Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বৃষ্টিপতনের শব্দ

বেবী সাউ

 

দুপুরের ঘুম জড়ানো চোখ। কানে বাজছে রিনিঝিনি সুর। একটা মোহনীয় আবেশে যেন তাল সাধছে কেউ। বৃষ্টি। ঝরঝর, ঝুনঝুন করে নামছে। ছাদের কার্নিশ বেয়ে, গাছের পাতা বেয়ে নেমে আসছে মাঠে ঘাটে।

আমাদের দোতলার জানলা দিয়ে দেখছি, সবুজ ধানের খেত জলে টইটম্বুর। অপূর্ব এক ভেজা গন্ধে ভরে আছে চারপাশটা। ব্যাঙ ডাকছে। ভিজে যাওয়া পাখিরা এসে ঢুকে পড়েছে পুবের বারান্দায়। নরদাদা, একটা ইয়া বড় বাঁশের তৈরি টুপি পরে পুকুর থেকে উঠে আসা মাছগুলিকে ধরছে। শিঙি, কই, মাগুর। উঠোনের এককোণে আমাদের নৌকোগুলি ভাসছে। ভাসতে ভাসতে পুকুরের দিকে ছুটছে। আর আমি ভাবছি, ডিঙি ভর্তি মাছের দৃশ্য। ভাবছি, পলাতক এক মনের গল্প। মন আনন্দে থইথই করছে। বৃষ্টির জন্য স্কুল নেই। টিউশন নেই। কেউ কাউকে বকছে না। মা-জেঠিমার তৈরি করা খিচুড়ি আর পাপড় ভাজা-তে বৃষ্টি আরও মধুময়, আরও রোমাঞ্চময়ী।

আর আমরা, দুই বোন, ভেবে নিয়েছি, আর যাই হোক এত সুরের মধ্য দিয়ে আমাদের গানের মাস্টার, পাঁচ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে কিছুতেই এসে পৌঁছাতে পারবেন না। নিশ্চিন্ত মনে আমি আর বোন ঘুমানোর ভান করে পড়ে আছি। মাঝেমধ্যে একেকবার পিটপিট চোখে দেখে নিচ্ছি বর্ষার গতিবেগ। চারপাশ অন্ধকার। আমগাছ ভিজে যাচ্ছে, ভিজে যাচ্ছে পুরোনো দিনের ধুলো। আনন্দের লহর বইছে যেন। কালো ধুয়াশা মেঘ। এত আনন্দের দিনে; পচা সরগম সাধতে হবে না ভেবে বেশ একটা ভালোলাগা জড়িয়ে আছে বুকের মধ্যে। কিন্তু বিকেল হতে না হতে কমে এল বৃষ্টির জলধারা। হালকা রোদ। আমাদের সমস্ত স্বপ্ন বৃষ্টিভেজা কাক হয়ে গেল। আর পরক্ষণেই ক্যাঁচ শব্দে খুলে গেল আমাদের সদর ঘরের দরজা। ভিজে জবুথুবু দুলালবাবু, গানের মাস্টার। সাইকেল ভর্তি কাদা। পা ভর্তি কাদা। সাদা পাঞ্জাবি চিপ্টে আছে শরীরে। ছাতা ভেঙে যা তা অবস্থা। এসে পৌঁছালেন।

জামাকাপড় পাল্টে বসলেন আমাদের খোলা বারান্দায়। চায়ের ধুম্রায়িত কাপ। মাদুরের ওপর বিরাজমান আমাদের হারমোনিয়াম। আমাদের দু-বোনের মুখ ভর্তি হতাশা, মনখারাপ। চারপাশ অন্ধকার করে বৃষ্টিধারা বইছে। মায়া, সুর, আলোয় ভরে আছে প্রকৃতি। বিষাদের মেঘ আমাদের মনে। কিন্তু হঠাৎই পাল্টে গেল পাঁজির সূচি। গ্রহের ফের। আর আমাদের রাগী দুলালস্যার, যিনি তার ভুল করলে বসাতেন এক বিরাট থাপ্পড়; আনমনে তাকিয়ে থাকলেন ভেজা রেলিঙের দিকে। কিছুক্ষণ পরে যেন ওই ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ধরলেন, (আমাদের দু-জনকে রেওয়াজ করতে না বলে) নিজেই গাইলেন– “মেঘমল্লারে সারা দিনমান/বাজে ঝরনার গান”– একের পর এক… সুরের গন্ধে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। চারদিকে ষোড়শী যুবতীর মতো নেচে যাচ্ছে বৃষ্টি। আর মা, জেঠিমা, বাবা, নরদাদা সবাই কাজ ভুলে ময়ূর হয়ে গেছে ততক্ষণে। সুর এসে ভরে দিচ্ছে আমাদের পোষমানা শ্রাবণকে। এক অজানা বৃষ্টিস্রোতে ধুয়ে যাচ্ছে আমাদের হরিতকী জঙ্গলের পিচ্ছল আয়ুর্বেদী দেহ। ধুয়ে যাচ্ছে নির্মম বিকেলের সূর্যাস্ত আর কুচিকুচি বিষাদ তুলো। তোমার গন্ধ ভিজছে, বহুদিন পরে, ভিজতে চাইছে জানালার ওপাশে জমে থাকা লেটারপ্যাড। তীব্র সুরের বাষ্পে ভরে যাচ্ছে পৃথিবীর হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, ব্লাড গ্রুপ– কোষের অণু পরমাণু। সুরের ছন্দে গাছ ভিজছে, পাথর ভিজছে, ভিজে যাচ্ছে টাটা স্টিল, সামনে দাঁড়ানো গাড়ির সারি আর ফুটপাথ। ছাদহীন মানুষেরা ভিজতে ভিজতে ভেজা শিখে গেছে সহজেই। আর ভিজছে আমাদের সমস্ত পাওয়া না-পাওয়া ঝুলি। গান। সরগম। কথা। আর সেদিনই প্রথম ঈশ্বর লাগছিল তাঁকে, গানের মাস্টার মশাইকে।

মনে আছে, সেদিন থেকেই আমিও প্রথম ভিজতে শিখেছিলাম। শিখেছিলাম গানের মধ্যে ভেজাতে আমার চারপাশটিকে।