমানুষের ভিড় হয়ে যেত। সেই সময়কার সংবাদপত্রে ফলাও করে ছাপা হয়েছে বিলাতি কলের অদ্ভুত মহিমার কথা, বলা হয়েছে, “আমরা আপনাদের সকল মিত্রকে এই পরামর্শ দিই যে তাহারা এই অদ্ভুত যন্ত্রবাষ্পের দ্বারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুই হাজার মোণ গোম পিষিতে পারে তৎস্থানে গমন করিয়া তাহা দর্শন করেন।” তবে ধান ভাঙা ও গম পেষাই করার যন্ত্র আসবার আরও আগে কলকাতায় এসেছিল আরেক আজব কল — একরকম নিঃশব্দেই বলা যায়। সেই যন্ত্র দেখতে ভিড় হয়েছিল কিনা, সে খবর কোনও সংবাদপত্রে পাওয়া যায় না। আর যাবেই বা কেমন করে? হিকি আর গ্লাডউইন সাহেব যখন প্রথম ছাপাকল নিয়ে আসেন কলকাতায়, তখন সংবাদপত্র ছিলই বা কই? হিকি সাহেব আর গ্লাডউইন সাহেবের নেটিভ কম্পোজিটররা প্রথম সে ছাপাকল দেখে কী ভেবেছিলেন তার কিছুই ইতিহাসের পাতা থেকে আমরা জানতে পারি না। অবশ্য না পারলেও সমস্যা নেই। ছাপাকল নামক যন্ত্রটি যে কলকাতা শহরকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছিল, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। বিনয় ঘোষ তাঁর কলকাতা কালচার-এ বলেছেন, “কলকাতা শহর যদি আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নবজাগরণের মহাকেন্দ্র হয়, তাহলে ধানকলের চাল, পাটকলের পাট বা কাপড়ের কলের কাপড়ের অনেক আগে, বইছাপা কলের বইপত্র সেই জাগরণের সঞ্চার করেছে বলতে হবে। প্রাসাদপুরী কলকাতা নয়, বা কলকারখানার চিমনির ধোঁয়ায় ঢাকা কলকাতা নয়, ছাপাখানায় ছাপা বইপত্রের কলকাতা, গ্রন্থ-নগরী কলকাতা-ই আমাদের আদি তীর্থস্থান। গৌড়, নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগর, মুর্শিদাবাদ, ঢাকা হল হাতেলেখা পাণ্ডুলিপির রাজ-নগর বা তীর্থনগর—প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় কালচারের প্রতীক। কলকাতা শহর ছাপাখানায় ছাপা গ্রন্থ-নগরী—আধুনিক কালচারের প্রতীক।”
কলকাতা-র আধুনিকতার অন্যতম পরিচয় যদি হয় ছাপাখানা সংস্কৃতি (বা ইংরেজিতে যাকে বলা হয় প্রিন্ট কালচার), তাহলে সেই গ্রন্থ-নগরীর পীঠস্থান নিঃসন্দেহে আজকের চিৎপুরের হারিয়ে যাওয়া সেই বটতলা। বিনয় ঘোষের ভাষাতেই বলা যায়, “বাংলাদেশের অনেক দীর্ঘায়ু বটগাছের মতন, শোভাবাজারের বটগাছের একটা বাঁধানো চাতাল ছিল। সেই বাঁধানো বটতলায় কবি-জ্ঞানের আসর জমত প্রায়, নিধুবাবুর টপ্পাসুরে বটতলার পরিপার্শ্ব সরগরম হয়ে উঠত। শুধু তাই নয়, ছাপার অক্ষরে নবযুগের বাঙালির সাহিত্য-সাধনার উদ্বোধনও হয় এই বটতলার আশেপাশের ছাপাখানায়।” লালদীঘি চত্বরের সাহেবি ছাপাখানা ও শ্রীরামপুরের মিশনারিদের মার্জিত জগতের বাইরে, ডিহি চিৎপুরের অলিতে গলিতে গড়ে ওঠা, কলকাতা শহরের আরও নানান অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া ছাপাখানার জগৎ — চটি বইয়ের বটতলা, কাঠখোদাইয়ের বটতলা, ছেনিকাটা হরফে সস্তার কাগজে ভুল বানানে বহু পরিশ্রমে সৃষ্ট অসংখ্য নাম না জানা বইয়ের বটতলা।
