দেবব্রত শ্যামরায়
‘আধুনিক ভারতের মন্দির’
প্রায় দু’দশক আগে আনন্দবাজার পত্রিকা তাদের দীর্ঘ পথ চলার ইতিহাস পাঠকদের ফিরে দেখাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেইমতো এক সকালে হাতে এল বেশ ঢাউস এক ক্রোড়পত্র, তাতে ছিল দশকভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ খবরের ঝাঁকিদর্শন, সঙ্গে সেই দশকে দেশের সামাজিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বাঁক বদলের আলোচনা। সেই ইন্টারনেট-পূর্ব যুগে এমন একটি সংকলন তথ্য ও ইতিহাসের আধার বিরল, উৎসাহ নিয়ে পাতা ওল্টানো শুরু করলাম। পঞ্চাশের দশকে পৌঁছেই চোখ আটকে গেল একটি উজ্জ্বল সাদাকালো ছবিতে। কালো পাথরে কোঁদা এক সুবেশী সাঁওতাল যুবতীর ছবি। টানটান করে বাঁধা কালো চুলে ফুল গোঁজা। যুবতী একটি চাবি ঘোরানোর চেষ্টা করছেন। ঠিক পেছনে সহাস্য মুখে দাঁড়িয়ে আছেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন-এর চতুর্থ নদীবাঁধ পাঞ্চেত, সেই পর্যন্ত তৈরি হওয়া সবচেয়ে বড় বাঁধ পাঞ্চেত, শ্রমিকরমণীর হাত দিয়ে উদ্বোধন করিয়ে জাতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে দিলেন পণ্ডিত নেহেরু। দিনটা ছিল ডিসেম্বর ৬, ১৯৫৯।
অনেকদিন পরে জেনেছি, যুবতী নয়, বছর পনেরোর এই আদিবাসী কিশোরীটির নাম ছিল বুধনি মাঝি। বুধনিকে নিয়ে এসেছিলেন দামোদর ঘাঁটি নিগমের কর্তারা। স্বাধীনতার পর জাতিগঠনের লক্ষ্যে আন্তরিক পণ্ডিত নেহেরু ব্যক্তিগতভাবে চেয়েছিলেন পাঞ্চেত বাঁধ উদ্বোধন করুন বাঁধেরই এক শ্রমিক। সেচ ও জলবিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজনে সারা পৃথিবীতে ঠিক সেই মুহূর্তে বড় বড় নদীবাঁধ প্রকল্প রূপায়নের কাজ শুরু হয়েছে। সদ্যজাত স্বাধীন দেশকে সম্পদশালী ও স্বনির্ভর করার কাজে খুব স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিক নীতিকে অনুসরণ করা শুরু করেছিলেন নেহেরু। বাঁধগুলিকে তিনি ‘আধুনিক ভারতের মন্দির’ বলে ভাবতেন, পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ভারি শিল্প তৈরির লক্ষ্যে স্টিল প্ল্যান্ট তৈরি করছেন তিনি, ভিলাই, বোকারো, দুর্গাপুরে। কল্যাণকামী সমাজতন্ত্রের আদর্শে প্রভাবিত নেহেরু ভেবেছিলেন বাঁধ নির্মাণের মতো প্রকল্পে লাভবান হবেন দেশের সাধারণ কৃষিজীবী মানুষ, পিছিয়ে পড়া মানুষের ক্ষমতায়ন ঘটবে। বুধনির হাত দিয়ে পাঞ্চেতের উদ্বোধন প্রান্তিক মানুষের সেই ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন তিনি।
উদ্বোধন করিয়ে প্রধানমন্ত্রী তো দিল্লি ফিরে গেলেন, কিন্তু তারপর বুধনির কী হল? বস্তুত নদীকে বাঁধ দিয়ে বেঁধে, তার স্বাভাবিক চলনকে রুদ্ধ করে মানুষ আসলে বড় ভুল করেছিল — নদী নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিবেশনীতির এই তীক্ষ্ণ প্যারাডাইম বদলকে বুধনির পরবর্তীকালের ট্র্যাজিক জীবন যেন এক কঠিন পরিহাসের মতোই অনুসরণ করে।
