আশরাফ জুয়েল
“ঐ চুতমারানির পোলা, কি অয়ছে? আমি কি তর বাপের লগে শুইতে গেচি? ভাগ খানকির পোলা, রাস্তা মাপ। এই সক্কাল রাইতে ভজর ভজর চোদাইতে আইচে, ফাল পাড়বি তো গুয়ার ভিত্রে…”
(এই ধরণের উপভাষা দিয়ে যখন একটা গল্প আরম্ভ হয় তখন সেই গল্পের গতিবিধি, এমন কি এর অন্তিম পরিণতি কী তা অনুমান করা কিছুটা সহজ হয়ে যায়। গল্পের এমন একটা অবস্থায় পাঠকের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে তিনি কোন ধরণের সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে যাবেন– এক্ষেত্রে পাঠকের সম্ভাব্য সিদ্ধান্তসমূহ জেনে নেবার চেষ্টা করা যেতে পারে–
ক। অশ্লীল শব্দ ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে গল্প পাঠে বিরত থাকা।
খ।
গ।
ঘ। শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও গল্পটার সাথে খানিকটা এগিয়ে যাওয়া।
একজন লেখক সব সময় আশাবাদী মানুষ, তাই ‘ঘ’-কে পাঠকের সম্ভাব্য সিদ্ধান্ত ধরে নিয়ে সম্মানিত পাঠক এবং গল্পটির সাথে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।)
শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে টি এস সি-র দিকে তাকালে প্রথমে কী কী চোখে আসে? বামে তাকালে ফুল মার্কেট, ডানে যাদুঘরের গেট। আরেকটু এগোলে ডানে পাবলিক লাইব্রেরী, বামে শাহবাগ থানা, আর খানিকটা এগোলে বামে ময়লা ফেলার ভাগাড়, ডানে চারুকলা, দৃষ্টিকে আরও খানিকটা দূরে ছুঁড়ে মারলে বামে ছবির হাট, ডানে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সামাধিস্থল। কী অদ্ভুত! ফুল মার্কেট, যাদুঘর, পাবলিক লাইব্রেরী, থানা, চারুকলা, ময়লা ফেলার জায়গা, ছবির হাট, নজরুল ইসলামের সামাধিস্থল! কারও সঙ্গে কারুরই কোনও সামঞ্জস্য নেই তবু এরা নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে, মানিয়ে নেয়া শিখেছে, শিখে নিতে হয়েছে। এই গল্পের প্লট টি এস সি মুখী নয়। বরং আজিজ’কে পেছন করে দাঁড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকলে যা যা চোখে পড়বে– তাদের পাশ কাটিয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে মৎস্য ভবনের দিকে। শিশু পার্কের বিপরীতে ঢাকা ক্লাব! এক পা দুই পা করে আরও খানিক এগিয়ে গেলে দেখা যায়– হ্যাঁ এই জায়গাটাতে রমনা পার্ক-সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, পরস্পরকে চুমু দেয়ার ভঙ্গিতে ঠোঁট বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু চুমু দেয়া হচ্ছে না। ঠোঁটের মাঝ বরাবর পিচ ঢালা ঢাকার নৃশংস রাজপথ। এই– এই জায়গাটা হচ্ছে এই গল্পের প্লট। সোহরাওয়ার্দীর দিকে মুখ হা করে দাঁড়িয়ে থাকা ফুটপাত, মানে রমনা’র গা ঘেঁষে আছে যে ফুটপাত তাকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে একটা খুপরি। খুপরিটাকে কেন্দ্র করে একটা সংসার ঘুরপাক খায়। সদস্য– সখিনা সঙ্গে পাঁচ ছয় জন বাচ্চা, একটা লালা, লালার বাচ্চারা, আর অসংখ্য খদ্দের, ভাতের খদ্দের, ভাতারের খদ্দের নয় কিন্তু।
কোলাহল জুড়ে নীরবতা –– প্রথম
–‘পাঁচডা নেড়ি কুত্তা, তিনডা মাগী, দুইডা মদ্দা, তাগো চ্যাইরডা পুলাপাইন, আমরা অগুনতি টোকাই, বাপ ফুঙ্গির পুতেরে অনেকেই দেহি নাই’-– ছেলেটির বয়স অনুমান অযোগ্য। তবে কৈশোরকাল পেরুতে পারেনি এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তাকে কেন্দ্র করে আরও কয়েকজন ছেলে-মেয়ে-শিশু। এক পাশে লালা তার সংসার সামলাতে ব্যস্ত।
