সৌমিত্র দস্তিদার
সাধারণত বাংলাদেশের কথা উঠলেই আমরা ঢাকার কথা শুনতে পাই। অধিকাংশ বেড়াতেও যাই ঢাকায়। পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রেও তাই। যা কিছু দ্রষ্টব্য আলোচনা সবই কলকাতাকে নিয়ে। টুরিস্ট গাইডে চোখ রাখুন, দেখবেন ওই চিড়িয়াখানা, মিউজিয়াম, দক্ষিণেশ্বর, বেলুড়, কালীঘাট, গড়ের মাঠ ইত্যাদি ইত্যাদি। খুব বেশি হলে শোভাবাজারের রাজবাড়ি বা চোরবাগানের মল্লিক প্যালেস। ওপারের ক্ষেত্রেও তাই। অথচ বাংলাদেশ বলতে মোটেই শুধু ঢাকা নয়। ওই দেশকে জানতে বুঝতে আপনাকে পুরনো যশোর, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, নোয়াখালি, পাবনা, নাটোর, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা দেখতেই হয়। নদীমাতৃক যে ছবি আপনার চোখে আশৈশব ভাসে তা দেখতে ওপারের গাঁ গঞ্জে ঘুরতে হবে।
আসলে সব দেশের মধ্যেই দুটি আলাদা আলাদা দেশ থাকে। একটি টুরিস্টদের জন্য। পিকচার পোস্টকার্ডে যা থাকে — সাজানো গোছানো পরিপাটি ছবি — এয়ারপোর্ট ও নবনির্মিত ফ্লাইওভার, হাইরাইজ, শপিংমল, ঢাকাতেও সেসব আছে। শেখ মুজিবর রহমানের বাড়ি, সংসদ ভবন রমনা, ঢাকা ইউনিভার্সিটি, শাহবাগ বায়তুল মোকারম বা মুক্তিযুদ্ধের মিউজিয়াম, রমনা কালীবাড়ি — সাধারণত ঢাকার চেনা চিত্রকল্প এটুকুই।
ঢাকার রিক্সা ও জ্যামের কথা এখন লোকের মুখে মুখে ফেরে। এই চেনা শহরের বাইরে অজস্র জায়গা আছে যা হাঁটতে হাঁটতে চিনতে হবে। পাশাপাশি আগেই বলেছি মফস্বল গ্রাম না দেখলে আজকের বাংলাদেশকে চেনা অসম্ভব।
বাংলাদেশ থেকে ফিরে এসেই আপনাকে অবধারিতভাবে শুনতে হবে — ওপারের হিন্দু নির্যাতনের অবস্থা কী দেখলেন? অথবা ওপারের অর্থনীতির চেহারাটা কেমন? আবার বাংলাদেশ গেলেও মুখোমুখি হতে হবে এমন সব প্রশ্নের যা নিয়ে আপনার কোনও ভূমিকাই নেই। এবারই ঢাকার শাহ জালাল আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে নেমে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে যেতে না যেতেই পুলিশ প্রশ্ন করল — দাদা, ইন্ডিয়া আমাদের পানি দেয় না কেন? এই পানি ও কাঁটাতার বিএসএফ, এসব নিয়ে প্রশ্ন কিন্তু সর্বজনীন। দশজনের মধ্যে অন্তত সাতজনেরই চাপা ক্ষোভ রয়েছে বিষয়দুটি নিয়ে। ঘটনাচক্রে আমার দেশভাগ নিয়ে সম্প্রতি করা ডকুমেন্টারি ফিল্ম ‘সীমান্ত-আখ্যান’-এর প্রথম পর্বে বিশিষ্ট সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক প্রশ্ন তুলেছেন কাঁটাতার নিয়ে। বলেছেন — কেউ যদি মনে করে গোলমাল করবে, কাঁটাতার কি তাকে আটকাতে পারবে? ক্ষুব্ধ হাসান আজিজুল হক আরও বলেছেন — কাঁটাতার নাৎসিরা দিত, হিটলার দিত। বন্ধু রাষ্ট্র কেন দেবে?
