দেবাশিস্ ভট্টাচার্য
ইংরিজিতে একটা কথা চালু আছে — দ্য প্রুফ ইজ ইন দ্য পুডিং। অর্থাৎ কিনা, পুডিং বলে যে একটি বস্তু আছে তার প্রমাণ পুডিং-টি খেলেই পাওয়া যায়, অনেকটা যেন লাঠির বাড়ি খেয়ে লাঠির প্রমাণ পাওয়ার মতো। যুক্তিটা এমনিতে চমৎকার, তবু এক বোকা মতন লোক একবার বলে উঠেছিল, আরে না মশায়, এই তো সারা জীবন ধরে এত সব রকমারি পুডিং খেলাম, কই কোনওদিন কোনও প্রমাণ-ট্রমান তো দাঁতে আটকায়নি! প্রমাণ যদি দাঁতে না-ই আটকাল, তো কী করে বলা যাবে যে পুডিং-এ প্রমাণ আছে?
লোকটা বোকা বটে, তবে তার কথাটাও কিন্তু পুরো ফেলে দেবার নয়। পুডিং-এর ভেতরে প্রমাণ থাকলে খাবার সময়ে অন্তত একবারও তো দাঁতে আটকাবে রে বাবা! এই পর্যন্ত পড়েই পাঠক মহাশয় নিশ্চয় ভাবছেন, লেখক ব্যাটা তো রামঠকান ঠকাল দেখছি, শিরোনামে সম্মোহন-টম্মোহন দেখে পড়ব বলে গুছিয়ে বসলুম, এ তো দেখি রান্নাবান্নার কলাম, এইবার বোধহয় বেশ কায়দা করে কাঁচালঙ্কার পুডিং-এর রেসিপি ফাঁদবে!
পাঠক মহাশয়কে আশ্বস্ত করে বলি, আজ্ঞে না মহাশয়, সম্মোহন নিয়েই লিখব। আসলে বলতে চাইছিলাম, বিশ শতকের গোটা দ্বিতীয়ার্ধটা ধরে সম্মোহনের স্বরূপ নিয়ে মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে যে তাত্ত্বিক বিতর্কটা চলছে, সেটা অনেকটা পুডিং-তর্কের ধাঁচেই। না না, সম্মোহন দিয়ে কী করা যায় বা যায় না বিতর্কটা সে নিয়ে নয়, গণ্ডগোলটা একদম গোড়াতেই— ‘সম্মোহন’ ব্যাপারটা আদৌ ‘কিছু একটা’ বটে কিনা, প্রশ্নটা উঠেছে সেখানেই। বিশ্বাস হল না তো? ঠিক আছে, প্রবন্ধের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করেই দেখুন তবে, গরিবের কথা বাসি হলে ফলে কিনা!
কেউ জিজ্ঞেস করতে পারেন, সম্মোহন নিয়ে আলোচনার দরকার পড়ল কেন হঠাৎ? তার তিনটি উত্তর আছে। প্রথমত, সম্মোহন বলতে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা তন্ত্রমন্ত্রঘেঁষা অলৌকিকতামণ্ডিত সম্ভ্রমের ভাব জেগে ওঠে, কাজেই অনেকেই হয়তো বিষয়টি নিয়ে কৌতূহলী হতে পারেন। দ্বিতীয়ত, সম্মোহনের স্বরূপ নিয়ে যে তত্ত্বচর্চা, তার ইতিহাস হল বিজ্ঞানের সামগ্রিক ইতিহাসের এক চিত্তাকর্ষক অধ্যায়, এভাবেও বিষয়টিকে দেখা চলে। তৃতীয়ত, সম্মোহনকে মানসিক চিকিৎসারও একটি হাতিয়ার বলে দাবি করা হয়, এবং এই দাবিটি প্রায়শই নানা অবৈজ্ঞানিক চিন্তা ও চর্চার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। যদিও এ লেখায় সম্মোহন চিকিৎসা বিষয়ে কোনও আলোচনা থাকবে না, তবুও সম্মোহনের ইতিহাসের মধ্যে চিকিৎসার প্রসঙ্গ বারবারই ঢুকে পড়েছে। কাজেই, সে নিয়ে কেউ চর্চা করতে চাইলে এ লেখাটি হয়তো যথাযথ প্রেক্ষিত সরবরাহ করতে পারবে।
শুরু করার আগে ‘সম্মোহন’ শব্দটির অর্থটা পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার, বিশেষ করে যেখানে সাধারণভাবে এর সাথে একটু তন্ত্রমন্ত্র অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে। সাধারণ ভাষায়, বিশেষ করে কাব্যে, একটা কথাকে নানা অর্থে প্রয়োগ করা চলে। কিন্তু অ্যাকাডেমিক্সে ‘সম্মোহন’ শব্দটির সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে, সেখানে একে নেশা বা রাসায়নিকের প্রভাব বা তন্ত্রমন্ত্র বা বশীকরণ বা ঘুমের ঘোরে হাঁটা বা ব্যক্তি-প্রভাব বা ইনফ্যাচুয়েশন ইত্যাদির সাথে গুলিয়ে ফেলা চলে না। একটা সাধু-সন্নিসি গোছের লোক এসে কারও দিকে স্রেফ চোখ পাকিয়ে তাকে বশ করে ফেলছে, এইসব গল্প অ্যাকাডেমিক্সের সম্মোহন-গবেষকদের কাছে মোটেই প্রাসঙ্গিক নয়। শুধুমাত্র বিশেষ ভঙ্গিতে কথা বলে (যাকে পরিভাষায় বলে ‘সাজেশন’ বা অভিভাবন) এবং পরীক্ষাধীন ব্যক্তিকে বিশেষ ধরনের গোলমালহীন শান্ত পরিবেশে রেখে যে ‘সম্মোহন’ সৃষ্টি করা হয়, মনোবিজ্ঞানীদের কাছে আজ শুধু সেটাই ‘সম্মোহন’ বলে বিবেচ্য। অবশ্য, এমনকি অ্যাকাডেমিক্সেও সম্মোহন নিয়ে অন্যরকমের নানা ধোঁয়াশা আছে, আসল গণ্ডগোলটা সেখানেই। সে নিয়ে দু-চার কথা এখানে হবে একটু পরে। আপাতত বলে রাখি, কয়েকটি বিশেষ ধরনের আচরণ যে ‘খাঁটি’ সম্মোহনের দৃষ্টান্ত সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ নেই। যেমন, সম্মোহিত ব্যক্তিকে হয়তো বলা হল দুহাতের আঙুলগুলো পরস্পরের ফাঁকে ঢুকিয়ে আঁকড়ে থাকতে, এবং সে তারপর ইচ্ছে সত্ত্বেও আর নিজের দুহাত খুলে আলাদা করতে পারল না, যতক্ষণ না তাকে তা করার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। কিংবা, তাকে হয়তো বলা হল যে তার হাত বেলুনের মতো হালকা হয়ে গেছে এবং তারপর সে সেই হাতটি দীর্ঘ সময় ধরে যন্ত্রণা উপেক্ষা করে তুলে ধরেই রইল। কিম্বা, তাকে বলা হল যে সম্মোহিত হয়ে তার তার গায়ের জোর খুব বেড়ে গেছে, এবং তারপর দেখা গেল যে এমনিতে সে যতটা ওজন তুলতে পারে তার চেয়ে অনেক বেশি ওজন তুলে ফেলল। আবার, তাকে হয়তো মদ বলে স্রেফ জল খাওয়ানো হল, এবং তা সত্ত্বেও সে তা খেয়ে মাতালের মতো আচরণ করতে লাগল। সেইরকম, তাকে হয়তো বলা হল যে সে শুনতে বা দেখতে পাচ্ছে না, এবং তারপর সে হয়তো সত্যিই কোনও জোরালো শব্দ শুনতেই পেল না বা সামনে রাখা মস্ত জিনিস দেখতেই পেল না (অন্তত তার বাহ্যিক আচরণে সেরকমই মনে হল)। এরকম আরও অনেক চমকপ্রদ বিষয়ই সম্মোহনবিদেরা পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন, যা মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রবল কৌতূহল সৃষ্টি করেছে দীর্ঘদিন যাবৎ। আজকের দিনে যত চর্চা ও বিতর্ক, তা এইগুলো নিয়েই।