–‘মায়ে রাইতের আন্ধারে চান্দা দিতে যায়’– পাশ থেকে কুচি করা সুতির হাফপ্যান্ট পরা একটা শিশু মেয়ে এ কথা বলে উঠল। হাফ প্যান্ট তার একমাত্র পোশাক।
–‘কে চান্দা নেয়?’– একেবারেই ছোট যে, যে ছেলে না মেয়ে তা বোঝা যায় না– সে এ কথা জিজ্ঞেস করল।
–‘মস্তানে নেয়’-– পাশ থেকে আরেকজন বলল।
–‘ডাণ্ডা হাতে আহে’ যার বয়স অনুমান অযোগ্য সে বলে উঠল।
–‘মুখে নাম নেয়া মানা, এমুন গন্নিমান্নিও আহে, মায়ে কইছে’-– যেন কোনও অমোঘ সত্য বর্ষিত হচ্ছে এই জটলাকে কেন্দ্র করে। লালার বাচ্চারা কুঁই কুঁই করছে। বাচ্চারা খেতে পাচ্ছে না বলে মাঝে মাঝে চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিচ্ছে শাহবাগের দিকে।
–‘মাজে মইদ্দ্যে চকচকা গাড়ি থিক্কা সাহেব লাহান লুকজনও নামে’– বর্তমান ভাবছে এই সব কোলাহলের জন্য পৃথক পৃথিবী খুলবে। কাকরাইল মসজিদ থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসে। সকলে চুপ মেরে যায় এই সময়টাতে। যথারীতি আজান শেষ হলেই আরম্ভ হয় কথোপকথন।
–‘মায়েরে নাকি সবডিরে চান্দা দিতে অয়?’ কে যে এ কথা বলে উঠল তা ঠাহর করা গেল না।
–‘ভোর বেলায় ঢলতে ঢলতে মায়ে আমাগো লাইগ্যা খাবার নিয়া আহে, খাবার খাওয়াইয়া আবার ভাত রানতে বহে। ভাতের ব্যবসা আরম্ভ না করলে তো পুলিশে ঘর ভাইঙ্গা দিবো, হালার পুলিশ’– কোনও কিছু না বুঝেই কথাগুলো বলে ফেলে পানের পিকের মতো ফ্রক পরা মেয়েটি (ফ্রকটির আদি রঙ ঠাহর করা যায় না), বলেই টের পায় সঠিক কথা সে বলেনি, এদিক ওদিক তাকায়, কাছেপিঠে কোনও পুলিশ টুলিশ দেখা যায় কিনা!
–‘তার পরেও তার মুহে চান্দের হাসি কতা কয়’– বড় ছেলেটি বলল এ কথাগুলো।
পাশে অলস ভঙ্গিতে শুয়ে আছে লালা, বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজের বাচ্চাদের দিকেও তাকায় সে। মায়াভরা দৃষ্টি লালার। আজ তার ভাগে বাচ্চাদের দেখে রাখার দায়িত্ব। লালার সঙ্গে সখিনার ভাগাভাগির সংসার! সংসারই তো। লালা যখন থাকে না তখন জরিনা তার বাচ্চাগুলোকে দেখে রাখে, আর সখিনা না থাকলে লালা। এটা নিয়ম হয়ে গেছে। দুই পক্ষই এতে খুশী।
জরিনা ভাত বেচতে গেছে। দোকান শাহবাগে। শাহবাগ নিজে ভ্রাম্যমাণ কিন্তু সখিনার ভাতের দোকান ফিক্সড। জাদুঘরের গেটের সামনের সড়ক-দ্বীপ হল সখিনার দোকান। রিকশা প্যাডেল ঠেলতে ঠেলতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া মানুষগুলো তার ভাতের খদ্দের। সকাল সাড়ে বারোটা থেকে বিকাল তিনটা পর্যন্ত ভাতের ব্যবসা। তার পর একটু বিশ্রাম। এরপর রাতের জন্য প্রস্তুতি। দীর্ঘ রাতের জন্য প্রস্তুতি। ক্লান্তিহীন রাতের জন্য প্রস্তুতি। ভাতারের জন্য নয়, ভাতের জন্যও নয়– কয়েকজন ছেলে-মেয়ে এবং লালার বাচ্চাদের খাবারের জন্য রাত জাগার প্রস্তুতি। রমনার ফুটপাতের খুপরি টিকিয়ে রাখার জন্য রাত জাগার প্রস্তুতি। সখিনা’র মনে হয় দিন বলে পৃথিবীতে আসলে কিছু নাই। অন্ধকারের বিশ্রামে পৃথিবী সূর্যকে নিজের মুখটা মাঝেমাঝে দেখিয়ে যায় আর কি! না হলে তো সূর্য মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়।
অতীত পৃষ্ঠা থেকে – দ্বিতীয়
