গোলাম রাশিদ
সন্ধ্যা হতে আর একটু বাকি।
সবাই উৎসুক। চোখেমুখে একটা চাপা উত্তেজনা, খুশির এবং প্রতীক্ষার।
কেউ বাড়ির ছাদে উঠেছে। কেউ এসে দাঁড়িয়েছে রাস্তার ধারে। ছোটরা তাদের বাইনোকুলার বের করেছে।
সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ নৈঋত থেকে পশ্চিম আকাশে। সবাই অপেক্ষায় রমযান শেষে শাওয়ালের চাঁদের। রমযানের ওই রোযার শেষে এল খুশির ঈদ।
মহাবুল হঠাৎ চেঁচাল, ওই তো দেখা যাচ্ছে। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল, কই কই, দেখি, কোথায়?
ওই তো নিমগাছটার উপরের ডালটার পাশ দিয়ে দ্যাখ।
কেউ খুঁজে পায় না।
আরে, ওই হলুদ মতো মেঘ দেখছিস না, তার ডানদিকে।
ছোট্ট আসিফ খুশিতে তিড়িং করে লাফিয়ে ওঠে। ওর বাইনোকুলারে ধরা পড়েছে ঈদের চাঁদ, একটুকরো খুশি।
ওই তো, ওই তো। মেঘের ফাঁকে, গাছের পাশে, ছাদের উপরে। ঈদ এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গ্রামের রাস্তায়। পাড়ার অতি উৎসাহী কিছু ‘বখাটে’ বুড়িমার চকোলেট বোমা ছোড়ে। দুম্ করে শব্দ হয়। সবাই চমকে যায়। অ্যাই, কে রে? ধর তো ওকে। কিন্তু ধরা যায় না। আরও কয়েকটা আতসবাজি আকাশে উঠে অল্প আলোয় মিলিয়ে যায়। সবাই প্রশ্রয়ের হাসিতে শুরু করে ঈদের দিনের সন্ধ্যা। বড়রা তড়িঘড়ি বাড়িতে ঢোকে। অনেকের এখনও সেদিনের ইফতার বাকি।
২.
ফারজানার খুব মন খারাপ। বাপিকে মেহেন্দির ডিজাইন বই আনতে বলেছিল বার বার করে। বাপি সেটাই ভুলে গেছে। এখন কীভাবে হাতে ডিজাইন করবে? ওর কান্না পাচ্ছে। রুবাই আপা বাড়িতে থাকলে কোনও কথাই ছিল না। আপা যা ডিজাইন পারে, তা বিশ্বের কেউ পারে না। কিছুদিন আগে আপা বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। এবার ঈদের দিন ওখানেই নাকি কাটাবে। আপাকে ছাড়া ঈদের দিন ভাবাই যায় না। ওকে এখন মেহেন্দি লাগিয়ে দেবে কে?
এদিকে শোয়াইব আর তারান্নুম ওদের ঈদের জামা বের করে ফেলেছে আলমারি থেকে। ওদের আর তর সয়নি। এখন একবার পরে মেজকাকুর ক্যামেরাটায় একটা ছবি তুলতে চায়। কিন্তু যেই জামা বের করেছে, অমনি আসিফটা কোথা থেকে ছুটে এসে ফ্রকের নিচের দিকটায় ওর পেইন্টিংয়ের রং লাগিয়ে দিল। এরপর তারান্নুমের সেকি কান্না! ওর মা আলমারি থেকে আরেকটা নতুন জামা বের করে দিলে তবে সে থামল। ও আশ্চর্য হয়ে গেছে। রুবাই আপা কখন জামা পাঠিয়ে দিয়েছে ওদের সবাইয়ের জন্য। ওরা সবাই ছবি তোলার জন্য রেডি হয়ে গেল। কিন্তু ফারজানা রাজি নয়। ও মেহেন্দি লাগিয়ে হাতের ছবি তুলতে চায়। অগত্যা অপেক্ষা। ফারজানার মেজমামণি মেহেন্দি লাগিয়ে দিচ্ছে। এদিকে মামুন বাড়ির গেটে শোলা কেটে কেটে সুন্দর করে লিখছে ‘ঈদ মুবারক’।
ঈদের আনন্দ কিন্তু এই শাওয়ালের চাঁদ দেখার দিনই শুরু হয় না। যেদিন রমযান মাসের চাঁদ দেখে প্রথম রোযা শুরু হয়, সেদিন থেকেই যেন সবাই সেজে উঠতে শুরু করে। ভোর রাত্রে ঘুম থেকে উঠে সাহরি খাওয়ার যে কি উত্তেজনা সে বলে বোঝানো মুশকিল। একদিকে ভোর রাতের গাঢ় ঘুম। অন্যদিকে স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরা আছে, কাল রোযা রাখবই। আবার চক্রান্ত করে মা ডেকে তুলবে না। তাই বেশ সজাগ থাকতে হয়। মা-ভাবীরা সাহরি রান্না করতে উঠেছে এটা বুঝতে পারলেই বিছানায় জেগে শুয়ে থাকা, কখন রান্না শেষ হবে। ওদিকে মসজিদের মাইকে পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর বলে চলেছে, ‘সাহরি রান্নার সময় হয়ে গেছে। আপনারা উঠে পড়ুন। আজকের সাহরির শেষ সময় তিনটে বেজে চল্লিশ মিনিটে।’ আলু, ডালের ভর্তা আর সঙ্গে ডিমের ঝোল। গরম গরম ভাত খেতে বসেই দেখা যায়, একি, একে একে সবাই ঘুম ঘুম চোখে উঠে আসছে। একসঙ্গে পুরো বাড়ি জেগে গেছে কোনও এক অজানা গন্ধে। খাবারের থালার কমতি পড়ে যায়। ছোট্ট শোয়াইবকে তখন যদি তার মা বলে, এসো তুমি আমার সঙ্গে খাবে, সে একদম জোরে জোরে ঘাড় নাড়ে। ও একলা খাবে। সাহরি কি মায়েরা খাইয়ে দেয় নাকি!
