চার নম্বর নিউজডেস্ক
In order for the character of a human being to reveal truly exceptional qualities, we must have the good fortune to observe its action over a long period of years. If this action is devoid of all selfishness, if the idea that directs it is one of unqualified generosity, if it is absolutely certain that it has not sought recompense anywhere, and if moreover it has left visible marks on the world, then we are unquestionably dealing with an unforgettable character.
ওপরের লাইনগুলি দিয়েই শুরু হয়েছে ফরাসি লেখক জাঁ গিয়োনোর ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত সেই বিখ্যাত ছোটগল্প, পিটার ডয়েলের ইংরেজি অনুবাদে যার নাম দ্য ম্যান হু প্ল্যান্টেড ট্রিজ। গল্পের নায়ক এলজার্ড ব্যুফের একা হাতে এক বিরাট বনভূমি গড়ে তুলেছিল জলহীন, ছায়াহীন মরুপ্রায় এক এলাকায়। গল্পের কথকের সাথে প্রথমবার এলজার্ডের দেখা হয় ১৯১৩ সালে। যেখানে প্রভাঁস অঞ্চলে এসে মিশছে আল্পসের ঢেউ, সেই অঞ্চলে একা একা ট্রেক করার সময়। তখন সঙ্গের সব জল ফুরিয়ে গেছে, ঠা ঠা রোদ্দুরের মাঝে আর পা চলছে না, মৃত্যু বুঝি আর দূরে নয়। মেষপালক এলজার্ডের কাছে মিলেছিল জল, আশ্রয়, আর অদ্ভুত এক প্রশান্তি। একলা এলজার্ড প্রতিদিন সকালে বেরিয়ে পড়ে একশো ওক বীজ নিয়ে, আর সেগুলি যত্নের সাথে পুঁতে দেয়। এরকম সে করে আসছে বেশ ক’বছর ধরে। প্রায় হাজার দশেক ওকচারা লকলক করে বেড়ে উঠছে একটা বড় এলাকা জুড়ে।
এরপর আসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, কথক সেই যুদ্ধে অংশ নেয়। যুদ্ধশেষে ক্লান্ত, অবসন্ন সে আবার বেরিয়ে পড়ে এলজার্ডের খোঁজে। দেখে গাছগুলি আরও বড় হয়েছে, আরও বিস্তৃত হয়েছে বনভূমি। বিশ্বব্যাপী ধ্বংস আর কোলাহলের কিছুই ছুঁতে পারেনি তাদের। শুধু এলজার্ড আগে ভেড়া চরাত, এখন মৌমাছি পোষে। কচি চারাগুলো থেকে ভেড়াদের সরিয়ে রাখতে সমস্যা হচ্ছিল বলে। আরও এক বিশ্বযুদ্ধও একইভাবে পার করে দেয় এলজার্ড। সাতচল্লিশ সালে যখন সে মারা যায় ততদিনে পুরোপুরি বদলে গেছে এক বিশাল ভূখণ্ড– মরুপ্রান্তর ঢেকে গেছে সবুজে সবুজে।
কল্পনার চরিত্র এলজার্ডের কাহিনীর সাথে ভারি মিল আসামের জোড়হাট জেলায় ব্রহ্মপুত্রের বুকে অরুণা চড়ার বাসিন্দা ‘পদ্মশ্রী’ যাদব পায়েং-এর। দুজনেই সভ্যতার চোখে প্রান্তবাসী মানুষ। এলজার্ড ছিল মেষপালক, যাদবের সংসার চলে গোরুর দুধ বেচে। পঞ্চাশ পার করা এলজার্ডের মনে হয়েছিল মরুভূমি হয়ে আসা পাহাড়ের ঢালে গাছ লাগালে আবার সেখানে জীবনের স্পন্দন ফিরে আসতে পারে। ব্যস। নিজের ঘাড়ে সেই দায়িত্ব তুলে নিয়েছিল সে। অরুণা ছাপড়ির ধু ধু বালুচরে আটকা পড়া ব্রহ্মপুত্রের বন্যায় ভেসে আসা শ’খানেক মৃত সাপ দেখে সদ্য দশ ক্লাস শেষ করা যাদবেরও মনে হয়েছিল একটু ছায়া পেলে এভাবে মরতে হত না ওদের। সেই ১৯৭৯ থেকে আজ অবধি প্রতিদিন এলজার্ডের মতোই অক্লান্তভাবে ছায়া তৈরি করে চলেছে যাদব। কাজ শুরু করার তেইশ বছর পর এলজার্ডের সৃজিত জঙ্গল দেখে বনবিভাগের কর্মীরা ভাবতেই পারেনি এটা মানুষের হাতে গড়া। সেই একই অবস্থা হয় আসাম বনদফতরের কর্মীদের, যখন ২০০৮-এ হাতির পালের ফসল নষ্ট করার অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তারা হাজির হয় অরুণা চড়ায়। বারোশো একরের কাছাকাছি বিস্তৃত বাঁশ, বহেড়া, সেগুন, গামার, অর্জুন, কৃষ্ণচূড়া, ছাতিম, আতা, কাঁঠাল, সাবাই ঘাস আর ওষধিতে ঠাসা এই হরজাই জঙ্গল ‘মোলাই কাঠোনি’ একজন মাত্র মানুষের চেষ্টার ফসল! বিশ্বাস করা কঠিন ছিল যাদব ‘মোলাই’ পায়েংকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানানো স্থানীয় সাংবাদিক জিতু কালিতা বা কানাডিয়ান উইল ম্যাকমাস্টারের পক্ষেও। ম্যাকমাস্টার তো পুরো ব্যাপারটাকেই একটা ধাপ্পাবাজি বলে ধরে নেয়। পরে মোলাই কাঠোনির গভীরে বড় বড় গাছ মাপা দূরত্বে সাজানো থাকতে দেখে তার ভুল ভাঙে।
এলজার্ডের সাথে যাদবের সবচেয়ে বড় মিল তাদের প্রচার-স্পৃহার অভাবে। পদ্মশ্রী পেয়েও, দেশে বিদেশে বহু সম্মান পেয়েও যাদব নিজের কাজ একই ছন্দে করে চলেছে। আশি-নব্বই দশকের উত্তাল সময়ে, যখন আসামের অনেক উপজাতির হাতেই বন্দুক উঠে এসেছিল, মিছিং উপজাতির যাদব তখনও সে সব কিছুর থেকে সরে মেতেছিল নিজের সাধনায়। সবার চোখের আড়ালে ঘটে যাচ্ছিল এক নিঃশব্দ বিপ্লব।
তবে অমিলও আছে। এলজার্ড চুপচাপ মানুষ ছিল। যাদব কিন্তু কথা বলতে পারে। তার ছোট ছোট চোখে স্বপ্ন খেলা করে যখন সে বলে দেশের সব স্কুলের বাচ্চাদের অন্তত দুটো করে গাছ লাগিয়ে বড় করতে হবে, অথবা দ্বীপের পাড় ঘেঁষে ঘন সারিতে নারকেল গাছ বসালে তারা আটকে দেবে মাজুলির ভাঙন। সে বিশ্বাস করে সবাই মিলে চেষ্টা করলে একদিন পৃথিবী আবার সবুজে সবুজ হয়ে উঠবে। ব্রহ্মপুত্রের আগ্রাসী বন্যারই মতো আমাদের এই ক্যুডন্ট-কেয়ার-লেস দানবীয় সভ্যতার স্রোতে ভাসতে ভাসতে ‘ফরেস্ট ম্যান’ যাদবের নিয়ে আসা গস্পেলে ভরসা করতে বড় ইচ্ছে হয়।