Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এক ব্যর্থ পরিবেশবিদের কবুলিয়তনামা

জলাভূমি পূর্ব কলকাতা

ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ

 

লেখক প্রয়াত ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ একজন UN Global 500 প্রাপ্ত এবং 2016 সালে Luc Hoffman পুরস্কারপ্রাপ্ত জলাভূমি বিশেষজ্ঞ এবং সংরক্ষণ কর্মী। ‘দি স্টেটসম্যান’ দৈনিকে প্রকাশিত তাঁর এই শেষ লেখাটি অনুবাদ করেছেন তাঁরই ছাত্রী এবং দীর্ঘদিনের সহকর্মী ধ্রুবা দাশগুপ্ত।

অমলের মা অনিতা মণ্ডল যখন আমার কাছে আসেন তখন ক’মাস আগের পুরনো চোট তার বাঁ পাকে প্রায় অকেজো করে দিয়েছে। চিকিৎসা প্রায় কিছুই করতে পারেননি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসতে গিয়ে প্রতিটি পদক্ষেপে চোখের কোণগুলিতে চামড়া কুঁচকে গিয়ে বেশ কিছু জ্যামিতিক রেখা তৈরি করছিল। রেখাগুলি যন্ত্রণার দ্যোতক। কোনওক্রমে ছোট ছেলের গাছের ডাল দিয়ে করে দেওয়া ক্রাচে ভর দিয়ে আসছিলেন তিনি।

অনিতা আমার কাছে আসছিলেন তার ভিটেবাড়ি বাঁচানোর শেষ ভরসার খোঁজে। আর পাঁচটা গ্রামের বাড়ির মতনই ছিল এই বাড়িটি — একটি ছোট নিকানো উঠোন, বাড়ির লাগোয়া একটি ছোট্ট পুকুর, চারিদিকে গাছপালা। এই তো, সায়েন্স সিটি থেকে ৬ কিমি দূরে, পূর্ব কলকাতার জলাভূমির কেন্দ্রস্থলে, নতুনহাট গ্রামে এই বাড়ি। কথিত আছে এই জলাভূমিটি নাকি প্রয়াত বিচারপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় একটি ঐতিহাসিক রায়ের দ্বারা আইনত সুরক্ষিত করে গিয়েছিলেন।

১৯৮১ সালে নেহাতই কাকতালীয়ভাবে আমি এই জলাভূমিতে এসে পৌঁছই। কলকাতার ময়লা জল কী করে পুনর্ব্যবহার করা যেতে পারে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন রাজ্য সরকার। উত্তরের খোঁজে বিশ্বের এক অজানা আশ্চর্যের সম্মুখীন হয়েছিলাম আমি, যার নাম দিয়েছিলাম তৎক্ষণাৎ — পূর্ব কলকাতার জলাভূমি। নামকরণের পরে প্রথম দায়িত্ব পড়ে এলাকা চিহ্নিত করার — এই এলাকার গ্রামগুলির লোকেদের নিয়ে ১২৫০০ হেক্টর এলাকা মানচিত্রায়িত করা হয়েছিল। ২০০২ সালে এই এলাকাটি রামসার সাইট [[১]] হিসাবে স্বীকৃত হয়।

