Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্রাচীন ভারতে অপরাধ বিজ্ঞান

সুশোভন রায়

 

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর দীর্ঘ কাল সুখে রাজত্ব করার পর যুধিষ্ঠির ও তার ভাইয়েরা তো গেলেন স্বর্গে, সিংহাসন দিয়ে গেলেন নাতি পরীক্ষিতকে। এবার রাজা হওয়ার পরে একদিন খবর, তার রাজ্যে নিকৃষ্ট “কলি” প্রবেশ করেছে। খবর পেয়েই প্রচণ্ড রেগেমেগে তীর ধনুক নিয়ে দ্রুতগামী রথে চেপে ছুটলেন তাকে দমন করতে। যেতে যেতে পথের ধারে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে তিনি নিজের রথের গতি কমান। তিনি দেখতে পান, যে একজন রাজবেশধারী ব্যক্তি হাতের চাবুক দিয়ে একটা তিন পা ভাঙ্গা ষাঁড়কে বেদম পেটাচ্ছে, আর তার পাশে দাঁড়িয়ে একটা রোগা ভোগা গাভী ঘাস খেতে চাইলেই লাথি মারছে আর গাভীটা ব্যথায় জোরে জোরে কাঁদছে। পাণ্ডবদের শাসন করা রাজ্যে এমন অনাচার হতে দেখে পরীক্ষিত অত্যন্ত দুঃখে ও রাগে রাজবেশধারীকে বলেন “কে তুই বদমাশ? নাটের মতো তো রাজার পোশাক পরেছিস, কিন্তু কাজ করছিস তো চণ্ডালের। ভেবেছিসটা কী অর্জুনদাদু নেই, কৃষ্ণদাদু পৃথিবী ছেড়েছে বলে ধরাকে সরা জ্ঞান করবি? কোন সাহসে তুই নিরীহ প্রাণীকে অত্যাচার করছিস? তোকে আজকে মেরেই ফেলব।” নির্যাতিত ষাঁড় ও গাভীটাকে উদ্দেশ করে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনারা কে? আর আপনার এমন অবস্থা হল কি করে?” এর উত্তরে এক অদ্ভুত কাহিনী শোনেন পরীক্ষিত, ঐ রাজবেশধারী ব্যক্তি হলেন স্বয়ং কলি, আর এই পা ভাঙ্গা ষাঁড়টা হল ধর্ম আর গাভী হল স্বয়ং বসুন্ধরা। সত্য যুগে যখন ধর্ম ছিল কানায় কানায় ভর্তি, তখন ধর্মের চারটি পা ছিল অক্ষত, একে একে সত্য থেকে ত্রেতা, ত্রেতা থেকে দ্বাপর যখন যুগ পরিবর্তন হয়েছে তখন অধর্ম বেড়েছে আর ধর্ম তত আহত হয়েছে আর ধর্মরূপী ষাঁড় তার একটি করে পা হারিয়েছে।

সত্যিকারের সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি-– এইসব যুগ ছিল বা আছে কিনা, আর থাকলেও তার শুরু বা শেষ কবে হয়েছিল, তা আমার আজকের এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধের বিষয় নয়। কিন্তু এই রূপক কাহিনীর আড়ালে একটা ঐতিহাসিক সত্য এই কাহিনীকারেরা লুকিয়ে রেখেছেন। সেটা হল বনচারী আদিম মানুষ যবে থেকে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে থাকতে শিখেছে, সম্পত্তি তৈরি করেছে তবে থেকেই অহংবোধের জন্ম হয়েছে আর সেখান থেকেই জন্ম নিয়েছে লোভের। আর লোভ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে নানারকম সামাজিক সমস্যার যেমন চুরি, ডাকাতি, অপহরণ ইত্যাদি। ফলে সমাজে এক বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং অবস্থা দূর করতে এক নতুন শাস্ত্রের উদ্ভাবন হয়, যার নাম দণ্ডশাস্ত্র, আর সেই সাথে আবির্ভাব হয়েছে দণ্ডশাস্ত্রের প্রয়োগকারী রাজার। মহাভারতকারের মতে প্রথম দণ্ডশাস্ত্রের রচয়িতা স্বয়ং ব্রহ্মা। তারপর তা যথাক্রমে শিব, দেবরাজ ইন্দ্র, শুক্র প্রভৃতির হাতে সংক্ষেপিত ও সম্পাদিত হয়ে মানুষের হাতে আসে। কিন্তু অপরাধীকে দণ্ডদানের জন্য যেমন আইন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন বিভিন্ন অপরাধের সুস্থ তদন্ত পদ্ধতি, যা দিয়ে সঠিক অপরাধী কে খুঁজে পাওয়া যায়। তাই প্রাচীন ভারতের তদন্ত পদ্ধতি তথা তদন্তকারীদের অপরাধবিজ্ঞানের জ্ঞান কেমন ছিল? তার একটা সংক্ষিপ্ত ধারণা দিতে চাওয়াই আমার আজকের এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য।