মোসাম্মৎ সায়রা খাতুন থেকে নামটা হঠাৎ মোসাম্মাৎ সায়রা বেগম হয়ে গেল। মা কী জন্য সেই বয়সে বিয়ে দিয়েছিল তা সায়রা জানত। ছেলে নাকি ভালো। ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করে। নিজে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসে ছেলে বিয়ে করে বউ নিয়ে যাবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার এক অজ গ্রামের বাপ না থাকা মেয়ের মায়ের কাছে এটাকে খুব বড় সুযোগ বলে মনে হয়েছিল। আর ছেলের বাড়িও তো পাশের গ্রামেই– জানাশোনা। তাই কোনও দ্বিধা কাজ করেনি। সায়রা খাতুন একেবারেই যে গ্রাম ছেড়ে আসতে চায়নি তাও না, ঢাকা শহর দেখবে, ভেতরে ভেতরে এ উত্তেজনা কাজ করেনি এ কথা বলা যাবে না। ঈদের তিনদিনের মাথায় তড়িঘড়ি করে সায়রা স্বামী সেকান্দর-এর সঙ্গে ঢাকা এসেছিল। ঢাকা মানে টঙ্গী। দেড় রুমের একটা বাসাতেও উঠেছিল। রান্নাঘর আর বাথরুমটা ছাড়া বাসাটা পছন্দ হয়েছিল সায়রার। রান্নাঘর আর বাথরুমটা কয়েক ঘরে ব্যবহার করতে হয়। স্বামী সেকান্দর বলেছিল খুব দ্রুত তারা আলাদা বাসা নেবে, বলেছিল সায়রা যদি তার কথা শোনে তাহলে খুব তাড়াতাড়ি নতুন বাসায় উঠবে তারা। তাজ্জব বনে গেছিল সায়রা খাতুন– স্বামীর কথা শুনবে না সে? স্বামীরা কেমন হয়– এ অভিজ্ঞতা সায়রার জীবনে আগে কখনও হয়নি। তাই বলতে পারবে না। তবে লোকটা স্বপ্ন দেখত। বিচিত্র ধরণের স্বপ্ন। এর ভেতর সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল বিদেশ যাবার স্বপ্ন।
কোলাহল জুড়ে নীরবতা — তৃতীয়
মাঝেমাঝে লালা খুব চিন্তায় পড়ে যায়। যখন সখিনা খুপরিতে ফিরে আসে তখন সে তার এক দঙ্গল বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে বের হয়। জরিনার মতো তার গন্তব্যও শাহবাগ। মাঝেমাঝে সে ঢুকে পড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ভাগ্য ভালো হলে মাঝে মাঝে শিখা অনির্বাণের আশেপাশে কিছু উচ্ছিষ্টাংশ পেয়ে যায়, নিবিষ্ট মনে বাচ্চাগুলোর খাওয়া দেখে সে, তার প্রাণ জুড়িয়ে যায়। মাঝে মাঝে শিখা অনির্বাণ লালাকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেয়। সেদিন সে ঘোরাঘুরি করে ছবির হাটে– ছবির হাট তার বাচ্চাদের শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেয় না, সেখানে প্রায়ই এক কবি তার পাউরুটির ভাগ দেয় লালার বাচ্চাদের। লালা ঐ কবির প্রতি কৃতজ্ঞ। যেদিন কবিকেও পায় না সেদিন বাধ্য হয়েই শাহবাগ থানার গেটের কাছে যে ময়লার ভাগাড় আছে সেখানে যেতে হয় লালাকে, ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও। সেখানে এর ওর সাথে ঝগড়াঝাঁটি করে খাবার আদায় করতে হয় লালাকে। কবে যে বাচ্চাগুলো বড় হবে– নিজেদের দেখভাল নিজেরা করবে?
সখিনার জন্য ইদানীং খুব চিন্তা হয় লালার। প্রতি রাতে জেগে থাকলে কী ভাবে নিজেকে টিকিয়ে রাখবে জরিনা? এসব ভাবতে ভাবতে লালা বেরিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের ভেতর সখিনা ফিরে আসবে। লালা বাচ্চাদের নিয়ে শাহবাগ থানা সংলগ্ন ময়লার ভাগাড় তন্ন তন্ন করে হাতড়ায়। আজ কোনও উচ্ছিষ্টাংশ উদ্ধার করতে না পেরে খুব অসহায় বোধ করে সে। শালা মানুষগুলো কি সবই খায় আজকাল? মন খারাপ করা ভঙ্গিতে সে বসে থাকে জাদুঘরের গেট সংলগ্ন ফুটপাতে। বাচ্চাগুলো খাবার না পেয়ে ঘেউ ঘেউ করছে। এমন সময় ছবির হাট ফেরত কবিকে দেখা যায়। বাচ্চারা একটু নড়ে চড়ে বসে। এবার বুঝি কবির পাউরুটি থেকে কিছু ভাগ পাওয়া যাবে। লালার লজ্জা লাগে খুব– একজন কবির খাবারে এভাবে ভাগ বসাতে। অবশ্য লালা তো নিজে থেকে কোনও দিন চায়নি। কবি নিজেই