আরও একটা কথা পরিষ্কার করে বলে নেওয়া দরকার। সম্মোহনের নামে বেশ কিছু সম্পূর্ণ মিথ্যে বাজে গল্প প্রচলিত আছে। তার মধ্যে একটা গল্প জাদুকর সিনিয়র পি সি সরকারের নামে খুব শোনা যায়। তিনি নাকি তাঁর একটি শো-তে সময়কে পিছিয়ে দিয়েছিলেন, অর্থাৎ, তাঁর সম্মোহনের প্রভাবে নাকি হলশুদ্ধু দর্শক নিজের নিজের হাতঘড়িতে তাকিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন যে, সময় আধঘণ্টা মতো পিছিয়ে গেছে। বহু লোকেই এই তথ্যটি ‘জানেন’ বলে দাবি করেন, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, স্বচক্ষে দেখেছেন কিনা জিজ্ঞেস করলে কাউকেই আর পাওয়া যায় না, এবং আধুনিক সম্মোহন-গবেষকরা গণসম্মোহন বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব স্বীকারও করেন না (যদিও, গণহিস্টিরিয়ার সাথে একে গুলিয়ে ফেলার একটা প্রবণতা অনেকের মধ্যে চালু আছে)। এই মিথ্যে গুজবটি আমাদের চারপাশে আমরা সিনিয়র পি সি সরকারের নামেই বেশি শুনতে পাই, কিন্তু আসলে এটি দেশি ও বিদেশি বহু খ্যাতনামা জাদুকরের নামেই চলেছে বিভিন্ন সময়ে। অবশ্য, ‘গণসম্মোহন’ ব্যাপারটাকে স্রেফ গুজব বলে উড়িয়ে দিলে আমার বয়সী অনেকেই হয়তো প্রবল আপত্তি করবেন, বিশেষ করে যাঁদের স্মৃতিতে তাজা আছে প্রায় আড়াই দশক আগে জুনিয়র পি সি সরকার-এর ‘ট্রেন ভ্যানিশ’-এর ঘটনা। যাঁরা আপত্তি জানাতে চাইবেন, তাঁরা নিশ্চিতভাবে পেশ করবেন সংবাদপত্রে সাড়ম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদন। হ্যাঁ, সে সব ‘খবর’-এর কথা আমাদেরও স্মরণে আছে বইকি। শুধুমাত্র আনন্দবাজার আর টেলিগ্রাফ এই দুটি সংবাদপত্রে বেরিয়েছিল সে সংবাদ, এবং যথাক্রমে বাংলা ও ইংরিজিতে প্রতিবেদন দুটি লিখেছিলেন একই ব্যক্তি– শঙ্করলাল ভট্টাচার্য (আমার জীবনে এমন ঘটনা ওই প্রথম এবং শেষ)। তখন তো কেব্ল্ টিভি ছিল না, সবাইকেই দূরদর্শনের সরকারি খবর শুনতে হত। সেদিন টিভিতে খবরটি যিনি পড়েছিলেন তিনি ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য, ওই প্রতিবেদকেরই (শঙ্করলাল ভট্টাচার্য) সহধর্মিণী। সেই দূরদর্শন-প্রতিবেদনে দেখানো হয়, স্থানীয় গ্রামবাসী ও বেশ কয়েকজন বিশিষ্টজনের সামনে একটু দূরে রেললাইনে এসে দাঁড়াচ্ছে অমৃতসর এক্সপ্রেস, এবং জাদুকর পি সি সরকার তা ‘অদৃশ্য’ করে দিচ্ছেন। পরে শুনেছিলাম, ওখানে দূরদর্শনের তরফে আদৌ কোনও ক্যামেরাম্যানই নাকি ছিলেন না। ভিডিও তোলা হয় ব্যক্তিগত উদ্যোগে, এবং দুরদর্শনের নিউজ এডিটরের হাতে ওই ভিডিও ক্যাসেট-টি নাকি পৌঁছয়ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে, অজানা কারণে সে নিয়ে আর প্রশ্ন ওঠেনি। আরও শুনেছিলাম, ক্যামেরাতে আসলে কিছুই ‘দেখা’ যায়নি। ট্রেনটি দেখা যাওয়ার পর অনেক দূরে থাকা দর্শকদের সামনে একটি বড় ব্যানার ধরে কিছুক্ষণের জন্য ঢেকে দেওয়া হয় (তা থেকেই আন্দাজ পাওয়া যায় ট্রেনটি দর্শকদের থেকে কত বেশি দূরে ছিল), এবং ট্রেনটি ঘুরে একটু নিচু পথে ল্যুপ লাইনে চলে গিয়ে দৃষ্টির অগোচর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যানারটি তুলে নিয়ে ‘ট্রেন ভ্যানিশ’ দেখানো হয়! খবরে বলা হয়েছিল ওটা নাকি অমৃতসর এক্সপ্রেস, কিন্তু অমৃতসর এক্সপ্রেসের সাথে এর রং, বগির সংখ্যা, যাতায়াতের সময়– এসব কিছুই মেলেনি। ওখানে ঠিক কী যে ঘটেছিল তা আজ নিশ্চিত করে বলা মুশকিল, তবে গোটাটাই যে খুবই গোলমেলে ব্যাপার তাতে সন্দেহ নেই, এবং ‘সম্মোহন’ ব্যাপারটির সঙ্গে এ ঘটনার যে কোনও সম্পর্ক নেই তাতেও সন্দেহ নেই।
আচ্ছা, যাক ওসব কথা, বরং সম্মোহনের বইপত্র নিয়ে কিছু কথাবার্তা হোক। কেউ যদি বইপত্তর জোগাড় করে নিজে নিজে এ নিয়ে পড়তে চান, তো তাঁর জন্য এ বিষয়ের বইপত্র সম্পর্কে আগেভাগে কিছু বলে দেওয়াটা উচিত কাজ হবে।
অন্য অনেক বিষয়ের ক্ষেত্রে বাজার চলতি অনার্স বা মাস্টার্স স্তরের টেক্সটবই সংগ্রহ করে একটু পড়াশোনা করে নেওয়া যায়, সেক্ষেত্রে পড়াশোনাটা বেশ সিরিয়াস গোছেরও হয়। কিন্তু সম্মোহনের ক্ষেত্রে যদি ভাবেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান কোর্সের বই জোগাড় করে পড়বেন, তো বিলক্ষণ সমস্যা আছে। মনোবিদদের মধ্যে হিপনোসিস নিয়ে সন্দেহ ক্রমশই বাড়ছে, ফলে সাইকোলজির সাধারণ টেক্সটে এর কথা খুব বেশি পাওয়া কঠিন। অতি স্পেশালাইজড কিছু মনোবিজ্ঞানী এখন এ নিয়ে চর্চা করেন, এবং তাঁদের মধ্যে অনেকেই এখন এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান। আমি আজ থেকে দশ-বারো বছর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিওর ও অ্যাপ্লায়েড (সাইকোলজি) উভয় বিভাগেই খোঁজ করেছিলাম, সম্মোহন নিয়ে কে ভাল কাজ করছেন। কাউকেই পাইনি, খালি প্রফেসর সোমনাথ ভট্টাচার্যের নাম শুনেছিলাম, যিনি নাকি বহুদিন আগেই অবসর নিয়েছেন।
