রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়
জ্ঞান শান্তিতে মন্দিরে বাস করে — জ্ঞানমন্দির। তাকে উৎখাত না-হয় নাই করতে পারল, অন্য স্থানে, অন্যকোথাও জ্ঞানগম্যির কথা যে হত না এমন তো নয়। ‘আড্ডা’ বললে ঠিক বোঝা যাবে না, এজন্য যে ‘আড্ডা’ এই বর্গটিও আত্মসাৎ করতে সক্ষম মন্দিরের পুরুতরা। চায়ের দোকান, ক্যান্টিন, কফি হাউস, রোয়াক স্থান যাই হোক না কেন, একটি শব্দ চলনশীল থেকে সব্বাইকে, সব জায়গাতেই ছুঁয়ে দিতে পারে।
শব্দটি হল ঠেক।
এর সঙ্গে ঠেকায় পড়ার (এই মুহূর্তে যে-দশা বর্তমান লেখকের) কি কোনো যোগ আছে? ঠেকা, ঠেকে যাওয়া এক সাময়িক বিপদ, বা বলা ভালো সমস্যা। ঠেক কি এমন কিছু করে, করতে চায় যাতে ভারসাম্যে চোট লাগে। আমরা ঠেকায় পড়ে যাই। বা, এদিক-ওদিক হাতড়ে একটা কোনও সমস্যা-প্রশ্ন নির্মাণ তার লক্ষ্য কি? আমি যা-যা ভাবছি, সেইসব ভাবনাকে দিব্যি ভেংচি কেটে এক যৎসামান্যকে মহান করে তুলতে পারে ঠেক। যেমন সে পারে অবলীলায় রাজা-উজির বধ করতে। পারে ফকিরের মাথায় ফুলের মুকুট পরাতে। এই সমস্ত কাজই বাক তথা শ্বাস নির্ভর বলে আছে এক আনন্দময় শ্রম। শ্রমের শরীর যা সর্পাঘাতে মারা গেলে বেহুলা-মান্দাস জোটাও অসম্ভব কিছু নয়।
ঠেক সংস্কৃতি সম্পর্কে যাঁরা নির্জ্ঞান, যাঁরা মনে করেন তাঁদের কথা অমৃত সমান, অধিকারী-অনধিকারী ভেদ সম্পর্কে যাঁরা অতিমাত্রায় সজাগ এবং এমন এক প্রবল ভাঙনের সময়েও ওই ভেদ-দুর্গ রক্ষায় নিবেদিত প্রাণ — খুব সম্ভবত আমি ওই গোত্রভুক্ত নই বলেই ঠেকবাজরা ধরে নিয়েছেন এবং আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ঠেক গরম করার জন্য। এঁদের জ্ঞাতার্থে একটি ছোট আত্ম-নিবেদন: আমি ভাই কেবলই আমার ‘অস্মিতা’ হারাইতেছি, এবং লক্ষ করিতেছি বারংবার যে — মোক্ষণ তাহা মহৎ কিছু নয়, তাহা অপেক্ষা সর্প-আচ্ছাদন (পড়ুন সাপের খোলস) যথেষ্ট মূল্যবান।
আমাদের প্রতিবেশী এই জীবটি সম্পর্কে পুরাণ-যুগ থেকেই কত কথার চল। সর্পযজ্ঞের নৃশংসতার কথাই-বা ভুলি কেমনে।
বেশি হ্যাজানো উচিত হয় না, যেজন্য হিংস্র, কোপন-স্বভাব ও আস্তিনের সাপ থেকে আমরা এক্ষুণি দূরে চলে যাব। ক্ষমতাকাল ও আমাদের (মানুষের) সৌন্দর্যবোধ মিলে যেসব জীবের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি আছে, হয় তারা বাঘ-সিংহ ও অতিকায় প্রাণী, নতুবা বিচিত্র স্বর, আকার ও বর্ণবৈচিত্রের পাখির দল। সাপই বলুন, আর শকুন, বা ছুঁচো-টুঁচোর নাম শুনলেই গা ঘিন ঘিন করে।