ভারতীয় সাহিত্যের আদিমতম উদাহরণ বৈদিক সাহিত্যে খুব জটিল ধরনের অপরাধের তদন্তের কাহিনী পাওয়া না গেলেও তদন্ত সংক্রান্ত দুটি কাহিনী পাওয়া যায়, যার একটি আছে ঋক বেদের ১০ম মণ্ডলের ১০৮ নং সুক্তে, সরমা পনি সংবাদে, যেখানে দেবতারা সরমা নামে কুকুরীকে হারানো গরু খুঁজে আনার কাজে নিযুক্ত করেন, আরেকটি আছে তৈত্তিরীয় আরণ্যকে, যেখানে প্রাণের ভয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে যাওয়া অগ্নিদেবকে খুঁজতে দেবতারা মাছকে গোয়েন্দা হিসাবে নিযুক্ত করেন। এর থেকে বোঝা যায় যে বৈদিক লেখকেরাও তদন্ত পদ্ধতির ব্যাপারে জানতেন

বৈদিক সাহিত্যের পরে পৌরাণিক সাহিত্যের দিকে নজর দিলে এমন একজন উজ্জ্বল চরিত্রের তদন্তকাহিনী চোখে পরে যিনি তদন্তের জন্য নন, প্রেমিক পুরুষ হিসাবে, দার্শনিক হিসাবে বেশি পরিচিত। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। বারণাবতের জতুগৃহের অগ্নিকাণ্ডে বিদুরের বুদ্ধিবলে পাণ্ডবেরা প্রাণে বেঁচে গেলেও, নিষাদ ভাই ও তাদের মায়ের পোড়া মৃতদেহ খুঁজে পাওয়ায় রটে যায় যে, পাণ্ডবেরা অগ্নিকাণ্ডে নিহত। তখন কৃষ্ণ গোপনে দগ্ধ অস্থি সংগ্রহ করেন এবং পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন যে, এই দেহাবশেষ পাণ্ডবদের নয়। এর উল্লেখ পাওয়া যায় খিল হরিবংশ গ্রন্থে। যার জোরে তিনি বলতে পেরেছিলেন—‘নাহি মরে পাণ্ডব সরূপে জানিল।।……{শ্রীকৃষ্ণবিজয়– মালাধর বসু}। কৃষ্ণ জীবনীর অভিন্ন অঙ্গ গোপিনীরাও গোয়েন্দাগিরিতে কম যায় না। কিন্তু কপালপোড়া তারা, গোয়েন্দাগিরি করে কৃষ্ণকে তো খুঁজে পেয়েছিল, কিন্তু জন্ম দিয়েছিল আসমুদ্রহিমাচল যার নামে বিচলিত হবে, এমন এক চরিত্রের। তাই রাস পঞ্চাধ্যায়ের ঐ অংশটি নিয়ে প্রচুর কাটাছেঁড়া হলেও গোপিনীদের গোয়েন্দাগিরি নিয়ে তেমন কোনও কথা ওঠেইনি, সবার প্রশ্ন শুধু “রাধা আছে কি নেই?” তাই আজকে যখন প্রাচীন ভারতের তদন্তকারদের কথা বলা হচ্ছেই, এই সুযোগে সংক্ষেপে আসল কাহিনীটা শুনিয়েই দেই, কী বলেন? কাহিনীটা হল এই রকম– কোনও এক শরৎকালের রাত্রিতে গোপিনীরা কৃষ্ণের সাথে প্রেমালাপের পর ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, সেই সুযোগে কৃষ্ণ এক গোপীনিকে নিয়ে বনের গভীরে চম্পট দেন। ক্লান্তি কিছুটা কাটতেই গোপিনীর দল তাদের মাঝখানে কৃষ্ণ নেই দেখে কষ্টে দুঃখে কাতর হয়ে দল বেঁধে খুঁজতে শুরু করে। খানিকক্ষণ খোঁজার পর তারা বনের এক জায়গায় এসে কয়েকটা পায়ের ছাপ দেখতে পায়। তারা সেই ছাপ পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পায় সেই পায়ের ছাপের মাঝখানে ধ্বজ, বজ্র, অঙ্কুশ, যব প্রভৃতি চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। আর বিষ্ণু পুরাণ অনুযায়ী, কৃষ্ণের পায়ের ছাপ চেনার একমাত্র উপায় হল ঐ চারটে চিহ্নের উপস্থিতি, এর থেকেই তারা বুঝতে পারে, যে তারা যাকে খুঁজছে সে আশেপাশেই আছে। কৃষ্ণের পায়ের ছাপ খুঁজে পাওয়ার সব আনন্দ মুহূর্তে উড়ে গেছিল, ঠিক তারপরেই কয়েকটা পায়ের ছাপ দেখে। আর তা দেখেই লেডি শার্লকেরা দুঃখের সাথে বলেছিল–

