প্রমিতা ভৌমিক
কোনও কোনও বৃষ্টি আসলে নিজের সঙ্গে নিঃশব্দ কথোপকথন। ঘুমের মধ্যে কারও দিকে বাড়িয়ে দেওয়া হাত। কাছে টানতে চাইছি, অথচ মাঝখানে দীর্ঘ অভিমান। অন্ধকার ঘন হয়ে এলে কোনও কোনও বৃষ্টি ক্রমশ একা করে দেয়। মাঝরাতে নাড়া দেয় স্মৃতির আশেপাশে। অথচ একা থাকার ভেতরে যে নিবিড় নির্জনতা ছুঁয়ে যায়, তা আমাকে নতুন করে বেঁচে ওঠা শেখায়।
একেক দিন বৃষ্টি হলে প্রেম আর অপ্রেমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকি আমি। সমস্ত আনন্দের পাশে থেমে থাকে আজন্ম লালিত বিষণ্ণতা। নিজের অজান্তেই কানে বেজে ওঠে– ‘আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে/তারই ছায়া পড়েছে শ্রাবণ গগন তলে’। সাদা-কালো দৃশ্যেরা আমাকে দুমড়ে-মুচড়ে, ছিঁড়ে-ভেঙে নিঃস্ব করে দেয়। আর ভাঙতে-ভাঙতে কখন যে এক নিবিড় অন্ধকারের ভেতরে ডুবে যেতে থাকি, বুঝে উঠতে পারি না ঠিক।
বৃষ্টি ঘন হলে নিজের কাছে খুলে যায় স্বীকারোক্তির আলো। কত সত্যিকে গোপন করে বেঁচে থাকি প্রতিদিন। কত সত্যিকে এড়িয়ে যাই অতি সযত্নে। বিশ্বাস আর অবিশ্বাস ছাড়াও জীবনে অন্য এক প্রত্যয়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় বর্ষা। যেভাবে জীবন আসতে পারত, যেভাবে এল না অসম্পূর্ণ নীরবতা– সব কিছু কেমন ওলটপালট হয়ে যায় অশান্ত জলের ঝাপটে।
বৃষ্টি এলে একটা অদ্ভুত বিরহ গ্রাস করে রেখে দেয় আমাকে। স্বল্পভাষী বলে কত দিন, কত রাত যে নিজের কাছে অসহায় হয়ে বসে থেকেছি, তা নিজেও জানি না। নিজেকেও বলা হয়ে ওঠেনি কত কথা। পুরনো প্রেম ঘিরে ধরেছে অফুরান বিস্ময়ে। মাঝে মাঝে ভেবেছি, তুমুলভাবে বেঁচে থাকি আবার; মাঝে মাঝে ভেবেছি, তীব্রভাবে চেয়ে থাকি নিজের চোখের দিকে। নিজের চোখ, নিজের ঠোঁট, নিজের চিবুক দেখে আয়নাকে বড় কাছের বলে মনে হয়েছে বার বার। বৃষ্টি কি তবে নার্সিসাস করে তোলে আমাকে! বিরহ আর নার্সিসিজম একসঙ্গে বেঁধে রেখে দেয়। ঘুম আসে চোখে। বর্ষার আলো-আঁধারি দেখতে দেখতে ঘোর লাগে, নেশা লাগে। আপন মনে দুঃখী লাগে নিজেকে।
বৃষ্টির ভেতরে কতরকম রং লেগে থাকে, খালি চোখে বুঝে উঠতে পারি না সব সময়। ঐ যে শুরুতেই বললাম, বৃষ্টির গভীরে একটা নিঃশব্দ কথোপকথন গাঁথা থাকে। সেই প্রতিটা কথাকে ঘিরে থাকে নানা রং। রামধনুর মতো একের পর এক ছবি খুলে যায় মাথার চারপাশে। দর্শক-আসনে বসে আমি ছুঁয়ে দেখি তাকে। শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে সদ্য যৌবনে আসা দিনগুলো চোখের সামনে এসে পড়ে। এত স্মৃতি গোপনে ছিল অথচ বুঝেও বুঝে উঠতে পারিনি। বৃষ্টি এক লহমায় নিয়ে চলে যায় ফেলে আসা দক্ষিণের বারান্দায়। নিয়ে যায় আলোর ভিড়ের পাশে জ্বলে ওঠা এক চিলতে অন্ধকারে। হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া দুঃখগুলো আমাকে ঘিরে ধরে প্রতিটা বৃষ্টির ছিটেতে। উপস্থিতের থেকে অনুপস্থিত, দৃশ্যের থেকে অদৃশ্য, ব্যক্তির থেকে নৈর্ব্যক্তিক দীর্ঘশ্বাস আমাকে বরাবর কাছে টেনে নেয়। বর্ষা এসে তাকে আরও গাঢ় করে দেয়। একটা নিভৃত আনন্দের অংশীদার করে তোলে।
বৃষ্টি নিয়ে সচেতনভাবে কিছু লেখার কথা ভেবে দেখিনি আগে। কারণ বৃষ্টি কত অনায়াসেই লিখে রেখেছে আমাকে। এত কথা বলার মাঝে একটা গভীর গোপন বৃষ্টিকে ক্রমাগত আড়াল করে কেটে যায় প্রতিটা দিন, প্রতিটা রাত পেরিয়ে যায়। চোখ বন্ধ করলে আলো-অন্ধকার পার হয়ে সামনে এগিয়ে আসে একটা ভোর– আষাঢ়ের ভোর। অনবরত বর্ষা সেদিন ধুয়ে দিচ্ছিল আমার দু চোখ। বাড়ি জুড়ে অসংখ্য লোক। এত মানুষ একসঙ্গে কোনও দিন আসেনি ঘরে। এত মানুষের চোখে একসঙ্গে এত জল দেখিনি এর আগে। বাগানের গাছগুলো তীক্ষ্ণ সবুজ হয়ে তাকিয়েছিল আমার দিকে। কত চেনা, তবু চির অপরিচিত। কিছু বলার থেকেও বেশি না বলা কথা সাজিয়ে অঝোরে ঝরে গেল জল। ভোরের ভেতর দিয়ে বাবা চলে গেল। শূন্য হাতে আয়ুরেখার পাশে জন্ম নিল অনিশ্চিত এক অদেখা বৃষ্টিরেখা।