বাঁধ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর নিজের গ্রাম, কারবোনায়, ফিরে যান বুধনি ও সেখানে গিয়ে এক অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। অনুষ্ঠানে তিনি পণ্ডিত নেহেরুকে মালা পরিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন, গ্রামের বয়স্করা অভিযোগ আনলেন যে, এর অর্থ তিনি নেহেরুজিকে বিবাহ করে ফেলেছেন। নেহেরু যেহেতু সাঁওতাল নন, বিয়ের পর বুধনিও আর সাঁওতাল নেই, তিনি সেই মুহূর্ত থেকেই সমাজচ্যুত, অতএব এই গ্রামে থাকার তাঁর আর কোনও অধিকার নেই। চিরকালের মতো নিজের গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হয় বুধনিকে। বছর তিনেক পরে কোনও কারণে ডিভিসির চাকরিও হারান তিনি। পরবর্তীকালে যে লক্ষ লক্ষ প্রান্তিক মানুষ বড় নদীবাঁধ নির্মাণের কারণে ঘরছাড়া হয়েছেন, জীবন ও জীবিকা হারিয়ে আক্ষরিক অর্থে পথে বসেছেন, রাষ্ট্রের মানবিক মুখ ক্রমশ দানবিক হয়ে উঠেছে, নিজের গ্রাম থেকে বুধনি মাঝির প্রস্থান যেন সেই দেশব্যাপী উচ্ছেদের এক অলৌকিক সূচনা করে দিয়েছিল।
ফরাক্কা নদীবাঁধ ও কপিল ভট্টাচার্য
অথচ আমরা কি সেই সময় বড় নদীবাঁধ নির্মাণের ক্ষতিকর মুখটির সম্বন্ধে আদৌ ওয়াকিবহাল ছিলাম না?
ওয়াকিবহাল ছিলাম না তা নয়। আমাদের ঘরের কাছে, এই কলকাতা শহরে, সেই ১৯৬১ সালে বসেই একজন সরকারি বাস্তুকার সবচেয়ে প্রথমে নদীবাঁধের পরিবেশধ্বংসী দিকগুলো আমাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন। তখনই ফরাক্কার গঙ্গাবক্ষে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল — ফরাক্কায় বাঁধ দিয়ে গঙ্গায় বাহিত পলিকে আটকে দেওয়া ও কলকাতা বন্দরকে পলিমুক্ত ও ব্যবহারের উপযোগী রাখা। এই পরিকল্পনা প্রাথমিকভাবে ছিল আর্থার কটন নামের ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারের, যিনি ১৮৫৩ সালে প্রথম এই প্রস্তাব রেখেছিলেন। স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নদীবাঁধ নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেন যা ১৯৪৯ সালে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা দফতরের হাতে চলে যায়। ফরাক্কা বাঁধের আরেকটা লক্ষ্য ছিল পদ্মা দিয়ে বাংলাদেশে বাহিত জলের পরিমাণ কমিয়ে মূল স্রোতকে হুগলি নদী দিয়ে বইয়ে নিয়ে যাওয়া, যা, তখন ভাবা হয়েছিল দক্ষিণ গাঙ্গেয় অঞ্চলকে পর্যাপ্ত জল সরবরাহ করবে ও জমা পলি ধুয়ে নিয়ে চলে যাবে।
কপিল ভট্টাচার্য ঠিক সেইসময় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ ও জলপথ বিভাগের মুখ্য বাস্তুকার ছিলেন, এবং ১৯৬১ সালে ফরাক্কা বাঁধ প্রস্তাব টেবিলে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তার তীব্র বিরোধিতা করলেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ ছিল হুগলি নদীতে এই পলিসমস্যা হিমালয় থেকে গঙ্গাবক্ষে বয়ে আসা পলির কারণে নয়। বরং দামোদর ও রূপনারায়ণ, হুগলির পশ্চিমদিক থেকে আসা এই দু’টি নদীর ওপর নির্মিত অপরিকল্পিত বাঁধগুলিই এই সমস্যা তৈরি করছে। বন্যার সময় নদীতে যে বান আসে এবং সেই বান যে সমতলের মাটি বহন করে নিয়ে আসে, এই দুই নদীর বাঁধগুলি তা ধারণ করার জন্য উপযুক্ত নয়, ফলে সেই পলি এসে হুগলিকে ভরিয়ে