অন্য অনেক ব্যাপারের মতো এ ব্যাপারেও বাংলা প্রকাশনার কথা খুব ফলাও করে বলার মতো কিছু নয়। হাতেগোনা বাজার চলতি কয়েকটি বাংলা বইয়ের কথা বলি। হোমিও চিকিৎসক সমীর চন্দ্র দাস ও ‘যুক্তিবাদী’ বলে পরিচিত ভুয়ো চিকিৎসক প্রবীর ঘোষের বেশ কিছু বইয়ে সম্মোহনের কথা আছে, কিন্তু এই বইগুলো সম্মোহন সম্পর্কে মিথ্যে অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্যে ভরপুর। জাদুকর সিনিয়র পি সি সরকারের বইটি দীর্ঘদিন অপ্রকাশিত থাকার পর আবার প্রকাশিত হয়েছে, এবং সেটি আরওই সাংঘাতিক, তন্ত্রমন্ত্র-ঘেঁষা কুসংস্কারে জর্জরিত। সম্মোহন বিষয়ে পাভলভীয় মতবাদ (নোবেলজয়ী রুশ বিজ্ঞানী ইভান পেত্রভিচ পাভলভ-এর তত্ত্ব) সম্পর্কে জানতে চাইলে ডাঃ ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের “পাভলভ পরিচিতি” বাংলায় সবচেয়ে ভাল বই, যা থেকে প্রবীর ঘোষ বিস্তারিত টুকেছেন, তাও আবার আদ্ধেকই না বুঝে। ডাঃ গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সম্মোহন’ বইটিও পাভলভীয় ধারায় লিখিত, এবং সম্মোহনের সঙ্গে সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নানা বিষয়েও অনেক তথ্যাবলি এ বইয়ে পাওয়া যাবে। জানার মতো তথ্য বেশ কিছু আছে ডাঃ প্রবীর বিশ্বাসের ‘সম্মোহন এবং মানসিক রোগ ও চিকিৎসা’ বইটিতেও, তবে আমার ধারণা, এটি পুরোপুরিভাবে ডেভিড ওয়াক্সম্যানের সম্মোহন-বিষয়ক বইটি অনুসরণ করে লেখা হয়েছে। ডাঃ ধীরেন্দ্রনাথ নন্দীর ‘মনের বিকার ও প্রতিকার’ বইতে সম্মোহন-চিকিৎসা নিয়ে অল্প কিছু কথা আছে। তবে, এই বইগুলোর একটাতেও সম্মোহনের প্রকৃত স্বরূপ ও চরিত্র বিষয়ে আজ যে প্রবল বিতর্ক চলছে সে বিষয়ে কোনও কথা নেই। আন্তর্জাতিক গবেষণার বর্তমান পরিস্থিতির মোদ্দা চিত্রটি পাওয়া যাবে এমন যথেষ্ট ভালো মানের আপডেটেড বই, পণ্ডিতি অথবা জনবোধ্য, এই মুহূর্তে বাংলায় আদৌ নেই বলেই আমার ধারণা, সেটা ভুল প্রমাণিত হলে খুশি হব।
বলা বাহুল্য, এ বিষয়ে ভালো ইংরিজি বইয়ের কোনও শেষ নেই। তবে সেখানেও কিন্তু ভালো বইয়ের থেকে বাজে বইয়ের সংখ্যা বেশি, ফলে বই বাছাইয়ে সতর্ক না হলে ভুল বইটির কাছে গিয়ে পড়বার সম্ভাবনা বিস্তর। প্রামাণ্য জ্ঞান যদি চান, তাহলে কারা আদৌ ‘এক্সপার্ট’ বলে গণ্য হতে পারেন সে বিষয়ে কিছু বোধ প্রথমে জাগাতে হবে। ইংরিজি বইই যদি পড়তে চান সে খুব ভালো কথা, তাহলে থিওডোর বারবার, নিকোলাস স্প্যানোস, আর্নস্ট হিলগার্ড– এঁদের লেখা পড়ুন। প্রথমজনের ‘এল এস ডি, মারিজুয়ানা, ইয়োগা অ্যান্ড হিপনোসিস’ খুবই ভালো বই। পড়তে পারেন রবার্ট বেকারের ‘দে কল ইট হিপনোসিস’ বইটিও। আর সম্মোহনের ইতিহাস পড়তে চাইলে পড়ুন অ্যালান গল্ডের মহাভারতোপম গ্রন্থ ‘এ হিস্ট্রি অফ হিপনোটিজম’, কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত। গ্রাহাম ওয়াগস্টাফ, ই এম থর্নটন এঁরাও খুব ভালো ভালো গবেষণা করেছেন এবং বই লিখেছেন। আরও অসংখ্য গবেষণাপত্র ও বইয়ের নাম করা যায়, কিন্তু এখানে তার প্রয়োজন নেই। সম্মোহন সম্পর্কে বেশ কিছু ভালো পাঠ্যবস্তু এখন আন্তর্জালে পাওয়া যায়, তার মধ্যে পেশাদার গবেষণা এবং জনবোধ্য লেখা দুইই আছে।
সম্মোহন জিনিসটার ব্যাখ্যা যদি পেতে হয়, অর্থাৎ সম্মোহন কেন কীভাবে হয় সে প্রশ্নের উত্তর যদি খুঁজতে হয়, তাহলে সবার আগে সম্মোহন জিনিসটার একটা নির্দিষ্ট সংজ্ঞা পাওয়া দরকার। মানে, কাকে সম্মোহন বলব, কী ঘটলে বলব যে ‘সম্মোহন’ বলে ব্যাপারটা আদৌ ঘটেছে? দুঃখের বিষয়, এ ক্ষেত্রে গণ্ডগোলের শুরু এই গোড়ার প্রশ্ন থেকেই। যে কোনও জিনিসের ইতিহাস যদি ঘাঁটতে চান, তাহলে ঠিক কোন জিনিসটি খুঁজছেন সেটা আগে আপনাকে জানতে হবে, না হলে ব্যাপারটার কোনও মানেই থাকবে না। যেমন ধরুন, যদি লোহার ইতিহাস খুঁজতে চান তাহলে লোহা কী বস্তু সে নিয়ে সুস্পষ্ট একটা ধারণা থাকতে হবে, সেই ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে আপনি পুরনো পুঁথিপত্র বা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে লোহার অস্তিত্ব অন্বেষণ করতে পারবেন, তার স্থান-কাল-পাত্র নির্ণয় করতে উদ্যোগী হতে পারবেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে লোহার নিদর্শনগুলো অতি বিভিন্ন ও বিচিত্র হতে পারে, কিন্তু তার মধ্যে ‘লোহা’ নামক বস্তুটির সারসত্তা নিয়ে সংশয় নেই। অথচ সম্মোহনের ইতিহাস যদি খুঁড়ে বার করতে চান, তাহলে দেখবেন সেখানে গোড়াতেই গলদ, কারণ ইতিহাসের বিভিন্ন মুহূর্তে বিভিন্ন আলাদা আলাদা চরিত্রের ঘটনাকে সম্মোহন বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ইতিহাস নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই এই কথাটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এইরকম ছোট আকারের লেখায় সম্মোহনের গোটা ইতিহাস বলবার ইচ্ছেটা কারও কারও কাছে কিঞ্চিৎ উচ্চাকাঙ্ক্ষী বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আপাতত এছাড়া আর খুব বেশি বিকল্প দেখা যাচ্ছে না, বহু দরকারি প্রসঙ্গ বাদ যাবার ঝুঁকি সত্ত্বেও।
