Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বিষমুক্ত খাবার অর্জনের যুদ্ধে সৈনিক ভৈরব-দের কথা, একটি রিপোর্ট

শুভাশিস মৈত্র

 

ভৈরব সাইনির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল কলকাতায় গড়িয়াহাটের কাছে বঙ্গদর্শন ডট কমের অফিসে। এক দুপুরে প্রচণ্ড ঘেমে টেমে ভৈরব আর ওর এক বন্ধু এসেছিলেন আমাদের সঙ্গে কথা বলতে। ওদের নিয়ে এসেছিল আমারই এক সাংবদিক বন্ধু জাফরুল হক। জাফরুল সাংবাদিক, তবে আমাদের মতো নেতাদের খবর লেখা সাংবাদিক নয়। ওর বাড়ি বসিরহাটে। ঘুরে বেড়ায় আজ এই গ্রামে তো কাল ওই গ্রামে। একজন উদার বামপন্থী। জাফরুল যখন হঠাৎ করে আমাকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা দাদা বলুন তো মুসলমানদের থেকে কেন খেলোয়াড় তৈরি হচ্ছে না? আমি বাধ্য হয়ে চুপ করে থাকি। তার পর হয়তো বলি উত্তরটা তুমিই খুঁজে বের করো। জাফরুল আমাকে একবার প্রশ্ন করেছিল, ‘দুর্গাপুজোর সময় তো আমি ডিউটি করি, পুজোর রিপোর্ট লিখি। কিন্তু ঈদের সময় কেন শুধুই আমিই রিপোর্ট লিখব। কেন অন্য সহকর্মীদের আপনি বলেন না ঈদের রিপোর্ট লিখতে? আমি বলি, ওরা জানে না, কী করে লিখবে? জাফরুল বলত, কেন জানবে না? এর উত্তর আমার কাছেও নেই। এই জাফরুল এক দিন ভৈরবকে নিয়ে এসে বলল, ওরা বাঁকুড়ায় রাসায়নিক সারের বিরুদ্ধে লড়াই করে জৈব চাষ করছে, আপনি একটা রিপোর্ট লিখুন। আমি তখনই রাজি হয়ে গেলাম। ভৈরবের সঙ্গে কথা বলে ঠিক হল, পরের সপ্তাহেই বাঁকুড়া যাব। সেই সূত্রেই আমার বাঁকুড়া যাওয়া।

ভৈরবের বাড়ি পাঁচাল গ্রামে। যেতে হবে বেলিয়াতোড় হয়ে। আমরা দুর্গাপুরে নেমে ট্যাক্সি নিয়েছিলাম। বেলিয়াতোড়ের কাছে এসে ট্যাক্সিচালককে জিজ্ঞাসা করলাম যামিনী রায়ের বাড়িটা কোনদিকে? ভাবলাম, এত দূরই যখন এলাম, যামিনী রায়ের বাড়িটা ছুঁয়ে একটু পুণ্য করেই যাই। চালক গিয়ারে হাত রেখে একটা বাঁক ঘুরতে ঘুরতে বললেন, কোন পার্টির নেতা উনি? যাই হোক, আর কথা না বাড়িয়ে বেলিয়াতোড় আসতেই চালককে বললাম, থামান চা খাব। নেমে এদিক ওদিক খোঁজ করতেই সেই মহৎ শিল্পীর বাড়ি খুঁজে পেলাম। আর জঙ্গলে ছেয়ে যাওয়া সেই বাড়ি দেখে মনটাও খারাপ হল। তালা বন্ধ। বুড়ো বয়সে কোনও মতে শ্যাওলা পড়া ভাঙা পাঁচিলে উঠে টলমল করতে করতে তীর্থ দর্শন হল। স্থানীয় মানুষ বললেন, বাড়িটা নাকি বিক্রি হবে, প্রোমোটার ঘোরাঘুরি করছে। তীর্থ দর্শন শেষ করে অবশেষে পৌঁছলাম ভৈরবের পাঁচাল গ্রামে। এসব কয়েক মাস আগের কথা। আসছি ভৈরবের কথায়।