দিচ্ছে। ফরাক্কা বাঁধ এই সমস্যাকে আরও বাড়াবে বই কমাবে না। তিনি তাঁর রিপোর্টে ফরাক্কা নির্মাণ নিয়ে সতর্ক করার পাশাপাশি কয়েকটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এক — ফরাক্কা বাঁধের নির্মাণ তো হুগলিকে পলিমুক্ত করবেই না, বরং তা কালক্রমে কলকাতা বন্দরকে মেরে ফেলবে। দুই — গরমকালে যখন বাহিত জলের পরিমাণ অর্ধেকেরও নিচে নেমে যায় তখন পদ্মায় বাহিত জলের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাবে যা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে। এবং তিন — বন্যার সময় ফরাক্কা বাঁধ থেকে জল ছাড়ার পরিমাণ এতটাই কম যে বন্যার সময় তা উত্তরের মালদহ, মুর্শিদাবাদ ও সংলগ্ন রাজ্য বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে প্লাবিত করবে।
বলাই বাহুল্য, শ্রী ভট্টাচার্যের সবক’টি অনুমান সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। এই পঞ্চাশ বছর হুগলি দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে কিন্তু যতটা জল বয়ে যাওয়ার দরকার ছিল, তা যায়নি। কলকাতা বন্দর দেহ রেখেছে সেই কবেই। কলকাতা বন্দরের পুনরুজ্জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে মোহনার কাছে হলদিয়ার সরে যেতে হয়েছে আমাদের। পূর্ব পাকিস্তান আর নেই, ফরাক্কার চেয়েও পরে তিস্তার ওপরে নির্মিত বাঁধ অধুনা বাংলাদেশের কাছে আরও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তিস্তার জলবন্টন এই মুহূর্তে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের একটি প্রধান ভরকেন্দ্র। মালদা-মুর্শিদাবাদের বন্যা এক বাৎসরিক ইভেন্ট, এবং সম্ববৎসর মানুষ ও গবাদিপশুর প্রাণহানি ও সম্পত্তিহানির খবর আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে।
এই ধরনের নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করার পাশাপাশি ফরাক্কা বাঁধকে কেন্দ্র করে কপিল ভট্টাচার্যের রিপোর্ট স্বাধীন ভারতের প্রথম দলিল যা নদীবাঁধ নির্মাণের সরকারি নীতিকে চ্যালেঞ্জ জানায়। এই রিপোর্টের জন্য কপিলকে সরকারি স্তরে রীতিমতো ভর্ৎসিত হতে হয়। সেই সময় ভারতে নির্মীয়মাণ অন্যান্য বড় বাঁধ বিষয়ক নথিগুলি ‘ক্লাসিফায়েড’ ছিল, একমাত্র কপিল ভট্টাচার্যের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তান কূটনৈতিক চাপ বাড়ায়। কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী কে এল রাও কপিল ভট্টাচার্যকে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দেন। আনন্দবাজার কপিল ভট্টাচার্যকে ‘পাকিস্তানের চর’ ঘোষণা করে। এই খবর অবশ্য উপর্যুক্ত আনন্দবাজারের ষাটের দশকের ঝাঁকিদর্শনে ছিল না। পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল ও অসম্মানজনক হয়ে ওঠায় উনি সরকার চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন। অবশেষে ১৯৬২ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয়ে ফরাক্কায় গঙ্গার ওপরে ২.৬২ কিলোমিটার লম্বা বাঁধ তৈরি হয়ে ১৯৭৫ সালে সম্পূর্ণ হয়।
অবিরল ধারা