স্থানীয় এক দালাল কিছুদিন ধরেই এদের ভিটেবাড়ি থেকে উৎখাত করার জন্য উত্যক্ত করে চলেছে। মানে মানে উঠে না গেলে পরিস্থিতি খুব খারাপ হবে বলে ক্রমাগত হুমকি দিচ্ছে। আইনের হাত এতদূর অবধি পৌঁছয় না। তখন কলকাতায় জার্মান কূটনীতিক ছিলেন ওলাফ ইভারসেন। এই অনন্য জলাভূমি এবং জলাভূমি সমাজের মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হতে তিনি খুবই আগ্রহী ছিলেন। অনিতা মণ্ডলদের কিছু সাহায্য হতে পারে ভেবে আমি তাকে এবং তার সহকারী অফিসারদের তাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। আসলে গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এরকম কারও বাড়িতে গেলে সাধারণভাবে এলাকায় তার ওজন বাড়ে। এখানে ফল হল তার ঠিক উল্টো — মণ্ডলদের অবস্থা আরও বিপদগ্রস্ত হল, হুমকি আরও বাড়তে লাগল। এখানকার পেশীশক্তি কাউকে ভয় পায় না। কষ্ট এখানেই যে আমি যত অতিথিদের জলাভূমি দেখতে নিয়ে এসেছি, ওলাফ তাদের মধ্যে অত্যন্ত মননশীল এবং মনে রাখার মতন একজন।

ওলাফের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে পড়ে গেল অ্যান রাইটের সঙ্গে এই জলাভূমিতে আসবার অবিস্মরণীয় ঘটনা। অ্যান রাইট ছিলেন আশির দশকে সুপরিচিত একটি নাম, বনাঞ্চল ভালোবাসতেন এবং সংরক্ষণের কাজে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি যখন জলাভূমিতে এসেছিলেন আমার অতিথি হয়ে তখন তিনি World Wide Fund for Nature (India) [[২]]-র Board of Trustees-এর সদস্য, এবং তাঁর কথাতেই আমি এই সংস্থার Board of Trustees-এ স্থান পেয়েছিলাম।

আমার সঙ্গে দু’ঘণ্টার বেশি পায়ে হেঁটে জলাভূমির অসংখ্য মনোরম জায়গায় ঘুরে, দাঁড়িয়ে, আড্ডা মেরে, ছুঁয়ে দেখে, অ্যান রাইট আমায় একটি অসামান্য কথা বলেছিলেন, ‘আজ আমি তীর্থস্থান দর্শন করলাম।’ কয়েক দশক ধরে সারা বিশ্ব থেকে কয়েক শো আগ্রহী মানুষ এসেছেন — বিশেষ করে ইওরোপ থেকে — তাঁরা তাদের বিস্ময়মিশ্রিত শ্রদ্ধা জানিয়ে গিয়েছেন এই জলাভূমিকে। নানা সুন্দর কথা বলে।

তাঁদের কারও কথাই আমাকে অ্যানের মতো নাড়া দিতে পারেনি। অ্যানের কথা যেন ঈশ্বরের আশীর্বাণীর স্বরূপ ছিল, কখনও ভোলার মতো নয়। কথাটা তাকে আজ বলতে খুবই ইচ্ছে করে। আরও বলতে ইচ্ছে করে যে আমি আমার পথের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছি, মনে হয় না এই জলাভূমিকে আর রক্ষা করা যাবে।

আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ১৯৮৬ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে এই জলাভূমির প্রাণকেন্দ্রে নিয়ে যাবার। ওঁর মহামান্য বেতনভোগী সেবকের দল বুঝেই উঠতে পারছিল না যে মুখ্যমন্ত্রীর সুরক্ষা বজায় রাখবার জন্য তাদের কী করা উচিত।

ওরা বোধহয় চিন্তিত ছিলেন যে এই উন্মুক্ত পরিবেশের বিশুদ্ধ বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে তো মুখ্যমন্ত্রী অভ্যস্ত নন, কোনও অসুবিধা হবে না তো? আমি ওনাকে জানিয়েছিলাম যে উনি বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট নগর-ভিত্তিক ময়লা জল পরিশোধনাগারের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, যা কিনা সৌরশক্তি দ্বারা পরিচালিত এবং জলাভূমির অধিবাসীদের পরম্পরাগত জ্ঞানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আমি মিথ্যা বলিনি। এই বছর (২০১৭ সালে) বিশ্ব জল দিবসের দিন পুনরুল্লিখিত হল যে শহর থেকে বেরোনো ময়লা জলের উৎকৃষ্টতম পরিশোধনাগার হল জলাভূমি অধিবাসীদের জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত এই অনন্যসাধারণ জলাভূমি।