“কস্যাঃ পদানি চৈতানি যাতায়া নন্দসুনুনা।

অংশস্যন্ত প্রকোষ্ঠায়াঃ করেণোঃ কারিণাঃ যথা।।

ভাবানুবাদ করলে মূল কথাটা এই দাঁড়ায় যে, দেখ দেখ কোনও একটা মেয়ে আমাদের কৃষ্ণের সাথে কাঁধে কাঁধ হাতে হাতে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এখন প্রশ্ন হল, এতসব কথা শুধু মাত্র পায়ের ছাপ দেখেই বলে দিল কী করে? জানি পাঠকদের অনেকেই খুব চালাক, এরই মধ্যে সব বুঝে গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাথা চুলকে যাদের টাক পড়ে গেল যে কী করে গোপিনীরা বুঝল যে ওটা কোনও মেয়েরই পায়ের ছাপ, এবং সে কাঁধে কাঁধ দিয়ে চলছিল, তাদেরকে বুঝিয়ে দেবেন শ্রীজীব গোস্বামী। শ্রীজীব গোস্বামী তার বৈষ্ণবতোষিণী টিপ্পনীতে ব্যাখ্যা করেছেন, যে দ্বিতীয় পায়ের ছাপগুলি তুলনায় ছোট এবং বাম পায়ের ছাপ প্রথমে ছিল, তাই সেটি স্ত্রীলোকের পায়ের ছাপ। আর কাঁধে হেলান দিয়ে চলছিল, সেটা বোঝা যাচ্ছিল, দুটো পায়ের ছাপ অসমান হয়ে পড়েছিল, তাই। এখানেই গোয়েন্দাগিরি শেষ হয়নি, আরেকটু এগিয়ে আরও কিছু পায়ের ছাপ তারা দেখতে পায়, যেগুলিতে পুরো পায়ের ছাপ ছিল না, ছিল শুধু দুই পায়ের সামনের অংশ, তাতে তারা এই সিদ্ধান্তে আসে যে এইখানে দাঁড়িয়েই কৃষ্ণ সেই অনির্দিষ্ট রমণীর জন্য ফুল পেড়েছিল, সোজাভাবে ফুল না পাওয়ায় দুই পা উঁচু করে ফুল পেড়েছে। ব্যস তার কিছুক্ষণ পরেই তারা সেই রমণীকে পেয়ে গেছিল, যাকে আজকের সারা বিশ্বের বৈষ্ণবেরা রাধা নামে জানে