প্রাচীন গ্রন্থে সম্মোহনের প্রথম নিদর্শন হিসেবে সাধারণত আড়াই-তিন হাজার বছর আগেকার প্রাচীন গ্রিক দেব-দেবীদের মন্দিরে ভক্ত ও পুরোহিতদের উন্মত্ত আচরণ ও তারপর শেষে মূর্ছা যাওয়ার ঘটনাকেই চিহ্নিত করা হয়। নিদ্রাদেব ‘হিপনস’-এর মন্দিরে পুজারিরা একঘেয়ে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে নিদ্রাকে আহ্বান করত, এবং তারপর আচ্ছন্ন অবস্থায় নানা বিচিত্র স্বপ্ন দেখত। এইসব স্বপ্নকে গূঢ় ইঙ্গিতবাহী বলে মনে করা হত। গ্রিক চিকিৎসা-দেবতা এসক্লেপিয়ুস, পরবর্তীকালের রোমান উচ্চারণে ঈস্কুলাপিয়ুস, হলেন আরেক দেবতা যাঁর মন্দিরে ওই একই কীর্তিকলাপ ঘটত। ‘দেবতার কৃপা’য় পাওয়া এইসব স্বপ্নের মধ্যে অবশ্য পার্থিব উপাদান কম ছিল না। সন্তানহীনা মহিলারা নাকি সে মন্দিরের পুরোহিতদের সান্নিধ্যে যৌনসঙ্গমের স্বপ্ন দেখত এবং তারপর বাস্তবিকই সন্তান লাভ করত। কাজেই, ঈস্কুলাপিয়ুস-দেবের পুরুতদের কিছু দুর্নাম থাকবে এটাই স্বাভাবিক। প্রাচীন গ্রিক ব্যঙ্গনাট্যকার অ্যারিস্টোফেনিস এইসব পুরোহিতবর্গের হাতুড়েপনা, ভণ্ডামি আর লোভকে অত্যন্ত অশ্রদ্ধার সাথে চিত্রিত করেছিলেন। ‘সম্মোহন’ গোছের বিবরণ পাওয়া যায় আরও অনেক সভ্যতারই প্রাচীন সব নথিপত্রে। যেমন, খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সালের চৈনিক চিকিৎসক ওয়াং তাই-এর লেখা, খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালের হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদ, ৩০০০ বছরের পুরনো মিশরীয় প্যাপিরাস-পুঁথি, ইহুদি ধর্মগ্রন্থ তালমুদ। ব্রিটেনের প্রাচীন আদিবাসী, যাদের ‘কেল্টিক জনগোষ্ঠী’ নামে অভিহিত করা হয়, তাদের পুরুতরাও মন্ত্রোচ্চারণ করে রোগীদের মধ্যে এক আচ্ছন্ন অবস্থার সৃষ্টি করত। এই পুরুতদের বলে ‘ড্রুইড’, তাই তাদের সৃষ্ট এই নিদ্রার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ড্রুইডিক স্লিপ’ বা ‘ড্রুইডীয় নিদ্রা’।
আধুনিককালে সম্মোহনের ইতিহাস শুরু হয় অষ্টাদশ শতকীয় জার্মান চিকিৎসক ফ্রান্ৎজ্ আন্তন মেসমার-কে দিয়ে, যিনি নানা অভিনব কায়দায় তাঁর রোগীদের মধ্যে এক ধরনের উন্মত্ততা সৃষ্টি করতেন, এবং দাবি করতেন যে, ঐধরনের উন্মত্ততা ও মূর্ছা সৃষ্টি করতে পারলেই নাকি রোগ সেরে যায়। তাঁর উদ্ভট চিকিৎসাপদ্ধতি ও তত্ত্ব ‘মেসমেরিজ্ম্’ নামে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। এমনকি, ‘হিপনোসিস’ বা ‘সম্মোহন’-এর প্রতিশব্দ হিসেবেও এর ব্যবহার আছে। নিজে জার্মান হলেও তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল প্রথমে অস্ট্রিয়া ও পরে ফ্রান্স। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ সাঙ্গ করে তিনি ওখানেই ডাক্তারি করতে থাকেন। তিনি দাবি করেছিলেন, সমস্ত জগত ছেয়ে রয়েছে এক অদৃশ্য চৌম্বক তরল, আমাদের শরীরে সেই তরলের প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হলেই নানা রোগ হয়, এবং তিনি নাকি বিচিত্র কায়দায় হাত-পা নাড়িয়ে সেই অদৃশ্য তরলের প্রবাহ বাধামুক্ত করে সে রোগ সারাতে পারেন। এই তত্ত্বকে তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘অ্যানিম্যাল ম্যাগনেটিজ্ম্’। দৃষ্টিহীন এক খ্যাতনামা সঙ্গীতজ্ঞার অন্ধত্ব তিনি এভাবেই নাকি সারিয়েছেন, এ কথা দাবি করে প্রচণ্ড আলোড়ন তুললেও শেষপর্যন্ত চিকিৎসক সমাজের কাছে তা মোটেই প্রমাণ করতে পারেননি, এবং ব্যাপারটা শেষকালে এক কেলেঙ্কারিতে পর্যবসিত হয়। সে কেলেঙ্কারির জেরে মেসমার ভিয়েনা ছেড়ে প্যারিসে চলে আসেন, এবং আবারও জমিয়ে প্র্যাকটিস শুরু করেন। এবার তিনি আবিষ্কার করলেন ‘গ্রুপ থেরাপি’, অর্থাৎ একসাথে একদল রোগীর চিকিৎসা। আন্তন মেসমার দল কে দল রুগীকে একসাথে বসিয়ে কিছু নল আর দড়িদড়া ধরে থাকতে বলতেন, সেই নল আর দড়িগুলো গিয়ে শেষ হত এক বড় জলের গামলায়। তিনি স্বয়ং সেই সময়ে রঙিন জমকালো পোশাক পরে সারা ঘর হাঁটাহাঁটি করতেন, আর রুগীদের কাছে গিয়ে, অনেক সময় শরীর স্পর্শ করেও, বিচিত্র ভঙ্গিতে হাত নাড়তেন, যাকে তিনি বলতেন “পাস দেওয়া”। উচ্চগ্রামে বাজত গান। তার সম্মিলিত প্রভাবে রুগীরা উন্মত্ত হয়ে উঠত, তাদের খিঁচুনি শুরু হত, বমি হত। এইটা হলেই নাকি সব রোগ সেরে যায়, তা সে যে রোগই হোক না কেন, এই ছিল মেসমার সাহেবের দাবি! রুগীর শরীরটি একটি চুম্বক, অতএব মেসমারকে হাত দিয়ে স্পর্শ করে সে চুম্বকের মেরু খুঁজতে হত। রুগীর মাথা নিয়ে চিন্তা ছিল না, কারণ ওখানে তো এমনিতেই গ্রহতারার প্রভাব পৌঁছচ্ছে। চিন্তা নেই পা নিয়েও, কারণ সেখানে পৃথিবীর চুম্বকত্বের পরশ লাগছে। তাঁর প্রবল দুশ্চিন্তা ছিল রুগীর তলপেট ও আশপাশ নিয়ে, এবং সেখানেই হাত বুলিয়ে তিনি চৌম্বক মেরুর অনুসন্ধান চালাতেন। যেহেতু রুগীদের মধ্যে মহিলারাও ছিলেন বহুল সংখ্যায়, অতএব মানুষজনের গল্পগুজবে তাঁর ‘অ্যানিম্যাল ম্যাগনেটিজ্ম্’ দ্রুত বদলে যেতে লাগল ‘সেক্সুয়াল ম্যাগনেটিজ্ম্’-এ। সেই অষ্টাদশ শতকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গে অবিজ্ঞানের খুব বেশি তফাত ছিল না, তবু ফ্রান্সে মেসমারের বুজরুকির বিরুদ্ধে পণ্ডিতেরা জোরালো প্রতিবাদ করেন, এবং তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত কমিশন হয়, যে কমিশনে ছিলেন আন্তন ল্যাভয়শিয়র এবং বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের মতো লব্ধপ্রতিষ্ঠ বিজ্ঞানীরা। এই তদন্তটি করতে গিয়ে তাঁরা যে অসাধারণ পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটান তা চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণা-পদ্ধতির ইতিহাসে এক মাইলফলক হয়ে আছে। এই কমিশন মেসমারের চিকিৎসাকে বুজরুকি বলে পরিষ্কার রায় দেয়। এর জেরে কিছুদিন পর মেসমারকে ফ্রান্স ত্যাগ করতে হয়।