বহুবার বাংলাদেশ গেছি। কাজে, অকাজে। এটা বুঝতে পারি দু দেশের মানুষের মধ্যেই এমন অনেক প্রশ্ন আছে, একে অন্যের সম্পর্কে যার মীমাংসা করা দরকার। না হলে জানাচেনার অজস্র ফাঁকফোঁকর দিয়েই জন্ম নেয় বহু গুজব, যা নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক কারসাজি — যা দুপারের জনমনে কখনও কখনও বিদ্বেষ জন্ম দেয়। সেই বিদ্বেষের তীব্রতা এমন যাতে কখনও কখনও আমাদের অনেক প্রগতিবাদী বন্ধুদেরও ভেসে যেতে দেখি।
বস্তুত এপারের মূলত হিন্দুত্ববাদীরা ওপার বাংলার যে ভয়ঙ্কর অন্ধকার ছবিটা আঁকেন বাস্তবের ছবি কিন্তু অত বিষণ্ণ, বিবর্ণ নয়। আমি কিন্তু কোনও বায়াসড জায়গা থেকে একথা বলছি না। অনেক সময় বলি যান না, একবার ওপারে ঘুরে নিজেই দেখে আসুন ছবিটা কেমন! কত সাম্প্রদায়িক ওপারের আমজনতা।
বাংলাদেশ বেড়াতে যাওয়া নিয়েও এক ধরনের ভয়, ট্যাবু কাজ করে সাধারণ পশ্চিমবঙ্গীয় বঙ্গসন্তানদের মধ্যে। আবার ওপারে যাওয়া ঠিক স্ট্যাটাস সিম্বল নয়, তাও হতে পারে। ফলে আমরা যত থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, ইংল্যান্ড, আমেরিকা যাই, তার চেয়ে অনেক সস্তায় সামান্য দূরের প্রতিবেশী দেশকে দেখার আগ্রহবোধ করি না।
ইদানীং অবশ্য প্রবণতাটা একটু কমছে। বাংলাদেশ যাওয়ার আগ্রহ কিছু বেড়েছে। তবে তা এপারের বাঙালির আমেরিকা, ইউরোপ যাওয়ার তুলনায় কমই। অথচ বাংলাদেশের সবুজের কোনও তুলনা নেই। পদ্মার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের তুলনা হয় না। কুয়াশাঢাকা শিলাইদহ বা কুষ্টিয়ায় লালন মাজার যে দেখেনি সে সত্যি সত্যি জীবনের এক অমূল্য সম্পদ হারিয়েছে। ঢাকার সদর ঘাটে বুড়িগঙ্গার ওপারে পেল্লাই সব স্টিমার। সারেঙের হাঁক ডাক চিৎকার। টিকিট কেটে কোনও একটায় আপনি উঠে পড়ুন। কেবিনে এসি নন-এসি দুই-ই পাবেন। ভিআইপি রুমও আছে। ডেকে উঠে চেয়ারে বসে জলের ছলাৎছলাৎ শব্দ শুনতে শুনতে সারেঙের রান্না গরমভাত, মুরগীর ঝোল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে বরিশালে পৌঁছে যাবেন খুব ভোরে। বরিশাল মানেই তো জলরাশি। ধান, নদী, খাল — তিনে মিলে বরিশাল। একদা বিখ্যাত বালাম চাল এখন আর নেই। একদা বয়ে চলা বেশিরভাগ খালও এখন বিলুপ্ত। তবে নদী পুরনো দিনের মতোই বয়ে চলেছে। কত নাম তার — কীর্তনখোলা, সন্ধ্যা, ধলেশ্বরী, আড়িয়াল খাঁ ইত্যাদি ইত্যাদি।
কয়েক বছর ধরে যেতে যেতে এই বাংলাদেশকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। কখনও এপারের লালগোলায় গিয়ে ওপারের গোদাগারির দিকে তাকিয়ে থাকি, কখনও আবার কাহারপাড়া শেখপাড়ায় গিয়ে রাজশাহী শহরের আলো দেখি। যে যেভাবে দেখে, আমি চেষ্টা করি ভালোবাসার চোখ দিয়ে ওপারের জনপদকে দেখতে বুঝতে। আমার ছবির শুরুর দিকে একটা স্কুলের দৃশ্য আছে। রাজশাহীর ভোলানাথ হিন্দু অ্যাকাডেমি বহু পুরনো স্কুল। একদা ইংরেজির পি. কে. দে সরকার ওই স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়িও কাছেই। ঋত্বিক শৈশবে এই ভোলানাথ স্কুলের ছাত্র ছিলেন। আমরা এই স্কুলে প্রথমবার গিয়েই চমকে উঠেছিলাম, সারিবদ্ধ ছাত্রছাত্রীরা দাঁড়িয়ে গীতা পাঠ করছে। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে। অবিভক্ত বাংলার প্রাচীন ও সর্বপ্রথম বারোয়ারির প্রচলন করেছিলেন তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ। প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো সে পুজোতেও একবার গেছিলাম আমি ও আমার স্ত্রী। এখনও সাবেক পুজোটি হয়। কংসনারায়ণের বসতবাড়িটি কলেজ হয়েছে। কাছাড়িটা এখনও আছে। রাজশাহীর পুটিয়া উপজেলায় জায়গাটা।
এক একটি শহরে আজও রমরমিয়ে হয় দুর্গাপুজো, দোল, রথযাত্রা ও অন্যান্য উৎসব। শুধু শহরে নয়। গ্রামে গ্রামে। পুটিয়া শিবমন্দির নিয়ে প্রবীণ এক হিন্দু ভদ্রলোক জানিয়েছিলেন — আমরা যে চাঁদা তুলি, তার অন্তত ত্রিশ চল্লিশ শতাংশ দেয় মুসলিম সম্প্রদায়। আর তারা না এলে আমাদের কোনও উৎসবই যেন সম্পূর্ণ হয় না। এই বর্ণময় টুকরো টুকরো ছবি খুব একটা সামনে আসে না বা আসতে দেওয়া হয় না।
মনে আছে কয়েকমাস আগে একবার খুলনা গেছি, স্থানীয় তরুণদের সঙ্গে হাঁটছি। শিবমন্দিরের কাছাকাছি এসে শুনলাম, বিরানব্বই সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে আক্রান্ত হয়েছিল এ মন্দির। কিছুটা ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছিল। স্থানীয় লোকজনের প্রতিরোধে পুরোটা হয়নি। ফেরার পথে উগ্রবাদীরা বাইরের রাস্তার নাম বদলে কাগজ সেঁটে লিখে দিয়েছিল — বাবরি চত্বর। দু-একদিন বাদে মূলত তরুণদের একটা বড় অংশ এসে এসব কাগজে সাঁটা নাম তুলে দিয়ে পুরনো নাম শিবমন্দির মোড়ই বহাল রাখে। ঘটনাচক্রে, বলাই বাহুল্য ওই তরুণদের অধিকাংশই মুসলমান।
এইবার সবে সবে বরিশাল গিয়েছি, আমার এক পরিচিত গৈলা গ্রামের একটা গল্প বলছিলেন — সেই বর্ধিষ্ণু গ্রামে কয়েক বছর আগে বড় একটি দশকর্মার দোকান হয়েছে। সে দোকানে বিক্রিও বেশ ভালো। এখন প্রশ্ন উঠবে — এই ক্রেতারা কারা? নিশ্চয়ই মুসলমানেরা নয়। তাহলে হিন্দু আধিক্য না থাকলে নতুন করে কেউ দশকর্মার দোকান দেবে না নিশ্চয়ই।
এপারের হিন্দুত্ববাদীরা যখন একতরফা অনুদার বাংলাদেশ দেখায়, তখন তারা ও তাদের নব্য সাকরেদ অনেক প্রগতিশীলও এড়িয়ে যান যে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় এখনও অর্থনীতির সিংহভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের দখলে। ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল, কুমিল্লায় মিষ্টি, স্বর্ণ ব্যবসা, মনিহারি, মুদি সামগ্রী — এই ক’টি ক্ষেত্রে একচেটিয়া আধিপত্য ওপারের সংখ্যালঘুদের। তবে এসব সত্ত্বেও অস্বীকার করা যাবে না বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় সংখ্যায় কমছে। এক এক জেলায় একেকরকম, কোথাও ১২ শতাংশ, কোথাও বেশি, কোথাও আর একটু কম। সবমিলিয়ে আনুমানিক দশ শতাংশ হবে।
