Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পিউলি

অজিত রায়

 

হপ্তা বাকি থাকতেই হারিয়াড়ের মেলা শুরু। জাহেরথানের সরু ছায়ালু বনপথে মেয়েমরদ, নুনানুনির আনাগোনা জোর ধরে। পাহাড়ের ওপর জাহেরথান, মূল। বিশাল দুই চাট্টান। লোকে বলে ওখানে মাথা ঠেকালে খোদ মারাংবুরু মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

বুধনি বলল, ‘চ পাগলা, মাথা ঠেঁকায় আসি।’

ছায়ায়, বেলাশেষের বাদলা আলোয় কাঁচা বুনোপথ। সরু রাস্তাটা বাঁকবদল করতেই চোখে লাগল বিস্ময়ের ঘোর। পথের দু-ধারে মেলার অকূল পসরা। দূর-দূরান্ত থেকে গরিব পসারিরা এসেছে। মেলা কমিটিকে কিঞ্চিৎ পাট্টাসেলামি দিয়ে দু-আড়াই হাত জায়গা ম্যানেজ। হরকিশিমি খেলনা, বেলুন, পটকা, জামাকাপড়, প্লাস্টিকের চটি, চুড়ি, ঘাগরা, চুন্নি, ব্লাউজ, কড়কড়ে বডিস। কাটতি বেশ। কেননা, দারুণ রঙচঙে জামাকাপড় পরা ছেলেমেয়েদের ঢল। কালো তেলকাষ্টে চেহারা, তেলচিটে বদন। সবুজ ফিতে, গোলাপি শাড়ির তরুণীরা কলকলিয়ে। মাথায় যেন বসন্তের ফুল। পুঁতির মালা, তাবিজ। কত দূর-দূর থেকে মানুষ! সঙ্গে পিঠে-বাঁধা নুনানুনি। তাদের পোটলা। মরদের কাঁধে নুনা, মেয়েমানুষের কাঁখে নুনি। তারবাদে মাইকে ঢ্যাড়া বাজছে : গিজতা গিজা গিজতা গিজা গিজিং গিজিং গিজতা গিজা ….

চারিধারে খুশিখুশি আবহ। সাঁঝের আলো একদমই ঢলে, তবু ভিড়ের আসায় খামতি নেই। ডুংরির ঢালে ঢিবরি আর হ্যাজাকের সারি। মাদল-ধামসার তফাৎ রেখে, ঝুমুরের টোল।

নাকের বেশর ঝিঁকিয়ে বুধনি হেথা-হোথা ছুটে বেড়াচ্ছে। অকারণে হাসছে, খিলখিলিয়ে। বহুদিন পর এরকম, বুকে উড়াল। মাথার চুল হাওয়ার তোড়ে বন্য। তার জোর আব্দার পাগলার পকেট না খসিয়ে আজ বাড়ি ফিরবে না। পাগলাকে বশে পেয়েছে কিনা, মানত সফল হয়েছে কিনা জানার এই তো ফারকাৎ। ফলত মাথার ফিতে, কানের দুল, প্লাস্টিকের চুড়ি, কপালের বিন্দি। মগলা কিছুতেই না করল না। শেষে কমলা আইসক্রিম, কাঠি গোঁজা। মাদলের তালে তালে মাজা দাপাচ্ছে বুধনি। তার মাজার ঝটকায় বাবুদের ক্যামেরা, স্মার্টফোন ক্ষণে ক্ষণে চমকায়।

অল্প দূরে চাখনার হাট। ছোট ছোট দোনায় বুট সিঝা, ছলা ভিজা, ঘুসুর মাংস, পোড়া মাছ, ডিমসেদ্দ, কালই ভাজা, আরও কত কী! সাথে চুকার ছয়লাপ। মহুয়ার চুকা, তাড়ি, মাড়ি, হাঁড়িয়া। মগলা বলল, ‘চ বুধনি, ইটাও হঁইয়ে যাক!’
বুধনির জন্য দশ টাকার দোনাভর্তি ঘুসু, মানে শুয়োরের মাংস, নিজের জন্য ছোলা সেদ্ধ আর কাঁচালংকা, নুন আর দু-চুকা মউল এনে পাশে বসল। ‘লে খা। আরও কুছু লিবি ত বল, মাঙ্গাছি।’

