Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

তারান্তিনো — চার

প্রিয়ক মিত্র

 

গত সংখ্যার পর

“পুলিশ কড়া হাতে দমন করছিল মুভমেন্ট। টেররিস্টদের বাড়বাড়ন্ত খানিক কমেছিল বলে মনে হচ্ছিল। এখন যা দেখছি…”

পরেরদিন খবরটা চাউর হতে শ্যামবাজারের একটি চায়ের দোকানে এই কথোপকথনটা হচ্ছিল। সেদিনের তৃপ্তি বারের অফিসফেরতা বসেছিল দোকানের প্রান্তে। মানিকতলার আড্ডার ওপর নজর রাখছে সে, গোপনে। সকালে অফিসযাত্রী সেজে বেরিয়ে চায়ের দোকান ভাতের হোটেল বাংলার ঠেক চিড়িয়াখানা গঙ্গার ধার ইত্যাদির ফাঁকে ফাঁকে সে জোগাড় করে আনে খবর। তার আহিরীটোলার বনেদীবাড়ির স্যাঁতস্যাঁতে চিলেকোঠার খাটিয়াতে রাতে শুয়ে পরিবারের সব গঞ্জনা, সারাদিনের যাবতীয় মধ্যবিত্ত রান্নার মশলার গন্ধ, নারীর অভাব জীবনে, বিয়ে করার তাগাদা, জীবনে দুবার বেশ্যাপল্লীর স্মৃতি (একবার সফল, একবার ব্যর্থ) এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে সে ভুলে যায় যে সে রাষ্ট্রের পোষা স্নিফার ডগ। সে ভুলে যায় যে আসলে সবটাই তার ছদ্মবেশ। গন্ধ শুঁকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা চিহ্নিত করেই তার দিন গুজরান হয়। ষড়যন্ত্র আর অন্তর্ঘাত — এই তার জীবনের ধ্রুব সত্য‌।

খবরের কাগজে একবার শেষবারের মতন চোখ বুলিয়ে নিল আদি ও অকৃত্রিম খোচড়। সভ্যতার গোড়া থেকেই গুপ্তচরবৃত্তি যে জাতটার নিয়তিতে লেখা আছে, তাদের উত্তরাধিকারী সে। একটি ধূর্ত খ্যাঁকশেয়ালও নিজের জন্য শিকার ধরে। খোচড়ের সব গতিবিধি রাষ্ট্রের জন্য।

সাউথ সিঁথির ঘটনাটা সত্যি ভাবাচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শী কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। পেটোর আওয়াজ পেয়ে সবাই ঘরে সেঁধিয়ে গিয়েছিল। শুধু একজন জানিয়েছে যে রাস্তায় একটা পুলিশ জিপের আওয়াজ পাওয়া গিয়েছিল আর তিনজন সি আর পিকে ঘোরাফেরা করতে দেখা গিয়েছিল।

মানিকতলার আড্ডার সদস্যরা জড়িয়ে নেই তো এই কেলেঙ্কারিতে? আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা সব লিডারই একে একে ধরা পড়ছে। আদিনাথ এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। মানিকতলার আড্ডায় আদিনাথ যায়? ওই পাঁচজনের মধ্যে একজন কি আদিনাথ?

চিন্তিত খোচড় উঠে দাঁড়াল বেঞ্চি থেকে। বিশেষ একজনের সঙ্গে শলাপরামর্শ প্রয়োজন।

টিপটপ পুলিশের গোয়েন্দা। সে ঘোষ বা বাঁড়ুজ্জে হতে পারে, সে অমল বিমল কমল হতে পারে। বিশ্বসাহিত্য নিয়ে কফিহাউসে আড্ডা মারা, ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত থাকা, পুরনো বইয়ের জন্য হন্যে হয়ে ফেরা, পাঁড় ইস্টবেঙ্গল সমর্থক, ফ্রয়েড মার্কস কণ্ঠস্থ থাকা পাইপ টানা দীর্ঘাঙ্গী অশ্বিনী বটব্যালকে পুলিশের গোয়েন্দা বলে চিহ্নিত করবে এমন বান্দা নেই আশেপাশে। কিন্তু ধূর্ততায় তার জুড়ি মেলা ভার।