মজাটা হত দিনের বেলায়। কেউ আটটার সময়, কেউ দশটা কেউ আবার বারোটা পর্যন্ত রাখত রোযা। তারপর যখন বাড়ির সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটি বলে দিত, তোমাদের রোযা এই পর্যন্তই। এবার ইফতার করে নাও। তখন রোযা ভেঙে ফেলত। তবে কেউ কেউ একদিন পুরো রোযাও রেখে দেয়। সন্ধেবেলায় সকলের সঙ্গে বসে ইফতার করে সেদিনের রোযা শেষ হয়।
ইফতারের আসল আইটেম হচ্ছে আনন্দ। বড়রা তো সারাদিন খালিপেটে কোনওকিছু না-খেয়ে তারপর সন্ধেতে ইফতার করে। কিন্তু, তারান্নুমরা ইফতারি আয়োজনের সময় থেকেই খেতে শুরু করে। এক টুকরো আপেল, শসা মুখে পুরে দিল। দুটো খেজুর নিয়ে পালিয়ে গেল কেউ। পানি খাব বলে এক গ্লাস শরবত ঢক্ ঢক্ করে খেয়ে নিল। আর একটু যারা বড়, তারা আয়োজন করত। থালা ধুত। সেই বড় থালায় খেজুর, আপেল, কলা, পেয়ারা, পেঁপে, তরমুজ, আনারস — হরেক রকমের ফল কেটে সাজানো। এই সময় ছেলেরা দাঁতন কেটে নিয়ে আসে জঙ্গল থেকে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। কোনও রোযাদার যদি নেয়। আবার দূরের কেউ অতিথি হয়ে আসে ইফতার করতে। সেদিন একটু আলাদা মজা। থালা সাজিয়ে সবাই অপেক্ষায় আছে ইফতারের সময় কখন হবে। এরই মধ্যে ছোট্ট তারান্নুম হয়তো টুপ করে এক টুকরো আম মুখে পুরে দিল। তৎক্ষণাৎ বড়দের মতো শাসনের সুরে ফারজানার ধমক,
এই ইফতারের আগেই তুমি খাচ্ছ কেন?
কই, আমি খাইনি তো।
আবার মিথ্যা কথা। আম্মু দেখেছ ও কেমন মিথ্যা কথা বলা শিখেছে।
আমি তো রোযা নেই। খেলেই বা কি।
আর সবাই তো রোযা আছে। রোযাদারদের সামনে খেতে হয় না, তুমি জান না?
ঠিক আছে, তোরা চুপ কর। ও আর খাবে না। এই বলে বড়দের মধ্যে কেউ ব্যাপারটা তখনকার মতো ম্যানেজ করে। পরে কিন্তু বিভিন্ন সময়ে সুযোগ পেলেই ফারজানা সবার সামনে খোটা দেবে, ওহ্, তারান্নুম! ও তো একদম বাঁদর। ইফতারের আগেই খেয়ে নেয়। এদিকে খোঁজ নিলে দেখা যাবে ইফতারি তৈরির সময় ফারজানার মুখ ক্রমাগত চলেছে! এর মধ্যে কেমন একটা মজা ছিল। বড়রাও এসব কথা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে হাসাহাসি করত। তখন আমরা লজ্জায় ছুটে পালিয়ে যেতাম, মুখ লুকোতাম।
তারাবির নামায হয় রোযার মাসে। ইফতারের ঘণ্টাখানেক পর দীর্ঘ নামায হয়। উৎসাহের বশে ছেলেরা সব নামায পড়তে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই ক্লান্ত হয়ে ঘুম পেয়ে একসা। অগত্যা পিছনের সারি থেকে বেরিয়ে ঘুমিয়ে পড়া।
সারা মাস ধরেই একটা মজার মধ্যে দিয়ে যায় রমযানের দিনগুলি। বাচ্চাদের বেশি আনন্দ, কিন্তু বড়দের আনন্দও কম নয়। ছোটদের খুশিতেই তাদের খুশি কিনা।
মহাবুল, আসিফ, ফারজানা, শোয়াইব, তারান্নুম, মামুন কোনও কাল্পনিক নাম নয়। ঘটনাগুলো তো নয়ই। এসবই আমাদের ঈদ আনন্দের অমলিন স্মৃতি। ঈদের চাঁদ, তারাকাঠি, মেহেন্দি, চুড়ি, সালোয়ার-কামিজ দিয়ে শুরু হয় যে আনন্দ তা এক সময় এসে ঠেকে লাচ্চা, বোঁদে, সিমাই, পায়েস, রসগোল্লা, পোলাও-বিরিয়ানিতে।
৩.
