চার নম্বর নিউজডেস্ক
‘ছাত্র ও রাষ্ট্র’ স্পেশাল ট্রেনে আমরা চার নম্বর নিউজডেস্কের তরফে যাদবপুরের দুজন ছাত্রের বক্তব্য রাখলাম। শাল্মী বর্মণ এবং সপ্তক মণ্ডল। দুজনেই কলা বিভাগের, শাল্মী সদ্য প্রাক্তন এবং সপ্তক দ্বিতীয় বর্ষের। আমরা চেয়েছিলাম মেডিকেল কলেজেরও একজন ছাত্রের বক্তব্য একই সাথে রাখতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে লেখাটি যথাসময়ে হাতে না পৌঁছনোয় প্রকাশ করা গেল না।
শাল্মী বর্মণ
প্রাক্তনী, ইংরাজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
অ্যাডমিশন কমিটির সিদ্ধান্ত, যেটা কিনা একটা ৪০ বছরের নিয়মও বটে, তাকে নাকচ করে যাদবপুরের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল (ইসি) সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে এ বছর আর্টস ফ্যাকাল্টির ছ’টি বিভাগে বি.এ.-তে ভর্তি হওয়ার জন্য অ্যাডমিশন টেস্ট নেওয়া হবে না। ভর্তি নেওয়া হবে বোর্ড পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে। কিন্তু কেন? কেন এতদিন ধরে চলে আসা একটি স্বাধীন এবং স্বচ্ছ সিস্টেমকে পালটাতে হবে? কোনও ছাত্রছাত্রীর তরফ থেকে কোনও অভিযোগ এসেছে বলে তো শোনা যায়নি! যে ১৭০০০ ছেলেমেয়ে চলে আসা পদ্ধতির ওপর ভরসা করে এ বছর ভর্তির আবেদন করেছিলেন, তাদের বিশ্বাসেরই বা কী মর্যাদা রইল?
শিক্ষামন্ত্রী অন রেকর্ড বলেছেন, “যাদবপুর ছাত্রভর্তির ক্ষেত্রে দুটি ভিন্ন মানদণ্ড প্রয়োগ করতে পারে না। কোনও কোনও বিষয়ে ছাত্রছাত্রীরা কেবল মেধার ভিত্তিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবে, আর কোনও বিষয়ে তাদের মেধার সঙ্গে আবার প্রবেশিকা পরীক্ষাও দিতে হবে— এ হয় না।” বোর্ডের পরীক্ষায় মেধা যাচাই হয়, আর প্রবেশিকা পরীক্ষায় হয় না— শিক্ষামন্ত্রীর এহেন অত্যাশ্চর্য দাবিটিকে আপাতত ছেড়ে দিলাম। সায়েন্স বা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর থেকে হিউম্যানিটিজে যে কিছু আলাদা দক্ষতার প্রয়োজন হয়, ফলে সেটি আলাদাভাবেই যাচাই করা বাঞ্ছনীয়— এটা বলারও প্রয়োজন নেই। প্রশ্ন একটাই— একটি স্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ‘এক মডেল’ চাপিয়ে দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকার এত ব্যগ্র কেন?
রাজনৈতিক সর্বগ্রাস সমস্ত কিছুকে এক গতে বাঁধতে চায়। আর সে জন্য তার হাতিয়ার হল এক মেকি স্বচ্ছতার ধারণা ছড়ানো। মন্ত্রীমশাই যখন এই স্বচ্ছতার কথা বলছেন, তখন কিন্তু তিনি ভেবেও দেখছেন না যে, যাতে কোনও পক্ষপাত না হয় সে জন্য যাদবপুরের প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রতিটি উত্তরপত্র একটি কোডিং এবং ডিকোডিং সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে যায়, এবং স্বনামধন্য অধ্যাপকরা যৌথভাবে সেগুলি দেখেন। তিনি এটাও ভাবছেন না যে, এই সিস্টেমই ধারাবাহিকভাবে অসাধারণ ফল দিয়ে চলেছে এবং উৎকর্ষের বিচারে যাদবপুরের শ্রেষ্ঠ ফ্যাকাল্টিই হল পাবলিক নলেজ। আসলে এগুলি তার ভাবার প্রয়োজন নেই। তিনি স্বচ্ছতা বা মেধা কিছুরই ধার ধারেন না। বৌদ্ধিক যোগ্যতা তাই তার কাছে নিছকই কিছু নম্বর। তার আপত্তির মূল জায়গা হল এই প্রবেশিকা পরীক্ষার পদ্ধতি এমনই এক পদ্ধতি, যেখানে কোনও তৃতীয় ব্যক্তির হস্তক্ষেপ খাটে না। রাজনৈতিক সর্বগ্রাস সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে কুক্ষিগত করতে চায়। এটাই তার চরিত্র। যাদবপুরের কলা বিভাগের এই নিয়ন্ত্রণ হাতে আসলে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে কার্যত গোটা বিশ্ববিদ্যালয়কেই। তার জন্য হিউম্যানিটিজের হবু যোগ্য ছাত্রদের ভবিষ্যৎ বলি দিতে হলে? হবে!
