Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এ-দেশে মহিলারা সুরক্ষিত নন : রয়টার্স-এর রিপোর্ট ঘিরে বিতর্ক

অন্বেষা বন্দ্যোপাধ্যায় 

 

এ সমাজ চেনে রক্ত-মাংসের একটা অবয়বকে। সেই শরীরটাকে, যা প্রতিমাসে রক্তসিঞ্চনে আগামীর বার্তা বহন করে। যদিও সে রক্তরেখা নাকি মেয়েকে অসূচি করে, তাই ঠাকুর ছোঁয়া নিষেধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই মেয়েরাই অক্লেশে চ্যালেঞ্জ জানায় পুরুষশাসিত সেনাবাহিনীকে; যুদ্ধবিমান, যুদ্ধজাহাজ তাদের হাতে ছেড়ে, নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যান ভারত-মা। ক্ষিপ্র গতি ও তীব্র ইচ্ছাশক্তিতে হিমা দাসের গলায় ঝোলে সোনার মেডেল, আবহে বাজে জনগণমন… যেমন বেজেছিল গীতা ফোগট, সাইনা নেহওয়ালের সময়ও। মিতালি রাজ ‘বিরাট’ অঙ্কের দশ ভাগ পেয়েও ২২ গজের যুদ্ধে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা ছিনিয়ে নেন।

কিন্তু জন্মপরিচয়ে তাঁরা যে নারী। কেমন করে সমাজ তাঁদের সাফল্যকে কুর্নিশ করবে? তাই সওয়াল করা হয়, কেন পুরুষ ক্রিকেটাররা টাকা বেশি পান। নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করা হয়, এক জন স্বর্ণপদকজয়ী অ্যাথলেট কেন ইংরেজি জানেন না! ওঠে আরও অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন। অর্থাৎ গতে বাঁধা সমাজের গড্ডালিকা প্রবাহ বলে ওঠে, তুমি তো মেয়ে। তাই এটাই তোমার প্রাপ্য। ঠিক যেভাবে বলা হয়, কর্মক্ষেত্রে মহিলার পদোন্নতি? সে তো কর্তৃপক্ষকে শরীরী আনন্দ দিলেই হয়ে যায়। পরিশ্রম ও সততা দিয়ে মেয়েরা কাজ করে নাকি! নাহ, সমাজ মানবে না যে একজন মহিলাও তাঁর একশো শতাংশ মনোযোগ ও শ্রম দিয়েই সাফল্যের শীর্ষে যেতে পারেন।

কারণটা কিন্তু সেই তাঁর সেই জন্ম-লিঙ্গেই লুকিয়ে।

নারীর প্রতি সমাজের এমন একবগ্গা মনোভাব দেখেই কবি জীবনানন্দ দাশ সম্ভবত লিখেছিলেন,

পৃথিবীতে সুদ খাটে: সকলের জন্য নয়।
অনির্বচনীয় হুন্ডি একজন দু-জনের হাতে।
পৃথিবীর এই সব উঁচু লোকদের দাবি এসে
সবই নেয়, নারীকেও নিয়ে যায়।

এই নিয়ে যাওয়ার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে আদি রসের ইঙ্গিত। বীরভোগ্যা বসুন্ধরার অনুষঙ্গ। নারী অর্থাৎ শরীর। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তি থাকবে না, থাকবে শুধু জীববৃত্তি। সহবাসেও মত থাকবে না, থাকবে শুধু ‘ভোগ করায় সম্মতি।’

ভারতীয় সমাজের এই বাস্তবতার জন্যই হয়তো চোখের সামনে বারবার ভেসে ওঠে শীতের রাতে ছিন্নভিন্ন হওয়া এক তরুণীর ছবি। ভেসে ওঠে অজস্র কামদুনি-কাঠুয়া-সাতনা-উন্নাওয়ের স্মৃতি। জ্যোতির আত্মা বলে, আমি আলো দিতে পারিনি। অগুনতি নির্ভয়া প্রশ্ন করে, ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’

সে কথাই সাজিয়ে-গুছিয়ে-বিশ্লেষণ করে তুলে ধরেছে সংবাদসংস্থা রয়টার্স। সাম্প্রতিক রিপোর্টে তারা বলেছে, ভারত কোনও কোনও ক্ষেত্রে নারী সুরক্ষার ক্ষেত্রে সিরিয়া, সৌদি, আফগানিস্তানের চেয়েও খারাপ।

অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা সত্যি। কোনও গল্পকথা নয়, রীতিমতো অঙ্ক কষে ওই সমীক্ষা দেখিয়ে দিয়েছে, গত প্রায় দশ বছরে, মহিলাদের উপর নিগ্রহ বেড়েছে ৮৩ শতাংশ মতো।

কীসের নিক্তিতে এমন উপসংহার?