লালার বাচ্চাদের দেখে তার নিজের খাবারের অংশ খেতে দেয়। জরিনার ভাত বেচতে আসার সময় হয়ে গ্যাল। এখুনি ফিরতে হবে খুপরিতে– জরিনা দিনের বেলা ভাত বিক্রির ব্যবসা করে, ভাতারের নয়। অবশ্য খুপরি এবং তার বাচ্চাদের এবং লালার বাচ্চাদের বাঁচাতে জরিনাকে রাত জাগতে হয়। সখিনা বলে পৃথিবীতে দিন বলে আসলে কিছু নেই। পুরোটাই রাত— অন্ধকার। পৃথিবী তো আদতেও সূর্যের কেউ হয় না। লালা অবাক হয়ে ভাবে এসব কথা। ভাবতে ভাবতে তার ভাবনারা এলোমেলো হয়ে যায়।
(গল্প এগোতে চায় না কিছুতেই, অনেক অনেক আলস্য পেরিয়ে আবার সচল হয় চিন্তার দানা–– এসে দাঁড়ায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটের বিপরীতের ফুটপাতে-– গল্পের প্লটে জরিনা/সখিনা লেখককে ফিরিয়ে নিয়ে যায় এইট পাশ সেকান্দরের স্মৃতিতে, সেকান্দর)
অতীত পৃষ্ঠা থেকে -– চতুর্থ
সেকান্দর, পড়াশোনা খুব বেশী করেনি। ভাব চলনে সেটা সেকান্দর বুঝতে দেয় না। এইট পাসের সেকান্দরকে তাই মনে হয় আই এ-বি এ পাসের সেকান্দর। হ্যাঁ সেকান্দর! সায়রার স্বামী সেকান্দর। সেকান্দরের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন সে বিদেশ যাবে। এই লক্ষ্যে সে দিনরাত কাজ করে। বাড়ি ফিরে আবার ফিরে না, খায় আবার খায় না, ঘুমায় আবার ঘুমায় না, টাকা জমায় আবার জমায় না। সে বিদেশ যাবেই যাবে। এক রুমের সংসার মানিয়ে নেয় সায়রাকে। সায়রাও। খারাপ লাগে না। মাঝে মাঝে সেকান্দর তাকে সিনেমা দেখতে নিয়ে যায়। সায়রার সিনেমা দেখার স্বপ্ন সে পূরণ করেছে– কম বড় কথা। সেকান্দারের প্রতি সায়রা কৃতজ্ঞ। সেকান্দার মাঝে মাঝেই সায়রাকে বলত– নতুন বাড়ি নেবে, তার আগে একবার বিদেশ যাবে সে, এয়ারপোর্টের পেছনের দিকে নিয়ে যায় সায়রাকে যেখান থেকে বিমানগুলোর উঠা নামা দেখা যায়– রাতের বেলা বিমানগুলোর উঠানামা দেখতে কি যে ভালো লাগত সায়রার! বেশি ভাল লাগত সেকান্দরের।
‘কি কর সায়রা বিবি?’ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা সেকান্দারের অভ্যাস। অভ্যাসটা সেকান্দার খুব যত্ন করে গড়ে তুলছে। এই সময়ে বাড়ি ফিরতে দেখে খুব অবাক হয় সায়রা। এমন সময়ে তো তার ফিরে আসার কথা না।
‘আপনি? কুণ্ঠে থ্যাক্যা অ্যালেন? এমন সময়ে তো আপনার আসার কথা লয়’
‘কি বল সায়রা? আমার বউয়ের কাছে আসবো-– কাকে জিজ্ঞেস করতে হবে আবার?’
‘না আপনি তো এ সমোয়ে বাড়ি ফির্যা আসেন না, তাই কহছি’
‘সায়রা বিবি চাঁপাই এর ভাষায় কথা বলা চলবে না তোমার, তুমি এখন ঢাকা শহরে থাকো, তুমি সেকান্দারের বউ। আর আমি বিদেশ গেলে তো তোমার মনে কর যা ইচ্ছা তাই’
‘মানে? বিদ্যাশ য্যাছেন আপনি?’
‘হ্যাঁ। কাছে আসো তো এদিকে একটু’
‘কি কহিছেন আপনি?’
‘কেন? বউকে তো আদর করতে ইচ্ছা করে আমার, বিদেশটা যাই আগে’
‘খালি বিদ্যাশ বিদ্যাশ করেন কেনে আপনি?’ ইদানীং সায়রা বেগম একটু আধটু রাগ করাও শিখেছে।
‘আরে বিদেশ গেলেই তো অনেক টাকা। সেখান থেকে ফিরে এসেই তো আমরা স্বপ্নের ঘর বানাব।’
সেকান্দর কাছে টেনে নেয় সায়রাকে। সায়রা নিজেকে সমর্পণ করে সময়ের কাছে। দিন এভাবেই চলছিল। হঠাৎ একদিন সেকান্দার খুশীতে টগবগ করতে করতে বাড়ি ফেরে, বউকে জড়িয়ে ধরে। তার হাতে ছোট নীল একটা বই। সায়রা পরে জানতে পারে এটা দিয়েই নাকি বিদেশ যাওয়া যায়। স্বামীর সাফল্যে তার বুক গর্বে ফুলে ওঠে।
নিয়মের জগত — সত্য
‘কি অয়চে রে, মায়ে আসতাচে না ক্যান?’
