বেবী সাউ
মানুষের যদি কোথাও অবিচ্ছেদ্য টান থেকে থাকে, সারাজীবন তার স্মৃতি বহন করে বেড়ায়, তা হচ্ছে তার ছোটবেলা — শৈশব। শৈশবের অনুভূতি, অনুভব সারাটা জীবন সযত্নে লালন করে তারা। ঠিক এরকমভাবেই গ্রাম্য জীবনধারার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে লোকসংস্কৃতির অবিচ্ছিন্ন ধারাটিও। গ্রাম্য জীবনে মায়ের সমান মর্যাদা পায় এইসব লোকগান, রীতি-রেওয়াজ, অনুভূতি, আবেগ। গ্রামের মানুষেরা সম্পূর্ণভাবে এইসব লোকসংস্কৃতির বিষয়গুলিকে তাদের জীবনধারার সঙ্গে মিলিত করে নেন। তাই বাংলার গ্রামগুলিতে এখনও রাতের অন্ধকারে বেজে ওঠে মরমিয়া বাঁশি — ঝুমুর গান; কখনও বা ব্রত পালনের সুর, আবার লোকরীতি অনুযায়ী বিভিন্ন নীতি-নিয়ম। কিন্তু দেখা গেছে এইসব বিষয়গুলির কাঠামো ভিন্ন ভিন্ন হলেও, কোথাও যেন একটা বিরাট মেলবন্ধন ঘটেছে তাদের মধ্যে। একাত্ম হয়ে গেছে। আর এই একাত্মবোধটিকে মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় — আবেগ শুধু আবেগ। আর বলাই বাহুল্য আবেগময়তা হল লোকসংস্কৃতির অন্যতম রূপ। লাল মোরামের রাস্তা পেরিয়ে, শাল পিয়াল ভেঙে কিছু লোকায়ত জীবন, কথার সঙ্গে মিলেমিশে গেছে যেন। উন্মুক্ত প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মবোধ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে গানগুলির মধ্যে। এখানে ঘুম ভাঙা ভোরের ভৈঁরো পাখির ডাক, মোরগের আহ্বান; সন্ধের ইমন হচ্ছে তুলসী তলার মঞ্চ, শাঁখের আওয়াজ। নেটওয়ার্কবিহীন জীবনে ঢুকে আছে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক, শেয়ালের হুক্কা-হুয়া। এখনও কী অদ্ভুত এইসব লোকায়ত জীবন! কী শান্ত! কী অপূর্ব সহজ সরল মানুষের জীবনধারা! এই গ্রাম্যধারার পরতে পরতে রহস্য, রোমাঞ্চ। পরতে পরতে প্রকৃতির সঙ্গে নিবিষ্ট করার আকুতি। এদের নাচের তালে সঙ্ঘবদ্ধ ঘুঙুরের শব্দ, গানে কীর্তনের কোরাস। আলপথের বাঁকা পথে হেঁটে যাওয়া নিজস্ব ভঙ্গিতে বাউল। কাজের মাঝে পরিশ্রম লঘু করার উপায়ও গান। তৃষ্ণায় মাথুর পালা। ভাটিয়ালি, ভাওয়া, ঝুমুর, কীর্তন বব ডিলানকেও হার মানাতে পারে। করম পরবের নাচ মাইকেল জ্যাকসনের আধুনিকতাকে ভাঙতে পারে। আমরা যারা একটা শহরকে দেখে যাচাই করি গ্রাম-বাংলাকে, ভাবি বাংলার আসল রূপ, তারা জানিও না কী অপার আনন্দ সৌন্দর্য বয়ে বেড়াচ্ছে গ্রাম্যজীবনের সবুজ ধানক্ষেত। শীতের সকাল। এঁদের ভাষায় সহজ অথচ কঠিন শব্দচয়ন মনে করায় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। শব্দ ব্যবহারে টান নিজস্ব অথচ কত আপনত্ব রিদমে মোড়া। স্কুলের সিলেবাসে হিন্দি বাংলা ইংরেজি শিখলেও নিজস্ব ভাষাতে কথা বলতে বেশি স্বচ্ছন্দ। ক্রিয়াকলাপের ভঙ্গি নিজস্ব। বিবাহ বন্ধন