অন্যদিকে রামায়ণের পাতায় নজর রাখলে দেখা যায় যে, ঠিক সেই অর্থে অপরাধ বা তদন্তের জন্য না হলেও রামচন্দ্রকে দুশ্চিন্তামুক্ত করতে রিগর মর্টিসের লক্ষণ ব্যাখ্যা করে বোঝান বানর বৈদ্য সুষেন। ঘটনাটির উল্লেখ আছে বাল্মিকী রামায়ণের যুদ্ধ কাণ্ডের ১০১ সর্গে।

ঘটনাটি এইরকম– মেঘনাদের অস্ত্রে লক্ষ্মণ দ্বিতীয়বার আহত ও মৃতপ্রায় হয়ে পড়ায়, রাম ভাইকে মৃত ভেবে নিয়ে হতোদ্যম হয়ে পড়েন, তখন সুষেন লক্ষ্মণের শরীর পরীক্ষা করে বলেন “দেখুন এই যে আপনি নিরুৎসাহ হয়ে পড়ছেন, তা অর্থহীন, কারণ লক্ষ্মণ মরেনি। কারণ এই যে ওঁর মুখ দেখুন, এখনও কেমন আগের মতোই হাসি হাসি আছে, না বিকৃত হয়েছে, না কালো হয়েছে। ওঁর হাতের তালু এখনও পদ্মের পাপড়ির মতো রক্তাভ (মানে এখনও ফ্যাকাশে হয়ে যায়নি) (আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র মতে এই দশার নাম Pallor Mortis)। মরা মানুষের দেহে এইসব দেখা যায় না মশাই। অতএব নিশ্চিন্তে থাকুন।” এইভাবে বানর বৈদ্য সুষেন তার চিকিৎসাবিদ্যার জ্ঞানের সাহায্যে রামের উৎকণ্ঠা কে শান্ত করেন এবং হনুমানকে দিয়ে দ্বিতীয়বার বিশল্যকরণী আনিয়ে লক্ষ্মণের প্রাণ বাঁচান