চিৎপুর রোড, আপজন সাহেবের মানচিত্রে ‘রোড টু চিৎপুর’, আজকের রবীন্দ্র সরণী — ব্যস্ত রাজপথ পার হতে গিয়ে অনেকেই হয়তো খবর রাখেন না যে তাঁরা কলকাতা শহরের অন্যতম প্রাচীন সরণী ধরে চলছেন। বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের পঞ্চদশ শতকে রচিত মনসামঙ্গলে চাঁদ সদাগরের সপ্তডিঙা চিত্রপুর বা চিৎপুর হয়ে কলিকাতার উদ্দেশ্যে এগোয়, যদিও সুকুমার সেন ও নীহাররঞ্জন রায়ের মতন ভাষা ও ইতিহাসবিদেরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে কলিকাতার উল্লেখটা পরবর্তীকালের গায়েনদের সংযোজন। এই রাস্তা ধরেই নাকি এককালে দুর্গম জঙ্গল পার করে মুর্শিদাবাদ-নদীয়া থেকে তীর্থযাত্রীরা কালীঘাটে যাওয়া-আসা করতেন, পথে পড়ত আদি চিত্রেশ্বরীর বা চিতেশ্বরীর মন্দির। কোনও এক দুর্ধর্ষ চিতে ডাকাত নাকি এই মন্দিরে এককালে নরবলি দিত, অনেক সময় বলা হয় চিতেশ্বরীর নামই আসে তার নাম থেকে। এইখানেই ছড়ি-খ্যাত বাবু গোবিন্দরাম মিত্র (যিনি ব্ল্যাক জমিনদার হিসেবেও পরিচিত ছিলেন) তাঁর নবরত্ন-পঞ্চরত্ন মন্দির তৈরি করেন, যা নাকি মনুমেন্টের থেকেও উঁচু ছিল। ইংরেজরা এর নাম দিয়েছিলেন ব্ল্যাক প্যাগোডা, ১৭৩৭ সালের ভূমিকম্পে (আধুনিক মতে সাইক্লোন বা সুনামি) খসে পড়ে যায় এই বিখ্যাত পঞ্চরত্ন চূড়া। রমজান মাসের বাজারে যে সকল খাদ্যরসিক জাকারিয়া স্ট্রিটে ভিড় করবেন, তাঁরা নাখোদা মসজিদ চিনলেও নবাব মহম্মদ রেজা খানের নাম হয়তো বা শোনেননি — নবাবি আমলের শেষ কিছু ছাপ যে এই অঞ্চলের স্থাপত্যে রয়ে গেছে তা হয়তো প্রত্যক্ষ করবার সুযোগ হয়নি। তবে চিৎপুর তো শুধু নবাব ও বাবুদের এলাকা নয়, বা কেবলই তীর্থযাত্রীদের বিচরণ ক্ষেত্র নয়, তারাপদ সাঁতরার ভাষায় “ইংরেজ আমলে এই চিৎপুর কলকাতার হৃৎপিণ্ডে একটি ধমনীর মতো [ছিল]।” সেই ধমনীর জীবনীশক্তির উৎস ছিল সাবেকি চিৎপুরে গজিয়ে ওঠা অসংখ্য কারিগর ও শ্রমিকের বসতি, কর্মক্ষেত্র। এই সকল কারিগরদের সম্মিলিত প্রতিভা ও উদ্ভাবনী শক্তির, শ্রমের সমাহার বটতলার ছাপাখানা সংস্কৃতি। তাই আজও উডকাট ছবিতে স্বর্ণকার ও কর্মকারদের পৃথক আঁচড়ের ফল দেখলে মুগ্ধ হতে হয়, নিমতলার কাঠগোলা হয়ে আসা ছাপাখানার অক্ষরের কথা মনে করে হতবাক হতে হয়, দর্জিপাড়ার প্রতীকবাবুর নোট জাল করার কাহিনি (অথবা আরবান লেজেন্ড) লোকমুখে শুনলে চমৎকৃত হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
ডায়মন্ড লাইব্রেরী
এ কথা বললে হয়তো অত্যুক্তি হবে না যে একবিংশ শতাব্দীর বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের মূলধারায় নস্টালজিয়ার স্থান যথেষ্ট উপরে। সিনেমার ফ্রেমে ফ্রেমে পুরনো কলকাতা-র হারিয়ে যাওয়া রূপের রোমাঞ্চ, বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখবার গুরুগম্ভীর বাণী, ফেসবুকের পাতায় পাতায় বাংলার হৃত গৌরব ধরে ফিরে পাওয়ার আকুতি, সরকারি নির্দেশে ইস্কুলে বাংলা শিক্ষা — এই সবের মাঝেই টিমটিম করে জ্বলে থাকা আজকের চিৎপুর চোখে আঙুল দিয়ে মনে করিয়ে দেয় যে নস্টালজিয়া-বিলাসী বাঙালি আজও ‘ঐতিহ্য’ ব্যাপারটির সম্পর্কে তেমন পরিষ্কার ধারণা পোষণ করেন না। ঐতিহ্য শব্দটি উচ্চারণ করলেই তাই মন স্মৃতিমেদুর হয়ে আসে, অথবা অতিশ্রদ্ধায় শিরদাঁড়া নুয়ে পড়ে। কল্পনার চোখে ঐতিহ্য হয়ে ওঠে ইট-কাঠ সম্বলিত অট্টালিকা এবং বাবু-বিবিদের ক্যারিকেচার, আর চিৎপুরের জীবনীশক্তির শেষ, ক্ষীণ হয়ে আসা উৎস, আজকের যাত্রাপাড়ার কপালে জোটে শ্লেষ ও ব্যঙ্গ। তারাপদ সাঁতরা কীর্তিবাস কলকাতা রচনার যুগে খুঁজে পেয়েছিলেন বেশ কিছু বইয়ের দোকান; তাঁর নিজের ভাষাতেই বললে, “আজ হয়তো সেকালের মতো অত বইয়ের দোকান আর নেই, তবুও যে’কটি দোকান আজও আছে তার মধ্যে নাম করা যেতে পারে, ‘নৃত্যলাল শীলস লাইব্রেরী’, ‘মহেন্দ্র লাইব্রেরী’, ‘কলকাতা টাউন লাইব্রেরী’, ‘ডায়মন্ড লাইব্রেরী’, ‘তারাচাঁদ দাস অ্যান্ড সন্স’, ‘অক্ষয় লাইব্রেরী’, ‘তারা লাইব্রেরী’, ‘ক্রাউন লাইব্রেরী’ প্রভৃতি।” বিনয় ঘোষ বলেছেন ‘সোল প্রোপ্রাইটার’ ধর মহাশয়ের কথা, শীল মহাশয়ের কথা, আরও বহু প্রকাশকের কথা। আজকের বটতলায় তাঁরা সকলেই স্মৃতি — পড়ে রয়েছে কেবল দুটি দোকান, ডায়মন্ড লাইব্রেরী ও মহেশ লাইব্রেরী। সেগুলোও যে বেশিদিন থাকবে না, সেই ব্যাপারে বয়স্ক সোল প্রোপ্রাইটাররা নিশ্চিন্ত। যে কারিগর-শিল্পীরা তাঁদের শ্রম দিয়ে গ্রন্থ-নগরীর পীঠস্থানটি গড়ে তুলেছিলেন, তাঁদের স্মৃতি বহন করে নীরবে কাজ করে চলেছেন আজও অলিতে-গলিতে কর্মরত বহু কর্মী। তাঁরা আজ সময়ের দাবি মেনে ডিটিপি শিখেছেন, ডিজিটাল অফসেট মেশিন বসিয়েছেন, লেটারপ্রেস আর লিথোগ্রাফি মেশিনগুলো বেচে দিয়েছেন বহুকাল আগেই। তাঁদের শ্রম ঐতিহ্যের তকমা পায় না, যে বহমান ট্র্যাডিশনের চলতা-ফিরতা ভাণ্ডার তাঁরা, তারও কদর নেই তেমন। হেরিটেজ ওয়াক আর ডিএসএলআর সম্বলিত সিটি টুরের হাত ধরে কিছু কিছু মানুষ আজকাল চিৎপুর চত্বর কিছুটা হলেও চিনতে শিখেছেন, সাম্প্রতিক কালে একাধিক শিল্পী/সংরক্ষণবিদ/শিক্ষাবিদ শহরের ঐতিহ্য রক্ষার কাজে এগিয়ে এসেছেন, এ নিয়ে সন্দেহ নেই, তাও প্রশ্ন থেকে যায় — বটতলার যে ‘রুইন’ বিনয় ঘোষ ৬০-এর দশকে গিয়ে খুঁজে পেয়েছিলেন, সেই তথাকথিত ধ্বংসস্তূপের জীবন্ত ইতিহাসের মূল্যায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ কেমন করে হবে?
***
চিৎপুরের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ানোর সময় বিনয় ঘোষের মতন ‘বিশুদ্ধ “অ্যাডভেঞ্চার”‘ উপভোগ না করে থাকলেও, তাঁর “বটতলা অভিযানের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার” — নাটক ও প্রহসনের রমরমা — আজকেও কিছুটা বোঝা যায়, যদিও সেই রমরমা আজ ফুরিয়ে আসার দিকে। প্রবীণ বটতলার প্রকাশক, জনৈক শীল মহাশয়কে বিনয় ঘোষ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “এই সব প্রহসন ও নকশা আজকাল বিক্রি হয় কেমন?”