বলো কিংবা শোক উদ্যাপন। দেবতার মন্দিরগুলো দেখলে আরও চমকে উঠতে হয়। বিশ্বাস আর আত্মসমর্পণে মোড়া গ্রাম্য দেবতার চাতাল, স্থাপত্য। নিষ্পাপ হৃদয়ে নিজেকে দেবতার কাছে উজাড় করে দেওয়া। সন্তানের ‘দুধভাতের’ চিন্তাতে অসহায় গ্রাম্যবধূর মাতৃহৃদয় — শেষ সহায় রূপে আকুতি জানায় দেবতার কাছে। মানতে যেমন লাল ধাগা বাঁধার প্রচলন আছে তেমনি আছে বলিপ্রথা। পায়রা, মুরগি, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি। শিউরে ওঠার, প্রতিবাদ হয় এইসব প্রথার; কিন্তু যখন আমরা নিজেরা হাজার হাজার পশুপাখি হত্যা করে চলেছি মাংসের লোভে, তখন! ভারসাম্য! কিন্তু তারা গৃহপালিত পশুপাখিকেও সন্তানস্নেহে পালন করেন। গৃহপালিত পশুটিও তাদের পরিবারের একজন যেন। কিন্তু আজ বিশ্বায়নের করাঘাতে এইসব গ্রামগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। কীর্তনে ঢুকে পড়েছে রমরমা হিন্দিগানের সুর। ভাটিয়ালিতে দেবের ‘খোকাবাবু যায় লাল জুতো পায়…’। সন্ধেবেলা এখন আর উঠোনে বসে না রূপকথার রোমাঞ্চ। তার বদলে স্টার জলসা, জি-বাংলার নায়িকারা পেতে বসেছেন তাদের অত্যাধুনিক সংসারের নগ্নরূপ। ‘কাঁদনাগীত’ ‘বিবাহগীত’ হারিয়ে যাচ্ছে ঠাকুমার মৃত্যুর সাথে সাথে। বাঁশির সুর ভেঙে তৈরি হচ্ছে শহর থেকে আগত গায়িকার বেসুরো ব্যান্ড সং। বাংলার শিল্পক্ষেত্র, নিজস্ব সংস্কৃতি অনেকদিন থেকেই ভাঙছে, বিংশ শতাব্দী থেকে। ব্রিটিশ আমল থেকে; হারাচ্ছে নিজস্ব সম্পদ। খেজুর পাতার চাটাইয়ের বদলে আদিবাসী রমণীর পছন্দ এখন শহরের প্লাস্টিকের মাদুর। তাঁতেবোনা শাড়ির জায়গায় ফিনফিনে শিফন। উন্নয়নের নাম করে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে শহরের জারিত বিষ। সরল সহজ জীবনযাপনকে অন্ধকার ভেবে, জ্ঞানের আলো জ্বালার নাম করে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর আগ্রাসন নীতি। একটা শহর যা ভাবছে, সেটাই কী একমাত্র সত্য জ্ঞান! প্রকৃত সংস্কার! ভারতের নিজস্ব আঙ্গিক, পরিকাঠামো ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে দেওয়া হচ্ছে স্মার্টফোনের লোভ। ভয় হয়। ফেলে আসা শৈশবের সেই গ্রামে যখন ফিরি দেখি তার পরিবর্তন। মৃত লাগে। জীবাশ্ম যেন। হয়ত আর কিছুদিন পর গ্রাম বাংলাকে দেখতে চাইলে ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রটাই একমাত্র রেফারেন্স হয়ে দাঁড়াবে। আর কিছু না।
