Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্রিয় লুকা

সোহম দাস

 

প্রিয় লুকা,

অনেক শুভেচ্ছা! এ চিঠি যখন লিখতে বসেছিলাম, তখন তোমরা সেমিফাইনালে যাওয়ার টিকিট বুক করে ফেলেছ! তৃতীয় পেনাল্টিটা মারবার পরে দেখছিলাম তোমার মুখটা! হৃৎপিণ্ডটা স্তব্ধ হচ্ছিল কি? তারপরই তোমার লাফিয়ে ওঠা! একটা বড়সড় ভার নেমে গেল, তাই না? ইগরের হাত ছুঁয়ে পোস্ট ছুঁয়ে বলটা শেষমেশ জড়িয়েই গেল জালে! ওঃ, কী শান্তি! সেকেন্ড হাফ থেকে পুরো খেলাটা প্রায় একার হাতেই তুলে নিলে! ম্যান অফ দ্য ম্যাচ! এই নিয়ে তিনবার! সাবাশ, লুকা!

কলোভেয়ার হোটেল। যার পার্কিং লটে খেলতেন মডরিচ

লুকা, তোমার কথা প্রথমবার শুনেছিলাম জোসিপের মুখে। জোসিপ বালো। এসবই তো তোমার জানা! তোমাদের থাকবার সেই হোটেল। কলোভেয়ার। তার পার্কিং লট। যুদ্ধের আঘাত সেখানেও। অথচ তোমার কাছে তা কোনও বাধাই হল না! দিব্যি ওই ছোট্ট চেহারা নিয়ে এবড়োখেবড়ো জায়গাটায় ফুটবল পেটাতে। হোটেলের রিসেপসনিস্ট বলত, বোমা-গুলিতে যত না কাচ ভাঙে, তার থেকে বেশি কাচ তুমি ভাঙো! হাঃ! হোটেলেরই একজন কর্মী জোসিপকে তোমার কথা বলেছিল, মনে আছে? ও তখন ক্লাবের ফার্স্ট-টিমের কোচ। তোমরা তারপর এলে আরেকটা হোটেলে। ইজ। স্কুল আর ট্রেনিং করার যাতে সুবিধা হয়! মনে আছে, তোমরা খেলছ আর হঠাৎই বোমারু বিমানের গোঁ-ও-ও, তারপরেই ভয়ংকর সব শব্দগুলো! একরকম অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তোমাদের! তোমাদের নিয়ে ছুটে পালাতে হত নিরাপদ আশ্রয়ে! তুমি অহেতুক জেদ করতে! আচ্ছা, সেই শিনপ্যাডগুলোর কথা মনে আছে তোমার? তোমার বাবা কাঠ চিরে বানিয়ে দিয়েছিলেন সেগুলো! ব্রাজিলের রোনাল্ডোর ছবি সাঁটা ছিল তাতে! ওগুলো আমি রেখে দিয়েছিলাম… যত্নে…

মডরিচদের বাড়ি। পরিত্যক্ত। ধ্বংসের মুখে

আমার তো এখন অখণ্ড অবসর! সূক্ষদেহটায় ভর করে হালকা মন নিয়ে ঘুরে বেড়ানো শুধু! আচ্ছা লুকা, তোমার সেই বাড়িটাকে মনে আছে? তুমি তখন খুবই ছোট। ওরা জ্বালিয়ে দিল তোমাদের বাড়িটা। তোমার বাবা-মা তোমাকে আর তোমার একরত্তি বোন জেসমিনকে নিয়ে তখন ৪০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে চলে এসেছে আমাদের এই শহরে! বাড়িটা এখনও আছে, জানো! ভেলেবিত পাহাড়ের ঢালে পাথুরে প্রান্তরে! বড্ড একলা! চাল নেই। হাড় জীর্ণ! একটা মনকেমনের হু-হু হাওয়া খেলা করে বেড়ায়! আর তোমার দাদু! দাদুর কথা মনে আছে তো নিশ্চয় তোমার! তোমরা দুই লুকা মিলে কত কী করতে! সেই দাদুকে ওরা কীরকমভাবে মেরে ফেলল! পাহাড়ের মাথায় ভেড়া চরাতে গিয়েছিলেন তোমার দাদু। জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে পেছনদিক থেকে গুলি করেছিল। সঙ্গে আরও ছ’জনকে! মাত্র ছ’বছর পেরিয়েছে তখন তোমার! সেই ছোট্ট তুমি কীরকম হয়ে গিয়েছিলে তখন! ক্রমাগত খুনের হুমকি ওই সার্ব উগ্রপন্থীদের! তারপর তোমাদের জ্যাডারে পাড়ি! তোমার নতুন জীবনে পাড়ি! কলোভেয়ার! ইজ! গোলাকার স্বপ্ন ডানা মেলল পায়ে পায়ে! আমাদের দেশ স্বাধীন হল! বড় ক্লাবে গেলে! বাবা-মা, জেসমিন আর দিওরের জন্য জ্যাডারে একটা ৮০ স্কোয়্যার ফিটের ফ্ল্যাট! গর্ব হয় সত্যিই, লুকা!… শুধু একলা পড়ে রইল বাড়িটা! আরও কতদিন থাকবে!