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ২০০০ সালের Water Framework Directive (WFD) গৃহীত হওয়ার পর গোটা ইউরোপ জুড়ে Big Dam Removal বা বড় বাঁধ বিনির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। বড় বাঁধ পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র ও মানবজীবনের যে প্রভূত ক্ষতি করে যার পরিমাণ বাঁধ থেকে পাওয়া সুফলগুলির তুলনায় অনেক গুণ বেশি, এ আর কোনও বিতর্কিত তথ্য নয়, রীতিমতো প্রমাণিত। বাঁধ নদীর স্বাভাবিক চলনছন্দ ব্যাহত করে, যার সঙ্গে মোহনা পর্যন্ত যাত্রাপথে এই নদীর ওপর নির্ভরশীল মানবসম্পদ ও প্রাণিসম্পদের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত। WFD-র হাত ধরে Dam Removal Europe সংস্থাটি মহাদেশের নদীগুলোকে মুক্ত করার কাজ শুরু করে দিয়েছে। সুইডেন, স্পেন, পর্তুগাল, ব্রিটেন, সুইজারল্যান্ড ও ফ্রান্সে এখনও পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৩৪৫০টি নদীবাঁধকে ধ্বংস করে ফেলা গেছে।
ইউরোপের দিকে তাকিয়ে স্বাধীন ভারত তার মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করেছিল। ভারত নদীমাতৃক দেশ। বিগত সত্তর বছরে আমরা সারা দেশে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি নদীবাঁধ তৈরি করেছি, বাঁধের সংখ্যার দিকে দিয়ে আমাদের স্থান চিন ও আমেরিকার পরেই। প্রকৃতির ওপর আমাদের মালিকানা লাগু করতে গিয়ে আমরা আন্তরিকভাবে নষ্ট করেছি আমাদের নদী ও বাস্তুতন্ত্র। কাবেরী জল সংকট, ফরাক্কা বাঁধ নিয়ে বিহার ও বাংলার সমস্যা, ওড়িশা-ছত্তিশগড়ের জলবণ্টন, হীরাকুঁদ বাঁধ বিতর্ক ইত্যাদি সমস্যা ছাড়াও নদীবাঁধের মানবমূল্য বা human cost অপরিসীম, বিশেষত, ভারতের মতো একটি দেশে যেখানে কালো ফাইল ও লাল ফিতের বাইরে পুনর্বাসন শব্দটির কোনও অস্তিত্বই নেই। দীর্ঘমেয়াদি নদী আন্দোলন হিসেবে নর্মদা বাচাও আন্দোলন আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেয়েছে, যেখানে নর্মদা নদীর ওপরে কুখ্যাত সরদার সরোবর বাঁধ গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশের ৫১,০০০ পরিবার বা আড়াই লক্ষ মানুষের জীবনকে সরাসরি আঘাত করেছে, যাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই প্রান্তিক জনজাতি গোষ্ঠীর।
দেরি হয়ে গেছে। আরও বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগে আমাদের দেশের নদীগুলিকে তাদের অবিরল ধারা ফিরিয়ে দেবার কাজ শুরু করে দিতে হবে আমাদের। নদীকে মুক্ত করে দেওয়া মানে পরিবেশকে জীবন ফিরিয়ে দেওয়া, এই বুড়ি পৃথিবীর আয়ু কিছুটা দীর্ঘতর করা, আমাদের সন্ততির জন্য আরও কিছুটা অক্সিজেন সুনিশ্চিত করা, একথা আমরা যত তাড়াতাড়ি বুঝব, ততই মঙ্গল। অচিরাচরিত শক্তির নতুন সবুজ উৎস খুঁজে বের করার দায় আমাদের, সে দায় নদীগুলির নয়, নদীবাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ তৈরিকে সেই শক্তির উৎস হিসেবে ভাবা বন্ধ করে দিতে হবে আমাদের।
ঘরছাড়া বুধনি মাঝিকে নদীর ধারে নিজের গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় এসে গেছে।