শতাব্দী দাশ
এটি একটি বিতর্কের এক পক্ষ। একই সাথে পড়ুন প্রবুদ্ধ বাগচীর লেখাটি। বিতর্কে অংশ নিন। -- স্টেশন মাস্টার
টলিউডের এক অভিনেত্রী সম্প্রতি শোরগোল ফেলেছেন তার প্রাক্তন বিবাহিত সঙ্গীর প্রতি শারীরিক-মানসিক অত্যাচারের অভিযোগ তুলে। অভিনেত্রীর প্রাক্তন নিজেও একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা। আমাদের মতো যারা গৃহহিংসা নিয়ে কাজ করি তাদের কাছে এই কেসগুলি ঠিক হাইপ্রোফাইল গসিপ নয়। বরং এসব খবর গৃহহিংসা, অন্তরঙ্গ সঙ্গী কর্তৃক শারীরিক-মানসিক অত্যাচার, সেই সংক্রান্ত আইনকানুন ও তার সীমাবদ্ধতা, বিচ্ছেদ, সন্তানের ভরণপোষণ, খোরপোশ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনার সুযোগ এনে দেয়।
প্রথমেই বলা দরকার যে গৃহহিংসা নিয়ে আমাদের সমাজে ধারণা অত্যন্ত সীমিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, এখনও, আমরা গৃহহিংসা বলতে বুঝি শারীরিক অত্যাচার, মারধোর, যার চিহ্ন নির্যাতিত বহন করবে শরীরে। নির্যাতিতর মৃত্যু ঘটে থাকলে তবেই সেই ঘটনা খবরের কাগজে স্থান পায় এবং তারপরেও চলে নির্যাতককে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মিতা মণ্ডলের মৃত্যু যেমন প্রচণ্ড শোরগোল ফেলেছিল দু বছর আগে। কিন্তু ঘটনায় যে মিতার স্বামীর দায় নেই তা প্রতিপক্ষ প্রমাণ করতে তৎপর হয়েছে। আমরা জানি না মিতা আদৌ সমস্ত নাগরিক সমাজের আন্দোলন সত্ত্বেও ন্যায় পাবে কিনা। আর নির্যাতিত বেঁচে থাকলে ও ৪৯৮/এ ধারায় কেস দায়ের করলে তো কথাই নেই। প্রচলিত ধারণা হল, ৪৯৮/এ একটি পৈশাচিক, পুরুষখেকো আইন যা গ্লিসারিনচোখো নারীরা বেচারা পুরুষদের ফাঁসাতেই ব্যবহার করে।
অভিনেত্রীর ঘটনাটি আমাদের আরও একবার মনে করিয়ে দেয়, তিনি কিন্তু শারীরিক নির্যাতন সত্ত্বেও তাঁর বরের বিরুদ্ধে বিগত বছরগুলিতে ৪৯৮/এ দায়ের করেননি। ঠিক এভাবেই ৪৯৮/এ দায়ের করা হয় না অধিকাংশ গৃহহিংসার ঘটনায় — সামাজিক বা আর্থিক ক্ষমতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে বেশিরভাগ মেয়েই তা করেন না। ৪৯৮/এ তবে সত্যি অপব্যবহৃত না বহুলভাবে অ-ব্যবহৃত?