তবে, এটি যে ‘সম্মোহন’ এমন দাবি কিন্তু মেসমার নিজে করেননি। তাঁর যে নিজস্ব এক উদ্ভট অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ছিল, সেটা ওপরে বলেছি। তাঁর কাজকর্মকে ‘সম্মোহন’ বলে দাবিটি করেছিলেন পরবর্তীকালের সম্মোহন-তাত্ত্বিকরা। বর্তমানে সম্মোহন বোঝাতে যে ইংরেজি শব্দটি বিজ্ঞানী ও সাধারণ সমাজে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়, অর্থাৎ ‘হিপনোসিস’, সেটি প্রথম ওই অর্থে ব্যবহার করেন স্কটিশ চিকিৎসক জেমস ব্রেইড, গ্রিক নিদ্রা-দেবতা ‘হিপনস’-এর নামানুসারে। ব্রেইড গোড়ায় ভেবেছিলেন নিদ্রার সঙ্গে এর কোনও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, তাই এমন নামকরণ। পরে ব্রেইড নিজের ভুল বুঝতে পারেন, এবং অন্য আরেকটি নাম ‘মোনো-আইডিইজম’ (অর্থাৎ, মনের মধ্যে ‘একটি মাত্র গেড়ে বসা ধারণা’-র ‘বাদ’ বা তত্ত্ব) চালু করার চেষ্টা করেন, কিন্তু ততদিনে প্রথম নামটি এমন যুৎসইভাবে চালু হয়ে গেছে যে সে চেষ্টা আর সফল হয়নি। এইভাবে সম্মোহন-চর্চার গোড়া থেকেই বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে এক ভুল লেবেলিং-এর শিকার হয়ে পড়ে।
ব্রেইডের পর উনিশ শতকের শেষদিকে ফ্রান্সে প্রায় একই সময়ে দুই বিখ্যাত সম্মোহনবিদ গবেষণা করতে থাকেন– জঁ মার্তিন শার্কো এবং ইপ্পোলিত বার্নহাইম। দুজনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল প্রচণ্ড। শার্কোর তত্ত্ব ও কাজকর্ম অনেক বেশি নাটকীয় ছিল, এবং তাঁর জীবদ্দশায় তিনিই প্রচারে ও প্রভাবে এগিয়ে ছিলেন, যদিও আধুনিককালে এসে দেখা গেছে যে আসলে বার্নহাইমের মতামতই আধুনিক মতের অনেক বেশি কাছের ছিল। শার্কো বলতেন, সম্মোহন হল কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি হওয়া হিস্টেরিয়া রোগ (এই রোগটির ধারণা আজ আর চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাছে স্বীকৃত নয়)। তিনি বলতেন, সম্মোহনের বিভিন্ন স্তর আছে এবং তাদের প্রত্যেকেরই কিছু বিশেষ লক্ষণ তিনি চিহ্নিত করেছিলেন, যেমন অবশ ভাব, শরীর শক্ত হয়ে যাওয়া, মূর্ছা ইত্যাদি। এইসব ‘লক্ষণ’ তিনি তাঁর মেয়ে রোগীদের দিয়ে পণ্ডিতদের সামনে অহরহই প্রদর্শন করাতেন। আধুনিক গবেষকরা অনেকে বলেন, শার্কোর হাসপাতালের রোগিনীরা বেশিরভাগই ছিলেন যাত্রাদলে অভিনয় করে বেড়ানো বা দেহব্যবসায়ী মহিলা, যাদের ওইখান ছাড়া যাবার আর বিশেষ জায়গা ছিল না। শার্কোর নির্দেশমতো বারবার প্রদর্শনী করতে করতে তারা শার্কো-কথিত বিভিন্ন লক্ষণ দেখানোতে অতি চৌখস হয়ে যেত, এবং সেগুলোই তাঁর সম্মোহন তত্ত্বের জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ হিসেবে প্রতিভাত হত। এখন বোঝা গেছে, আসলে ওইসব মেয়েদের অনেকেরই মৃগী রোগ ছিল, এবং শার্কো মৃগী সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গও জানতেন না। শার্কোর দাপটে মৃগীরোগের উপসর্গগুলোই সম্মোহনের প্রামাণ্য লক্ষণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। শার্কোর হাসপাতালে তাঁর সম্মোহন তত্ত্বের প্রমাণ যোগাবার জন্য এইসব মেয়েরা প্রতিদিনই অসংখ্যবার নানা রোগ-লক্ষণের প্রদর্শনী করে যেত, এবং শেষ পর্যন্ত বদ্ধ উন্মাদ হয়ে তাদের ঠাঁই হত পাগলাগারদে। তাঁর অ্যাক্সেল মুন্থে নামের এক ডাক্তারি ছাত্র ঐরকম এক মেয়েকে তাঁর কবল থেকে উদ্ধার করে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে, এবং শার্কোর হাসপাতাল থেকে চিরতরে বহিষ্কৃত হয়। শার্কোর এই নাটকীয় সম্মোহন-তত্ত্বের বিপরীতে বার্নহাইম যা বলেছিলেন তা অনেক বেশি কাণ্ডজ্ঞানসম্মত, এবং অনেক বেশি করে আধুনিক মতামতের কাছাকাছি। তিনি বলতেন, সম্মোহন শুধু মেয়েদের বা রুগীদের ব্যাপার নয়, এ সবাইকেই করা যায়, এবং এ হল স্রেফ সম্মোহনবিদের নির্দেশে (‘সাজেশন’ বা ‘অভিভাবন’) মানসিকভাবে প্রভাবিত হয়ে সেইমতো আচরণ করবার ব্যাপার। মেসমার থেকে শার্কো পর্যন্ত সম্মোহনের সাথে যে একটা উন্মত্ততা এবং অস্বাভাবিকতার ব্যাপার জড়িত ছিল, বার্নহাইম তা থেকে সম্মোহনকে বার করে আনেন। তিনি স্বাভাবিক লোকজনকে শান্তভাবে সম্মোহন করে দেখাতেন, কোনও উত্তেজনার ব্যাপারই ছিল না সেখানে। আরও পরে জার্মানিতে ফ্রয়েড যখন সম্মোহন নিয়ে কাজ করেন, তখন তিনি শার্কো ও বার্নহাইম উভয়ের দ্বারাই প্রভাবিত ছিলেন। প্রথমে এ নিয়ে উৎসাহী হলেও পরে ফ্রয়েড দেখেন, সম্মোহন করে মোটেই রোগ সারানো যায় না, এবং সম্মোহন ছেড়ে নিজস্ব ‘সাইকো-অ্যানালিসিস’ পদ্ধতি চালু করেন।
ফ্রয়েডের প্রভাবে উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের গোড়ায় সম্মোহন নিয়ে উৎসাহ খুবই কমে যায়। এই সময় পর্যন্ত সম্মোহনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত ছিল ঘুম, অচৈতন্যতা, মূর্ছা ইত্যাদি ব্যাপারস্যাপার। কাজেই এটা আশ্চর্যের নয় যে, ফ্রয়েডের প্রায় একই সময়ে রুশ শারীরবিদ ইভান পাভলভ সম্মোহনকে নিদ্রার কাছাকাছি কোনও এক বিষয় বলে ধরে নিয়ে তার এক স্নায়ু-বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করবেন। অবশ্য, পাভলভের বৈজ্ঞানিক মেজাজটি খুব জোরদার হলেও শেষ পর্যন্ত ‘ঘুম’ ব্যাপারটার সঙ্গে সম্মোহনের কোনও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আদৌ প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। বস্তুত, বিশ শতকের তৃতীয়-চতুর্থ-পঞ্চম