কাছাকাছিই, জোড়ায় জোড়ায় ঘাসের ওপর বসে পড়েছে আরও বেশ কজন। মেয়ে-মরদ, তরুণ-তরুণী, বুড়ো-বুড়ি। তাদের সঙ্গে নুনানুনি। বেশির ভাগই সাঁওতাল। তবে কোল আর মুণ্ডারাও ঢুকে পড়েছে। ভাষার খানিক ফারাক বাদে, মাদলের সাথে সবার তাল একই পানা। একজন মুণ্ডা বুড়ো কোমর দোলাতে গিয়ে অল্প টলে গেল, ওর বুড়ি ওকে সামাল দিল। বুড়োর ফোকলা খিখি। বুড়ি নিজের আঁচল দিয়ে বুড়োর ধুতি থেকে ভেজা ঘাস-পাতা ঝাড়ে।

‘লে, আর টুকুন খাঁয়ে ইবার উঠ।’

‘না। খাব নাই। হামার পাগলাকে হামি দেইখব।’ বুধনি নেশা-ধরা চোখে,– ‘মনে লেয় তুই হামার লতুন বর বটিস। আজই সাঙ্গা হইল তুর সঁগে।’

ভিকিরির পিয়াসু চোখে মগলা চেয়ে। এই প্রথম সেও বুধনিকে দেখছে। বুধনির কাঁখ, কাঁখতল, স্বাস্থ্য। আ, কতকাল এসব চোখে পড়েনি! ভুলেই গেছিল জঙ্গলের টানে। আজ একজাই হুটসে সামনে। নেশার তোড়ে হাঁটু অব্দি কাপড়, মহুয়ায় চোবানো ঠোঁটে কলকল করে হাসছে বুধনি। দিনের ফিরতি আলোর যাবতীয় ছটা আছড়ে পড়ছে বুধনির গায়ে। মগলা দেখল, বুধনি আগের চেয়ে আরেকটু পুষ্ট, চোখের তলায় কালি ফিকে, আর গাল দুটো বেজায় লালসীক। মগলা নামু হয়ে বুধনির মালাইচাকিতে থাবা রাখতেই হুটসে সরে গেল বুধনি। চোখে পাতার পর পাতা তুলে, কানখি নজর তাক করে পাগলার দিকে ছুঁড়ে দিল। পাগলা ঝটসে গর্দান তেরছা করে চোখের তীর সামলালো।– ‘ইটা কী হঁইছে রে বুধনি, আনজান লকগিলানের সামুতে মজা লিছিস? চ ঘর চ, আজ তুকে খাব।….’

মগলা আবার রিপিট করল কথাটা, ‘হঁ হঁ, আজ তুকে খাব। ঘরের কিবাড় আঁটে তুর শরীলের খিল খুইলে খাব। তুর হাড় হাড্ডি রক্ত মাস, সব খুলে খুলে চুষে-চিবায়ঁ খাব।’

‘হঁ, ইতো দিন পরলে তুর হুড়ালে ঘাপাং দিছে!’ বুধনি শরমরাঙা চোখে তাকায়,– ‘মাইরব এক ধাকান, সিধা যাঁয়ে গাঢ়ায় পালটি খাবি, হঁ….’

অবশ্য ভেতরে সত্যি বিদ্যুৎ খেলে গেছে। এমন কথা মগলার মুখে এক যুগ পর। বুধনির মানত তো হারিয়াড়ের আগেই সার্থক! ওর বুকের সবখানা মাঠ কাঁড়া-দৌড়ের জন্য খালি হয়ে গেল। কাঁড়া লাফাবে, গুঁতো লাগাবে, শিং বিঁধবে। ফলত মেলা থেকে ফিরনের পথে বুধনি ঈষৎ বেশিই মাতে।– ‘ইবার তুকে পালাতে দিব নাই রে পাগলা! এইঠিনে বান্ধে রাইখব। বুঝলি, এই ঠিনে!’ সে বুকের ঢাকা উড়িয়ে দুই সুডৌল বুনো বাতাপির মধ্যবর্তী গভীর চিড়ফাঁট দেখায়। তদুপরি ভরপুর মাংস কেঁপে কেঁপে ছোঁয়া দেয় মগলাকে। বুধনির অন্ধকারে মাখা কালো দারুমূর্তি থেকে ভুতকেশী ফুলের তেজী কামগন্ধ বেরিয়ে মগলার রক্তাঞ্চলে দ্রুত চলাফেরা করে।

‘বুধনি, তুকে আজ খাব। আজ হামার হুড়াল খেপেছে। আজ খাব। এখনি খাব। লে, তুই ভুঁয়ে লিটা।’
শালবীথি পেরুতে গিয়ে বুধনি নাকের বেশর ঝিঁকিয়ে থমকে দাঁড়ায়। তার চুল, তার শাড়ি, তার সর্বাঙ্গ তিরতির কাঁপে।

–‘কী রে জাড় লাগছে?’