United Nation-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী মহিলাদের বিরুদ্ধে Domestic Violence হল —
“Any act of gender based violence that results in or is likely to result in physical, sexual and psychological harm or suffering to women, including threat of such acts, coercion or arbitrary deprivation of liberty, whether occuring in public or private place.” United Nations স্পষ্টতই একে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ বলে উল্লেখ করছে।
আমাদের দেশে অবশ্য বৈবাহিক সম্পর্কে মানসিক বা যৌন নির্যাতনের ধারণা অত্যন্ত অস্বচ্ছ, শারীরিক নির্যাতন নিয়ে তাও কিছু আলোচনা হয়।
আশির দশকে গৃহহিংসা বলতে মূলত বোঝা যেত পণের দাবিতে বধূর উপর নির্যাতন। সেই থেকেই মূলত অ্যান্টি-ডাউরি অ্যাক্ট হিসেবে ৪৯৮/এ-র আবির্ভাব ১৯৮৩ সালে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন থেকে মেয়েদের রক্ষা করা। আইনটির বয়ান ছিল এরকম —
“Husband or relative of husband of a woman subjecting her to cruelty. — Whoever, being the husband or the relative of the husband of a woman, subjects such woman to cruelty shall be punished with imprisonment for a term which may extend to three years and shall also be liable to fine. Explanation. — For the purpose of this section, “cruelty” means –
- any wilful conduct which is of such a nature as is likely to drive the woman to commit suicide or to cause grave injury or danger to life, limb or health (whether mental or physical) of the woman; or
- harassment of the woman where such harassment is with a view to coercing her or any person related to her to meet any unlawful demand for any property or valuable security or is on account of failure by her or any person related to her to meet such demand”
ইত্যাদি।
আইনটিতে চোখ বোলালেই বোঝা যায়, মূলত শারীরিক নির্যাতন, আত্মহননে প্ররোচনা ইত্যাদির কথাই বলা হয়েছে, বিশেষত তা যদি হয় পণের দাবিতে। এই বহুল-চর্চিত ও বহুল-নিন্দিত আইনটি নিয়ে গত ক’বছরে সুপ্রিম কোর্টেও প্রচুর জলঘোলা হয়েছে। আইনটি পরীক্ষামূলকভাবে শিথিল করে দেওয়া হয়েছিল ‘পুরুষ অধিকার’ কর্মীদের দাবির কাছে নতিস্বীকার করে, ২০১৭ সালের জুলাই মাসে। আইনটির সমালোচনা করতে অনেক সময়েই একে ‘আফস্পা’ বা ‘ইউএপিএ’-র মতো অন্যায্য আইনের সাথে তুলনা করা হয়। ভুলে যাওয়া হয়, রাষ্ট্র সর্বশক্তিমান আর পরিবারে নারী প্রান্তিক। তাই রাষ্ট্র কর্তৃক দমনের সাথে নারী অধিকার আইনের তুলনা চলে না।
যাই হোক, যে কোনও সমালোচনার আগে, এই ৪৯৮/এ আইনটির প্রণয়নের ইতিহাস একবার খুঁটিয়ে দেখা দরকার।