এই কমার গল্পটা অনবরত নানাভাবে জানান দেওয়া হচ্ছে। সেখানে আড়ালে চলে যাচ্ছে দু’টি তথ্য। এক, ’৪৭ সালে দেশভাগের সময় হিন্দু জনসংখ্যা শতাংশে কত ছিল, এখন কত হয়েছে? হিসেব করলে দেখতে পাবেন সংখ্যার বিষয়ে তখন আর এখন খুব কিছু ফারাক নেই। সেসময়ের মতো এখনও বাংলাদেশে দু’কোটির বেশি হিন্দুর বাস।
এ যদি তথ্যের একদিক হয় অন্যটি আরও উল্লেখযোগ্য — ও দেশের হিন্দুরা দশ শতাংশ। অথচ সরকারি চাকরিতে, কলেজ স্কুল শিক্ষকতায়, পুলিশে, আমলা, আধিকারিকদের মধ্যে তাদের উপস্থিতি বিপুল। পাশাপাশি এ রাজ্যের সংখ্যালঘু “তোষণে”র নানা গালগল্পের মধ্যেও তাদের সামাজিক রাজনৈতিক আর্থিক পরিস্থিতি কী তা সাচার কমিটিই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। সাচার রিপোর্টের ১২ বছর কেটে যাওয়ার পরেও পরিস্থিতি যে খুব একটা বদলায়নি তা ভুক্তভোগী মাত্রই স্বীকার করবেন।
তবু বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের ক্রমে চলে আসাটা নিঃসন্দেহে দু’দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যেও এক বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন। স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে ওপারে নির্যাতন চরমে বলেই দলে দলে হিন্দুরা স্বাধীনতার সত্তর বছর বাদেও এভাবে ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। এর অনেকগুলো ব্যাখ্যা আছে। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর বলেছেন — স্বাধীনতার আগে থেকেই বর্ণ হিন্দুদের বড় অংশ এপারে আসতে শুরু করেছিলেন। প্রাক্তন আই সি এস অশোক মিত্রের লেখাতেও বিষয়টি আছে। গ্রামের উচ্চবর্গীয় সামন্ত সম্ভ্রান্ত হিন্দুরা চলে আসায় তাদের ওপর নির্ভরশীল সমাজের নিম্নবর্গের অংশ, ধোপা, নাপিত, পুরোহিত, ছোট ব্যবসায়ীদেরও একটা অংশের ঢল নামে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ অবধি। এই সময় ঢাকা, খুলনা ও অন্যত্র ছোট বড় একাধিক দাঙ্গাও হয়। তবে তা অধিকাংশই ভারতে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচারের প্রতিক্রিয়ায়। ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ অবধি এই দেশ ছাড়ার প্রক্রিয়া থাকে। তার পিছনে দাঙ্গাহাঙ্গামা ভীতিপ্রদর্শন একটা কারণ হলেও আর একটা কারণ আমরা বিশেষ করে হিন্দুত্ব বা মনুবাদীরা স্বীকার করি না যে উচ্চবর্ণের হিন্দু মনস্তত্ত্বে একধরনের চাপা মুসলিম বিদ্বেষ ছিলই। ফলে তাদের আধিপত্য মানতে না পেরেও হিন্দুদের একটা বড় অংশ এপারে চলে আসেন। এর পিছনে ছিল অবিভক্ত বাংলার সমাজ অর্থনৈতিক কাঠামোর একটা ভূমিকা। এমনকি দাঙ্গার ইতিহাস বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ঐতিহাসিক সুরঞ্জন দাশ দেখিয়েছেন যে ১৯৪০ সাল অবধি অধিকাংশ দাঙ্গায় পিছনে ছিল একধরনের শ্রেণি রাজনীতি। বাংলায় জমিদারি ছিল বর্ণহিন্দুদের হাতে। প্রজারা ছিলেন হয় মুসলমান নয় নিম্নবর্গের হিন্দু। ফলে জমিদারি