পুরাণের পর আসা যাক প্রাচীন ভারতের আরেকটি কাহিনী ভাণ্ডারে, জাতকের গল্পে। এই কাহিনীগুলি মূলত বুদ্ধদেব তার শিষ্যদের উপদেশ দিয়ে সঠিক পথ দেখানোর জন্য বললেও এখানেও এমন অনেক কাহিনীর খোঁজ পাওয়া যায় যেখানে বোধিসত্ত্ব তার বুদ্ধি ও পর্যবেক্ষণ শক্তির মাধ্যমে তার ও তার বন্ধুবান্ধবদের প্রাণ, সম্পত্তি রক্ষা করেছিলেন, এমনকি হাতি ঘোড়া প্রভৃতি ইতর প্রাণীদেরও মানসিক শান্তি দিয়েছিলেন। তেমনি একটি কাহিনী হল জাতক সমগ্রের প্রথম গল্প অপবন্ন জাতক, যেখানে বোধিসত্ত্ব তার প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে, ধূর্ত যক্ষের চাল ব্যর্থ করে নিজের দলকে সুস্থ অবস্থায় মরুভূমি পার করিয়ে ছিলেন। এই গল্পে, বোধিসত্ত্ব একজন বণিকের ঘরে জন্মে বড় হয়ে একজন বড় ব্যবসায়ী হন। একবার তিনি এক দূর দেশে বাণিজ্য করতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, এবং ৫০০ গাড়ি জিনিস বোঝাই করে রওনা দেন। এই যাত্রাপথে ছিল একটি জলহীন বন, যেখানে আগে থেকে বিনা জলসংগ্রহ করে ঢুকলে জলকষ্টে মৃত্যু ছিল অনিবার্য, এছাড়া ছিল অচেনা বিষাক্ত ফলের গাছ। তাই যে বা যারা এই বন অতিক্রম করতে চাইত তারা আগে থেকেই তাদের গতি ও প্রয়োজন অনুযায়ী জল সংগ্রহ করে তারপর এই বনে ঢুকত। ঐ বনে এক নরমাংসভোজী যক্ষ তার দলবল নিয়ে থাকত। তারা কৌশল করে, ভেজা পোশাক পড়ে, কাদা মেখে, বনে ঢুকছে এমন দলের সাথে দেখা করে, এটা বোঝানোর চেষ্টা করত যে সামনে প্রচুর জল আছে, তারা খামোখা জল বয়ে নিয়ে তাদের গতি কমাচ্ছে। যারা তাদের ফাঁদে পা দিত, যক্ষেরা তাদের মৃতদেহে ভোজ লাগাত। একই ভাবে যক্ষের দল বোধিসত্ত্বের দলকে মূর্খ বানাতে এলে বোধিসত্ত্ব তাদের গালাগালি দিয়ে তাড়িয়ে দেন। পরে তার দলের লোকেরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছিল “ঐ লোকটা তো বলল সামনে প্রচুর জল আছে, বৃষ্টি হচ্ছে ,আরও দেখলাম ওদের মাথার চুল, গায়ের পোশাক ভেজা, আবার গলায় পদ্মের মালা। সামনে যদি এতই জল পাওয়া যায় তাহলে কষ্ট করে জল বয়ে নিজেদের গতি কমাব কেন? এই কথা শুনতে পেয়ে বোধিসত্ত্ব গাড়ি থামিয়ে সবাইকে এক জায়গায় বসিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “এই শুকনো জায়গায় জলাশয় আছে, এটা আগে কখনও শুনেছ???” তারা উত্তর দিয়েছিল “না, সেই জন্যই এটা নিরুদক কান্তারি।”

“দ্বিতীয় প্রশ্ন, লোকটা বলল, যে সামনে বৃষ্টি হচ্ছে…।” “তা বাপু বলো তো, যদি কোথাও বৃষ্টি হয় তাহলে কতদূর থেকে জোলো হাওয়া টের পাওয়া যায়?” উত্তর এল “আন্দাজ এক যোজন।” তখন বোধিসত্ত্ব বলেছিলেন “তাহলে গায়ে ঠাণ্ডা হাওয়া লাগছে কি???” যথারীতি উত্তর এল “না”।

“আচ্ছা, গায়ে হাওয়া নাই লাগতে পারে, কিন্তু কালো মেঘ কতদূর থেকে দেখা যায় বলো তো?” তারা বলল, “প্রায় এক যোজন।” “দেখলে?”, আবার মাথা নিচু করে উত্তর, “না”।

একই ভাবে তারা বিদ্যুৎ চমকাতে দেখেছে কিনা, আর মেঘগর্জন শুনেছে কিনা জিজ্ঞাসা করায় তারা না বলার পর, বোধিসত্ত্ব সবার সামনে যক্ষের সব প্ল্যান খুলে বলে দিয়েছিলেন। এই ছিল বোধিসত্ত্বের প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিপদ থেকে রক্ষার নমুনা। একই প্লটের ওপরে লেখা আরেকটি কাহিনী “ফল জাতক”-এ বোধিসত্ত্ব তার দলের লোকজনকে বিষাক্ত ফল খেয়ে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। যখন বোধিসত্ত্বকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, যে তিনি কী করে বুঝেছিলেন যে এই নির্দিষ্ট গাছটির ফলই বিষাক্ত (কারণ, রূপে, গুণে, গন্ধে সবেতেই সেটি আমের মতো) তখন তিনি একটা খুব সুন্দর কবিতার মাধ্যমে সেটা ব্যখ্যা করেন–