শীল মহাশয় বলেন, “হয়, তবে আগের মতন আর হয় না।”
তিনি আরও বলেন, এবং পুরোটাই উদ্ধৃত করছি এইখানে, “আগে যে সব যাত্রার দল ছিল, অপেরা পার্টী ছিল কলকাতায়, এখন আর তাঁরা নেই। আজকাল সিনেমাই সব সর্বনাশ করে দিয়েছে। আগে যাত্রা হলে, প্রধান নাটক অভিনয়ের শেষে সব সময় একটা প্রহসন ও রঙ্গনাট্য অভিনীত হত। এখন যাত্রার দল, অপেরা পার্টী প্রায় সব উঠে গেছে, যাত্রাও গেছে, বিশেষ হয় না, প্রহসনও তেমন কাটতি নেই। যা কিছু নাটক প্রহসন বিক্রি হয়, তার অধিকাংশই মফস্বল।”
সন্দেহ হয়, যাত্রাবিদ এই শীল মহাশয় ডায়মন্ড লাইব্রেরীর প্রকাশকদের মধ্যেই একজন, যদিও বিনয় ঘোষ তাঁর পুরো নাম লেখেননি, লেখেননি প্রকাশনার নামও। চিৎপুরে আজও সাদামাটা সুন্দর ক্যালিগ্রাফির হরফে লেখা ডায়মন্ড লাইব্রেরীর সাইনবোর্ড যাত্রাদলের রঙ-বেরঙের পোস্টারের পাশে স্বমহিমায় অবস্থিত, যদিও পালার পুস্তক কিনতে কত মানুষ আজ আগ্রহী, সে কথার উত্তর জানা নেই। তাও প্রবীণ গণেশচন্দ্র ও বৈদ্যনাথ শীলের কাছ থেকে যেটুকু সময় ও তথ্য পেয়েছি, সেটাই চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি লেখার পরবর্তী অংশে।
***
গণেশচন্দ্র এবং বৈদ্যনাথ শীল
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ডায়মন্ড লাইব্রেরী এই পাড়ার সব থেকে পুরনো সংস্থানগুলোর একটা। শুরুর সময়ের কথা যদি একটু বলেন…
বৈদ্যনাথ শীল : [ডায়মন্ড লাইব্রেরীর স্থাপনা হয়] ১২৮৪ সালে।
স্থাপনা কে করেন?
গণেশচন্দ্র শীল : স্থাপনা করেন আমার ঠাকুরদাদা, নদেরচাঁদ শীল।
বৈদ্যনাথ শীল : হ্যাঁ, (জোর দিয়ে) নদেরচাঁদ শীল।
আপনরা কি তখন থেকেই যাত্রাজগতের সাথে এইভাবে যুক্ত, না অন্যান্য ধরনের কাজও করতেন?
গণেশচন্দ্র শীল : তখন অন্য সব ধরনের বই ছিল। পাঁচালি-টাচালি…
বৈদ্যনাথ শীল : রামায়ণ, মহাভারত… কত কী!
হ্যাঁ, তখন তো এগুলো খুবই জনপ্রিয় ছিল।
বৈদ্যনাথ শীল : তারপর কিছু উপন্যাস ছিল।
কোন উপন্যাস?
বৈদ্যনাথ শীল : তখনকার দিনের উপন্যাস।
কোনও উদাহরণ বলতে পারবেন?
গণেশচন্দ্র শীল : তখনকার দিনের কিছু কিছু লেখক ছিল। এমনি ঘরোয়া লেখক। ঘরোয়া কাহিনি নিয়ে লিখত। সেইগুলোই বিক্রি হত। যেমন বিষদৃষ্টি, উদাসিনী রাজকন্যার গুপ্তকথা…
বৈদ্যনাথ শীল : সেনাপতির গুপ্তরহস্য…
নামগুলো শুনেই মনে হচ্ছে রোমাঞ্চকর কাহিনী একেকটি। আমার নিজের রিসার্চের সময় দেখেছি বাড়ির মেয়েরা এই ধরনের লেখাপত্র খুবই ভালোবাসতেন।
বৈদ্যনাথ শীল : এই বইয়ের নাম আপনি শোনেননি। শোনার কথাও না।
সেটা ঠিকই…
গণেশচন্দ্র শীল : আরও অনেক সব ছিল, আমরাও এখন সব ভুলে গিয়েছি।
বইগুলোর দাম কেমন হত?
গণেশচন্দ্র শীল : তখনকার দিনে কত আর হত? তখন এক টাকা, চার আনা।
বৈদ্যনাথ শীল : তখন তো আনা পয়সার ছিল সিস্টেম। সেই হিসেবে টাকা, পয়সা, আনা লেখা হত। দামও সেরকম ছিল।
অর্থাৎ আপনারা এখন যেমন স্বল্প মূল্যে বই বিক্রি করেন, তখনও স্বল্প মূল্য থাকত।
বৈদ্যনাথ শীল : তখন তো ভ্যালুও অনেক কমই ছিল। জিনিসপত্রের দাম কম থাকার জন্য বইও অনেক কম দামে বিক্রি হত।
আচ্ছা। আপনাদের দোকানটা কি তখন থেকেই এখানে? না কি আগে অন্য কোথাও ছিল?