‘আয়বো, খারা না, মনে লয় মায়ে ভাত বেইচ্যা শ্যাষ করবার পারে নাই’
‘তাইলে কি অয়বো বাই? খিদা লাগচে তো!’
‘মায়ে না আয়লে তো খাইতে আরুম না’
‘হ’
‘ল, মায়েরা দেইখ্যা আহি, শাহবাগে থে ঘুইরা আহি চ’
‘কিন্তু মায়ে যে মানা করচে’
‘ইট্টু দেইখ্যা লই, কি কস বাই?’
‘বুইন ডি আমার! খুব খিদা লাগচে? তুই বয় ইট্টু, দেহি কিছু আনতে আরি কি না?’
‘কান্দিস না সোনা বুইন আমার, মায়ে চইল্যা আয়ব তো, দেহিস তোর লাইগা চক্লেট আনবো মায়ে।’
‘হহ তোরে কয়চে?, মায়ে আনবো ভাত, ভাত বুঝস, ভাত খাইলে প্যাট ভরে, চক্লেট খাইলে প্যাট ভরে না, ভাত খামু, ভাত, খুব খিদা লাগচে’
‘আচ্ছা বাই মায়ে তো দিনে ভাত ব্যাচে, রাইতে কি অরে? কইতে আরবা বাই?’
‘কি হরব আবার, কাম হরে’
‘কি কাম হরে বাই?’
পাঁচ-ছয় জন বাচ্চা নিজেদের মাঝে এভাবেই কথা বলে। নিজেদের চেনার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যায় তারা। এদের মধ্যে যে সবচেয়ে বড়, ছেলেটি যানবাহনের ফাঁক খুঁজে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে যায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউটের গেটের সামনের চায়ের দোকানে। ফিরে আসে কিছুক্ষণ পরে। একটা বনরুটি নিয়ে, চোখমুখে উজ্জ্বল হাসি। সে পাউরুটি নিয়ে এসেছে তার ভাইবোনদের জন্য। নিজের প্রতি তার আত্মবিশ্বাস বাড়ছে। মনে হচ্ছে মা না থাকলে হয়তো সেও পারবে। নিজেরা ভাগাভাগি করে খেতে গিয়ে কয়েক টুকরা পাউরুটি এগিয়ে দেয় লালার বাচ্চাদের দিকে। ওদেরও তো ক্ষিধা লাগে। লালা অবাক বিস্ময়ে দেখে কত নিবিড় সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে বাচ্চাগুলো। লালার বাচ্চারা কুই কুই করে খায় পাউরুটির অংশ বিশেষ। লালার নিজেরও খুব ক্ষিধা লেগেছে। সখিনা ফিরে এলে সেও বেরিয়ে পড়বে বাচ্চাদের নিয়ে। আজ তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হবে লালাকে। আজ রাতে তাকে ডিউটি করতে হবে। আজ রাতে পুলিশ আসবে। আজ রাতে চান্দা নিতে আসবে পুলিশ, টকা না পেলে শরীরের চান্দা নেবে। লালা ভাবে সে নারী হলে মাঝেমাঝে সখিনাকে রেস্ট দিত, সখিনার বদলে সেই না চান্দার বদলে শরীর দিত। কিন্তু তা তো হবার নয়, তাই সেই সময়টায় লালা ইচ্ছা করেই ডিউটি নেয়, খুব সতর্ক থাকে সেই সময়টায়, একটু উল্টাপাল্টা বা বাড়াবাড়ি দেখলেই সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। যদিও সখিনার ভয় ডর বলে কিছু নেই। এ মেয়ে গোটা দুনিয়া বিক্রি করা মেয়ে! জরিনার সঙ্গে থাকতে থাকতে কেন যেন একটা দায়বদ্ধতা তৈরি হয়েছে সখিনার জন্য। সখিনা আছে বলেই হয়তো লালাও তার বাচ্চাদের নিয়ে থাকে এই ফুটপাতে।
জগতের নিয়ম — মিথ্যা
সায়রা খাতুন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল, নিজের দোষে নয়। কোথায়? তার কোনও হদিস সে নিজে নিজেকেই দিতে পারেনি। দেবে কীভাবে? জানতই না সে কোথায়? ঠিক কতটা সময় আলোর মুখ দেখেনি তা স্পষ্ট করে বলতে পারেনি। পারবেই বা কীভাবে? অবশেষে একটা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাদের। সুনসান পরিবেশ, আশেপাশে লোকালয় আছে বলে মনে হয় না। মাঝেমাঝে কিছু মানুষের ফিসফাস কথা শোনা যেত। স্পষ্ট ছিল না কথাগুলো, মুখগুলোও তেমনই অস্পষ্ট। এমন অদ্ভুত এবং ভয়ঙ্কর কথা সায়রা কোনওদিন শোনেনি। মানুষের