গল্পটা প্রথমত এক সৈনিকের। তবে গল্প যত এগোবে দেখা যাবে সৈনিকের সংখ্যা মোটেই এক নয়। যেন একটা সেনাবাহিনীরই ছায়া দেখা যাচ্ছে। আর এই বাহিনীকে যদি সেনাবাহিনী বলি, তবে সেই সেনাবাহিনীর প্রধান কমান্ডারের নাম কৃষিবিজ্ঞানী ডঃ দেবল দেব।

গল্পের শুরু বাঁকুড়ার পাঁচাল গ্রামে। কী হচ্ছে ওই অপরিচিত পাঁচাল গ্রামে? লক্ষ কোটি টাকার যে হাইব্রিড ধানের ব্যবসা, ততোধিক বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানিগুলির সারের বাণিজ্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন বাঁকুড়ার পাঁচাল গ্রামের গুটিকয় ‘যুবক’। আজকের যুগে আধুনিক বিপ্লব কী হতে পারে, তা বুঝতে হলে যেতে হবে এই পাঁচাল গ্রামে। আজ ওঁরা সংখ্যায় ৫০ জন। কিন্তু এমন দিন আসতেই পারে যেদিন ওঁরা হয়ে যেতে পারেন পাঁচ লক্ষ, পাঁচ কোটি বা তার চেয়েও বেশি। কীভাবে?

পাঁচাল, শিল্পী যামিনী রায়ের বাড়ি বেলিয়াতোড় থেকে মাইল দশেক। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পিচ রাস্তা। রাস্তা ভাঙা-চোরা। তবে বাস চলে। পাঁচাল গ্রাম থেকে কিলোমিটার খানেক দূরে ধানখেতের মধ্যে ছোট্ট খড়ের কুড়েতে বসে কথা হচ্ছিল ভৈরব সাইনির সঙ্গে। সঙ্গী ছিলেন তুলসি দে আর কানাই দে। ওদের একটিই স্লোগান, ‘নিজের জল নিজের মাটি বিষাব না’।

ভৈরবদের অফিস ঘর

একটা প্রায় ছিঁড়ে যাওয়া মলিন বই, ‘লুঠ হয়ে যায় স্বদেশভূমি’ (উৎস মানুষ প্রকাশন), সেটাই ওঁদের গীতা। এই বই পড়ে জীবনটা বদলে গিয়েছে ভৈরব সাইনির। ভৈরবের এখন বয়স ৪২। আর পাঁচজনের মতো ভৈরবও স্কুল কলেজে পড়েছে। কিন্তু একজন পুরোদস্তুর চাষি ভৈরব। কৃষিবিজ্ঞানী দেবল দেব তখন পাঁচাল গ্রামের কাছেই অর্জুনপুরে গ্রামবাংলা সহ দেশের প্রায় হারিয়ে যাওয়া ধানবীজ সংরক্ষণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এই বীজ যদি পৃথিবী থেকে মুছে দেওয়া যায় তাহলে রাসয়ানিক সার নির্ভর হাইব্রিড ধান ছাড়া মানুষের আর গতি থাকবে না। ফলে বাংলা সহ দেশের প্রায় দেড় হাজার প্রাচীন ধানবীজকে কংসের হাত থেকে কৃষ্ণকে রক্ষা করার মতো করেই বাঁচিয়ে রেখেছেন এই কৃষিবিজ্ঞানী।

ধানবীজ যেহেতু রাখা যায় না, প্রতি বছর চাষ করে নতুন বীজ তৈরি করে সংরক্ষণ করতে হয়, সেই কাজটাই করে যাচ্ছেন দেবল দেব। এছাড়াও আর যা যা তিনি করে চলেছেন আমাদের চোখের আড়ালে, তা জানতে হলে যেতে হবে তাঁর ওয়েবসাইটে। যার ঠিকানা — cintdis.org। বলে রাখা ভালো, দেবল দেবের এই এনজিও কোনও সরকারের টাকায় চলে না। চলে বন্ধু এবং শুভানুধ্যায়ীদের সহায়তায়। টেলিফোনে দেবল দেব জানালেন প্রায় ২৪ বছর ধরে তিনি এই কাজ করে চলেছেন।