কন্যাভ্রূণ হত্যা থেকে শিশুকন্যা হত্যা, পণের জন্য অত্যাচার-খুন, জোর করে বিয়ে দেওয়া, মেয়েকে পড়াশোনা করতে না দেওয়া ও তৎসংক্রান্ত মানসিক নির্যাতন, গার্হস্থ্য হিংসার নানা দিক, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা-সহ আরও নানা কিছু, সাধারণ যানবাহনে নারীনিগ্রহ, নারীপাচার ও যৌনদাসত্ব এবং বন্ডেড লেবার। বিশ্বের দ্রুততম উন্নয়নশীল অর্থনীতির এই হচ্ছে অন্য ছবি।

তাহলে? কালে কালে যেখানে ধ্বনিত হয়েছে, মহিলারা না এগোলে, তাঁরা নিরাপদ বোধ না করলে কখনওই সম্ভব নয় কোনও দেশের অগ্রগতি, তাহলে ভারতের কেন এমন ভিখারি-দশা?

উত্তরটা সহজ, কারণ, মহিলারা এদেশে এখনও দ্বিতীয় শ্রেণিরই নাগরিক। তাই তাঁদের সব কিছুই গুরুত্বহীন। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা বলছে, প্রায় ৭০ শতাংশ তরুণ মনে করেন স্ত্রী বা অন্য আত্মীয় মহিলাদের পেটানোর মধ্যে কোনও অন্যায় নেই। আবার প্রায় ৬৫ শতাংশ মহিলাও মনে করেন, স্বামী মারবেনই তো, এতেই বা অন্যায়ের কী আছে! ফলে সর্বত্রই ভাবখানা এমন তো হওয়ারই ছিল। কী আর এমন নতুন কথা রিপোর্টে বেরিয়েছে!

অনেকটা একইরকম মনোভাব খাস ভারত সরকারেরও। তাদের মহিলা ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রক তো এই নিয়ে কোনও মন্তব্যই করেনি, বরং আগ বাড়িয়ে জাতীয় মহিলা কমিশন একখানা প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। সেখানে তারা সাফ জানিয়েছে, এখন মহিলাদের বিরুদ্ধে যে কোনও ধরনের অপরাধ অনেক বেশি শাসি্ত হচ্ছে। মহিলারা সামনে এসে পুলিশে জানাচ্ছেন। এই রিপোর্টে যেসব বিশেষজ্ঞদের মত নেওয়া হয়েছে, তাঁরা ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি জানেনই না। তাই এমন ভুলে-ভরা রিপোর্ট!

কিন্তু আদতে কি ছবি তাই বলে? নাকি এখানেও সেই চিরকালীন রোগ ‘অস্বীকার করে বেঁচে থাকতে চাওয়া’ বা ‘Living in denial’– এই শান্তি পাচ্ছে ‘অচ্ছে দিন’-এর স্বপ্ন ফেরি করা সরকার?

পরিসংখ্যান বলছে, পরেরটা ঠিক। গত ৫ বছরের ‘এনসিআরবি’ তথ্য যদি বিশ্লষণ করা যায়, দেখা যাবে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ শুধু বৃদ্ধি পেয়েছে তাই নয়, নতুন ধরনের অপরাধও ক্রমশ বাড়ছে।