অশ্বিনী বটব্যালের সঙ্গে খোচড়ের দেখা হয়েছে বাবুঘাটে। মুড়ির ঠোঙার ভেতর ইতস্তত হাত ঘোরাতে ঘোরাতে টিপটপ অশ্বিনী চিন্তা করছিলেন কালকের সাউথ সিঁথির ঘটনার কথা। মানিকতলার আড্ডার সঙ্গে কালকের ঘটনার সম্পর্ক আছে কি আদৌ? আদিনাথ রায় কি মানিকতলার ওই বাড়িতে যায়? এসব সাতপাঁচ ভাবনার মাঝে বসন্তের হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছিল অশ্বিনীর যত্নে পাতা চুল। খোচড় নির্নিমেষ তাকিয়েছিল গঙ্গার দিকে, তার মুখের ভেতর চলছিল মুড়ি চিবোনোর নিরন্তর ব্যায়াম। আচমকা ছেদ পড়ল।

“তপন আর ওই দুই ভাই, ন্যাংটা নকশাল, এদের খুঁজে বের করা দরকার আগে।”

অশ্বিনীর ঠান্ডা গলার স্বরে নির্দেশের আভাস পেয়ে খোচড় বলল, “স্যার এরা সকলে আলাদা আলাদা ডেরায় থাকে।”

“সেগুলো কোথায়? তুমি চেনো?”

“চিনি স্যার। সবকটা ডেরাই। তবে কোথাওই খাতায় কলমে এরা থাকে না।”

“হুম। ন্যাচারালি। জায়গাগুলো কোথায়?”

“সোনাগাছির কাছে একটা মেসে থাকে তপন। ওই দুই ভাইয়ের একজন থাকে আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটা ছাপাখানার ভেতর, আর একজন শেয়ালদার পাশে একটা হোটেলের ঘরে।”

“শেয়ালদার পাশে হোটেল?” মুখচোখের চেহারা পাল্টে গেল অশ্বিনীর।

“হ্যাঁ স্যার। গোল্ডেন স্টার। হিপিদের আস্তানা।”

“মাই গুডনেস। দ্যাট মিনস আদিনাথ রায় ইজ হিয়ার। ওইই মূল চক্রী তার মানে।”

“কী করে বুঝলেন স্যার?” গোল গোল চোখ চেয়ে রইল অশ্বিনীর দিকে।

“হিপিদের আস্তানাগুলোই আদিনাথ রায়ের হাইডআউট। এটা আমি জানি।”

“স্যার, এদের ডেরা ধরে ধরে সার্চ করলে হয় না?”

“তাহলেই ওপরমহলকে ব্যাপারটা জানাতে হয়!” একটা অদ্ভুত দীর্ঘশ্বাস ভেসে উঠল অশ্বিনীর গলায়।

কী হল তার জীবনে? সে ফ্রান্সে যাবে ভেবেছিল একসময়। তার স্বপ্নের দেশ, ফ্রান্স। আলব্যের কামু, জঁ পল সার্ত্রে, জাঁ লুক গোদারের দেশ… ফ্রান্স। সিনেমায় মোড়া দেশ, ছবির মতন দেশ… ফ্রান্স।

আদিনাথ রায়। অন্তত এই একজনকে সে ঈর্ষা করেছিল তার ছাত্রজীবনে। তার যাবতীয় অহমিকা ধুলোয় মিশে গিয়েছিল আদিনাথের অগাধ পাণ্ডিত্যের সামনে। আদিনাথের মতন মানুষ সে হতে পারল না।

সিমপ্যাথি খুব বিপজ্জনক। অশ্বিনী বটব্যাল আদতে অশ্বিনী বটব্যাল নয়। অশ্বিনী বটব্যাল আদতে রাষ্ট্র। আদিনাথ রায় তার জীবনের সবচেয়ে বড় শিকার। সে এখন শিকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ।