‘লুঠ হয়ে যায় স্বদেশভূমি’, বইটি ভৈরব পেয়েছিলেন দেবল দেবের কাছ থেকে। পড়ে মনে হল, পৃথিবীর এই জল এই মাটি বিষাক্ত করার অধিকার কারও নেই। একদিন সারের দোকানে গিয়ে ধারের টাকা মিটিয়ে এলেন ভৈরব। বাড়িতে যেটুকু রাসায়নিক সার ছিল নষ্ট করে ফেললেন। শুরু হল জৈব চাষ। সঙ্গে চলল জৈব চাষ নিয়ে পড়াশোনা। সবাই তখন ভৈরবকে রাস্তায় দেখলে ঠাট্টা করে বলত ওই দেখ কৃষিবিজ্ঞানী যাচ্ছে। এসব ১১-১২ বছর আগের কথা।

এমন সময় দেবল দেব বাঁকুড়া ছেড়ে চলে গেলেন দক্ষিণ ওড়িশায়। যাওয়ার সময় ভৈরবকে দিয়ে গেলেন ১২০ প্রজাতির বাংলা এবং অন্যান্য রাজ্য থেকে সংগ্রহ করা আদি ধানবীজ। ভৈরব হাইব্রিড ধানের চাষ ছেড়ে বাংলার প্রাচীন ধানের চাষ শুরু করলেন। এবং সবটাই জৈব চাষ। কাজটা সহজ হল না। বাড়ি থেকে বাধা এসেছিল। বাড়ি ছেড়ে প্রায় ১০ মাস গুজরাটে কাজ নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। তারপর বাড়ি, মানে বাবা মা রাজি হলেন। স্ত্রী শ্যামলী অবশ্য বরাবর পাশে ছিলেন। তার অবশ্য কারণও আছে। শ্যামলীর সঙ্গে ভৈরবের আলাপ গ্রামে বিজ্ঞান আন্দোলন করতে গিয়ে। সে সময় ভৈরবের শখ ছিল অন্য বন্ধুদের সঙ্গে ছোট্ট একটা চার ইঞ্চি টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশের তারা চেনা।

২০০৫ সালে ভৈরব প্রথম বার চাষ করলেন পাঁচ প্রজাতির ধান। সে সব ধানের নাম, বহুরূপী, গোবিন্দভোগ, বকুলফুল, কেরালা সুন্দরী এবং দ্বারকাশাল। ব্যবহার করলেন, এক গ্রামও রাসায়নিক সার নয়, সবটাই জৈব সার। সেই শুরু। বাজার ছিল না। আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বছরের পর বছর। হাইব্রিড স্বর্ণের চেয়েও কম দামে ধান বিক্রি করতে হয়েছে। কিন্তু থামেননি ভৈরব। উপরন্তু সঙ্গে পেলেন কানাই, তুলসিদের মতো আরও কয়েকজনকে। ২০১১ সালে দেবল দেব চলে গেলেন দক্ষিণ ওড়িশায়। কিন্তু তাঁর আদর্শ থেকে গেল পাঁচাল গ্রামে।

ধীরে ধীরে ছবিটা বদলাল। এখন ১২টি রাজ্যে চাল পাঠাচ্ছেন ভৈরবরা। বাজার বাড়ছে। লাভও বাড়ছে। জৈব সারে চাষ করা প্রাচীন ধানের জনপ্রিয়তা বাড়ছে প্রতিদিনই। তা দেখে এখন ভৈরবরা ৫০ জন মিলে তৈরি করেছেন বিশেষ ক্লাস্টার। সেই ক্লাস্টারের নাম বসুন্ধরা সুস্থায়ী কৃষি খামার। মোট ১৫০ বিঘা জমিতে এই চাষ হচ্ছে। কেন্দ্রীয় প্রকল্প, ‘পরম্পরাগত কৃষি বিকাশ যোজনা’, ভৈরবদের ‘বসুন্ধরা সুস্থায়ী কৃষি খামার’ এই প্রকল্পের অধীন। ২০১৬ থেকে শুরু হয়েছে এই প্রকল্প। জৈব কীটনাশক, জৈব সার, চাষের ষন্ত্রপাতি, বীজ ইত্যাদি কিছু সরকারি সাহায্যও তাঁরা এখন পাচ্ছেন।