গ্রামদ্বারে শোভে বৃক্ষ, দুরারোহ নয়, ফলভারে সদা অবনত রয়।

ইহাতে বুঝিনু, শুন, গ্রামবাসীগণ, এফল সুফল নয় খাইলে মরণ।।

ভাগবত পুরাণে যেমন কৃষ্ণের গোপিনীরা পায়ের ছাপের খোঁজ করে “রাধা”-র খোঁজ পেয়েছিলেন, বোধিসত্ত্বও দুই দুই বার তাঁর পায়ের ছাপ বোঝার বিশেষ গুণকে কাজে লাগিয়ে, নিজের সম্মান ও নিজের সাথীদের প্রাণরক্ষা করেছিলেন (নলপান জাতক ও পদকুশল মানব জাতক দ্রষ্টব্য)। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, পায়ের ছাপ অনুসন্ধান করে আততায়ীর খোঁজ করার যে পদ্ধতি, তা কবে আরম্ভ হয়েছিল তা জানা না গেলেও, “Vedic index Of Names and Subjects” গ্রন্থের রচয়িতা Mcdonel & Keith-এর মতানুসারে, বৈদিক যুগ থেকেই পশুপালক সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বিশেষ শিক্ষায় ওস্তাদদের খোঁজ পাওয়া যায়। আর এর গুরুত্ব কতটা গভীর ছিল এই তথ্যেই বোঝা যায় যে, ব্রিটিশ আমলেও রাজস্থান অঞ্চলে “খোজী” নামে এক সম্প্রদায়ের কথা জানা যায় যারা, পুলিসকে বালির ওপর হয়ে থাকা পায়ের ছাপ দেখে পায়ের মালিককে ধরতে সাহায্য করতেন

সাহিত্যিক প্রমাণ ছাড়া প্রাচীন ভারতের তদন্ত পদ্ধতি ও অপরাধ বিজ্ঞানের সম্পর্কে সবচেয়ে সুগঠিত আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির খোঁজ পাওয়া যায় যেখান থেকে তা হল আমাদের দেশের প্রাচীন ল মেকারদের রচনা। তাদের মধ্যে কৌটিল্য অন্যতম। কৌটিল্য তাঁর “অর্থশাস্ত্র” গ্রন্থে বিভিন্ন অপরাধীদের শনাক্ত করতে যে যে পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছেন তার অনেকগুলিই, তার অন্যান্য নীতির মতোই, আজকের যুগেও অনেকাংশে ব্যাবহারযোগ্য। সেগুলি নিন্মলিখিত–

কৌটিল্যের করা নিয়মানুসারে, নগরে ঘটে যাওয়া কোনওরকম অপরাধের তদন্ত করার দায়িত্ব ছিল সেই অঞ্চলের “স্থানিক” (যে শব্দ থেকে আজকের “থানা” শব্দের উৎপত্তি) ওরফে গভর্নরের। ভিন্ন ভিন্ন অপরাধের তদন্ত পদ্ধতি ভিন্ন ধরনের।