অপরাধের কথা যদি ছেড়েও দেওয়া যায়, তাহলেও দেখা যায় মেয়েরা কেমন পোশাক পরবে, কীভাবে চুল ছাঁটবে (মানে ছোট করলে কতটা), চশমা পরতে হলে কী করণীয়, রং ফর্সা নয় কেন, শরীরের গড়ন কেমন হবে, বিয়ে কবে হবে (মনে রাখবেন, করবে নয় কিন্তু), সন্তান হচ্ছে না কেন, দত্তক কেন, সিঙ্গল মাদার— এ আবার কেমন অলক্ষুণে খেয়াল, কেরিয়ার? ঘর-গেরস্তালির কাজ না জানা… সব নিয়েই সমাজের বড্ড মাথাব্যথা। এভাবে বলা যে আসলে মানসিক নির্যাতন তা কিন্তু ১০ জনের মধ্যে অন্তত ৯ জনই না জেনে করছেন। আর যে মহিলারা সবরকম অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছেন, তাঁরা সমাজের চোখে হয়ে উঠছে ‘রেবেল’ বা বিপ্লবী। আশঙ্কিত হচ্ছে সমাজ-সরকার। পাছে তাদের পুরুষতন্ত্রের মৌরসিপাট্টা চলে যায়! তাই স্তব্ধ করা হচ্ছে গৌরী লঙ্কেশের মতো যুক্তিবাদীদের, জেলে পোরা হচ্ছে বস্তারের আদিবাসীদের পাশে দাঁড়ানো সোমা সেনকে। বৃহদর্থে দেখতে গেলে এই সব নারীরা তো ‘উদ্ধত’। তাঁরা সমাজের লক্ষ্মণরেখা পেরিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছেন। এমন নারীদের কি মানা যায়! যায় না তো। কারণ এভাবে যে কিছু মেয়ে প্রতিবাদী তৈরি হচ্ছে। প্রতিবাদের স্বর যে বড় উচ্চগ্রামের, ভগবান যেখানে নিদ্রা গিয়েছেন, সেখানে এত গোলযোগ সইতে পারেন নাকি!

তাই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বললেই ব্যাখ্যা শেষ হয় না। তাই আপাত সহজ ব্যাখ্যার মধ্যে লুকিয়ে থাকে জটিল এক সমাজতত্ত্ব।

তাই এ রোগের উৎস লুকিয়ে সমাজ ও অর্থনীতির এক অশুভ আঁতাতে। যাকে আমরা ভোগবাদ বলে জানি। তারাই ঠিক করে দেয়, মহিলাদের স্থান কোথায় হবে। তাই প্রথম ও তৃতীয় বিশ্বের জন্য তৈরি হয় দ্বিবিধ বিজ্ঞাপন। প্রথম বিশ্বে নারী শরীরের সঙ্গে আসে তাঁদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রতিষ্ঠার কাহিনীও। তাই তাঁদের পণ্যায়িত উপস্থিতিকে সমাজ প্রশ্ন করে অন্যভাবে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বে তাঁরা শুধুই যেন ভোগ্যপণ্য। সেখানে কোনও বিজ্ঞাপনে মহিলাদের আত্মবিশ্বাসী দেখালে, তা হয় ব্যতিক্রম। তাই নারীর সমার্থক হয়ে যায় শরীর। সে জন্যই তাঁদের প্রতি অপরাধে আসলে কারও কিছুই যায় আসে না।

রাজা থুড়ি সরকারও চুপ করে থাকে। এমন কথা স্বীকার করলে যে মানে সাগবে। প্রকাশিত হবে এক নির্লজ্জ-নগ্ন সত্য, যা ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পঢ়াও’-এর পরিপন্থী। আর স্তাবকের দল তো আছেই, এক্ষেত্রে মহিলা কমিশন যে ভূমিকাটা পালন করেছে। কাজেই—

সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ, তবুও
সবাই হাততালি দিচ্ছে… কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম, চোখে
পড়ছে না যদিও, তবু আছে,
অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয়।
আর ঘুমিয়ে পড়েছে সেই শিশুটি, বা হারিয়ে গেছে, বা গুম হয়েছে। যার নিষ্পাপ কণ্ঠ ও দৃষ্টি প্রশ্ন তুলতে পারত, ‘রাজা, তোর কাপড় কোথায়?’

এমন রাজার দল সর্বত্র। সে জন্যই মহিলারা নিরাপদ নেই জেনেও তাঁরা নিদ্রা যেতে পারেন। অ্যাড দুনিয়ার রাজা আবার কাপড় দেখতেই চান না, চলচ্চিত্র দুনিয়ার রাজা দেখেন সূক্ষ্মতম মসলিন শাড়ি। আর আলো ছুঁতে চাওয়া নারীর দল একাই লড়ে নিজের লড়াই। কিন্তু তা সর্বজনীন নয়।

হঠাৎই ঘুম ভাঙে রাজার। মহাষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধিকালের ঢাকের শব্দে। আবার এগিয়ে আসছে একটা অবয়ব। ত্রিশূল হাতে। জাগ্রত তৃতীয় চক্ষু… শক্তিরূপিণীকে প্রণাম করেন তিনি। রাজার প্রণাম করা ‘বিকাশ’ দাঁড়িয়ে দেখে। মুচকি হাসেও…

পরদিন দেশ জুড়ে হইচই— প্রতি ৩১ মিনিটে একটি মেয়ে ধর্ষিত হচ্ছে। সদ্য শিকার ২, ৪, ৭ বছরের তিন শিশু।