সচকিত হয়ে গেল অশ্বিনী বটব্যাল।

“ঠান্ডা মাথায় এগোতে হবে এখন। এদের ডেরাগুলোতে সার্চ অপারেশন চালালে এরা পালাবে, বাড়িতে গিয়ে হাঙ্গামা করলে এরা খবর পাবে। খুব ধীরে চলতে হবে। তুমি এগোও। কোনও খবর হাত ফসকে যাওয়া যাবে না। সব খবর সঠিক সময় পাওয়া চাই।”

সাইকেলের চাকায় হাওয়া দেওয়ার দোকানটাতে সন্ধের পর খানিক ভিড় হালকা হয়েছে। দোকানি একটা বিড়ি ধরিয়েছে সদ্য। এমন সময় দুটো ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়াল দোরগোড়ায়।

একটু ভ্রূ কুঁচকে দুজনের দিকে চাইল দোকানি। চোখের ওপর একটা হাত ছাউনির মতন রেখে জরিপ করল ভালো করে। তারপ‍র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দোকানের পাশে একটি অন্ধকার ঘরে মিলিয়ে গেল। নীরবে তাকে অনুসরণ করল দুই ছায়ামূর্তি।

রাস্তার উল্টোপারে ঘাপটি মেরে ছিল খোচড়। অন্ধকারে জ্বলন্ত চোখ দেখে বোঝা যায় জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে আছে কোনও অজানা জানোয়ার, খোচড়ের চোখ জ্বলেও ওঠে না। ল্যাম্পপোস্টের আড়ালে সে নির্বিঘ্নে লুকিয়ে থেকে নজর রাখছে গোটা বিষয়টার ওপর।

দুটো ছায়ামূর্তি ঢুকেছিল দোকানের ভেতর, দোকান থেকে বেরিয়ে এল দুজন সশস্ত্র কনস্টেবল।

খোচড়ের চোখ স্থির। সে বিভ্রান্ত। এরা কারা? কখন উদয় হল এরা?

খোচড়ের ভাবনার মাঝে একটা বাচ্চা ছেলে আচমকা দৌড়ে এসে চেপে বসল দোকানের বাইরে রাখা একটা সাইকেলে। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে চম্পট। দোকানের দরজা দিয়ে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল দোকানি, বাঁ হাতে মুঠো করে ধরা একটা বিড়ি।

“দাঁড়াও শুয়ারের বাচ্চা! তোমার মজা আমি দেখাচ্ছি!”

দোকান হাট খোলা রেখে ছুটল দোকানি। আর এর মাঝেই দুজন কনস্টেবল হাওয়া।

শুনশান পাড়ায় এই অদ্ভুত আধিভৌতিক ঘটনাপ্রবাহ হজম করতে না পেরে খানিক থমকে গেল খোচড়। তারপর কালবিলম্ব না করে সোজা দোকানের ভেতর হাজির হল এসে।

টিমটিমে হলুদ আলো জ্বলছে একটা। অনেকগুলো সাইকেল ডাঁই করে রাখা, পাম্পিং মেশিন, এবং এ জাতীয় আর যা যা প্রয়োজন এই দোকানে থাকা। কিন্তু কোনও অস্বাভাবিক জিনিস তো…

আচমকা চোখ পড়ল কোণের ঘরের দরজায়। একটা ছোট তালা সাঁটা একটা সরু দরজা। দরজার ওপারে কী? চোরাকুঠুরি?

হঠাৎ একটা টিকটিকির জন্য আঁতকে উঠতে হল খোচড়কে। ফলে চোরাকুঠুরির দিক থেকে চোখ ঘুরল দেওয়ালের দিকে। আর তারপর দরজায় চোখ পড়তেই শিরদাঁড়ায় হিমেল স্রোত খেলে গেল খোচড়ের।

ফতুয়া আর লুঙ্গি পরা একটা সিড়িঙ্গে চেহারার লোক খুনে দৃষ্টিতে চেয়ে তার দিকে। এমন লাল টকটকে চোখ খুব কম দেখেছে সে।

গলা শুকিয়ে গেছে খোচড়ের।

ঘরে এক এক করে দুটো পা রাখল দোকানি।

মুঠোয় সাঁটা বিড়িতে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল।

তারপর ধীর গতিতে আরও দুপা এগিয়ে এল দোকানি।

খোচড় ধপ করে বসে পড়ল একটা টুলের ওপর।

খ্যাঁক খ্যাঁক করে একটা বিশ্রী হাসি হাসল দোকানি।

“সত্যেন হাজির স্যার। কী লাগবে?”