একবার। জীবনে মাত্র একবারই আমি একটি সাপের করুণ, ক্ষমাপ্রার্থীরূপ দেখে ফেলি। তা ছিল প্রায় একটা পারফরম্যান্স, যেন-বা নাটকের একটি দৃশ্য। ঠেকবন্ধুরা ভুলেও ভাববেন না এতে কল্পনার কোনও স্থান আছে। এবং মনে রাখবেন, হুবহু এই দৃশ্য, এই ঘটনা আপনারা যে-কেউ যদি না দেখে থাকেন, ভবিষ্যতে দেখলেও দেখতে পারেন। সম্ভাবনা একটু কমের দিকেই যদিও। কেননা, উন্নয়ন। কেননা, জলাজমির বিনাশ। কেননা, শহরে একটি লম্বা দাঁড়াশ সাপ এখন দেখতে পাওয়া অসম্ভব। অসম্ভব হয়ে উঠছে এক ঝাঁক শালিকের দেখা পাওয়াও।
ঘটনা এই রকম। কয়েকটি শালিক পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে। চেঁচানোটা হিংস্র, ঝগড়ুটে। সেই চিৎকার অনুসরণ করে তাকাতেই দেখি প্রায় পাঁচ-ছ হাত লম্বা মোটাসোটা একটা দাঁড়াশ সাপ পালিয়ে বাঁচতে চাইছে আর শালিকের দল তেড়ে আসছে, ঠুকরে দিচ্ছে। স্বল্প বিষ সম্বল দাঁড়াশ হাজার চেষ্টা করেও পালাতে পারছে না।
এই ঘটনা এন্টালি পদ্মপুকুর লাগোয়া একটি ফুটবল মাঠে। সেখানে একটা বটগাছও ছিল। আশা করি বলে দিতে হবে না যে, এই বটগাছে শালিকের বাসা ছিল এবং এই দাঁড়াশটিই সেখানে প্রথম হামলা চালায়, একটা শালিক ছানাকে আক্রমণ করাতেই এই যুদ্ধের সূচনা।
লড়াই ক্ষেত্রটি ঘিরে মানুষের একটা জটলা। এই জটলায় সাপ বা শালিক কারও প্রতিই পক্ষপাত নেই। তাদের চোখে রাক্ষুসে খিদে। তাদের চোখে কুরুক্ষেত্র-র যুদ্ধ দেখার বাসনা। তারা যেন এমন একটি হিংসাত্মক ঘটনার মধ্যে শিল্পের সৌন্দর্য খুঁজে পাচ্ছে, খুঁজে পাচ্ছে ভারত-পাক ক্রিকেটের জাতীয়তাবাদী, রাষ্ট্রবাদী এক যুদ্ধ।
যুদ্ধের বিবরণ, শালিকের হানা, সাপটির বাঁচার চেষ্টা বহুতর নৈতিকতার সওয়াল খাড়া করতে পারে, আবার সমস্ত নৈতিকতার পরত একের পর এক খুলে খসে পড়ছে তা-ও দেখি।
আমাদের গ্রামদেশে সাপ-শালিক লড়াই অব্যাহত। কে কার ডেরায় গিয়ে কার বাচ্চা সাবাড় করেছে বা করছে সেই গপ্প এক নয়, সেই গপ্পে কেউ দোষী নয়, কেউ নয় নির্দোষ। যে-আমরা গ্যালারিতে বসে এই নিষ্করুণ দৃশ্য উপভোগ/মন্তব্য/ধিক্কারে সাজাই সেই আমরাই কি বহন করি না হিংসা-অনল? আমরা সাপ না শালিক? দৈনন্দিন শূন্য, একঘেঁয়ে, জীবন তদ্রূপ-ই। এই জীবন থেকে যা চুঁইয়ে পড়তে পারে — শুধু ভয়, ভয়ের আশঙ্কা ও আয়োজন। শরীর তা যারই হোক, চাষার, সাপের বা শালিকের, তা কি শত্রু নয়, তাকেই কি শত্রু ঠাওরাই না? এবং বধ্য, কদর্য শরীরে সুন্দরতম আত্মার সন্ধান সর্পগতিতে সাহায্য করে, পালাই। যে, যেভাবে পারো পালাও।
[ঠেক পত্রিকার সেপ্টেম্বর, ২০১১, প্রাক্-শারদীয়া সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত।]