আজকে আরও বলি যে এই জলাভূমি কার্বন ধারণ করে যাতে কলকাতার উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণ হয়। যে সব বিজ্ঞজনেরা হালফিলে আবহাওয়া নিয়ে গুরুগম্ভীর গবেষণা করেন তাদের তো কয়েক দশক আগে তেমন দাপট ছিল না, তাই পূর্ব-কলকাতার জলাভূমির পরিপ্রেক্ষিতে কার্বন নিয়ে এই আলোচনা হয়নি। আজকের দিনের উন্নয়নের নাট্যমঞ্চে এই আলোচনা বাধ্যতামূলক, তাকে উপেক্ষা করা যাবে না। কিন্তু কলকাতাবাসীদের এই বিষয়ে চিরস্থায়ী নিস্পৃহভাব অত্যন্ত বেদনাদায়ক। বিশ্বে এরকম হাতেগোনা কটি শহরই আছে যেটি এরকম একটি জলাভূমি দ্বারা এমন ব্যাপকভাবে উপকৃত।

কিছুদিন আগে বাঙালিদের একান্ত নিজস্ব এবং লোকপ্রিয় দুর্গোৎসব শেষ হল। যেই উৎসবের প্রধান সামাজিক বার্তা অসতের উপর সতের, মন্দের উপর ভালোর জয়। বিশ্বের দরবারে বোধহয় এমন উপলক্ষ দ্বিতীয়টি নেই যাকে ঘিরে কোনও জাতির সৃজনশীল সত্তা এমনভাবে নিজেকে প্রকাশিত করে। দুর্গাপূজার মণ্ডপসজ্জার বিষয়বস্তু নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না — ইতিহাস, বিভিন্ন ধরনের জীবন-জীবিকা, গ্রামজীবনের নানা ছবি, অসাধারণ পরিবেশ-বান্ধব বার্তা এমনকি বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে ঘটে যাওয়া ঘটনাও তুলে ধরা হয়। কিন্তু একটুও আশ্চর্য লাগে না যখন ভাবি যে পূর্ব কলকাতার জলাভূমির এই অনন্যসাধারণ নিদর্শন নিয়ে কখনও কোনও মণ্ডপসজ্জা হয়নি। কত হাজার হাজার ট্যাবলয়েড, ফ্লেক্স, হোর্ডিঙের মধ্যে একটিও এই জলাভূমির ঘটনাবলি বা তার প্রক্রিয়াকে উল্লেখ করেনি। সরকারি আধিকারিকেরাও এই বাস্তুতন্ত্রের মূল্য সম্পর্কে উদাসীন। এক দশকে অন্তত তিনজন মুখ্যসচিবকে অনুরোধ করেছি যেন গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলিতে পূর্ব কলকাতার জলাভূমি সম্পর্কে বিলবোর্ড লাগানো হয়। এখনও অপেক্ষা করছি। এখনও বিলবোর্ডে শুধু বাড়ি বানানোর বিজ্ঞাপনই জ্বলজ্বল করছে। জলাভূমির শুরুতে একটা বড় হোর্ডিং আছে যেখানে সুন্দরবনে যাবার নির্দেশিকা ঘোষণা করা আছে, কিন্তু জলাভূমির কোনও উল্লেখ নেই। অথচ দুটিই কিন্তু সংরক্ষিত এলাকা।