হিউম্যানিটিজে স্মরণশক্তি বা মুখস্থবিদ্যার চাইতে বেশি প্রয়োজন হয় সৃজনশীল চিন্তা করার ক্ষমতা। রাজ্য বা দেশের কোনও স্তরের পরীক্ষাতেই এই ক্ষমতাকে উৎসাহ দেওয়া বা পরখ করা হয় না। এই সাধারণ সত্যটাকেই ভুলিয়ে দিতে চাইছে রাজ্য সরকার। তাদের এই কুৎসিত হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টা কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রবেশিকা পরীক্ষার ওপরেই আক্রমণ নয়, বরং একে দেখতে হবে সামগ্রিকভাবে সাধারণের নাগালে থাকা একটি উৎকৃষ্ট শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আক্রমণ হিসেবেই। যারা যাদবপুর শুনলেই ভুরু কুঁচকান, তাদের এই সত্যটা উপলব্ধি করার সময় এসেছে। এটি আসলে বৃহত্তর জনগণের ওপরেই আক্রমণ, কারণ, যাদবপুর, শেষ বিচারে, জনগণের একটি সম্পদ।
সপ্তক মণ্ডল
ইংরাজি বিভাগ, দ্বিতীয় বর্ষ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
সমাজকে নিজেদের তাঁবে রাখার জন্য জোর করে অন্যায় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া সমাজপতিদের প্রাচীন অভ্যেস। একসময় গ্রামের মোড়ল থেকে শুরু করে দেশের রাজা যা করতেন, এখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত শাসকও সুকৌশলে একই কাজ করেন। আর এমন পরিস্থিতিতে সব দেশে সব কালে শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মুখ ছাত্রসমাজ, সমাজের সবচেয়ে নির্ভয় সংবেদনশীল অংশ। ভয় দেখিয়ে, মেরে, অপবাদ দিয়ে যদি ছাত্রছাত্রীদের মেরুদণ্ড একবার ভেঙে দেওয়া যায়, তাহলেই কেল্লা ফতে– অর্ধেক যুদ্ধেই জিত। দেশজুড়ে তাই স্বয়ংশাসিত মুক্তবুদ্ধির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। ‘আমার খাও, আমার পড়ো, অতএব আমার কথা শুনে চলতে হবে’– ফ্যাসিস্ট শাসকের হিসেবপত্র খুব সহজ। এমনই প্রবণতার এক অনিবার্য ক্রসসেকশন যাদবপুর, যেখানে দুর্নীতির দোহাই দিয়ে ভর্তির প্রবেশিকা পরীক্ষা তুলে দিতে তৎপর হয়েছেন কর্তৃপক্ষ ও শাসক দল। এটা অগণতান্ত্রিক, এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় হস্তক্ষেপ করে, তাকে বিপথগামী করে তোলার পথ আরও মসৃণ করতে চান তারা। পরীক্ষা ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করে প্রথমে MCQ , পরে বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ এনে পরীক্ষায় হস্তক্ষেপ করার পরিকল্পনা করে সরকার। তাতে আমাদর অধ্যাপকগণ ও ছাত্র উভয়েই অত্যন্ত অপমানিত ও অবহেলিত বোধ করেন, এবং যাঁরা এই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরির দায়িত্বে, তাঁদের প্রতি এই অনাস্থাকে তীব্র কটাক্ষ করেন। এই বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়ানেয়া ও দোলাচলের মাঝে কর্তৃপক্ষ হঠাৎ ২৭শে জুন, একটা বৈঠকে জানান যে কিছু অনিবার্য কারণে প্রবেশিকা পরীক্ষা ব্যবস্থা তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা এই বছরের জন্য। তামাম কলকাতার শিক্ষাজগৎ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ওঠে ও সরকারের সুবিধাবাদী রাজনীতির তীব্র কটাক্ষ শুরু করে, ছাত্রছাত্রীরা অনড় অবস্থানে বসেন, এবং তাতে কর্তৃপক্ষ পাত্তা না দেয়াতে, ২০ জন ছাত্রছাত্রী জীবন বাজি রেখে আমরণ অনশনে নামে, যাদের প্রত্যক্ষভাবে এই পরীক্ষা ব্যবস্থার সাথে কোনওরকম ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িয়ে নেই। আমাদের দাবি, সেই পুরনো পরীক্ষা ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনতে হবে, এবং কোনওরকম বহিরাগত প্রভাব এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কাঠামোতে পড়বে না। আইনি জটিলতার দোহাই দেখিয়ে, ইউনিভার্সিটি স্টেটুট এর নিয়ম ভেঙে, যেরকম বেআইনি কাজকর্মে লিপ্ত হয়েছে কর্তৃপক্ষ, সেটা অত্যন্ত নিন্দনীয়। কার অঙ্গুলিহেলনে এসব হচ্ছে, তা বুঝতেও বাকি নেই আমাদের। আমরা আমাদের পুরনো দাবিতেই অনড় থেকে, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে গিয়েছি, সাথে সঙ্গত দিচ্ছেন আমাদের মাস্টারমশাইরা, যাঁরা অদম্য স্পৃহার সাথে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন প্রতি পদক্ষেপে, আমরা যার জন্য ধন্য। প্রত্যেক বিভাগে ক্লাস বন্ধ, ছাত্রদের জায়গায় দেয়াল লিখনে ভরা ক্লাসরুম। সংগ্রাম চলছে জোরকদমে, শুধু কলা বিভাগেই নয়, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছেন প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বিভাগের লোকজন, তথা সমগ্র শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষজন। লড়াই চলছে, এবং অরাজকতাকে, ক্ষমতালোলুপতাকে আমাদের যুবা রক্তের সামনে মাথা নোয়াতে হবে, এই বিশ্বাস সকলের। কারণ, যাদবপুর যে কখনও হারতে শেখেনি।