Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অথ ‘গণশত্রু’ কথা

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

 

ইয়ে দুনিয়া হ্যায় ইয়া আলম-এ-বদ হাওয়াসি
ইয়ে দুনিয়া আগার মিল ভী যায়ে ত ক্যায়া হ্যায়

–শাহীর লুধিয়ানভি, প্যায়াসা

যোগ্যতা ও শত্রুতার মাঝে একটা ক্ষীণ রেখা আছে। সেটা পার করা উচিত নয়। সংসদে একবার এক প্রবীণ বিজেপি সাংসদ এই মন্তব্য করেছিলেন। করেছিলেন নিজেরই দলের আরেক প্রবীণ নেত্রীর বিরুদ্ধে। সেই নেত্রীই হলেন সুষমা স্বরাজ, দুঁদে ও দক্ষ প্রশাসক গভর্নর স্বরাজ কৌশলের স্ত্রী। মোদী সরকারে কেন্দ্রীয় বিদেশমন্ত্রী। ইদানীংকালে দেশব্যাপী ‘টুইটারে’-র কুরুক্ষেত্রে ক্রমেই যিনি মহামতি ভীষ্মের মতো শত সহস্র সমালোচনার তীরের উপর শরশয্যা গ্রহণ করেছেন।

সেন্ট্রাল হলের বাইরে টি বোর্ডের সামনে প্রবীণ সেই বর্ষীয়ান নেতা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলেছিলেন, যোগ্যতা অনেক ক্ষেত্রেই অস্বস্তির কারণ হতে পারে, অতি যোগ্য হলে তো কথাই নেই। সেদিন তার সে কথায় বেশ প্রতিবাদই করেছিলাম। বলেছিলাম, তাহলে তো যোগ্য ব্যাক্তিদের বাদ দিয়েই দেশ চালাতে হয়। তাতে অসুবিধা কিছু নেই। শুধু সেই রাষ্ট্রটি জাহান্নমে যাবে। নেতাটি বলেছিলেন, রাষ্ট্রের পিঠোপিঠি রয়েছে দুটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দের আলাপ ও বিস্তার– রাষ্ট্রনীতি ও রাষ্ট্রবাদ। ঘুড়ি ওড়ানোর সময় লাটাইয়ের সুতোয় ঢিল দেয়া ও গুটানোর তত্ত্ব জড়িয়ে রয়েছে যার সাথে। স্থান কাল পাত্র সাপেক্ষে সেই খেলা শিখে নিতে হয়। যে এই অলিখিত ‘রুলবুক’ অনুসরণ করবে সেই টিকে থাকবে এই খেলায়, নচেত নয়। সেদিন প্রবীণ লোহিয়াপন্থী মানুষটির সাথে পুরোপুরি একমত হতে না পারলেও, ইদানীং কেন্দ্রীয় বিদেশমন্ত্রীর জঘন্য হেনস্থার ইতিহাস দেখে সেই তত্ত্বেই, কেন জানি না, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে।

প্রায় পনেরো দিন হতে চলল, বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে সারাদেশ জুড়ে বহুমানুষ ‘টুইটে’ নিদারুণভাবে ‘ট্রোল’ বা নিন্দা করে চলেছেন। আজও তা পূর্ণ উদ্যমে অব্যাহত। তাদের দাবি সুষমা যোগী আদিত্যনাথের ‘গড়’ উত্তরপ্রদেশের লখনৌতে এক পাসপোর্ট আধিকারিককে ইচ্ছাকৃতভাবে এক পাসপোর্ট আবেদনকারী দম্পতিকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন করার অভিযোগে বদলি করেন ও সেই দম্পতিকে পাসপোর্ট জুটিয়েও দেন। ওই আধিকারিকের চোখে স্ত্রী হিন্দু অথচ স্বামী মুসলিম, এই তত্ত্ব অত্যন্ত গোলমেলে ঠেকেছিল। সেই দম্পতি সুষমাকে নালিশ জানাবার পর, তিনি তৎক্ষণাৎ আধিকারিকের বদলির ব্যবস্থা করেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টুইটারে বিদ্বেষপূর্ণ, নিম্ন মনোবৃত্তিসম্পন্ন কুকথার ঝড় বওয়া শুরু হয়, যার মূল ‘এজেন্ডা’ সুষমা নাকি মুসলিম তোষণ করছেন। সুষমাও থেমে থাকেননি। টুইটের পালটা টুইট করে ছুঁড়ে দেন ‘চ্যালেঞ্জ’। এরপর সুষমা টুইটারেই জনমত নেওয়ার আয়োজন করেন— তাঁকে এই রূপ অকথ্য অপমান করা ঠিক হচ্ছে কিনা? ১,২৪,৩০৫ জন এই প্রসঙ্গে মত দান করেন, ৫৭% বলেন, এটা অত্যন্ত অন্যায়। কিন্তু ৪৩% জানান, এই ‘আক্রমণ’ যথার্থ। সুষমা গর্হিত অপরাধ করেছেন, তাকে কথা শুনতেই হবে। এই সংখ্যাটি ৫৩,৪৫১ ও তা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে [সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা]। অর্থাৎ, অধিকাংশ মানুষ মনে করছেন কাজটি অন্যায়। তাই সুষমার প্রতি নিক্ষিপ্ত তীব্র জঘন্য বাক্যবাণগুলি ন্যায়সঙ্গত।