গণেশচন্দ্র শীল : আগে ছিল ওপারের দিকে [চিৎপুর এলাকাতে]। আগে এখানে একটা বটগাছ ছিল।
বৈদ্যনাথ শীল : এই কিছুটা আগে একটা বটগাছ ছিল।
সেই থেকেই কি বটতলা নাম আসল?
বৈদ্যনাথ শীল : হ্যাঁ ওটাই বলতে যাচ্ছিলাম।
আপনারা মনে হয় না সেই গাছ দেখেছেন…
বৈদ্যনাথ শীল : না, আমরা দেখিনি।
গণেশচন্দ্র শীল : বটতলায়… বটগাছের তলাতে যেমনি মেলাতে সবাই বসে না, সেরকম বটগাছের ছায়াতে বসত সবাই ওই বইটই নিয়ে — ওই দু আনা, চার আনা, এক আনা [দাম]…
লোকের কাছে বই কীভাবে পৌঁছাত?
গণেশচন্দ্র শীল : ওরা আসত।
বৈদ্যনাথ শীল : এসেই নিত। তখন তো ডাকব্যবস্থায় এরকম বই যেত না।
তখন বোধহয় এরকম দোকানপাটও ঠিক ছিল না, পাকাপাকি প্রেমিসের ব্যাপারটা তো পরে হল, তাই না? তারপর তখনকার দিনে ফিরিওয়ালারা ছিল… কিছু আত্মজীবনীতে এঁদের কথা পড়েছি, যে ফিরিওয়ালারা বই নিয়ে বাড়ি বাড়ি যেত।
বৈদ্যনাথ শীল : ফিরিওয়ালা ছিল। আর তখন এই বই ছাড়া আরও অন্যান্য বই প্রকাশ হত, যেইগুলো বটতলার বই। অনেকে বলে বটতলার বই মানেই নোংরা বই।
সেটা বোধহয় একেবারেই ঠিক নয়। আপনাদের এখানেই তো ধর্মীয় বই থেকে যাত্রার বই, সবই তো বিক্রি হয়।
বৈদ্যনাথ শীল : সেইসব বই এখন আর নেই। আমাদের অনেক রকম বই ছিল, ওসব বইয়ের চাহিদা কমে যাওয়ার জন্য আর ছাপা হয় না। কিন্তু রামায়ণ, মহাভারতের বই এখনও ছাপা হয়।
হ্যাঁ, কিছু বইয়ের চাহিদা সব সময় থাকে। রামায়ণ, মহাভারত সেই বইয়ের মধ্যে পড়ে।
গণেশচন্দ্র শীল : হ্যাঁ।
আরেকটা ছোট প্রশ্ন। আপনাদের ঠাকুরদা, নদেরচাঁদ শীল, তিনি তো এই বইয়ের ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু আপনাদের পারিবারিক ব্যবসা নিশ্চয় বইয়ের ব্যবসা ছিল না?
গণেশচন্দ্র শীল : শুনুন, সেটা বলতে পারব না। আসলে তখন তো আমরা হইনি।
বৈদ্যনাথ শীল : হইনি, আর আমরা জানারও চেষ্টা করিনি। আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি বইয়ের ব্যবসা, তাই আমরা জানি আমাদের বইয়ের ব্যবসা আছে। সেটাই পৈতৃক ব্যবসা।
হ্যাঁ, আপনাদের ক্ষেত্রে বই পৈতৃক ব্যবসা, সেটা ঠিকই বলেছেন।
গণেশচন্দ্র শীল : হ্যাঁ, মোটামুটি তাই।
আপনাদের এখনকার এই যে ঠিকানা, এটা কি আপনারাই শুরু করেন, নাকি আপনাদের বাবার আমল থেকেই আছে?