তেমনভাবে গ্রামে যাদের শৈশব কেটেছে কিংবা কোনও কর্মসূত্রে গ্রামে থেকেছেন, কাটিয়েছেন কিছুটা সময় তাদের মধ্যেও গ্রামের প্রতি একটা ভালোবাসার, আত্মীয়তার সূত্রপাত হয়। ভালোবাসার টানে বারবার ছুটে ছুটে যান। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের গ্রামগুলির মধ্যে এই টানটা অনুভব করা যায়। শাল সেগুনের জঙ্গলে মধ্যে অনুভব করা যায় রহস্য রোমাঞ্চ। ভালোবাসা, আবেগের সম্পর্কটিকে। এই অঞ্চলের একটা নিজস্ব লোকসাহিত্য আছে। এই সাহিত্যের চরিত্র দেখে মনে হয় যে এই সৃষ্টিগুলি সমাজের সচেতন মনের অবদান নয় বরং বহুদর্শী মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টি। তাতে যেমন দেখা যায় সাহিত্যের বিভিন্ন রসের সমাহার তেমনি উপভোগ্যতাও। আছে ঝুমুরের ঘুঙুর নিক্কন, করম ঠাকুরের জন্য নাচ এবং গানের সুরের আবহ। আবার বিষাদ দুঃখ কষ্ট জড়িত কাঁদনাগীতের হৃদয় বিদারক সুর। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের লোকজীবনের অভিন্ন অঙ্গ হচ্ছে এখানকার রুক্ষ শুষ্ক মালভূমির এলাকার দুঃখ কষ্ট। তাদের নিত্যদিনের জীবনে লেগে আছে দুঃখ কষ্ট দৈন্য দারিদ্র্য হাহাকার লাঞ্ছনার ইতিহাস।
আর এইসব দুঃখ কষ্ট বিরহ লাঞ্ছনা শোক অপমানগুলিকে লোকায়ত মানুষজন তাদের আত্মীয়দের সঙ্গে ভাগ করে নেন — নিতে চান। তাদের কোনও অন্য মাধ্যম না থাকায় সুরের সাহায্যে গুনগুন করে তাদের কষ্টটিকে ব্যাখ্যা, বর্ণনা করেন। মনের ভেতরের দুঃখ কষ্ট বঞ্চনাগুলি বেরিয়ে আসে কথার মাধ্যমে, সুর সংযোগে।
এইসব দুঃখ কষ্টের বর্ণিত গানগুলি হচ্ছে কাঁদনাগীতি। কেঁদে কেঁদে কান্নার কারণ বর্ণনা করে গাওয়া। লোকায়ত মানুষের সহজ-সরল জীবনযাত্রার দুঃখ-বিরহের প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে মিলিত হয়েছে এক ভাবঘন নিবিড় উপলব্ধি যা গানগুলির কথায় ও সুরে প্রকাশিত হয়েছে। অন্য এক মাত্রা সংযোজিত হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, ক্ষেত্রবিশেষে গানগুলির text পাল্টে যাচ্ছে। যখন শোকপ্রকাশ করা হচ্ছে, মৃত ব্যক্তির অতীতটিকে তুলে আনা হচ্ছে। আবার কন্যা বিদায় নেওয়ার সময় তার পাঠ আলাদা। তখন মেয়েটির এতদিন বাপের বাড়িতে কাটানো সুখের মুহূর্তগুলি বর্ণনা করা হচ্ছে। আবার নির্যাতন বর্ণনাকালে তা অন্যভাবে প্রকাশিত। রাগ দুঃখ অভিমানের সুর আলাদা।
গানগুলির ভাষাতাত্ত্বিক পাঠ (language text) অনেকটা ছাঁচবদ্ধ। এই কাঁদনাগীত গেয়েই পাত্রীকে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় বাপের বাড়ি থেকে বিদায় নিতে হয়। আবার কেউ মারা গেলে তাকেও গানের মাধ্যমে কেঁদে কেঁদে বিদায় জানাতে হয়। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, বিশ্বায়নের প্রভাবে পাত্রী অনেকসময় এই গান গাইতে অস্বীকার করলে পরিবারের অন্যান্য আত্মীয়স্বজনেরা এই গান গেয়ে পারিবারিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করেন। সুতীক্ষ্ণ কান্নার সুর ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের পথেঘাটে, প্রান্তরে। গাছপাতা