বোঝা গেল লোকটার নাম সত্যেন। গলা খাঁকারি দিয়ে খোচড় বলল, “না। তেমন কিছু না!”

“এ আবার কীরকম কথা হল স্যার, দোকানে এসেছেন, কিছু লাগবে না?”

খোচড় এই কথা বলার ভঙ্গির আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসল বক্তব্য বুঝে নিয়েছে। এটা শুধুই সাইকেলের চাকায় হাওয়া দেওয়ার দোকান নয়। অন্য কোনও ধান্দা আছে এই ব্যবসার আড়ালে।

সেটা কী তার কোনও আন্দাজ সে পাচ্ছে না এখনও।

“ইয়ে, একটু জল…”

ম্যাজিকের মতন কাজ হল এই কথায়।

“তো আগে বলবেন তো স্যার। সাদা তো?”

খোচড়ের আর বুঝতে বাকি নেই কিছু। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, “পড়েছ যবনের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে”, যবনের সাথে খানা খাওয়ায় গোলমালটা কোথায় তা ভগাই জানে। কিন্তু মোদ্দা কথা হল এখন আর ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই খোচড়ের। পকেটের ওজন বুঝে সে ধরা গলায় বলল, “সাদা!”

ঘরের এককোণে এগিয়ে গেল সত্যেন দোকানি। শুইয়ে রাখা ট্রানজিস্টার সোজা করে বসিয়ে চালাল।

“মন চলো নিজ নিকেতনে”

গান বাজছে। একটা ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে চাপা একখানা লোহার ড্রাম এবার চোখে পড়ল খোচড়ের। তার ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিল সত্যেন দোকানি।

একটা বিপদের আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠল খোচড়ের। কিন্তু লোহার ড্রামের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা বোতল।

নিশ্চিন্ত হয়েও বুকের ভেতরে ধুকপুকুনি টের পাচ্ছিল খোচড়। দোকানির হাতে টাকা ধরিয়ে সোজা ভ্যানিশ হল সে।

থানার ভেতর রেডিওতে ‘হাল ক্যায়সা হ্যায় জনাব কা’ বেজে চলেছে। টেবিলের ওপর দুটো পা তুলে বসে আছেন ওসি আশিস চাকলাদার। ডান পায়ের গোড়ালির ওপর বৃহৎ বুটসুদ্ধ বাঁ পায়ের পাতা তালে তালে নড়ছে। সামনে খালি টিফিনবক্স লুটোপুটি খাচ্ছে।

আচমকা ষাট পাওয়ারের বাল্বের আলো থরথর করে কেঁপে নিভে গেল। আশিস চাকলাদার দুটো হাত মাথার পেছনে দিয়ে চোখ বুঁজে ছিলেন, প্রচণ্ড বিরক্তিসূচক একটা শব্দ করে বললেন, “লোডশেডিং না কী!” দুটো পা নামিয়ে আনলেন টেবিল থেকে। সোজা হয়ে বসে। চেয়ারের দুটো হাতল ধরে কনস্টেবলদের উদ্দেশ্যে একটা হাঁক পাড়লেন, গান তখনও বেজে চলেছে।

কেউ এল না।

আরও বাঁজখাই গলায় আরও খানিকটা বিরক্তি যোগ করে হাঁক পাড়লেন ওসি আশিস চাকলাদার।

পেছনে দুজন কনস্টেবল এসে দাঁড়াল অন্ধকারে। আশিস চাকলাদার অন্ধকারে ভালো ঠাহর করতে না পেরে বাঁজখাই গলায় বললেন, “মোমবাতি নিয়ে আয় না শালারা, কখন থেকে ডাকছি!”