এই যে ইউনাইটেড নেশনের সংজ্ঞায় বলা হল প্রাইভেট প্লেস বা ব্যক্তিগত পরিসরের কথা, এটিই গৃহহিংসাকে এক ধোঁয়াশাপূর্ণ প্রান্তর করে রেখেছিল বহুদিন যাবৎ। চার দেওয়ালের মধ্যে যা ঘটছে, তার সাক্ষীই বা থাকবে কে? দ্বিতীয়ত, গৃহহিংসাকে দম্পতির ‘ব্যক্তিগত ব্যাপার’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যেত সহজেই। তৃতীয়ত, বউ-এর সাথে ঠিক কী কী করা যায় না, কোথায় ভালোবাসা কর্তৃত্বের রূপ নেয় আর কোথায় কর্তৃত্ব হয়ে যায় নির্যাতন –এসব নিয়ে ধারণাও ছিল অস্বচ্ছ। কারণ সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগতভাবেই আমরা গৃহহিংসার ধারা শোণিতে বহন করছি। অন্যান্য দেশ ও সংস্কৃতির মতোই, হিন্দু পুরাণে ও সংস্কৃতিতে নারীবিদ্বেষ ও গৃহহিংসার ঐতিহ্য সুস্পষ্ট। এই পত্রিকাতেই আগে একটি নিবন্ধ লেখা গেছিল তা নিয়ে।
তার উপর, ভারতীয় ফৌজদারি আইনব্যবস্থা অনুযায়ী, অপরাধীর অপরাধ প্রমাণিত হতে হবে ‘beyond reasonable doubt’. অভিযোগকারীর ঘাড়েই থাকে অভিযোগ প্রমাণের দায় এবং গৃহহিংসার ক্ষেত্রে সেখানেই গণ্ডগোল। অভিযোগকারিণী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চার দেওয়ালের মধ্যে ঘটা ঘটনা প্রমাণ করতে পারেন না, অপরাধীর অপরাধ ‘সকল সন্দেহের ঊর্ধ্বে’ প্রমাণিত হয় না। ফলে, অভিযুক্ত বেকসুর খালাস পেতে থাকে। বাড়তে থাকে বিবাহিত মহিলাদের মৃত্যু। Dowry Prohibition Act, 1961 যে বিবাহিত মহিলাদের রক্ষাকবচ হতে ব্যর্থ হচ্ছে, সে বিষয়ে ৭০ আর ৮০-র দশকের নারীবাদীরা সরব হতে থাকেন। মিছিল নামে পথে। পুণেতে মঞ্জুশ্রী সারদা বা শৈলা লৎকরের মৃত্যু যখন ঘটছে, মোটামুটি একই সময়ে কলকাতায় সুরূপা গুহর রহস্যজনক মৃত্যু ঘটছে। নারীবাদীরা বারবার দাবি করতে থাকেন যে পণজনিত অত্যাচার ও গৃহহিংসার বিষয়গুলি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনে আইনসংস্কার করা হোক। আন্দোলনকারীরা লক্ষ করেন, হত্যা শুধু নয়, বাড়ছে বধূদের আত্মহত্যাও। নানাবিধ আন্দোলনের পর, অবশেষে ১৯৮২ সালে বসে Criminal Law Amendment Committee, 1982.
অতঃপর ল কমিশন অব ইন্ডিয়া তার ৯১তম রিপোর্ট (১০ই অগাস্ট, ১৯৮৩) পেশ করে। সেখানে কমিশন পণমৃত্যু আটকাতে হিন্দুবিবাহ আইন, পণ সংক্রান্ত আইন, এমনকি এভিডেন্স আইনেরও পরিবর্তনের সুপারিশ করে। অপরাধ প্রমাণের দায় চাপে অভিযুক্তর ঘাড়ে, ভারতীয় আইনের ইতিহাসে যা অভূতপূর্ব। ফলত, আসে ৪৯৮/এ ধারাটি। আইনের বয়ান তো আগেই বর্ণিত হয়েছে। আমরা হয়ত আরও জানি যে ধারাটি কগনিজেবল (অর্থাৎ সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই গ্রেপ্তার করা যায় অভিযুক্তকে) ও নন-বেইলেবল। কী উদ্দেশ্যে এই আইন প্রযুক্ত হবে তার বর্ণনায় ‘পণ-বিরোধিতার’ কথা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। বরং ধারাটির ক্ষমতা আরও প্রসারিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে — ‘punishment for subjecting married women to cruelty’ — এই উদ্দেশ্যে ধারাটি প্রযোজ্য। অর্থাৎ কারণ যাই হোক, শারীরিক নির্যাতন হলেই বা আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিলেই এই আইন প্রযুক্ত হবে।