চেহারা এতটা ভয়ংকর হতে পারে, কারও কণ্ঠ এত কর্কশ হতে পারে? মানুষ সম্পর্কে এমন কোনও ধারণা ছিল না সায়রার। সেকান্দরের শেভ করা মুখটা তার খুব মনে পড়েছিল সে সময়। সেকান্দর বলত সে বিদেশ যাবে, সেকান্দর বিদেশ গিয়ে তাকেও বিদেশ নিয়ে যাবে। আচ্ছা সেকান্দর তো পাসপোর্ট করেছিল? সে কি বিদেশ গেছে? সায়রার তো কোনও পাসপোর্ট ছিল না। তাহলে? কোথায় সে? ছোট ঘরের অন্ধকারে আটকে গেছে সায়রার ভাবনা। সায়রা আন্দাজ করার চেষ্টা করে, কিন্তু তার আন্দাজ তীর খুঁজে পায় না। বর্ষার ভরপুর নদীতে দিক হারা নৌকার মতো ঘুরপাক খেতে থাকে। আন্দাজ করতে পারবেই বা কীভাবে? যে মেয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মফস্বলের একটা থানা নাচোল থেকে এসে শহর বলতে শুধুমাত্র টঙ্গীকেই বুঝেছে সে কীভাবে ঠাহর করতে পারবে যে সে এখন কোথায়? সম্ভবত সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। সম্ভবত বলার কারণ এই ছোট ঘরে এমনিতেই আলো ঢোকা নিষেধ। দরজা জানালা সব বন্ধ। কিন্তু সায়রা টের পাচ্ছে যে সন্ধ্যা নামছে, সন্ধ্যার নিজস্ব একটা গন্ধ আছে, সেই গন্ধ শুঁকে শুঁকে সায়রা টের পাচ্ছে যে সন্ধ্যা নামছে। এর পরেই রাত, রাত মানেই অবিশ্বাসী অন্ধকার, অন্ধকারের ডানায় চড়ে নেমে আসবে ভয়। সায়রা মনে করার চেষ্টা করছে আসলে কি ঘটেছিল, হ্যাঁ, মনে পড়ছে। সেকান্দর কোথায় যেন বেড়াতে যাবার কথা বলে তাকে নিয়ে বেরিয়েছিল বাড়ি থেকে। কোথায় যাবে সেটা বলেনি। সায়রা স্বামীকে জিজ্ঞেসও করেনি কোথায় নিয়ে যাবে তাকে। করবেই বা কেন? সেকান্দর তো তার স্বামী। তবে বাসে উঠে সিটে বসার পর সেকান্দর একটা ডাবের পানি খাইয়েছিল, এটুকু মনে আছে শুধু।
(এই অবস্থায় লেখক নিজেই পাঠক সেজে বহুবার পড়েন গল্পটা। লালা নামক চরিত্রটা গল্পটাকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে।)
জীবন বৃত্তান্ত — প্রথম
সখিনার সঙ্গে লালা প্রায় সাত মাস। উদ্দেশ্যহীন ভাবে লালা এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করত; কখনও শাহবাগ থানার সঙ্গে লেগে থাকা ময়লার ভাগাড়ে, কখনও শিশু পার্কের সামনে, কখনও বা দোয়েল চত্বরের ওদিকটায়। টি এস সি বা হাইকোর্টের ওদিকে খুব কম যেত লালা। ওদিকে প্রতিযোগিতা বেশি, টিকতে পারবে কি না তা বুঝে উঠতে পারত না লালা। লালা আগে থাকত গুলশানের দিকে। কিন্তু ঐ এলাকায় লড়াই বড়লোকদের সঙ্গে। আভিজাত্য রক্ষার্থে কর্তৃপক্ষ ঐ এলাকা থেকে সব বেওয়ারিশদের তাড়িয়ে দিয়েছিল। ব্যাপারটা লালার কাছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতোই মনে হয়েছিল। কিন্তু কিচ্ছু করার সামর্থ্য তার ছিল না। ঘুরতে ঘুরতে সে এসে পড়েছিল শাহবাগ এলাকায়। এই এলাকার সুবিধা দুইটা। এক– এখানে কিছু মানুষ বাস করে। দুই– থাকার জন্য আশেপাশে বেশ ফাঁকা এলাকা আছে, আছে দুইটা পার্ক। একদিকে রমনা পার্ক, আরেকদিকে সোহরাওয়ার্দী। কিন্তু এগুলোর কোনটার কারণেই লালা এখানে থাকেনি। থেকেছে মূলত বাচ্চাগুলোর জন্য। বাচ্চাগুলো যদিও তার ঔরসজাত নয়। কিভাবে যেন তারা জুটে গেছিল, লালা তাদের তাড়িয়ে দেয়নি। সঙ্গে সঙ্গে রেখেছে– বাচ্চাগুলো লালাকে বাপ বানিয়ে নিয়েছে। আরেকদিনের ঘটনা খুব মনে পড়ছে লালার। খাবারের খোঁজে একদিন লালা বাচ্চাদের নিয়ে পাবলিক লাইব্রেরীর সামনের