পশুপাখিও বিরহে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। গুনগুন সুরের মাধ্যমে কান্নার কারণ বর্ণনা, তার শোক কেন বাধা মানছে না আসন্ন বিরহকে কল্পনা করে, গায়ক তার নিজের ভাষায় বিলম্বিত সুরে কান্নার মাধ্যমে তা প্রকাশ করেন। ছাঁচবদ্ধ সুরে বলে যান শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন; বিরহ; এবং শোকাহত জীবনের নিষ্করুণ আলেখ্য।
শোকপ্রকাশক গানগুলি অন্য একটা মাত্রা দাবি করে। সাধারণত শোকপ্রকাশকালে, অর্থাৎ কোনও ব্যক্তির মৃত্যুতে এইসব গানগুলি গেয়ে গেয়ে মৃতব্যক্তির আপনজনেরা কাঁদেন। অনুভব করেন মৃত ব্যক্তিটির পূর্ব স্মৃতি। রাজস্থানের ‘রুদালি’ জাতি যেভাবে শোকপ্রকাশ করে তা থেকে এ সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাঁদনাগীতিগুলি লোকায়ত জীবনের নিজস্ব রচিত। তাৎক্ষণিকভাবে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনেরা নিজস্ব সুরে, কথায় এসব গান গেয়ে চলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অবশেষে কিছুটা শোক প্রশমিত হলে তারা মৃতদেহের সৎকারের অন্যান্য উপাচার জোগাড় করেন। আবার দেখা যায়, মৃত ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে উঠে আসছে আরও অনেক মৃত পূর্বপুরুষদের কথা। এ পর্যন্ত সমস্ত ঘটে যাওয়া শোক যেন একত্রিত হয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলছে।
সুতীক্ষ্ণ কান্নার সুর শোকাহত মহিলার কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হয়ে নিথর পরিবেশকে খান খান করে দেয় — হৃদয়কে বিদ্ধ করে। কেন তার শোক বাধা মানছে না — কতটা পরিমাণ দুঃখে আক্রান্ত হচ্ছে তার হৃদয়, তা ফুটিয়ে কান্নার মধ্যে গায়ক নিজের ভাষায় সাজিয়ে টেনে টেনে সুরে গেয়ে যান। সুর্বণরৈখিক ভাষায় এমনই একটি গান —
একি থিলা মোর কপালে গো
একি থিলা মোর কপালে
মোকে ছাড়ি তুমহি চালি গেল কঁঠে
তুমি বলিথিল, মোকে নেই যাব….
শব্দার্থ:
থিলা -- ছিল; তুমহি -- তুমি; চালি -- চলে; কঁঠে -- কোথায়; বলিথিল -- বলেছিলে; নেই -- নিয়ে; যাব -- যাবে।
সদ্য স্বামীকে হারানো যুবতী নারীর কান্না এটি। স্বামী মারা যাওয়ার পর সে দিশেহারা হয়ে পড়ছে। চারপাশে অন্ধকার দেখছে। কীভাবে সামলাবে তার এই বিপদ। তাই তার স্বামীকে দোষারোপ করে বলছে, একবারও তুমি আমার কথা ভাবলে না। চলে গেলে।
চোখের জল বাঁধ মানেনি। গানগুলি শুনলে বোঝা যায় ব্যক্তিটির যাবতীয় পরিচয়। সন্তানের প্রতি তার স্নেহ কেমন ছিল, কেমন ছিল তার দাম্পত্য কিংবা তার দুঃখকষ্টময় জীবনযাত্রা। ডাক্তার দেখাতে না পারার খেদ, অভাব-দারিদ্র একটা মানুষকে কেমন কালরোগে টেনে নিয়ে গেছে তার ব্যাখ্যান। গানের কথাগুলি শুনতে শুনতে নিজে আমিও হয়ে উঠেছিলাম তাদের একজন। একবিংশ শতাব্দীও লজ্জায় চুপ ছিল সেদিন।