মোদী সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় অন্যতম ‘হাই প্রোফাইল’ বিদেশ মন্ত্রকের দ্বায়িত্বে থাকা সুষমা তার কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা, আবেগপ্রবণতা, সৎ ও কড়া সিদ্ধান্তের জন্য দল ও বিরোধী পক্ষ উভয়েরই শ্রদ্ধার পাত্রী। মন্ত্রকের কাজ ও ‘টুইটার’ উভয়ক্ষেত্রেই তিনি সিদ্ধহস্ত। ‘টুইটারে’র দুনিয়ায় তিনি ‘কল্পতরু’৷ এতটা সম্ভবত মোদীও নন। যার ফলে ‘টুইটারে’ তার ভক্ত ও অনুগামীদের সংখ্যা আকাশছোঁয়া। পাসপোর্ট পেতে সমস্যা হোক বা ভিনদেশে কোনও অনাকাঙ্খিত বিপদ, বিদেশ মন্ত্রকের কাজ হোক বা অন্য মন্ত্রকের কাজ, সামাজিক সংকট হোক বা ব্যাক্তিগত বিপর্যয়– সবেতেই রয়েছে সুষমার বরাভয়। যেন সরকারের মধ্যে থেকেও তিনি নিজেই এক ‘সমান্তরাল’ সরকার। তিনি বাগ্মী, বিদূষী, বুদ্ধিমতী, স্থিতধী ও দক্ষ প্রশাসক৷ প্রায় সমস্ত রাষ্ট্রদূতদের তিনি নাম ধরেই সম্বোধন করেন। মন্ত্রকের প্রতিটি বিষয় তার নখদর্পণে৷ সেই ‘অতিমানবিক’ সুপার ওম্যান সুষমাকেই কিনা দেশবাসী সরাসরি তুলে দিল নীতিবোধের কাঠগড়ায়, শুধুমাত্র দুই পৃথক ধর্মের দম্পতিকে সাহায্য করার সুবাদে। হয়তো এটা আমাদের দেশেই সম্ভব। হয়তো সত্যি সুষমার বোঝা উচিত ছিল ‘যোগ্যতা ও শত্রুতার মধ্যবর্তী সেই ক্ষীণ রেখা’টির কথা। বোঝা উচিত ছিল মাঝেমাঝে রাষ্ট্রবাদকে বস্তায় পুড়ে যমুনায় ভাসিয়ে রাষ্ট্রনীতি নামের মানিয়ে চলার ক্লেদজ লিঙ্গনীতিতে মাথা ঠেকানো দরকার। কিন্তু সুষমা তা করেননি। তাই বুঝতে পারেননি কখন জনগণের সেবা করতে গিয়ে নিজেই একাংশের কাছে ‘গণশত্রু’ ও সর্বোপরি নিজের দলে ‘দলশত্রু’তে পরিণত হয়েছেন। আর এটাই ‘ট্র‍্যাজেডি’।

কথায় বলে, দুনিয়াদারির পথে চলতে গিয়ে হোঁচট খেলে মানুষ ঘরেই ফেরে প্রিয়জনের কাছে শুশ্রুষার জন্য। কিন্তু সেই ঘরই যদি নেপথ্যে হোঁচট খাওয়ার ইন্ধন জোগায়, তবে? কেন্দ্রীয় বিদেশমন্ত্রীর ক্ষেত্রেও তাই দেখা গেল। যখন সংখ্যালঘু তত্ত্বের ভিত্তিতে ঝাঁকেঝাঁকে কটাক্ষ ও সমালোচনার বাণ উড়ে আসছে তার দিকে, তখনই দেখা গেল সেই তীরগুলির অধিকাংশই গেরুয়া রঙে মোড়া৷ উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের পাশাপাশি বিজেপি শিবির থেকেও উড়ে এল বিরুদ্ধ সমালোচনা, অশালীন মন্তব্য ও কটুকথা৷ অভূতপূর্বভাবে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং অবতীর্ণ হলেন মৌনমদির ভূমিকায়। শুধু মাত্র ভোটব্যাঙ্ক ও ‘নেপোটিজমে’র তাগিদে সুষমা স্বরাজের হেনস্থায় একটা শব্দ খরচা করলেন না প্রধানমন্ত্রী। সুষমা বাড়ি ফিরলে যেন তার স্বামী তাকে উত্তম মধ্যম দিয়ে সহবত শেখান– এমন ভয়াবহ স্পর্ধা বেপরোয়া উগ্রতা যখন আছড়ে পড়ছে এক পঞ্চাশোর্ধ মহিলার উপর তখন সেই চূড়ান্ত ধৃষ্টতা নিয়েও মুখ খোলেননি মোদী। রাজনাথ সিং, নিতিন গড়করির মতো বিজেপির শীর্ষ নেতারাও এ নিয়ে তীব্র ও মৃদু সমালোচনা করলেও প্রধানমন্ত্রী সহ বিজেপির সিংহভাগ ছিল মৌন। এই ঘটনাই মনে করিয়ে দেয় নাগপুরে আরএসএস শিবিরে যাওয়া নিয়ে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ঘিরে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ওঠা ঝড়ের প্রসঙ্গ। প্রশ্ন ওঠে, এই মৌনতার আড়ালে আগ্রাসী ভিড়কে প্রচ্ছন্ন মদত দিলেন না মোদী? যেন মৃদু প্রতিহিংসার ঝলক উঠে এল কোথাও। আর এখানেই রাষ্ট্রের অভিভাবকরূপে তার ব্যর্থতার দলিল লেখা হয়ে গেল।