বস্তুত, ১৯৮৩ সালের আগে শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন আটকানোর কোনও মজবুত পরিকাঠামোই ছিল না ভারতীয় আইনব্যবস্থায়। একরকমভাবে, ৪৯৮/এ ভারতীয় গৃহহিংসার হাঁড়ি ভাঙল খোলা হাটে। ‘ব্যক্তিগত’ এল প্রকাশ্যে — যেমনটা হওয়া নাকি ‘ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী’। ৪৯৮/এ ধারা-ই প্রথম স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা (যাকে মনু বা যাজ্ঞবল্ক্য পবিত্র কর্তব্য বলেছেন)-কে ক্রিমিনাল অফেন্স হিসেবে চিহ্নিত করল। ফলে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের রক্তচক্ষু যে প্রথম থেকেই এই বিশেষ ধারার উপর পড়বে, তা বলা বাহুল্য।
অবশ্য এর পরেও অধরা থেকে গেল মানসিক বা যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রগুলি। সুরক্ষার ঘেরাটোপের বাইরে থাকলেন পরিবারের বাকি নারীরা, যেমন — মেয়ে, মা, বোন প্রভৃতি (স্ত্রী ছাড়া বাকিরা)। এই ফাঁকগুলি পূরণ করতে সিভিল আইন আসবে ২০০৫ সালে যা Protection of Women against Domestic Violence Act, 2005 হিসেবে পরিচিত হবে।
কিন্তু প্রচণ্ড কঠোর এই ৪৯৮/এ ধারার আইনকে পিতৃতন্ত্রের শিরদাঁড়া ভাঙার জন্য ব্যবহার তখনই করা যেত, যখন পুলিশ ও প্রশাসন সহায় হত। কিন্তু ঘটতে থাকল ঠিক তার উল্টোটা। ঘটনা হল, এখনও পণের বিষয়ে সুস্পষ্ট উল্লেখ না থাকলে পুলিশ কেস নিতে চায় না। কেস নিলেও অনেক সময় পুলিশই প্ররোচিত করে কেস তুলে নিতে। আবার অনেক সময় অভিযোগকারী নিজেই তা চায়। এমনকি কোর্টের বাইরে মিটমাট করে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় কিছু এনজিও-ও একসময় সাহায্য করেছে, খোদ লালবাজারে বসে। তাদের নাম উহ্য রাখলাম।
পুলিশের মতো এই সমাজসেবী সংস্থাগুলোও কি পিতৃতান্ত্রিক ছিল? এরকমই এক সংস্থার কর্ণধারের সাথে একবার কথা হয়েছিল। বলেছিলেন — বেশিরভাগ স্ত্রীই প্রচণ্ড মার খাওয়ার পরেও স্বামীর শাস্তি চায় না। চায়, স্বামীকে পুলিশ একটু কড়কে দিক, যাতে সে আর মারধোর না করে। মূল উদ্দেশ্য — সুস্থভাবে সংসার করা, কারণ সংসার টিকিয়ে রাখাই যে মোক্ষ, তা মেয়েদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে আশৈশব। অন্যদিকে ৪৯৮/এ-তে কেস করলে এবং সেই কেস টেনে নিয়ে গেলে দীর্ঘসূত্রী বিচারব্যবস্থায় তারা মানসিক ও সামাজিকভাবে সহায়হীন হয়ে পড়ে। বেশিরভাগ নির্যাতিতরই মানসিক, সামাজিক, আর্থিক জোর থাকে না শেষ পর্যন্ত কেস লড়ে যাওয়ার। তাই বাধ্য হয়ে মিটিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হত।