–‘হঁ, দমে জাড়। জাড়ে ঘাম দিছে, ভিৎরে ঝইরছে–’

মগলা বুধনির গা ছুঁয়ে দেখল ওর সমস্ত মাংস বেজায় উত্তপ্ত। আলাভোলা যতই হোক, মুহূর্তে ঠাউরে ফেলল, বুধনি পিউলি হয়ে গেছে। এ এমন ফুল, অতিশয় কামতুরা হলে নিজের ভার আর নিজে বইতে পারে না। শরীর ও শাড়ি ঢলে ঢলে পড়ে, লুটিয়ে। মগলা বলে, ‘হ, বুঝলি। কাপড়টো খুল আর ভুঁয়ে লিটা।’

অন্ধকার, নির্জন বুনোপথ। কেউ নেই চেয়ে দেখবার। মাদলের ধিতাং ধিতাং বোল শাল-পলাশের শাড়ি ভেদিয়ে, রুকনির জলে ছলাৎ মেরে, অদূরের ফুলডুংরি পাহাড়ে ধাকান খেয়ে নেশার শরীর আরও নাচবন্ত করে। অন্ধকার ছায়াঘন নির্জন রাস্তায় শালপাতা, বেলো পাতার অনিবার ওড়াওড়ি। গা জুড়ে মাতলা বাতাস। পুবের আকাশে তা দিচ্ছে বাদলা পোঁচড়।
ওরা ক্ৰমে আবাসা হয়ে পরস্পর জড়াজড়ি করে শুয়ে পড়ে শালপাতার ঘেসো জমিনে। আপাদ উলঙ্গ পিউলির হস্তাদি দু হাতে ধরে মগলা তার বুকে লেহন চালু করে। অপরবাগে বুধনিও নিজস্ব রসনোলা মাধ্যমে অবলেহ ও চাটন সহকারে মগলার হুড়ালটিকে সমূহ শরিফ করে। মগলা অতঃপর মুচড়িয়ে নোয়াতে থাকে সুমনের পাপড়ি, কেশর, টাটি ও পুষ্পরজ। অবস্থা এতাদৃশ যে চুড়ির ঝিনির ঝিনির আর শরীরী ঝাপটানি ব্যতিরেকে বাদবাকি সব নিস্তব্ধতায় নিলীন।

ক্ৰমে বাতাস আরও শান খেলে, বৃষ্টিরও ছেনালি শুরু। প্রথমে চিরুনি ছিঁটে, ফের আঁচল পুরো আছড়ে। কখনও থামে, গস্তানি মতন চায়, হাঁপায়, ফের ঝমঝম নাদে। এমনি করে আধ ঘণ্টা প্রায় চলল। কাঁচা রাস্তায় পাঁক লেগে দুটো আদিম শরীর বেহদ পিছল। শালতলায় ভিজে তৃণের জাজিমে অনবরত নতুন রেখাচিত্রের বয়ন। দুঃখ কষ্ট হতাশা, দিনানুদিনের রূঢ় শিলালিপি মুছে তাদের শরীর ও মনে সাঁঝচাঁদের হিমেল কিরণরেখা।

একসময় ধীরে শান্ত হয়ে আসে মাদল। শুধু সর্বাঙ্গে পাতা-ভেজানো জলের টুপটাপ। অবসিত বাহু সিক্ত বসন মাজায় জড়ায়। গিঁট বাঁধে। খোঁপায় ফিতে। তারপর মৃদু ভঙ্গে শালগুঁড়ি ধরে উঠে দাঁড়ায় উভয়ে। দুজনেই সদ্যসমাপ্ত সম্ভোগক্রীড়ায় যুগপৎ তোষিত ও অবসন্ন। ধরিত্রীও তৃপ্ত– তার সুখী কলকলানি, শীৎকারের পদ্মগন্ধ ক্ৰমে দূর হতে দূরে অপচীয়মান।