বিষমুক্ত এই কৃষির ফসল যেদিন সরকারি ‘গ্রিন সার্টফিকেট’ পাবে, তাদের বিদেশে রফতানির দরজাও খুলে যাবে বলে আশা। দেবল দেবের ভাবনা যে ভৈরবদের মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে, তা বোঝা যায়। কারণ এই মুহূর্তে বাঁকুড়ায় এমন ক্লাস্টারের সংখ্যা ২০টি। গোটা রাজ্যে ১২০টি। ফলে বোঝাই যায় আরও অনেক ‘দেবল দেব’ অলক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন বিভিন্ন জেলায়।

ভৈরবদের এখন দরকার হল, এই ধরনের চালের জন্য ঠিকঠাক একটা মিল। সাধারণ মিলে বিক্রির জন্য চালকে ঘষে মেজে চকচকে করে দেওয়া হবে। দেখতে হয়তো সুন্দর লাগে, কিন্তু, সেই চালে কোনও খাদ্যগুণ থাকে না। বলা যায় সেই চাল, যা আমরা কলকাতায় খেয়ে থাকি, শুধু গ্লুকোজে ভরপুর। যা ডায়বেটিস ছাড়া আর কিছু উপহার দিতে পারে না।

এখনও ভৈরবরা যে চাল করেন, তার পুরো আতপটাই ওঁরা করেন বাড়িতে কড়াইতে সেদ্ধ করে। তার পর কালো চাল ইত্যাদি বাছাই করা হয় হাতে। তবে এটা ঠিকই চাহিদা আরও বাড়লে যদি বাড়ির বাইরের শ্রম ব্যবহার করতে হয়, তবে চালের দাম বাড়বে। কিন্তু, ভালো জিনিসের জন্য, বিষমুক্ত খাবারের জন্য মানুষ বোধহয় দাম দিতে প্রস্তুত। অন্তত ভৈরবদের অভিজ্ঞতা এমনই। ভৈরব জানালেন, এখন সব থেকে বেশি চাহিদা যে সব চালের সেগুলি হল, কালাভাতি (কালো চাল, খিচুড়ি, পায়েসের জন্য তা ছাড়া ক্যান্সারের রোগীকেও খাওয়ানো হয়), কেলাশ, দেরাদুন গন্ধেশ্বরী, গোবিন্দভোগ, রাঁধুনি পাগল, রাধাতিলক ইত্যাদি। এছাড়াও তাঁদের জৈব চাষের তালিকায় আছে তিল, সর্ষে, ডাল, আলু (অল্প), গম (অল্প), ভুট্টা, কাপাস তুলো। ভৈরবরা মাটির নীচের জল-সম্পদ সেচের জন্য ব্যবহার করেন না। মাটি যাতে নষ্ট না হয়, জলে আর্সেনিক যাতে না আসে। তাই ওঁরা বোরো চাষ করেন না। এমনকি নিজেদের অফিস ঘরে লাগিয়ে নিয়েছেন একটা সোলার ল্যাম্প।

অভীক লিখতে বলেছেন। ভাবলাম ভৈরবকে ফোন করে একটু জেনে নেই এখন তিনি কী করছেন। ভৈরবকে পেলাম। বললেন, তিনি এখন আছেন ওড়িশার কন্দমল জেলায়। প্রকৃতিবিজ্ঞানী শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ওঁরা জঙ্গলে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে একটা সমীক্ষা করছেন। খুঁজছেন জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল মানুষরা জঙ্গল থেকে কী কী পাচ্ছেন, কোন কোন উদ্ভিদ হারিয়ে যাচ্ছে, জীব বৈচিত্র সুরক্ষিত কিনা ইত্যাদি তাদের সমীক্ষার বিষয়। ভৈরব জানালেন, এবছর ওঁরা আরও আরও নতুন কিছু ধানের জৈব চাষ করছেন। নতুন কিছু ধরনের তুলা বীজও এবছর তাঁরা চাষ করছেন বলে জানালেন ভৈরব।

ভৈরব জানালেন, যদি কোনও চাষি এই ধানের চাষ করতে চান, তাঁরা তাঁকে বীজ দিয়ে সহায়তা করেন। কিন্তু বীজ ওঁরা বিক্রি করেন না। ভৈরব বললেন, বীজের কোনও মালিকানা হয় না, ওটা তো প্রকৃতির দান। তাই বীজ আমরা বিক্রি করি না।’

এই হল মাল্টিন্যাশনালের থাবার নীচে দু’একটা প্রদীপের গল্প্।