গত দুই দশকে আমি তিনজন পরিবেশমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। প্রথম জন কার্ল মার্ক্সের অনুগত ছিলেন এবং আমার উপস্থিতিতে সর্বদাই অস্বস্তিতে ভুগতেন। অন্য দুজন খুবই সৌজন্যের সাথে আমার কথা শুনেছেন কিন্তু মন্ত্রীদের অন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং কাজের চাপ থাকে তার ফলে প্রকৃতির এই অঢেল সম্পদের কাহিনি শোনবার বা বোঝবার তাদের সময় কোথায়? এই বছর দুর্গোৎসবের পরে আমি বানতলায় গিয়েছিলাম। বানতলা হল এই জলাভূমির পরিশোধন কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রীয় স্থল। এমন কিছু পরিবর্তন চোখে পড়ল যা পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল যে এই হচ্ছে শেষের শুরু। এই কাহিনি কিন্তু কেবল ভেড়ি-পুকুর বোজানোর বা বাড়ি বানানোর কাহিনি নয়। এই কাহিনি অনেক বেশি মারাত্মক এবং এমন কিছু লোকের দ্বারা বাস্তবায়িত হচ্ছে যাদের এই জায়গা থেকে সরানো যাবে না।

আমাদের পায়ে হেঁটে চলার পথ যেমন আজ হকারের দখলে তেমনই অনেকগুলি বে-আইনি প্লাস্টিক বাছাই করা এবং বর্জ্য প্লাস্টিক ধোবার এবং পুনর্ব্যবহারের কারখানা জলাভূমির অনেকটা এলাকা অবৈধভাবে দখল করেছে। যারা এই কারখানাগুলি চালায় তারা এই এলাকায় বহিরাগত এবং এই এলাকার ঐতিহ্য বা এখানকার ময়লা জল পরিশোধনের তাৎপর্য সম্পর্কে কিছুমাত্র ওয়াকিবহাল নয়। তারা লালকুঠি সাইফন এবং বানতলা লকগেটের পেছনে ছায়ানাভি গ্রামের এলাকায় নিজেদের সবলে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ওদের এই কারখানাগুলি থেকে নিঃসৃত বর্জ্য পদার্থ এবং তরল বর্জ্য অনায়াসে মাছের জন্য ময়লা জলের খালে প্রবেশ করে এবং খুবই তাড়াতাড়ি মাছ মারা যেতে আরম্ভ করবে। এছাড়াও আছে চামড়ার ছাঁট জাল দেবার কারখানা, যাতে আছে বড় বড় কড়াই। এই কড়াইগুলি থেকে তরল বর্জ্য অবশ্যই বি এন দে রোডের দক্ষিণে বাসন্তী রোডের মাছের ভেড়িগুলিতে যেই খাল জল দিয়ে যায়, সেই খালে গিয়ে পৌঁছবে। একদা শান্ত লালকুঠি সাইফন এলাকার এই ভয়াবহ পরিবর্তন বিশ্বাস করতে অসুবিধা হচ্ছিল আমার। আমি জানি যে এই জায়গা দেখতে যাবার জন্য অদূর ভবিষ্যতে আমার উপর প্রচণ্ড চাপ আসবে। এই পুরো দৃশ্যটাই চোখে আঙুল দিয়ে আমার মগজে একটাই কথা গেঁথে দিচ্ছিল, যে একজন ইকলজিস্ট হিসেবে আমি শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ। এই কর্দম, দুঃসহ বাস্তব দুঃস্বপ্নের মতো আমাকে, আমার চেতনাকে আগামী দিনে তাড়া করে বেড়াবে।

পাদটীকা :

[[১]] পাঠকদের অবগতির জন্য বলি, আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি রামসার সাইট হিসাবে স্বীকৃত হয় — এইভাবে স্বীকৃত জলাভূমিকে রক্ষা করার দায়িত্ব সেই দেশের সরকারের। ইরানের রামসার শহরে বিশ্বের অনেক দেশ সই করেছিল নিজেদের দেশের বৈশিষ্টপূর্ণ জলাভূমিগুলিকে চিহ্নিত করার এবং টিকিয়ে রাখার চুক্তি।

[[২]] সংরক্ষণের কাজে যুক্ত একটি এন জি ও (non government organization)।