ডাস্টবিনে ঘোরাঘুরি করছিল। হঠাৎ সে দেখে একটি সদ্যোজাত বাচ্চা, মানুষের বাচ্চা। নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কয়েকটি কাক ঘিরে ধরেছে সদ্যোজাত বাচ্চাটাকে, ঠোকর মারছে, রক্তাক্ত করে ফেলেছে বাচ্চাটাকে। লালা গিয়ে বাচ্চাটার পাশে দাঁড়িয়েছিল। এ শহরে কাক একছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আছে। অত্যাচারী হয়ে উঠেছে দিনে দিনে। কাকগুলো লালাকে দেখে সরে গেছিল বাচ্চাটার আশ পাশ থেকে। কোনও পাষাণহৃদয় কুমারী মা হয়ত বাচ্চাটাকে ফেলে পালিয়েছে। লালা ফেলে যেতে পারেনি। সে ভেবে পাচ্ছিল না এই মানুষ বাচ্চা ফেলে রেখে সে কীভাবে যাবে। এদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। শহরের রাত মানেই অন্ধকার, তা যত উজ্জ্বল আলো জ্বলুক না কেন! এমন সময় শাহবাগের দিক থেকে একজন মেয়েলোককে আসতে দেখেছিল লালা। মেয়েলোকটি ময়লার ভাগাড় সংলগ্ন ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল টি এস সি-র দিকে। ময়লার ভাগাড়ে পড়ে থাকা বাচ্চাটির মিহি সুরের কান্না শুতে পায় মেয়েলোকটি। থমকে দাঁড়ায় ফুটপাতে। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ময়লার ভাগাড় থেকে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেয়, কোলে তুলে নিয়ে বুকে জড়ায়, যেন এটা তার নিয়মিত কাজের একটা অংশ, যেন এটা সে দীর্ঘদিন থেকে নিয়মিত করে আসছে। লালার চোখে পানি চলে আসে। মেয়েলোকটাকে লালার ভালো লেগে যায়। মেয়েটিকে অনুসরণ করে লালা। বাচ্চাদের নিয়ে মেয়েটির পেছনে পেছনে– যার কোলে হঠাৎ পাওয়া একটা মানুষ-বাচ্চা, লালা সোহরাওয়ার্দি উদ্যান হয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটের গেটে এসে দাঁড়িয়েছিল। মেয়েটি রাস্তা পার হয়ে ফুটপাতের খুপরিতে ঢুকে পড়েছিল। ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটের গেটের বাম পাশে বেশ কয়েক দিন ছিল লালা। বাচ্চাদের নিয়ে মাঝে মাঝে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘুরতে যেত, সেখান থেকে ছবির হাট। সাহস করে একদিন বাচ্চাদের নিয়ে রাস্তার ওপারে মানে রমনা পার্কের সাইডের ফুটপাতের খুপরির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল লালা। দুই একদিন ঘুরঘুর করেছিল ফুটপাতের খুপরির আশেপাশে। দুই একবার খুপরি প্রধান সেই মেয়েলোকটার চোখাচোখি হয়েছে। লালা লক্ষ করেছিল এই মেয়েলোকটি তাকে এবং তার বাচ্চাদের তাড়িয়ে দেয় কিনা? কিন্তু না, মেয়েলোকটি তাকে তাড়িয়ে দেয়নি বরং তার চোখে আশ্রয় দেখেছিল লালা। ধীরে ধীরে তাদের ভেতর, তার বাচ্চাদের সাথে মেয়েলোকটির বাচ্চাদের একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মাঝে মাঝে লালা আর সখিনা নিজেদের মাঝে সুখ দুঃখের কথা চালাচালি করত। দুই জনের উচ্চারণ আলাদা, কিন্তু ভাষা একই– ওরা খুব সহজেই একে অপরের কথা বুঝতে পারত, যদিও প্রথম প্রথম বুঝতে অসুবিধা হত।
জীবন বৃত্তান্ত –– সর্বশেষ
‘শোন বুইন, আমরা কলাম অনেক বড় হমু, অনেক। মায়ে দ্যাখস না কত কষ্ট করে আমাগোর লাইগ্যা?’
‘হ বাই, অনেক বর হমু, ঢাহা কেলাবের লাহান বর?’
‘ওই তুই চুপ হরবি? বাই, আমরা কলাম শিশু পার্কের ট্রেনের চাইতেও বড় হমু।’
‘বুইন হোন তোরে পড়াশুনা করামু, বুজ্জছস?’
‘কিয়ের পরাশুনা?’