দশকে মিলটন এরিকসন, লেসলি কুন, সালভাতর রুশো প্রমুখ সামনের সারির সম্মোহন-বিশারদরা জেগে থাকা অবস্থায় সম্মোহনের পরীক্ষামূলক প্রদর্শনী অ্সংখ্যবার ঘটিয়ে দেখাবার পর ঘুমের সাথে সম্মোহনের সম্পর্কহীনতা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এই ঐতিহাসিক ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে সম্মোহন সম্পর্কে এক অদ্ভুত উপলব্ধি উঠে আসে। সম্মোহন তাহলে আদৌ কোনও সুনির্দিষ্ট ‘ফেনোমেনন’ নয়, এ হল আসলে একটি ঐতিহাসিকভাবে তৈরি হওয়া লেবেলের আড়ালে একগুচ্ছ আলাদা আলাদা ব্যাপার– কখনও তা উন্মত্ততা ও মূর্ছা, কখনও নিদ্রালু দশা, কখনও আবার সম্পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায় কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট এক অদ্ভুত প্রশান্তি। প্রশ্ন হল, তাহলে আমরা ইতিহাসে কাকে খুঁজছি, আদৌ কি তেমন কোনও নির্দিষ্ট জিনিসের অস্তিত্ব আছে? এই গুরুতর প্রশ্নটি নিয়ে ভাবতে ভাবতেই পাঁচের দশক নাগাদ সম্মোহন-চিন্তায় এসে পড়ল এক নাটকীয় মোড়।
আসলে, চল্লিশের দশক থেকেই রবার্ট হোয়াইট ও অন্য দুয়েকজন মনোবিজ্ঞানী সম্মোহন নিয়ে নানা মৌলিক প্রশ্ন তুলে গবেষণাপত্র লিখতে থাকেন, এবং সে সব প্রশ্নকে সংহত করে সম্মোহন সম্পর্কে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের তাত্ত্বিক বিকল্প নির্মাণ করেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ-মনোবিদ থিওডোর সার্বিন, পাঁচের দশক নাগাদ। তিনি বলেন, সম্মোহনের প্রকৃত স্বরূপ কী এ নিয়ে গবেষণা আসলে বুনোহাঁসের পেছনে ছোটার মতো ব্যাপার, কারণ, সম্মোহন আসলে আলাদা কোনও শারীরিক বা মানসিক অবস্থা নয়, এ হল এক ধরনের ‘রোল টেকিং বিহেভিয়ার’ মাত্র। ঘুমের সময় বা মাদকের প্রভাবে মানুষের চেতনা যেমন এক ভিন্ন দশায় এসে পৌঁছয়, সম্মোহনের ক্ষেত্রে মোটেই তা ঘটে না, এক্ষেত্রে সম্মোহিত ব্যক্তি শুধু সামাজিক চাপের শিকার হয়ে এক প্রত্যাশিত আচরণ করে। পরীক্ষাধীন ব্যক্তি বুঝতে পারে যে, সম্মোহিত ব্যক্তি যা যা করে থাকে বলে কথিত আছে তাকে এখন সেই সেই জিনিসগুলো করে দেখাতে হবে, তার জন্য নির্ধারিত যে ‘সামাজিক ভূমিকা’, সেইটা তাকে পালন করে দেখাতে হবে, ইংরিজিতে যাকে বলে ‘সোশ্যাল রোল প্লেয়িং’। মানে, আমরা যেমন বাড়িতে সন্তানের সামনে দায়িত্বশীল আচরণ করি, কর্মক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতনের সামনে অনুগত ভাব দেখাই, বন্ধুসংসর্গে কিঞ্চিৎ অবাধে হইহুল্লোড় করি, আবার প্রেমিক/প্রেমিকার কাছে কমিটমেন্ট প্রমাণ করবার চেষ্টা করি, এও সেই গোছেরই ব্যাপার আর কি! বলা বাহুল্য, এই অভিনব তত্ত্ব খুবই সাড়া ফেলতে পেরেছিল। পেরেছিল যে, তার পেছনে অবশ্য এর অভিনবত্ব ছাড়া আরও কারণ ছিল। কারণটা হচ্ছে, হাজার চেষ্টা ও উৎসাহ সত্ত্বেও কোনওদিনই সম্মোহনের কোনও শারীরতাত্ত্বিক ভিত্তিই ইতিমধ্যে খাড়া করা যায়নি। সম্মোহিত অবস্থায় পরীক্ষাধীন ব্যক্তির নাড়ির গতি, রক্তচাপ, হৃৎস্পন্দন, মস্তিষ্ক-তরঙ্গ (ই ই জি), কোনও কিছুতেই কখনও এমন কোনও বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়নি যা শুধু সম্মোহনের ক্ষেত্রেই ঘটে এবং আর কখনওই ঘটে না। রুশ বিজ্ঞানী পাভলভ একটি শারীরতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু সেটা থেকে গিয়েছিল একটা তত্ত্ব-প্রস্তাব হিসেবে, কোনওদিনই যা সেই অর্থে ‘প্রমাণিত’ হয়নি। পাভলভ বলেছিলেন, সম্মোহন হচ্ছে এক ধরনের আংশিক নিদ্রা, যখন সম্মোহিতের মস্তিষ্কের শুধু সেই অংশটিই জাগ্রত থাকে যা সম্মোহকের ‘সাজেশন’-এর প্রতি মনোযোগ দিচ্ছে, এবং বাকি অংশ থাকে নিস্তেজিত, ফলে সম্মোহিত ব্যক্তির বিচারবুদ্ধি সীমিত হয়ে পড়ে, এবং তখন সে নির্বিচারে সম্মোহকের কথা মেনে চলতে পারে। বিশ শতকের তিরিশ ও চল্লিশের দশকে যখন অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণ হয়ে গেল যে, সম্মোহনের সাথে আসলে নিদ্রা বিষয়টির আদৌ কোনও সম্পর্কই নেই, তখনই পাভলভের তত্ত্বপ্রস্তাব প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলল। এখন, এই প্রেক্ষিতটি মাথায় রাখলে বোঝা যায় যে, কেন সেই সময় সমাজ-মনোবিদ থিওডোর সার্বিনের ‘রোল প্লেয়িং’ তত্ত্ব বিশেষজ্ঞমহলে অত সাড়া ফেলেছিল (মনে রাখবেন, এই ‘রোল প্লেয়িং’ কিন্তু মোটেই ইচ্ছাকৃত অভিনয় বা জোচ্চুরি নয়)।
কিন্তু, এই অভিনব তত্ত্বের সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা গড়ে ওঠার পথে আবার কিছু কাঁটাও ছিল না এমন নয়।
ইতিমধ্যে সম্মোহন সংক্রান্ত অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এমন অনেক কিছুই দেখানো হয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে ‘রোলপ্লেয়িং’ তত্ত্ব দিয়ে যার ব্যাখ্যা সম্ভব না। যেমন, সম্মোহিত ব্যক্তি হয়ত অস্বাভাবিক রকম জোরালো যন্ত্রণা সহ্য করছে বা গায়ের জোর দেখাচ্ছে যা তার এমনিতে পারবার কথা নয়, বা তাকে কালা বা অন্ধ হওয়ার ‘নির্দেশ’ দেওয়ার পর সে আর শব্দ শুনতে পাচ্ছে না বা সামনের জিনিস দেখতে পাচ্ছে না, এই রকম সব অদ্ভুত ব্যাপার। প্রশ্ন হচ্ছে, সম্মোহিত ব্যক্তি যদি তার সামাজিক ভূমিকাই পালন করবে, তো তাতে তার সহ্যশক্তি বা গায়ের জোর এইসব বাড়বে কীভাবে, এগুলো তো আর নিছক মনের ব্যাপার নয়!