এই কথাটাই ছিল তার ইহজীবনে বলা শেষ কথা। এর প্রায় পরে পরেই একটি রুমাল তার মুখে চেপে ধরল তার বাঁদিকে দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবল। ডানদিকের জন একটা খুর নিয়ে চাকলাদারের গলার ওপর একটি গভীর সরলরেখা এঁকে দিল। চাকলাদারের মাথা টেবিলের ওপর রাখা ফাইলের ওপর ধপাস করে পড়ল। তার গলার মাঝের বিভাজিকার রক্তে ভেসে গেল ফাইল।

চাকলাদার নকশাল নিধনে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার গুরুত্ব কলকাতার পুলিশমহলে সত্যি কজন বোঝে তা নিয়ে প্রবল আক্ষেপ ছিল চাকলাদারের। আজ সেই জ্বালা জুড়োল। কয়েকজন অজানা দলছুট নকশাল তাকে তার যোগ্য সম্মানটা দিয়ে গেল। সব মরণ নয় সমান ইত্যাদি…

চাকলাদার এবং তিনজন কনস্টেবলের গলাকাটা লাশ পাওয়া গিয়েছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার থানায়। কনস্টেবলের বেশে দুজনকে থানায় ঢুকতে এবং বেরোতে দেখা গেছে সন্ধের দিকে এই খবরও নিশ্চিতভাবে জানা গেছে দুজন প্রত্যক্ষদর্শীর থেকে। খোচড়ের খবর অনুযায়ী দুয়ে দুয়ে চার করেই এগোতে হবে।

অশ্বিনী বটব্যাল, লালবাজারের আরও দুজন দুঁদে গোয়েন্দা অফিসার, কয়েকজন সাদা ঊর্দি পরেরদিন সকালে এসে দাঁড়াল সত্যেনের দোকানঘরের সামনে।

সাইকেলের চাকায় হাওয়া দেওয়ার যন্ত্রটা বগলে করে সত্যেন এসে পৌঁছল আরেকটু পরে। গলির মোড়ে দাঁড়িয়েই দোকানের সামনের জটলাটা দেখতে পেল। পুলিশ দেখে খানিক লোক জমেছে।

জটলার মুখ ফিরল তার দিকে।

দুটো রাস্তা খোলা তার সামনে। এক, দৌড়োনো। দৌড়ে সে কতদূর পালাবে! পুলিশ তাকে ধরে ফেলবেই। তার জখম পায়ের পাতা ঘুরে যাবে আর কিছুক্ষণ পর। সে মুখ থুবড়ে পড়বে পিচগলা রাস্তায়। পুলিশ তাকে মেরে ফেলবে না। তাকে থানায় নিয়ে যাবে। তার পেছনে রুল ঢোকাবে, গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেবে, বরফের চাঁইয়ের নীচে শোয়াবে। খবর বের করতে হবে, কোথায় আদিনাথ? কারা আসে তার দোকানে? এসব খবর।

সত্যেনের নিজের শরীরটা নিয়ে একসময় মায়া ছিল। সে একবার হাত বুলোল তার পেছনে।

পুলিশ ছুটে এল তার সামনে। পেছন পেছন বাদবাকিরা।

একদম সামনে যে সাদা উর্দি কনস্টেবল এসে পৌঁছোল, তার পেটে সত্যেনের গেঁজেতে লুকিয়ে থাকা ছুরিটা ঢুকে গেল সোজা। ঝুঁকে পড়ল সাদা উর্দি।

সাদার ওপর লাল রং দেখতে সবসময়ই ভালো লাগে। তাই হয়তো জটলা সামান্য সময় মুগ্ধ হয়ে রইল কনস্টেবলের সাদা জামায় ঢাকা পেটের মাঝখানে লাল গোলাকৃতি রংটার দিকে তাকিয়ে।