যুদ্ধ থামল। সকলে ফিরতে শুরু করেছে! রয়ে গেলে তোমরা! তোমার ফুটবলের জন্যে! কষ্ট করেছিলেন তোমার বাবা-মা! অসম্ভব আত্মত্যাগ! তোমার কাকাও! সেই শিনপ্যাডগুলো… আঃ, একই কথা বলছি বারবার! আসলে বয়স… যাক সে কথা! লুকা, সেই হাজদুক স্প্লিত! বলেছিল, এত কম ওজন আর হাইট নিয়ে ফুটবল হয় না! মনে আছে, তুমি ফুটবল ছেড়েই দেবে বলেছিলে! তারপর আমাদের ক্লাবে! আমিও বলেছিলাম, এত ছোট চেহারায় হবে না! তোমাকে বারে ঝুলিয়ে রাখতাম দিনের পর দিন! কিন্তু আমি যে দেখেছিলাম, তোমার মধ্যে জিনিস আছে! তুমি শুধু ফুটবলপ্রেমী হতে আসোনি! আটবছর থেকে তারপর তোমার যাত্রা জ্যাগ্রেবের পথে! জীবনের পথটা শুধু ভাবো লুকা! যে ক্লাব একদিন রিজেক্ট করে দিয়েছিল তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীরা লুফে নিল তোমায়! ডায়নামো! দ্রাভকোর সাথে বলেকয়ে তোমায় পাঠালাম! সেই দ্রাভকোই… আচ্ছা পরে আসছি সে কথায়! আশা ছিল, তুমি ভালো করবেই! তারপর ওরা তোমায় জ্রিন্সকিতে পাঠাল! সেইখানে জাত চেনালে তুমি! লিগের প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার! একটা বড় প্রশস্তি! ওদের লিগটা বড় বেশি ফিজিক্যাল ফুটবলে বিশ্বাসী। সেখানে তুমি ফ্লাইং কালার্সে বেরিয়ে এলে! তুমি, লুকা, তুমি… যাকে একদিন বড় ক্লাব বলেছিল এত দুর্বল চেহারায় খেলা হয় না! আসলে লুকা ফুটবলটা যে হয় মস্তিষ্ক দিয়ে, হৃদয় দিয়ে! এখন তোমার ছোটাগুলো দেখি মাঝমাঠ ধরে! ফাউল করতে এসেও বোকা বনে যায় ডিফেন্ডারগুলো, আর আমি দেখি আমার ছোট্ট ছেলেটা কীরকম অবলীলায় কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ওদের, পায়ে হরিণের গতি! নাঃ, বড় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছি! তারপর যা বলছিলাম, জ্রিন্সকি মস্টার থেকে আবার নিজের দেশে! ইন্টার জ্যাপ্রেসিচ! ওদের সেকেন্ড করলে, সাথে ইউরোপা লিগে তোলা! তোমার গ্রাফটা ক্রমশই ওঠার দিকে দেখে এসেছি! তারপরেই ফিরলে ডায়নামোতে! ২০০৫। এসেই জ্যাডারে তোমার কিনে দেওয়া ৮০ স্কোয়্যার ফিটের উপহারটা ওদের জন্যে! আদর্শ সন্তান তুমি! সব মনে আছে লুকা! ডায়নামোকে পরপর তিনবার চ্যাম্পিয়ন করলে! শেষ দুবার ক্রোয়েশিয়ান কাপও! বড় ক্লাবের কথা চালাচালি শুরু হল। আর্সেনাল চায়। তোমার প্রিয় ক্লাব চেলসিও। লুকা, আবারও দেখো, তুমি শেষমেশ রেকর্ড দামে টটেনহ্যামে গেলে! ওদের রাইভ্যাল! টটেনহ্যামকে দায়িত্ব নিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে তুললে! ভেবে দেখো, একসময় হাজদুকে খেলতে চেয়ে নাম করলে ডায়নামোতে। চেলসিকে সমর্থন করে নায়ক হয়ে উঠলে হোয়াইট হার্ট লেনে। এরকমভাবেই হয়ত বরাবর ঠিক হয়ে আছে তোমার ডেস্টিনি, এরকমই থাকবে! যেরকম একসময় বলতে, বার্সেলোনায় খেলা তোমার স্বপ্ন!