গানগুলি রচনায় অভিনবত্ব লক্ষ করা যায়। মা বাবা দাদা বৌদি আত্মীয়স্বজন — কার কাছে কী বলে কাঁদা হবে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কিছু পাঠ্য বা text আছে। যেহেতু গানগুলি তাৎক্ষণিক রচনা, চোখের সামনের দৃশ্যগুলিই গানের রূপ পাচ্ছে। কিন্তু তাও কীভাবে কখন কার কাছে কোন গানটি গাওয়া হবে তার কিছু নিজস্ব নিয়ম আছে। মায়ের কাছে নিজের সবকিছু উজাড় করে বলা যায়, আবার দাদা বৌদির কাছে আলাদা কিছু। কাকিমার কাছে গাওয়া এরকম একটা গান —
উঠিলা সুয়ারি বসিলা নাই কাকীগো
ঘুরি চাহিবাকু দিশিলা নাই কাকীগো
গাড়িয়া ভিতরে নাড়িয়া গাছ কাকীগো
নাড়িয়া ধরিছে গুটি পঞ্চাশ কাকীগো
এঠে খাইথাঙ গটা নাড়িয়া কাকীগো
সেঠে কী খাইমু বাঁটা নাড়িয়া কাকীগো
কাঁদনাগীতি-গুলো সাধারণত নারীসমাজেই প্রচলিত। মেয়েরাই এর রচয়িতা, গায়িকা। ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের দুঃখকষ্টের নির্মম বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য মৌখিক ধারায় এই গানগুলির প্রকাশ। এইসব মানুষদের কাছে পেয়েছি অন্তরের বোধ; অসীম আত্মীয়তা। অতিথিদের এরা দেবতা ভাবেন। গানগুলির ভাষা স্থান অনুযায়ী পাল্টে যেতে থাকে। ওড়িশাতে ওড়িয়া ভাষার টান বেশি, ঝাড়খণ্ডে তেমন হিন্দি আবার বাংলাতে বাংলা ভাষার।
কাঁদনাগীতি হল মেয়েলি সঙ্গীত এবং গানগুলি সম্পূর্ণভাবে ধর্মীয় সংস্রবহীন। কোনও রাজনৈতিক তথ্য, কোনও জাতপাত বর্ণবৈষম্য কিংবা কোনও ধর্মসংক্রান্ত তথ্য ধর্মাচরণ গানগুলিতে সম্পূর্ণভাবে অদৃশ্য। প্রধানত প্রিয় স্বজনের মৃত্যুশোকে পরমাত্মীয়া মহিলারা এই ধরনের গান গেয়ে দুঃখ শোক প্রকাশ করে থাকেন এবং বিবাহের শেষে আত্মজা কন্যা পিতৃগৃহ ছেড়ে শ্বশুরালয়ে যাবার সময় পালাক্রমে কন্যা এবং কন্যার মাতা ও স্বজনেরা কাঁদনাগান গেয়ে থাকেন। শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন, কষ্ট সহ্য করতে না পেরে নির্যাতিতা মেয়েটি তার মায়ের কাছে প্রকাশ করে তার জীবনের দুর্বিষহ ছবিটি —
নদী ধারে ধারে পাকা পনস মাগো
মোর শাশুঘরে কালা বংশ মাগো
কুটাই খাইবে মোর মাংস মাগো
সিজাই খাইবে মোর মাংস মাগো
শব্দার্থ:
পনস – কাঁঠাল; শাশুঘরে -- শ্বশুরবাড়িতে; কুটাই খাইবে -- কেটে খাবে; সিজাই খাইবে -- সেদ্ধ করে খাবে।
নারী নির্যাতনের ছবিটি বেশ সুস্পষ্ট এই গানটিতে। কীভাবে একটা নারীকে প্রতিনিয়ত কষ্ট-অত্যাচার-ভয় সহ্য করতে হয়, কীভাবে তার জীবনটি অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে শ্বশুরবাড়িতে — গানটিতে তাই প্রকাশ পেয়েছে।