এরপর আরেকজন সাদা উর্দি সচেতন হল, তার বেয়নেট সত্যেনের কাঁধে খোঁচা মারল সজোরে। সত্যেনের আকাশি রঙের ফতুয়াতে লাল রংটা তেমন জুতসই লাগল না কারও।

সত্যেনকে পাকড়াও করা হল।

একটা বাল্ব জ্বলছে মাথার ওপর। এখনও কিছুই শুরু হয়নি। শুধু খানকয়েক রুলের ঘা পড়েছে শিরদাঁড়া বরাবর। আসল খেলা যে এখনও শুরু হয়নি তা সত্যেন জানে ভালোভাবে।

সামনে এসে দাঁড়াল সাদা উর্দি। আর ঠিক তার পাশেই একটা টুল টেনে নিয়ে দু পা ফাঁক করে বসলেন অশ্বিনী বটব্যাল।

টিকটিকির টিক টিকে কান পেতে ছিল সত্যেন। একমনে। এইসময় সামনের মোটা কালো বিঘত সাইজের টিকটিকির মতন দেখতে সাদা উর্দি কর্কশ গলায় বলে উঠল,

“সালা চুল্লুও বেচিস, আবার মাওয়ের বাচ্চাদেরও পুষিস! এলেম আছে মাইরি তোর!”

সত্যেন এক দৃষ্টিতে তাকাল সাদা উর্দির টিকটিকির দিকে। পাশে একটা উর্দি ছাড়া টিকটিকি বসে। সে অদ্ভুত শান্ত চোখে তাকিয়ে সত্যেনের দিকে।

“ওই মালটা খোচড় ছিল সেটা তখনই বুঝে নিতে হত। ওখানেই খালাস করে দিতে হত শুয়ারকে!”

“চোপ বাঞ্চত!” ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় গর্জন করে উঠল সাদা উর্দি।

“আপনাদের ওপর কালীর অভিশাপ পড়বে! কোনও শুয়ারের বাচ্চা বেঁচেবর্তে থাকবে না!”

হো হো করে হেসে উঠলেন অশ্বিনী বটব্যাল। “আবার কালী! জব্বর জিনিস তো বাপ তুমি!”

“আপনারা সব খরচের খাতায়!” সত্যেন একমনে বলেই চলল।

“তবে রে চুল্লুখোর!” সাদা উর্দি লাঠির এক ঘা বসাল সত্যেনের গোড়ালিতে। কঁকিয়ে উঠল সত্যেন।

“এই চুতিয়া, বল কারা আসে তোর দোকানে সন্ধেবেলা? পুলিশের উর্দি, আর্মস এসব কাদের জন্য রাখা?”

সত্যেন সাদা উর্দির কথার উত্তরে বিচ্ছিরিভাবে হেসে উঠল। সাদা উর্দি দিশেহারা রকমের রেগে গিয়ে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় আবার বলে উঠল, “বলবি কি বলবি না বাঞ্চত?”

“আপনার স্টকে আর খিস্তি নেই?”

সাদা উর্দি রাগে ফোঁসফোঁস করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। অশ্বিনী বটব্যাল থামাল তাকে।

অশ্বিনী বটব্যাল এবারে একটা দোমড়ানো সিগারেট বার করল কানের পাশ থেকে। দুবার ফুঁ দিল তার সামনে পেছনে। তারপর ফস করে দেশলাই জ্বলল। সিগারেট জ্বলে উঠল অশ্বিনী বটব্যালের ঠোঁটে।

সত্যেন জানে এবার এই জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা লাগবে তার বুকে। তার বুকে দগদগে ফোসকা পড়বে।

সত্যেন বেইমানি কখনও করেনি এমন নয়, কিন্তু নেমকহারামি তার ধাতে নেই। আদিনাথ এবং আদিনাথের পরিবারের নুন সে বহুদিন ধরে খেয়ে আসছে।

নিজের পঁয়তাল্লিশ বছরের শরীরটাকে খানিক প্রস্তুত করে নিল সত্যেন। খেলা এবার শুরু হবে।

আবার আগামী সংখ্যায়