ক্রোয়েশিয়ান ফুটবলে মডরিচের প্রি-রেজিস্ট্রেশন ফর্ম

রিয়ালে পৌঁছে আমায় ফোন করেছিলে, লুকা! মনে আছে তো? তোমার তো আজকাল শুনি কিছুই নাকি মাঝে মাঝে মনে পড়ে না! দেশের গর্ব তুমি! মানুষের সাথে এমন প্রতারণা তোমার সাজে না! পারলে ক্ষমা চেয়ে নিও! তাতে ইমেজের কোনও ক্ষতি হবে না! যাইহোক, যা বলছিলাম! আসলে আমার প্রিয়তম ছেলেটার কাছ থেকে এসব আশা করতে পারব না, কোনওদিনও! তুমি কোথা থেকে উঠে এসেছ, নিজের চোখেই তো দেখেছি! কীরকম ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিশ্রম করে যেতে! তারই সুফল তো পাচ্ছ আজ! প্রতিটা সিজনে পাস অ্যাকিউরেসি, বল রিকভারি, ফাউলস ওয়ন, চান্সেস ক্রিয়েটেড– সবের উপরে জ্বলজ্বল করে আমার ছেলেটার নাম! চূড়ান্ত পেশাদার একটা ক্লাব যারা ফিটনেস পড়ে গেলে ‘লেজেন্ড’ শব্দটারও কোনও গুরুত্ব দেয় না, তাদের দলের ইঞ্জিন হয়ে উঠলে! ২৪শে মে, ২০১৪। লিসবনের ফাইনালের রাত। তোমার করা তিরানব্বই মিনিটের কর্নারটা থেকে সের্জিওর গোল! সমতা! তোমার জীবনের প্রথম সবচেয়ে বড় ট্রফি! ম্যাচের পরে তুমি আমার কথা বলেছিলে! বলেছিলে, এই জয়টা আমাকে উৎসর্গ করছ! তার ঠিক তিন মাস আগেই মায়া কাটিয়ে ফেলেছি আমি! এখন সত্যিই আফসোস হয়, লুকা, অল্প হলেও! আরও তিনটে মাস যদি বাঁচতাম…