এদিকে রেট অফ কনভিকশন বা দোষ প্রমাণ ও সাজার হার যেহেতু এইসব নানাবিধ কারণে কম, তাই ৪৯৮/এ ধারার সমালোচনা হতে থাকে একটি তুমুলভাবে অপব্যবহৃত আইন হিসেবে। কেস কাঙ্খিত লক্ষ্যে না পৌঁছলেই ধরে নেওয়া হয় তা ভুয়ো। ৪৯৮/এ-র বিরুদ্ধে শুরু হয় ‘পুরুষ অধিকার কর্মী’দের লড়াই।
এত ঘটনাপ্রবাহের মাঝে, ২০০৫ সালে ভারত সরকার সেন্টার অব সোশাল রিসার্চকে গৃহহিংসার বিষয়টিকে খতিয়ে দেখতে বলে। দেখা যায় পাঁচ কোটি বিবাহিত মহিলা গৃহহিংসার শিকার। কিন্তু কেস নথিভুক্ত হয়েছে মাত্র ০.১%, বা হাজারে একটি। ১০০টির মধ্যে ৮০টি ক্ষেত্রে অ্যান্টিসিপেটারি স্টেজে বা মহিলা-সেলে কেস মিটিয়ে নেওয়া হয়। বাকি ২০টির মধ্যে ১১-১২টি কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। এই সব সীমাবদ্ধতার কারণেও ডিভি অ্যাক্ট, ২০০৫ নামক সিভিল আইনের ধারাটির আগমন।
এবার ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো-র ২০০৬ থেকে ২০১৫ সালের খতিয়ান অনুযায়ী দেখা গেল, অপরাধ প্রমাণ ও সাজার হার হতাশাজনকভাবে কম ৪৯৮/এ ধারার ক্ষেত্রে। অথচ কেস ফাইল করার হার বাড়ছে প্রতিবছর। শুধু তাই নয়, প্রতিবছর ১০% হারে বাড়ছে ঝুলে থাকা বা পেন্ডিং কেসের সংখ্যা। ২০১৫ সালে দেখা গেল পেন্ডিং কেস ২০০৬ সালের দ্বিগুণের বেশি (৪.৭৭ লাখ ও ২.০৬ লাখ যথাক্রমে)। ২০০৬-এ সাজার হার ছিল ২১.৯%। কিন্তু ২০১৫ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১৪.২%। শুধু এইসব নথির উপর ভিত্তি করে ‘লিগাল টেররিজম’ আখ্যা দেওয়া হয় এই ধারাকে। ২০১২ সালের ল কমিশনের রিপোর্টে জানা যায়, ২৪৪ জন আইন সংক্রান্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন পদস্থ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল — এই ধারাটি বেইলেবল হওয়া উচিত কিনা। ১০০ জনই পক্ষে রায় দিয়েছেন।
অবশেষে ২০১৭ সালের জুলাই নাগাদ সুপ্রিম কোর্টে এ কে গোয়েল, ইউ ইউ ললিতের বেঞ্চ জনৈক রাজেশ শর্মার দায়ের করা উত্তর প্রদেশ সরকার-বিরোধী মামলায় এক অনভিপ্রেত রায় দেয়। অথবা ৪৯৮/এ বিরোধিতার ধারা দেখলে তা এতটাও অনভিপ্রেত নয়। রায়টি পরীক্ষামূলকভাবে ৪৯৮/এ-কে শিথিল করে। এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বলে, যখন দৃশ্যমানভাবে কোনও শারীরিক আঘাত থাকবে বা মৃত্যুর ঘটনা ঘটবে, তখনই পুলিশ একমাত্র চটজলদি ব্যবস্থা নেবে। এই রায় আরও নির্দেশ দেয়, জেলার আইনি পরিষেবা কেন্দ্রগুলির অধীনে ‘পরিবার কল্যাণ কমিটি’ গঠন করতে হবে। এই কমিটিগুলিতে নাগরিক সমাজের ব্যক্তিরা থাকবেন অভিযোগ যাচাইয়ের জন্য। স্পষ্ট শারীরিক নির্যাতনের চিহ্ন না দেখা গেলে, এই কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতেই নাকি পুলিশ এবং আদালত ব্যবস্থা নেবে। স্বয়ং পুলিশও যেখানে সংবেদনশীল নয়, সেখানে এহেন কমিটির হস্তক্ষেপে একটি চণ্ডীমণ্ডপীয় ব্যবস্থাই গড়ে উঠবে, বলা বাহুল্য। কমিটি পক্ষপাতিত্ব, দুর্নীতি ও লিঙ্গবৈষম্যমূলক মনোভাবের ধারক-বাহক হলেই বা কী হবে? এইসব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।