বিশেষভাবে এই প্রশ্নগুলোর মোকাবিলা করার জন্য ষাটের দশক থেকে কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ববিদ থিওডোর জেনোফোন বার্বার ও তাঁর শিষ্যবর্গ। দশকের পর দশক ধরে তাঁরা করে চললেন অসামান্য সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা। বলা হয়, বার্বার ও তাঁর শিষ্যবর্গ সম্মোহন নিয়ে যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, তাঁর পূর্ববর্তীরা সবাই মিলেও নাকি তত করেননি। তিনি সম্মোহন চর্চায় এক নতুন যুগের সূচনা করেন, প্রখ্যাত সম্মোহন-ইতিহাসকার অ্যালান গল্ড যাকে ‘দ্য বার্বার রিভোল্যুশন’ বলে অভিহিত করেছেন। বার্বার প্রশ্ন করলেন, হ্যাঁ, সম্মোহন করে তোমরা যে অনেক অদ্ভুত জিনিস ঘটাতে পারো সেটা দেখতেই পাচ্ছি, কিন্তু তোমরা কি কখনও ভেবে দেখেছ যে, ওইসব ঘটনা ঘটাতে আদৌ সম্মোহনটা লাগে কিনা? এসো, সেটাই তবে এখন পরীক্ষা করে দেখা যাক। তিনি দ্বর্থ্যহীন পরিচ্ছন্নতার সাথে পরীক্ষা করে দেখালেন, আসলে এইসব ঘটনা পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় ‘অ্যাটেনশন’ (মনোযোগ) বা ‘মোটিভেশন’ (প্রণোদনা) জাতীয় ইতিমধ্যে-জানা ধ্যানধারণার ওপর ভিত্তি করেই, তার জন্য ‘সম্মোহন’ বলে আলাদা কিছু একটা আছে বলে ধরে নেবার মোটেই দরকার নেই। যেমন, যে লোকটা এমনিতে দশ কিলোর চেয়ে বেশি ভার মোটেই তুলতে পারে না, তাকে ‘সম্মোহন’ করে গায়ের জোর বাড়াবার সাজেশন দিলে সে যেমন বারো কিলো তুলে ফেলতে পারে, ঠিক তেমনি আবার যদি তাকে বলা যায় যে দশ কিলোটা মেয়েদের স্কোর এবং সেহেতু তার আরেকটু বেশি পারা উচিত, তখন সে নিজের পুরুষত্ব প্রমাণের সামাজিক তাগিদের চাপে একই কাজ করে ফেলতে পারে। এ হল ‘মোটিভেশন’-এর উদাহরণ। আবার ধরুন, পরীক্ষাধীন ব্যক্তিকে কানে হেডফোন লাগিয়ে দিয়ে খুব আকর্ষণীয় একটি টেপ করা গল্পপাঠ মন দিয়ে শুনতে বলা হল, এবং এও বলা হল যে পরে ওই গল্পটি ঠিকঠাক শুনিয়ে তাঁকে স্মৃতিশক্তির পরীক্ষা দিতে হবে, অথচ গল্পপাঠ শোনাকালীনই তাঁর অজান্তে তাঁরই নিজের হাতটি রক্তচাপ মাপার অছিলায় তাঁর চোখের আড়ালে রেখে তাতে ক্রমাগত যন্ত্রণা দেওয়া হতে লাগল। দেখা যায়, এক্ষেত্রে মনোযোগ সরিয়ে রাখার ফলে তিনি অনেক বেশিমাত্রায় যন্ত্রণা সহ্য করতে পারেন, এবং সম্মোহন করে যন্ত্রণাহীনতার ‘সাজেশন’ দিলে যতটুকু পারা যায় তার চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশিই পারেন। এ হল ‘অ্যাটেনশন’ বা মনোযোগ সরিয়ে রেখে কাজ হাসিলের উদাহরণ। অবিশ্বাস্য, তাই না?
সম্মোহন-নির্দেশিত বধিরতা ও দৃষ্টিহীনতা নিয়েও বার্বার কাজ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, সামনে একটা টেবিল রেখে তারপর সম্মোহিতকে যদি নির্দেশ দেওয়া যায় যে সে টেবিলটিকে দেখতে পাবে না, তাহলে পরীক্ষাধীন ব্যক্তি দাবি করে বটে যে সে বাস্তবিকই টেবিলটি দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু টেবিলের ওপারে রাখা কোনও জিনিস তুলে আনতে বললে সে কিন্তু টেবিলটি ফুঁড়ে যাবার চেষ্টা করে না, তার পাশ দিয়ে ঘুরেই যায়, যদিও কেন ওভাবে গেল তার কারণ জিজ্ঞেস করলে অন্য কোনও অদ্ভুত অজুহাত দেয়। এমনি করে বার্বার নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেন যে, তথাকথিত ‘শারীরিক’ প্রমাণগুলো আসলে থিওডোর সার্বিন-এর ‘রোল প্লেয়িং’ তত্ত্বকে মোটেই খণ্ডন করতে পারে না!
তাহলে, এত সব চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আমরা এখন ঠিক কোথায় এসে পৌঁছলাম?
এসে পড়লাম এমন একটা মুহূর্তে যেখানে সম্মোহন তত্ত্বচর্চায় রয়েছে দুটি সমান্তরাল চিন্তাধারা বা ‘স্কুল’। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী আর্নস্ট হিলগার্ড ও তাঁর শিষ্যরা বলছেন সম্মোহন ‘কিছু একটা বটেই’, অর্থাৎ, এর পিছনে রয়েছে মন ও মস্তিষ্কের বাস্তব কোনও এক বিশেষ ‘স্টেট’ বা দশা– ঘুম বা মাদকাচ্ছন্ন দশার মতোই। তাই, এই ধারাকে বলা হচ্ছে ‘স্টেটিস্ট স্কুল’, আমি যার বাংলা করতে চাই ‘দশাবাদী ধারা’। আর তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী থিওডোর বার্বার ও তাঁর শিষ্যবর্গ, যাঁরা বলছেন ‘সম্মোহন’ হল সামাজিক প্রত্যাশা অনুযায়ী এক বিশেষ ধরনের আচরণ যার পিছনে রয়েছে ‘অ্যাটেনশন’ বা মনোযোগ আর ‘মোটিভেশন’ বা প্রণোদনার খেলা। এই ধারাটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘সোশিও-কগনিটিভ স্কুল’, যার বাংলা হয়তো হতে পারে ‘সমাজ-অনুজ্ঞাবাদী ধারা’। বলা দরকার, হিলগার্ড ও বার্বার উভয়েই এখন গত হয়েছেন, তাঁর শিষ্যরা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু তাহলে প্রশ্ন, বার্বার ও তাঁর শিষ্যরা যদি অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিপক্ষকে সুনিশ্চিতভাবে খণ্ডনই করে থাকেন, তাহলে আবার বিরোধী ধারার অস্তিত্ব থাকে কী করে? এর উত্তর হচ্ছে, প্রথমত, জ্ঞানের জগতে কোনও কিছু প্রমাণিত হলেই তা প্রতিষ্ঠিত হয় না, তাতে অনেক সময় লেগে যেতে পারে, অনেক সংশয় ও বাধা পেরোতে হতে পারে। দ্বিতীয়ত, ‘ব্রেন স্ক্যানিং’ প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হবার পর এই বিতর্ক এক নতুন জীবন পেয়েছে। বিশ শতকের শেষদিক থেকে ‘এফ এম আর আই’, ‘পেটস্ক্যান’ এবং এই ধরনের ‘ব্রেন স্ক্যানিং টেকনিক’ কাজে লাগিয়ে নতুন করে বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে, এবং এ বিতর্ক নতুন আকারে আজও চলেছে। দশাবাদী গবেষকরা সম্মোহিত ব্যক্তির মস্তিষ্ক নানা যন্ত্র দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে বলছেন, সম্মোহিত হলে মস্তিষ্কের ক্রিয়াশীলতায় নানা পরিবর্তন ঘটে, অতএব সম্মোহন বাস্তব ‘কিছু একটা’ বটে। আর তার উত্তরে সমাজ-অনুজ্ঞাবাদীরা বলছেন, মনোযোগ বা প্রণোদনার পরিবর্তন হলেও তো মস্তিষ্কে কিছু না কিছু ঘটবারই কথা, কাজেই সম্মোহিতের মস্তিষ্কে ‘কিছু একটা’ ঘটলেই যে সেটা ‘সম্মোহন’ নামক কোনও এক নতুন বস্তু বলে ধরতে হবে, এমন দায় মোটেই নেই। বিষয়টি যারপরনাই চিত্তাকর্ষক, তবে সে সব কথা অন্য কোনও সময়ে সবিস্তারে হবে। আপাতত এ পর্যন্ত বিবৃত ইতিহাসকে একটু ফিরে দেখে ক্ষান্ত দিই।