বর্তমান সময়ে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন, সংস্কৃতির বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে লোকউত্সবের রূপ পরিবর্তন হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কিছু সমস্যার কারণে এইসব লোকগান, কাঁদনাগীতি আজ লুপ্ত হয়ে যেতে বসেছে। ব্যক্তিগত ক্ষেত্র সমীক্ষা করতে গিয়ে দেখেছি; গানগুলি খুবই কম সংখ্যক মহিলার মধ্যে বেঁচে আছে। যাদের বয়েস ৪০ থেকে ৭০-এর মধ্যে। আজকালকার জেনারেশন এই গানগুলি সম্পর্কে মোটেও উৎসাহী নয়। পারিবারিক ধারাটিকেও অস্বীকার করছে তারা। একটি কাঁদনাগীতি দিয়ে আপাতত এই আলোচনা শেষ করি। যদিও সংগ্রাহক হিসেবে বলি, প্রায় ১০০টির কাছাকাছি কাঁদনাগীতি সংগ্রহ করেছি এবং সেগুলি এখন সংরক্ষণের চেষ্টা চলছে।
ক্ষেত্র সমীক্ষা করতে গিয়ে বুঝেছি, “কাঁদনাগীতি” একটা স্বতন্ত্র আবেদন। সম্পূর্ণভাবে জীবনাশ্রয়ী এই গানগুলিতে নারী সমাজের নির্যাতিত করুণ অবস্থানটি ফুটে উঠেছে। কাঁদনাগীতি-গুলির গহন-গহ্বরে ঢুঁ দিলে দেখা যাবে নারীদের প্রেম, যন্ত্রণা, হাহাকার, বিরহ, অভিযোগ, মান-অভিমান, আর্ত-বিরহ, বেদনাভর্তি হৃদয়ের কথা বড় হয়ে উঠেছে। গানগুলির নিজস্ব কিছু টেক্সট আছে। গানগুলি দুঃখের অস্থিস্বরূপ। কিন্তু নগরায়ন, বিশ্বায়নের ফলে গানগুলি আজ বিলুপ্তির পথে। নতুন প্রজন্মের নারীরা পরিবর্তনের ধারায় সংস্কৃতির কিছুটা গ্রহণ করলেও এই গানগুলি আজ বিলুপ্তির পথে।
জীবনভাবনা অর্থাৎ জীবনচেতনার মর্মমূলে এই কাঁদনাগীতি-গুলির সৃষ্টি হয়েছে। গানগুলির মূল্য অপরিসীম। এই গানগুলি নিয়ে নতুন প্রজন্ম, লোক-সংস্কৃতির গবেষকদের এগিয়ে আসা উচিত। এগিয়ে আসা উচিত সরকারেরও। কল্যাণময়ী গ্রামের লাল ধুলোয় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যেন দুঃখের ভগ্নাংশগুলি।
মা’র কাছে বলবি দাদা ভালো সুখে আছি
ঝিঙা ফুল ফুটলে দাদা দাঁতুন করতে বসি
কাঁকুড়ফুল ফুটলে দাদা ভাত খাইতে বসি
মা’র কাছে বলবি দাদা ভালো সুখে আছি…
মুখে মুখে তাৎক্ষণিক রচনা এই কাঁদনাগীতি-গুলি সংগ্রহ করা একান্ত প্রয়োজন কেননা, এই গানগুলিতে দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলার লোকায়ত সমাজের জীবনালেখ্য উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে; সংস্কৃতি, জীবনবোধের সঠিক চিত্রটি অনুধাবন করা যায় সহজেই। তাছাড়া, ফিল্ম সংস্কৃতি এই লোকসংস্কৃতিকে গ্রাস করছে সহজেই। সবার আন্তরিক উদ্যোগে, নিরপেক্ষ সহযোগিতায় এই সংরক্ষণ সম্ভব হতে পারে। নিজস্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে সজাগ হলেই এই অবক্ষয় রোধ সম্ভব হবে। নিজস্ব জীবনভাবনা, জীবনচেতনার মর্মমূলে এই গানগুলির সৃষ্টি। সচেতন হলে আমরা আরও কয়েক শতক এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে পারব।