আরও বিস্ময়করভাবে, কেন্দ্রীয় মহিলা ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রক জাতীয় মহিলা কমিশনকে (এন সি ডব্লিউ) নির্দেশ দিয়েছে, যে সমস্ত পুরুষদের বিরুদ্ধে ৪৯৮/এ ধারায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে সেই ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ শোনার জন্য একটি ব্যবস্থা রাখতে হবে, যা এন সি ডব্লিউ-এর দায় বা দায়িত্ব নয়। অর্থাৎ এক সার্বিক পশ্চাদমুখী, পিতৃতান্ত্রিক সরকারের আমলে নারীর মানবাধিকার সুনিশ্চিত করার আইনকে ভোঁতা করে দেওয়া হল। অবশ্য এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে এই রায় পরীক্ষামূলকভাবে দেওয়া হয়েছিল এবং একই সাথে সর্বোচ্চ আদালত ৩১শে মার্চ, ২০১৮-র মধ্যে ন্যাশনাল লিগাল সার্ভিসকে এই বিষয়ে বিশদ রিপোর্ট পেশ করতেও বলেছিল।
অতঃপর, প্রতিবাদে সরব হল দেশের মহিলা সংগঠনগুলি। প্রধান বিচারপতি খেহরকে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করলেন সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির পক্ষে মারিয়াম ধাওয়ালে ও রীজা জয়াপ্রসাদ, সেন্টার ফর স্ট্রাগলিং উইমেন-এর পক্ষে মায়া জন, জনবাদী মহিলা সমিতির পক্ষে আশা শর্মা ও মইমুনা মোল্লা, গিল্ড অব সার্ভিসের পক্ষে মোহিনী গিরি ও রেশমা আরিফ, জয়েন্ট উইমেন্সের পক্ষে জ্যোৎস্না চ্যাটার্জি, হুসনা সুভানী ও পদ্মিনী কুমারসহ আরও কয়েকটি সংগঠনের প্রধানরা। সংগঠনগুলি দাবি করে, ৪৯৮/এ ধারাটিতে কোনও বদল ঘটালে কার্যত আইনটিই অকার্যকর হয়ে যাবে। এই ধারায় করা অধিকাংশ মামলাই মিথ্যা — এই অভিযোগ সাধারণভাবে দেশের মহিলাদের মিথ্যেবাদী হিসেবে দাগিয়ে দেয়। তাঁরা উল্লেখ করেন, সর্বোচ্চ আদালত সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছে মহিলাদের উপর মৌখিক এবং মানসিক অত্যাচারের বিষয়গুলিকে। অল্প কিছু ভুল অভিযোগের উদাহরণ তুলে ধরে এই আইনকে লঘু করলে বহু লড়াই-এর ইতিহাসকে অমর্যাদা করা হবে, তাঁরা বলেন। তাঁরা নথি তুলে দেখান যে, ২০০৫ এবং ২০০৯ সালে যত অভিযোগ এই ধারার অধীনে দায়ের করা হয়েছিল তার মধ্যে মাত্র যথাক্রমে ৮.৭৮% এবং ৭.০৮% অভিযোগই ভ্রান্ত ছিল। কমসংখ্যক দোষী সাব্যস্ত হওয়ার অর্থ মিথ্যা অভিযোগ — আদালতের এই যুক্তিকেও নস্যাৎ করে মহিলা সংগঠনগুলি। বরং তাঁদের মতে, দোষী সাব্যস্ত না হওয়ার কারণ যথাযথভাবে তদন্ত না হওয়া, প্রমাণ সংগ্রহ না করা, পুলিশের অসংবেদনশীলতা ও লিঙ্গবৈষম্য, সাক্ষীদের বাতিল করা ইত্যাদি।