‘বুইন তরে হাসিনা ম্যাডাম বানামু, খালেদা ম্যাডাম বানামু।’
‘বাই, ওরেই খালি বেশী বালোবাসো ক্যান?’
‘নারে বাই হকলরে বালোবাসে।’
‘তোরা আমার ভাই-বুইন, আমি বালবাসুম না তো কে বাসবো? ক?’
‘বাই, বর লুকেরা কি হারাপ?’
‘হ, হারাপই তো’
‘বড় লুকেরা কি সব ঢাহা কেলাবে থাহে, ভাই…’
‘মনে অয়’
পাঁচ ছয় জন শিশু, এদের মধ্যে যে বড় সে ছেলে, বাকি সবাই তাকে ভাই ডাকে, বাকিদের মধ্যে সবচেয়ে যে ছোট– মেয়ে, তার বয়স সাড়ে তিন বছর, অন্য সবাই তাকে খুব ভালোবাসে। তাকে ঘিরেই তাদের সমস্ত স্বপ্ন ঘোরপাক খায়, আগামীর ঘোড়া যেন সেই সাড়ে তিন বছরের মেয়ে শিশুটি। এখানে যে কয়জন শিশু আছে তাদের প্রত্যেকের বয়স পাঁচ থেকে সাড়ে তিনের ভেতর। সখিনা এদের মা। আসলে বাচ্চাগুলো কেউই জরিনার নিজের বাচ্চা না– কিন্তু মা। হ্যাঁ ওদের মা। কিভাবে যে এদের পেয়েছে জরিনা– শুধু জরিনা জানে। সে যখন প্রথম এখানে এসে– রাস্তার ধারের এই খুপরিতে থাকা আরম্ভ করেছিল– তার সঙ্গে কুলসুমও ছিল। রাতের কাজ করতে গিয়ে সে পেটে বাচ্চা ধরেছিল। যে রাতে বাচ্চা জন্ম হল সে রাত থেকেই কুলসুম উধাও- না মরেনি, পালিয়েছিল, বাচ্চাকে ফেলেই পালিয়েছিল। এই লাইনে বাচ্চা থাকলে কদর কম। সখিনা বাচ্চাটাকে নিজের বুকে তুলে নিয়েছিল। বাকি বাচ্চাগুলোও কোনও না কোনও ভাবে তার এই খুপরিতেই, সখিনার বুকের স্নেহে আস্তানা গড়ে নিয়েছে, জরিনাকে আপন ভেবে, নিরাপদ ভেবে তার কাছেই থেকে গেছে।
জীবন বৃত্তান্ত –– পুনরাবৃত্তি
হয়ত এতক্ষণে সেকান্দর বিদেশের বিমানে উঠে পড়েছে। সেকান্দরের বিদেশ যাবার স্বপ্ন তাহলে পূরণ হয়েছে? আহ সেকান্দর। তৃতীয় রাতের পর; তাদের নিয়ে আসা হয়েছিল সম্পূর্ণ নতুন অচেনা এক বাড়িতে। শুধু কি বাড়িটি অচেনা? মানুষগুলোও তো পাল্টে গেছে। মানে গত দুইদিন যে তিনজন– মানুষের সাথে তাদের ছিল তারাও পালটে গেছে। এখানের মানুষগুলোর চেহারা আলাদা– কথা বার্তা– পোশাক আলাদা। সেকান্দর! স্বামী, তুমি কি বিদেশ যেতে পেরেছ?
সায়রা নামে এই পৃথিবীতে কেউ নেই আর। মুম্বাই তাকে বানিয়েছিল– চামেলি। খুব দ্রুত চামেলি বাজার পেয়ে গিয়েছিল। প্রতি রাতে অন্যদের তুলনায় তাকে দ্বিগুণ খদ্দেরের মনোরঞ্জন করতে হত; চামেলি ওরফে সায়রা একটা চুক্তি করেছিল– দেশ থেকে তার সঙ্গে পাচার হয়ে যাওয়া তেরো বছরের মেয়েটিকে যেন না ছোঁয়া হয়, কথাটা তারা রেখেছিল। মাস সাতেক পর একদল মানবাধিকার কর্মী তাদের উদ্ধার করে, কিছুদিন একটি মানবাধিকার সংস্থার জিম্মায় থাকে তারা। পরবর্তীতে সেই মানবাধিকার সংস্থা সায়রাদেরকে দেশে ফেরত পাঠায়। সায়রা দেশে ফেরত এসেছিল ঠিক– কিন্তু সে তো সায়রা নয়– সে চামেলি– তাই হয়তো গ্রামের কেউ তাকে গ্রহণ করেনি। চামেলি ফিরে এসেছিল ঢাকা শহরে। তার নাম হয়েছে জরিনা/সখিনা। এই নাম তাকে দিয়েছে লালা, একটা কুকুর– যে পুরুষ মানুষের চেয়ে ঢের বিশ্বাসের– সেকান্দরের চেয়ে তো অবশ্যই…