তমিস্লাভ বাসিচের সঙ্গে

২০১৫-তে তোমার চোট পেয়ে বেরিয়ে যাওয়াটা ওদের কাছে বড় ফ্যাক্টর হয়ে গেল! ওরা বলেছিল, তোমার যোগ্য পরিবর্ত পাওয়া যায়নি! আহ, এসব শুনলে মনটা কেমন ছটফটিয়ে ওঠে! ইচ্ছে করে, গিয়ে জড়িয়ে ধরি তোমায়! তুমি আসলে অনেকটা ওয়াইনের মতো! যত বয়স বাড়ছে, যত বেশি অভিজ্ঞ হচ্ছ, ততই যেন মেলে ধরছ নিজেকে! গতবছর উয়েফার বেস্ট মিডফিল্ডার পুরস্কারটা পেলে! ব্যালন ডি ’ওরের দৌড়েও ছিলে! ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপেও গোল্ডেন বল। এখন মাঝমাঠে তোমার সমকক্ষ কেউ নেই! আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে গোলটা দেখেছি! এরকম গোল আগেও করেছ! ক্লাবের হয়ে! দেশের হয়েও ইউরো কাপে! কিন্তু এই গোলটা তোমাকে সত্যিই একরকম পূর্ণতা দিয়েছে! তিনজনকে সামনে রেখে ওরকম একটা ফেন্ট। তাতেই ঘেঁটে গেল ওরা! তারপর নিয়ে এলে একদম দুরূহ একটা কোণে! তিনজনের মাঝখান দিয়ে কার্লড শটটা! ওটা শুধু পা দিয়ে তুমি মারোনি, মেরেছ হার্ট থেকে! আরও দেখছিলাম, নিকোলাসের দিকে ওভাবে বুক বাগিয়ে তেড়ে গেলে! ক্যাপ্টেন! লিডার! গার্জেন! ডেনদের বিরুদ্ধে ওই থ্রু-টা! ওরকম একটা থ্রুই যথেষ্ট জেতানোর জন্য! দুর্ভাগ্য তোমার! তবে বিশ্বাস করো, পেনাল্টিটা মিসের পরও আমার খাঁটি বিশ্বাস ছিল তুমি ঠিকই পারবে! পারলেও! হয়ত শুধু আমি নই, তোমাকে যারা চেনে, কলোভেয়ারের পার্কিং লট থেকে দেখছে যারা তোমায়, তারা হয়ত সকলেই জানত তুমি পারবেই! পারলেও! তুমি জানতে ক্যাসপার কোনও একটা দিকে ঝাঁপাবেই! কী ঠান্ডা মাথায় সোজা ঢোকালে বলটাকে! একটু একটু করে এগিয়েছ! এ চিঠি যখন শেষ করছি, তখন তুমি দলকে নিয়ে মস্কোতে! ইতিহাস গড়ে ফেলেছ তোমরা! আরও একধাপ পেরোতে পারলেই বৃত্তটা সম্পূর্ণ! লুকা, ’৯৮-এর কথা মনে পড়ে! তখন তেরো তুমি! বন্ধুদের সাথে ফুটবল দেখতে! সেমিফাইনালে হেরে গেলাম আমরা! খুব মনমরা হয়ে গিয়েছিলে! আজকে কী মনে হচ্ছে, লুকা? পারবে? নাঃ, এসব প্রশ্ন করে তোমায় বিব্রত করব না!

আচ্ছা, বিব্রত করার কথা যখন উঠলই, একটু আগে দ্রাভকোর কথা বলছিলাম! দ্রাভকো এতটা স্বার্থলোভী আমার জানা ছিল না! ওকেই বলেকয়ে তোমায় জ্যাগ্রেবে পাঠাতে পেরেছিলাম! সে-ই কিনা তোমাকে এভাবে ফাঁসাল! কিন্তু তুমিই বা এই মিথ্যাচারটা করলে কী করে? স্টারডম বাঁচাতে? ইমেজ বাঁচাতে? কী লাভ হল? দেশের একাংশ তোমায় বিশ্বাসঘাতক বলছে, লুকা! যে হোটেলে তোমরা ছিলে, সেই ইজে তোমার উদ্দেশ্যে ব্যঙ্গ পোস্টার! লুকা, আমারও সত্যিই বিশ্বাস হচ্ছে না! আমার ভাগ্য ভালো হয়ত জীবদ্দশায় তোমার কালিমালিপ্ত হতে দেখে যেতে হল না! তবু তোমায় শুভেচ্ছা, দেশকে স্বপ্ন দেখাতে পেরেছ এতকিছুর মধ্যেও! সবকটা ম্যাচ জিতে চূড়ান্ত স্টেজে পৌঁছেছ তোমরা, তোমার দল, তুমি! ফাইনালটায় উজাড় করে দিও! তেতাল্লিশ লক্ষের ছিয়াশি লক্ষ চোখের ওপরেও আরও কয়েকজন– তোমার দাদু, তাঁর সেই ছয় সঙ্গী, তোমাদের সেই বাড়িটা, আমি…

ইতি,

তমিস্লাভ,

(যাকে একদিন বাবা বলে ডাকতে তুমি)