এহেন কঠিন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সুষমা কী করবেন বা কী করা উচিৎ তা নিয়ে শুরু হয়েছে দরকষাকষি। প্রশ্ন উঠেছে বিজেপিতে তার থাকা নিয়েও। একজন মন্ত্রীরূপে তার যা করণীয় তিনি তা করেছেন। সেই সিদ্ধান্ত ঠিক কি ভুল তা সময় বিচার করবে। কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের জনগণ বা শাসকদলের মনোভাবের যে কদর্য চিত্র উঠে এল ভারতীয় রাজনীতি তা সহজে ভুলতে পারবে না। জনতা বহু ক্ষেত্রে অগভীর, আবেগতাড়িত, উগ্র ও অপরিণত। দেশের শাসনকার্যের মাথায় বসা নেতারাই তাদের অভিভাবক। তাই তাকে শাসন করার বদলে তা নিয়ে ঘৃণ্য রাজনীতি খেললে একদিন কাঁচা মাঞ্জায় নিজের হাতই ফালাফালা হবার সম্ভাবনা থাকে। সুষমা নিগ্রহ সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের দিকে ক্রমশ ঠেলে দিচ্ছে দেশের একতা, সার্ব্যভৌম ও অখণ্ডতার সংস্কৃতিকে। তাই সময় থাকতে ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো।

শেষে মনে পড়ছে সেই গল্প দুটি। প্রথমটি, কথামৃতে পড়া এক সাপের গল্প। ঋষি তাকে হিংসা ত্যাগের মন্ত্র দিয়েছিলেন যা নিত্য পাঠ করে বদরাগী সাপটি হিংসারহিত হয়ে পড়ায় গ্রামের লোক সাহস পেয়ে তাকে অত্যাচার করতে থাকে। দীর্ঘকাল বাদে সন্ন্যাসী ফিরে এসে দেখেন সাপটি হিংসা ত্যাগ করেছে বটে কিন্তু মন্ত্রের গুণে অত্যধিক ক্ষমাশীল হয়ে স্বাভাবিক প্রতিরোধের ক্ষমতাও হারিয়েছে। সন্ন্যাসী তাকে বলেছিলেন যে তিনি হিংসা ত্যাগ করতে বলেছিলেন ঠিকই কিন্তু প্রাণ বাঁচাতে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধসাপেক্ষ ‘ফোঁস’টুকু করতে বারণ করেননি। সাপটি বুঝতে পারে তার করণীয় কী!

অন্য একটি গল্পে প্রতিদিন মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় এক বিছে সন্ন্যাসীর পথ আটকাত। সন্ন্যাসী হাতে বিছের কামড় খাওয়া সত্ত্বেও তাকে হাতে তুলে সরিয়ে দিত। প্রতিদিনই এমন অদ্ভুত কাণ্ড দেখে তার এক শিষ্য তাকে প্রশ্ন করায় সন্ন্যাসী জানান– ‘বিছে যদি বিছে হয়ে তার কর্তব্য না ভোলে, আমি সাধু হয়ে ক্ষমা ও উপকারের মার্গ ছাড়ি কী করে?’

ক্ষমা, প্রতিহিংসা, সহিষ্ণুতা, কর্তব্য ও প্রয়োজনে প্রতিরোধের এই বিপরীত নীতিপাঠ নেওয়ার সময় এসেছে। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপরিচালক উভয়েরই৷

আর, শেষের পরেও, মানে ঐ ইংরেজিতে যাকে লাস্ট বাট নট দা লিস্ট বলে, সে হল আমার-আপনার মতো এই সাধারণ মানুষের কথা। মন্ত্রীসান্ত্রীদেরই যদি এই আক্রান্ত এবং অপমানিত হতে হয়, আমরা কিন্তু নেহাতই উলুখাগড়া। সোশাল মিডিয়ার যে দানব আজ উন্মুক্ত, তা অনেক সময়েই প্রদীপের দৈত্যরূপে আসলেও, তার দাঁত-নখও রয়েছে কিন্তু। আমরা প্রস্তুত তো? দানব কিন্তু, ঐ যে বললাম, উন্মুক্ত!