বৈদ্যনাথ শীল : আমার ঠাকুরদাদা, নদেরচাঁদ শীলের পরে আমার বড় জ্যাঠা, কানাইলাল শীল, আর আমার বাবা, সূর্যকুমার শীল, এর দুজনে আমাদের এই ব্যবসাটার হাল ধরেন। তারপর ওনারা গত হয়ে যাওয়ার পর আমরা দুজন ভাই এবং আরেকজন ভাই ছিল… উনিও গত হয়েছেন। তো তারপর আমরা দুজন — গণেশচন্দ্র শীল, আমার নাম, আর বৈদ্যনাথ শীল, দুজনে ব্যবসাটা এখন চালাই। এই আমরাই এখন আছি। আর এখন যাত্রাজগতের যা অবস্থা, সেইখানে কতদিন যে আর আমরা আমাদের প্রোডাকশন কীভাবে আর কতদিন নিয়ে যেতে পারব, সেটা আমি আর বলতে পারছি না।
গণেশচন্দ্র শীল : শুধু তাই নয়, এখন এই শিল্পটাও তো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সে তো ঠিকই। যাত্রা এখন অনেকটাই বদলে গেছে। বন্ধ হয়ে হয়ে গেছে বলব না, কিন্তু বদলে গেছে…
বৈদ্যনাথ শীল : বদলে গেছে। আর আমাদের সরকার তো বিভিন্ন ক্ষয়িষ্ণু শিল্পগুলোকে চাঙ্গা করার জন্য অনেক চেষ্টা করছেন, কিন্তু আমাদের যাত্রাশিল্পকে চাঙ্গা করার খুব একটা চেষ্টা কিন্তু করছেন না। ওই মাসখানেক বিভিন্ন জায়গায় যাত্রার অনুষ্ঠান হচ্ছে। উৎসব হচ্ছে। যাত্রা উৎসব বলে চালাচ্ছে।
গণেশচন্দ্র শীল : যেমনি ধরুন বাগবাজারে।
ওখানে ফণীভূষণ মঞ্চে আমিও যাত্রা দেখেছি।
বৈদ্যনাথ শীল : কিন্তু ওই কদিনই যাত্রা ব্যাপারটাকে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে।
আরও ধরুন আমি যদি অনলাইন জানতে চাই, গুগল করে, কী কী পালা হচ্ছে, আমি জানতে পারব না। আমাকে এখানে এসে জানতে হবে। এটা একটা সমস্যা। আজকাল তো এগুলো বদলে গেছে, আমাদের অভ্যাস এখন সবার আগে একবার গুগল করা…
বৈদ্যনাথ শীল : গ্রামে-গঞ্জে যাত্রার প্রচলন প্রথম থেকেই বেশি। এখন না হয় শহরে হচ্ছে, হলেতে হচ্ছে। কিন্তু সেই আসল জায়গাতে এখন যাত্রার প্রচলন কমে গেছে। মানুষের মধ্যে আর যাত্রা করার ইচ্ছা নেই, জানি না কী জন্য…
সিনেমা কি একটা কারণ হতে পারে?
বৈদ্যনাথ শীল : না, এই টিভিটা হয়ে নষ্ট হয়েছে যাত্রাশিল্প অনেকাংশে।
বাড়িতে বসেই যদি লোকে দেখতে পায় তাহলে আর পয়সা খরচা করে [যাত্রার] দলকে ডাকবে কেন?
গণেশচন্দ্র শীল : আগে তো লোকে সেই রাতে যাত্রা দেখতে যেত আর ফিরত সেই ভোরে। সেইসব জিনিস আর নেই। আর এখন টিভিতে অনেক চ্যানেল, একেকটা চ্যানেলে একেক জিনিস…
বৈদ্যনাথ শীল : বিভিন্ন রকমের জিনিস দেখানো হচ্ছে টিভিতে।
এখন তো ফোনেই টিভি। আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো টিভিও দেখে না, এখন ফোনেই অনেক সময় সব কিছু দেখে নেয়।
বৈদ্যনাথ শীল : এখন আমরা যারা যাত্রামোদী, তাদের কাছ থেকেই শুনতে পাই, ‘আপনাদের যাত্রাটা এখন কেন কম হচ্ছে?’ তারাও এই কথা বলে যে বাড়ির মেয়েরা আগে যাত্রা দেখতে যেত, এখন ওই টিভি দেখছে। বাড়িতে সকাল বিকেল রান্নাবান্না করে ৬টার আগে টিভির সামনে বসে গেল।
গণেশচন্দ্র শীল : এখন রাতে রুটি করা বন্ধ হয়ে গেছে।
[হেসে] সিরিয়ালের ফাঁকে ফাঁকে কাজ করে নেন নিশ্চয়।
গণেশচন্দ্র শীল : না, রুটিটা আনতে যেতে হয়। [হাসি]
বৈদ্যনাথ শীল : বাজারে যে রুটি বিক্রি হয় সেখান থেকে কিনে নিয়ে যেতে হয়।
গণেশচন্দ্র শীল : তার হাসব্যান্ড যখন অফিস থেকে ফেরে — এই এতগুলো রুটি এনো।
বৈদ্যনাথ শীল : ব্যস।
আচ্ছা, আপনাদের আরেকটা প্রশ্ন করব। আপনাদের নতুন প্রকাশ হচ্ছে যে বইটা দেখলাম [‘ঘরে ঘরে মমতা’ নামে একটি বই], বললেন মৌলিক নতুন লেখা। এই পাড়ায় যে নানারকম পালা হয়, সেই সবের বই-ই কি আপনারা প্রকাশ করেন?