এই আন্দোলন বৃথা যায়নি। বিচারপতিদের দৃষ্টিভঙ্গি দ্রুত বদলাতে থাকে। অক্টোবরে প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বেঞ্চ জানায়, এইরকম রায়ের কুপ্রভাব নারীসুরক্ষার উপর পড়বেই। ২০১৮ সালের এপ্রিলে আশ্বাস মেলে, ৪৯৮/এ-র পুনর্বিবেচনার রায়টি পুনর্বিবেচিত হবে। নারীবাদী আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিং উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন এই ক্ষেত্রে।
সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, গোয়েল সাহেবের রায়টি পুনর্বিবেচনার জন্য দীপক মিশ্রর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের কাছেই আসবে। আবার নারী-আইনজীবীদের সংগঠন ‘ন্যায়াধার’-এর ৪৯৮/এ-কে পুনরায় শক্তিশালী করার পিটিশনটিও দীপক মিশ্রর বেঞ্চই বিবেচনা করে দেখবে। যৌথ শুনানি আগামী ৯ই জুলাই তারিখে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, এই শুনানিতে যদি ৪৯৮/এ-কে তার আগের দাঁত নখ ফিরিয়ে দেওয়াও হয়, তাহলেও শুধুমাত্র বধূর শারীরিক নির্যাতনের বিরুদ্ধেই আইনকে শক্তিশালী করা হবে। মানসিক নির্যাতনের জন্য হাতে থাকবে শুধু সিভিল ধারাটি। আর যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রটির জন্য সুস্পষ্ট ধারা আনতে তো আরও অনেক আন্দোলন প্রয়োজন। বৈবাহিক ধর্ষণ এখনও ভারতীয় আইনের চোখে অবাস্তব। এমতাবস্থায় ৪৯৮/এ-কেও খর্ব করা মানে দু পা এগোনোর বদলে চার পা পিছিয়ে যাওয়া।
একটি আইনের ধারা নিয়ে আলোচনা করে আর কিছু পরিসংখ্যান মজুত করে আসলে গৃহহিংসার ব্যাপ্তি সঠিকভাবে অনুধাবন করা যায় না। হয়ত পরে কখনও গৃহহিংসার ডায়নামিক্স নিয়ে আলোচনা করা যাবে। আপাতত এটুকু বলা যায় যে গৃহহিংসা এক বিশ্বজনীন মহামারী। অত্যাচারিত এক্ষেত্রে সেই মানুষটির দ্বারাই নির্যাতিত হচ্ছে যাকে হয়ত সে ভালোবাসে, বার বার বিশ্বাস করে ফেলে। একশোটার মধ্যে নব্বইটা গৃহহিংসার কেসেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে দেরি হয় বা মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বেরিয়ে আসা যায় না। অনেক সম্পর্কেই বিষয়টা শুধুমাত্র দিনের পর দিন মারধোরের হয় না। মাঝে থাকে অনেক ভালোবাসার মুহূর্ত, তথাকথিত ‘ভুল বোঝাবুঝি মিটে যাওয়া’, ক্ষমা চাওয়া, আদরযত্ন — যা বিষয়টিকে আর পাঁচটা অপরাধ থেকে পৃথক করে। গৃহহিংসা বিষয়ক নিরলস কাজ করে চলা এক পুরুষ মনোবিদ লান্ডি ব্যাংক্রফট এসব বলছেন। ‘সাইকল অফ ভায়োলেন্স’-এর ডায়াগ্রামও তিনিই আঁকেন।
এই সাইকলে একবার ঢুকে পড়লে হানিমুন ফেজ > টেনশন ফেজ > ভায়োলেন্ট ফেজ > হানিমুন ফেজ > টেনশন ফেজ > ভায়োলেন্ট ফেজ ঘূর্ণাবর্তের মতো চলতে থাকে। নির্যাতিত বেরোতে বা মুখ খুলতে পারে না। মৃত্যুর বা চূড়ান্ত হতাশার অতলে তলিয়ে যায়।
ঘূর্ণাবর্ত যাকে অতল সমুদ্রের তলদেশে আছড়ে মেরে ফেলল, বা যে কোনওরকমে খড়কুটো আঁকড়ে বেঁচে ফিরল, দেশের আইন তাদের পাশে সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়াবে না? ন্যায় দেবে না তাদের?