ঈদের দিন সকাল। সবাই ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে পড়ে। তার আগেই মায়েরা ওঠে। সিমাই তৈরি হয়ে যায় আগেই। পাড়ার কোনও এক বাড়িতে সিমাই বানানোর মেশিন আসে। সবাই গিয়ে সেখান থেকে সিমাই তৈরি করে আনে। এখন আর হাতে বানানো সেই সিমাই দেখা যায় না। প্যাকেটে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের রমরমা বাজারে। ঈদের দিন সিমাই রান্না করা হয়। তবে এর সঙ্গে মূল আকর্ষণ লাচ্চা আর বোঁদে। বোঁদে বাড়িতে বানানো হয়। কিন্তু মুদিখানার দোকানে প্যাকেটে করে যে লাল-সবুজ-হলুদ রঙের বোঁদে পাওয়া যেত তার আকর্ষণই আলাদা। বেছে বেছে রঙিন বোঁদে খাওয়ার দিনগুলো ভুলবার নয়।
স্নান করার সময় বেশ হুটোপুটি পড়ে যায়। সকাল আটটায় ঈদের নামায শুরু। এদিকে সকালে বেশ ঠান্ডা। গায়ে পানি ঢালতেই তিড়িংবিড়িং করে লাফাতে ইচ্ছে করে। তারপর আবার আব্বুর কড়া হুকুম, সাবান মাখতে হবে। চুলে শ্যাম্পু লাগাতে হবে। বছরকার দিন বলে কথা। স্নান করে হু হু করে কাঁপতে কাঁপতে নতুন পাজামা আর পাঞ্জাবি পরে নিয়ে সূরমা লাগানোর পালা। এই পর্ব বড্ড কষ্টের। চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে গালে গড়িয়ে পড়ে। কালিতে লেপ্টালেপ্টি। সাবান মাখা ফর্সা মুখখানা মুহূর্তের মধ্যে শেষ! তবে সূরমা লাগানোটা যতটা অত্যাচার মনে হত, আতর লাগানোর ব্যাপারটা ছিল ঠিক উলটো। পারলে পুরো আতরের শিশি গায়ে ঢেলে নিই আর কি!
এরপর আসে বাটিভরতি সিমাই, লাচ্চা, বোঁদে, মিষ্টি। এতকিছুর পর আর খেতে ইচ্ছে করে না। দাদার বচন, ঈদের নামায পড়তে যাওয়ার আগে মিষ্টিমুখ করে যেতে হয়। অতএব লাচ্চা থেকে কিশমিশগুলো, রঙিন বোঁদে বেছে নিয়ে টপাটপ মুখে পুরে দিই। তারপর মিষ্টিমুখ করে ঈদগাহের পথে হেঁটে যাওয়া। সঙ্গে জায়নামাজ আর আঙুলে বড়দের আলতো ছোঁয়া।
মসজিদগুলো রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হয়। মসজিদের প্রধান দরজায় ঢুকতেই ছিল একটা সুন্দর ফুলে ভর্তি কাগজফুলের গাছ। তার সঙ্গে রঙিন কাগজগুলোও বেশ মানিয়ে যেত। এখানে একটা ব্যাপার থাকে। গাছের ছায়ায় জায়গা নেওয়ার ব্যাপার। ঘন্টাখানেক নামায পড়া রোদের মধ্যে বেশ কষ্টকর। তাই কাঁঠাল গাছের ছায়া চায় সবাই। তবে হুড়োহুড়ি হয় না। আজ সবাই কেমন শান্ত। চোখে সূরমা, আতরের সুগন্ধ, ঈদে কেনা নতুন পাঞ্জাবি। স্বর্গীয় দীপ্তি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ইমাম সাহেব বুঝিয়ে দিতে শুরু করেন রোযার গুরুত্ব, ঈদের খুশি কীভাবে দরিদ্র প্রতিবেশীর সঙ্গে ভাগ করে নিতে হবে।
নামায শেষে বাড়ি ফিরতে হয় অন্য পথে। বাড়ির পথে ফেরার সময় মনে হয় সব শেষ হয়ে গেল। একটা বিদায়ের সুর বেজে ওঠে চারদিকে। এরপর আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়া আছে, ভরপেট খাওয়াদাওয়া আছে, বেড়ানো আছে। তবু মনে হয় ঈদগাহ থেকে বেরনোর পর যেন ঈদ শেষ হয়ে গেল। এ যেন আরেক বিসর্জন। তখন শুরু হয় আগামীর জন্য অপেক্ষা।