গণেশচন্দ্র শীল : না, আমরা সব প্রকাশ করি না। কারণ এখানে যে পালাগুলো হয়, মানে দু একজন দিয়েই অভিনয় হয়। আর বইটাতে চরিত্র থাকবে ধরুন ১০ জন, ১৫ জন, কিম্বা ম্যাক্সিমাম হলে ২০ জন… কিন্তু এখানে খুব বেশি হলে ৮ জন, ১০ জন। দেখুন এবার আমাদের খরচাটাও তো তোলা চাই। ৮-১০ জন হলে তো আর খরচাটা উঠবে না। তাই বইয়ের ভলিউমটা বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
বৈদ্যনাথ শীল : এবার যাত্রাশিল্পটার মধ্যে যারা শিল্পী, যারা অপেরার মাধ্যমে অভিনয় করে, তাদের অভিনয় প্রক্রিয়া আলাদা। হয়তো হিরো হিরোইনের আশেপাশে আর কিছু শিল্পী নিয়ে গোটা বইটা চালিয়ে গেল। আমরা যে এই যাত্রার বইগুলো প্রকাশ করছি, এটা গ্রামেগঞ্জে যেসব অ্যামেচার ক্লাব তাদের জন্যই এইসব বইগুলো প্রকাশ করা হয়। তারা কী, সেখানে ১০-১২ লোক হবে, সবাই মিলেই তো পার্ট করবে। গ্রামের একটা ক্লাবকে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে এক জন দু জনকে দিয়ে অভিনয় করালে তো চলবে না।
গণেশচন্দ্র শীল : যারা যারা ডোনেশন দেবে…
বৈদ্যনাথ শীল : যারা যারা ডোনেশন দেবে সবাই, মানে নিজেরা খরচা করে, সবাই মিলেই কাজটা করবে।
মানে পাড়ার নাটকের মতন…
বৈদ্যনাথ শীল : এবার সেটাই মঞ্চেতে নিয়ে আসা। এতে রিক্রিয়েশনও হয়, আর নাটক যে একটা লোকশিক্ষে, সেটাও দেখানো হয়।
আপনাদের অনেকগুলো সামাজিক পালা আছে দেখলাম…
বৈদ্যনাথ শীল : শুধু সামাজিক নয়, ঐতিহাসিক, পৌরাণিক।
গণেশচন্দ্র শীল : আগে এইসবই বেশি চলত।
বৈদ্যনাথ শীল : আগে বেশি চলত। আগে লোকে শিক্ষিত কম ছিল, বই কম পড়ত, কিন্তু যাত্রা করার মাধ্যমে তারা শিক্ষা পেয়ে যেত, যে হ্যাঁ এই রাম ছিল, এই রাবণ, কে কী করেছে, কে শয়তান ছিল, কে ভালো ছিল, কে মন্দ ছিল। সামাজিক পালা তো অনেক পরে এসেছে। সামাজিকটা আমাদের লাইফেই এসেছে। এই আমরা যতদিন আছি ততদিনই এসেছে। তার আগে ছিল ঐতিহাসিক [পালা]। প্রথমে পৌরাণিক [পালা], তারপর ঐতিহাসিক। এই নানা জায়গায় যুদ্ধবিগ্রহ হত সেই সব নিয়ে ঐতিহাসিক পালা হত। ধরুন মোগল সম্রাট আকবর, এইসব নিয়েই…
আমি ঔরঙ্গজেব বলে একটা পালা দেখেছিলাম মনে আছে।
বৈদ্যনাথ শীল : হ্যাঁ তারপর শাহজাহান। বাপ্পাদিত্য। অনেক কিছু আছে।
যাত্রার বই ছাড়াও আপনারা দেখছি ধর্মীয় বই বিক্রি করেন অনেক…
বৈদ্যনাথ শীল : ধর্মীয় বই আমাদের প্রকাশনাতেই আছে। সেইগুলো রাখি। এছাড়া আমাদের স্থানীয় ক্রেতা যারা তাদের জন্য আমরা অনেক রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, ভাগবত সবই রাখি।
এগুলোর চাহিদা কমে না কখনও…
গণেশচন্দ্র শীল : এগুলো আছে বলে আমরা এখনও বেঁচে আছি।
বৈদ্যনাথ শীল : এগুলো আমাদের ব্যবসার একটা অঙ্গ।
গণেশচন্দ্র শীল : ওই বলে না, পাঁচ ফুলের সাজি নিয়ে বসলে…
বৈদ্যনাথ শীল : আমরা বারো মাসের জিনিস নিয়ে বসি যাতে খদ্দেররা দোকানে আসে বারো মাস। স্কুলের বই নিয়ে যারা বসে তাদের সিজন শুরু হওয়ার পর খালি তিন চার মাস বিক্রি, আর তা ছাড়া ইঞ্জিনিয়ারিং ডাক্তারির বইয়ের বিক্রি ভালো চলে। কিন্তু আমরা বারো মাসের বই রাখি তাই আমাদের সারা বছর ধরেই খদ্দের আসে।
আপনাদের কি নিজেদের প্রেস আছে?