এ পর্যন্ত যে ইতিহাস বললাম সেটা নিয়ে সংক্ষেপে একটু ভেবে দেখা যাক। এক্কেবারে প্রাচীনকালের সম্মোহন বলতে বোঝানো হচ্ছে তন্ত্র-মন্ত্র দিয়ে বশ করা (এখনও অনেকে তাই বোঝেন)। অষ্টাদশ শতকে জার্মান ডাক্তার মেসমার বিশেষ অঙ্গভঙ্গি ও পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁর রুগীদের মধ্যে যে মানসিক উত্তেজনা ও শারীরিক খিঁচুনি আনতে পারতেন সেটাকেই বলা হল ‘সম্মোহন’। উনিশ শতকে ফরাসি চিকিৎসক শার্কো বললেন, সম্মোহন হচ্ছে কৃত্রিমভাবে তৈরি বায়ুরোগ। কিন্তু ওই একই সময়ে ওই ফ্রান্সেই আবার বার্নহাইম বললেন, সম্মোহন আসলে স্রেফ মনোবিদের ‘সাজেশন’ বা নির্দেশ মেনে আচরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। বিশ শতকের একেবারে গোড়াতে ফ্রয়েড বললেন, সম্মোহন মানে সচেতনের বেড়া ভেঙে অচেতন মনের বেরিয়ে আসা। আর রাশিয়াতে পাভলভ বললেন, সম্মোহন হচ্ছে ঘুম ও জাগরণের এক মধ্যবর্তী অবস্থা। কিন্তু তার পরেই বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত আসতে লাগল জাগ্রত ও স্বাভাবিক অবস্থাতেই সম্মোহনের রাশি রাশি তথ্য– উইজলি ওয়েল্স্, মিলটন এরিকসন, সালভাতর রুশো, লেসলি কুন প্রমুখ মহারথীদের হাত ধরে। পঞ্চাশের দশকে মনোবিদ থিওডোর সার্বিন এইসব দেখেশুনে চিন্তা করলেন, আচ্ছা, যুগ যুগ ধরে এই যে এতসব আলাদা আলাদা বিষয়কে ‘সম্মোহন’ বলে চালানো হচ্ছে, ব্যাপারটা আসলে এমন নয় তো যে, সব যুগেই মনোবিদ ও রুগীর নিজস্ব বিশ্বাসই প্রতিফলিত হয়েছে তাঁদের আচরণে? এই মত খ্যাত হয় ‘সোশ্যাল রোল প্লেয়িং’ নামে। বিশ শতকের বাকিটা জুড়ে মার্কিন মনোবিদ থিওডোর বার্বার ও তাঁর শিষ্যরা প্রমাণ করলেন, ‘মনোযোগ’, ‘প্রণোদনা’ এই জাতীয় জানাচেনা ধ্যানধারণা দিয়েই সবকিছুর যৌক্তিক ব্যাখ্যা সম্ভব, ‘সম্মোহন’ বলে আলাদা একটা অদ্ভুত অজানা বিশেষ কিছু আছে বলে ধরে নেবার মোটেই দরকার নেই।
অবশ্য, এঁদের বিরোধীরাও আছেন। তাঁরা বলবেন, দ্য প্রুফ ইজ ইন দ্য পুডিং– সম্মোহন তো ‘ঘটছে’, তার মানেই সম্মোহন আছে। উত্তরে বার্বার সাহেব হয়ত মুচকি হেসে বলবেন, উঁহু, পুডিং খেয়েছি বটে কিন্তু কোনও প্রমাণ-ট্রমান তো কই দাঁতে আটকায়নি!
দেখলেন তো, শেষে গিয়ে আবার সেই পুডিং-এর কেস! গোড়াতেই বলেছিলাম, মিলল তো?
[ নিচে সম্মোহন সম্পর্কিত কিছু বই ও গবেষণাপত্রের কথা উল্লেখ করলাম, যা আমার বিবেচনায় অত্যন্ত প্রামাণ্য ও উচ্চমানের । এ লেখায় যা যা তথ্য ব্যবহার করেছি তার প্রায় সবই এই উৎসগুলো থেকে পাওয়া যাবে, এবং এখানে যা বলতে পারিনি এমন অনেক কিছুই জানা যাবে । শিরোনাম, লেখক, প্রকাশক এবং প্রকাশকাল — মোটামুটি এই ক্রমই এখানে অনুসরণ করেছি । পড়ার সুবিধের জন্য লেখকের নাম বক্রাক্ষরে (ইটালিক্স) উল্লেখিত হয়েছে । লেখাটি যদি কোনও সংকলনের অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধ হয়ে থাকে, তবে সংকলনগ্রন্থটির নাম উদ্ধৃতিচিহ্নের মধ্যে রাখা হয়েছে । এই তালিকার মধ্যে কিছু হয়ত আন্তর্জালে বিনামূল্যেই মিলতে পারে (শেষ দুটো তো বটেই), চেষ্টা করে দেখতে পারেন । ]
- A History of Hypnotism, by Alan Gauld, Cambridge University Press, 1992
- LSD, Marihuana, Yoga and Hypnosis (Modern applications of Psychology), by Theodore Xenophone Barber, Aldine Transaction, 1970
- They Call it Hypnosis, by Robert Baker, Prometheus Books, New York, 1990
- Experimental Hypnosis, by T. X. Barber, in “Handbook of General Psychology” (Ed. B.B. Wolman), Prentice Hall, 1973
- The dark side of history: subversive magic and the occult underground, by Michael Edwardes, Corgi Books, 1980
- Franz Anton Mesmer : The Wizard from Vienna, by Vincent Buranelli, Coward, McCann & Geoghegan, 1975
- The Chain of Reason versus the Chain of Thumbs, by Stephen Jay Gould, in “Bully for Brontosaurus”, W. W. Norton & Company, 1992
- Hypnosis: Fact and fiction, by F. L. Marcuse, Pelican Books, 1959
- Does Neuroimaging of Suggestion Elucidate Hypnotic Trance?, by Amir Raz, International Journal of Clinical and Experimental Hypnosis, 59:3, 363-377, 2011
- Hypnosis and the relationship between trance, suggestion, expectancy and depth: Some semantic and conceptual issues, by Graham F. Wagstaff, American Journal of Clinical Hypnosis, 53:1, July 2010
*মতামত সম্পূর্ণত লেখকের নিজস্ব।