অত্যাচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ সময় সময় দাঙ্গার চেহারা নিত। ১৯৪০ পরবর্তী ভারতীয় রাজনীতিতে মুসলিম লিগের উত্থানের পরে ছবিটা ধর্মীয় চেহারা নিতে থাকে। ঐতিহাসিকভাবে দীর্ঘদিনের অত্যাচারিত মুসলিম প্রজা ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পরে প্রতিহিংসা নেবে। এই আশঙ্কায় হিন্দুদের সচ্ছল অংশ দেশত্যাগ করেন। কোথাও কোথাও প্রতিহিংসার ঘটনাও ঘটেছে বৈকি। তবে ভয়, অশিক্ষা ও পুরনো প্রতিপত্তি চলে যাওয়ার উদ্বেগ নিঃসন্দেহে দেশত্যাগের একটা কারণ।
এখনও অনেকে এপারে আসছেন তা কিছুটা ভয়ে কিছুটা ‘হিন্দুস্থানে’ আসার প্রলোভনে। অনেকেই আবার দ্বৈত নাগরিকত্ব ভোগ করেছেন। আবার এটা ঠিকই এদেশে যত মুসলিম অত্যাচার বাড়ছে, ওপারেও তার পালটা একধরনের গুমোট আবহাওয়া একটু হলেও টের পাওয়া যাচ্ছে। সেইসঙ্গে ভারতের নানা দাদাসুলভ আচরণ ওপারের সাধারণ জনতার মনে যে অসন্তোষের জন্ম দিচ্ছে, তাকে ব্যবহার করেও হিন্দুদের ওপর ক্রোধের আবহ তৈরি করছে দুই দেশের চতুর রাজনীতিবিদরা।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমনে কোনও সাম্প্রদায়িকতা নেই। ঈদ ও পুজোয় দুই সম্প্রদায়ই সর্বসম্মতভাবে অংশ নেয়। আনন্দ করে। যারা বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক বলে রাতদিন গাল দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা খোঁজ নিয়ে দেখুন সেদেশ শতসহস্র ভারতীয় কাজ করছেন।
’৭১ সালে লাখ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে দেশটা স্বাধীন হয়েছিল, আজও সে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে নানা বিষয়ে। অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য অনেক বিষয়েই তার সাফল্য ফেলে দেবার নয়।
আমরা যখনই কোনও দেশ নিয়ে কথা বলি তখন তাঁর রাষ্ট্র ও জনগণকে এক করে ফেলি। ভারতের বিদেশনীতি বা বাংলাদেশ সরকারের বহু নীতি নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সমালোচনাও থাকবে। কিন্তু দু’দেশের জনগণের মধ্যে বৈরিতা থাকার কথা নয়। গ্রাম শহর মফস্বল জানা অজানা অজস্র জনপদ ঘুরতে ঘুরতে মনে হয়েছে বাংলাদেশের জনগণ বন্ধুদের হাত ধরতে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি তৎপর, সক্রিয়, আন্তরিক ও উষ্ণ।
এমন একদিনও পাবেন না যে ওদেশের সাধারণ লোক আপনাকে তাঁর বাসায় আমন্ত্রণ বা দাওয়াত দেবে না। ইন্ডিয়া সম্পর্কে তাঁদের অভিমান আছে আবার মুগ্ধতা ভরা ভালোবাসাও আছে। কলকাতা তাঁদের অধিকাংশের প্রাণের শহর। খুলনার প্রত্যন্ত গ্রামের এক স্কুলে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের বড় অংশ জানিয়েছে যে তারা বড় হয়ে কলকাতায় পড়াশোনা করতে চায়।
যখনই ওদেশে যাই, আবার ফিরে আসি তখন ওই শিশুদের মুখ চোখের সামনে ভাসে। যে মুখে কোনও সাম্প্রদায়িকতার চিহ্ন নেই। ওরাই তো আসল বাংলাদেশ। ভোরের আলো। সে সব বাদ দিয়ে কেন আমি সবসময় অন্ধকারের গল্প শুনব।