গণেশচন্দ্র শীল : আগে ছিল।
লেটারপ্রেস মেশিন রাখতেন?
বৈদ্যনাথ শীল : হ্যাঁ। সেইজন্য সেগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এখন অন্য জায়গায় প্রিন্ট করাই।
গণেশচন্দ্র শীল : আগেকার দিনে যে সমস্ত বই প্রিন্ট হত, তার ধরনটা ছিল একটু অন্যরকম। [কিছু পুরনো বই রাখা ছিল, তাঁরা বার করে দেখালেন।] এখন কাগজ বা কালি, দুটোর একটার কোয়ালিটিও সেরকম নেই।
***
শেষবার দেখা করতে গিয়ে শীল মহাশয়দের কাছে জানতে চেয়েছিলাম বিনয় ঘোষের কথা তাঁদের মনে আছে কিনা, বা বইটা তাঁরা চাক্ষুষ দেখেছেন কিনা। সে কথা তাঁরা মনে করতে পারলেন না, কথা দিলাম সামনের বার বইটাই নিয়ে যাব তাঁদের জন্য। তারাপদ সাঁতরা এককালে লিখেছিলেন, এই চিৎপুর রোডেরই প্রসঙ্গে,
এ পথেই সিরাজদৌল্লার ফৌজ পৌঁছেছিল ট্যাঙ্কস স্কোয়ারে, ফোর্ট উইলিয়ামের দরজায়। এ বাহিনীকে ঠেকাবার জন্য পেরিন সাহেবের বাগানে কামান বসিয়ে ছিল ইংরেজরা। এই পেরিনের বাগান থেকেই সম্ভবত বাগবাজার। বাগবাজারের খালের ধারে ভাবছিলাম, চিৎপুর পরিক্রমা শুরু করব কোথা থেকে? খালের ওপারে কাশীপুর রোড। এ পারে আগে ছিল হ্যারিসন রোড পর্যন্ত আপার চিৎপুর রোড, পরের অংশটুকু লোয়ার চিৎপুর রোড। আজ গোটা রাস্তাটি রবীন্দ্র সরণি। এই দীর্ঘ রাস্তার দু’ধারে এখনও ছড়িয়ে রয়েছে কলকাতার স্মৃতিবৈভব। সে স্মৃতি আজ প্রায়শ জীর্ণ, ধুলিমিলন, তবু অবহেলার যোগ্য নয়, কেন না আজ নাম তার যাই হোক, চিৎপুর রোড এক আশ্চর্য স্মৃতির সরণি। এ পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে জেগে ওঠে হারানো সুতানুটি। সম্ভবত হারানো কলকাতাও।
‘স্মৃতির সরণি’ বা ‘রুইন’, তা যাই হোক না কেন, এ কথা নিঃসন্দেহে সত্যি যে চিৎপুরের অলিতে-গলিতে আজও বটতলা শুধু স্মৃতি নয়। আজকের যাত্রাপাড়ায় টেলিভিশনের চটকের সুস্পষ্ট ছাপ রইলই বা, হুতোম-খ্যাত ও অধুনা-লুপ্ত হাফ আখড়াই, ফুল আখড়াই, কবিগান বা পাঁচালির দলের স্পর্শ থেকে যায় তাঁদের গানে-গানে, আজও। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি-জড়িত ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে আজও ছেলেরা ইস্কুলে যায়, কুমোর-স্বর্ণকার-কর্মকারেরা আজও কাজ করে যান নিঃশব্দে। ছাপাকল নামক যন্ত্রদানব তার রূপ বদলিয়ে ফেললেও তার কাজের শেষ হয় না, জরাজীর্ণ প্রাচীন অট্টালিকার ছায়া ও ব্যস্ত রাজপথের গাড়ি-ঘোড়ার আওয়াজের মাঝেও (এ পথে ‘বিনা ব্যাঘাতে রাস্তায় চলা সোজা কর্ম নয়’, হুতোম তো কবেই লিখে গেছেন) ছাপাকলের ঘটাং-ঘটাং শব্দের মধ্যে বেঁচে থাকে সুপ্রাচীন গ্রন্থ-নগরী।