যেমন, কোনও চুরি বা ডাকাতির খবর পেলে স্থানিক অকুস্থলে গিয়ে যদি দেখে যে চোর পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে চুরি করে পালিয়েছে, বা সিঁদ কাটার ধুলো মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে বা সিঁদ একবারে সিঁড়ি বা দরজার কাছেই কাটা হয়েছে, তাহলে ধরে নিতে হবে যে এই চুরির সাথে বাড়ির কোনও লোক অবশ্যই জড়িত। এই সন্দেহ হলে তিনি তদন্তকারী গোয়েন্দাকে ওইখানে উপস্থিত সকলকে তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করার উপদেশ দিয়ে বলেছেন, ১) এমন কেউ তো নেই যে তখন ঐ তদন্তের সময়ে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছে বা ঘুমে ঢলে পড়ে যাচ্ছে?; ২) কথার জবাব দিতে গিয়ে তোতলাচ্ছে, খাবি খাচ্ছে, ভুলভাল জবাব দিচ্ছে; ৩) বা এমন কেউ যার গায়ে হাতে পায়ে ধুলো লেগে আছে, শরীরে খুব ব্যথা, জামাকাপড় ছিঁড়ে গেছে, হাত পা কেটে গেছে; ৪) গায়ে হাত পায়ে প্রচুর তেল মেখে বসে আছে; ৫) সদ্য সদ্য স্নান সেরে এসেছে; ৬) জুয়ার নেশা আছে; ৭) কোন মেয়ের প্রেমে পড়েছে; ৮) গরীব নারী বা ভৃত্য– এমন কোনও একটা দোষযুক্ত নারী বা পুরুষকে গ্রেফতার করে জেরা করলেই আসল চোরের খোঁজ পাওয়া যাবে। আর যদি অকুস্থল তদন্ত করে মনে হয় যে, বাড়ির লোকের কোনও হাত নেই, এটা বাইরেরই কোন কালপ্রিটের কাজ তাহলে স্থানিক তাঁর আন্ডারে থাকা গোপদের নিয়ে নগরের আনাচে কানাচে সেই চোরকে খুঁজে বেড়াবেন। তাহলে কী তিনি চোর বাছতে নগর উজাড় করে বেড়াবেন? না, সম্ভাব্য চোর বা ডাকাতদের চেনার একটা অত্যন্ত মনোবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উল্লেখ করেছেন কৌটিল্য তাঁর বইতে। সেগুলি হল এইরকম-– ১) তারা নিজেদের পরিচিতিসূচক তথ্য ভুয়ো বলে; ২) সে লুকিয়ে লুকিয়ে থাকে, বা ঘরের মধ্যেই সারাদিন কাটায়; ৩) বারবার বিদেশ গমন করে; ৪) প্রচুর খরচা করে; ৫) কোনও রকম আঘাতের চিহ্ন লুকানোর প্রানপণ চেষ্টা করে; ৬) সাধু সন্ন্যাসীর বেশে লুকিয়ে থাকে; এবং সব শেষে ৭) মহামাত্রকে (মানে আজকের ভাষায় পুলিস) দেখলেই হয় লুকিয়ে পড়ে বা তাদের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, গলা শুকিয়ে যায়, তোতলাতে থাকে ইত্যাদি।

তবে এতকিছু করতে হবে ঘটনা ঘটার মাত্র তিন দিনের মধ্যে, কারণ তিন দিন পার করে গেলে, যে যে চিহ্নের কথা উপরে বলা হল তাঁর একটাও দেখা যাবে না। তখন গ্রেফতার করার একামাত্র উপায় হল মালসহ গ্রেফতার করা

তবে সন্দেহভাজনদের ধরার পরে ধৃতদের জেরার মাধ্যমে নানাভাবে পরীক্ষা করে সত্য উদ্ঘাটন করে প্রকৃত দোষীদের শাস্তির কথা বলেছেন। কারণ সন্দেহভাজনদের অনেকেই শুধুমাত্র পেয়াদার লাঠির মার থেকে বাঁচতে কিছু না করেও নিজেকে দোষী বলে দেয়। এরকম ঘটনার একটি উৎকৃষ্ট সাহিত্যিক উদাহরণ হল, জাতক সমগ্রের “মহাসার জাতক”।

কাহিনীটি এইরকম– মহারাজ ব্রহ্মদত্তের মহারানীর সোনার হার, পাহারায় থাকা দাসীর ঘুমিয়ে থাকার সুযোগে চুরি করে রাজ উদ্যানের একটি পোষা মাদী বাঁদর। দাসী ঘুম থেকে উঠে হার দেখতে না পেয়ে চুরি গেছে মনে করে “চোর ধর, চোর ধর” বলে চিৎকার করায়, সেই সময়ে ঐ জায়গায় ট্যাক্স দিতে আসা এক নাগরিক প্রাণ ভয়ে পালাতে গেলে পেয়াদারা তাকেই চোর ঠাউরে গ্রেফতার করেন, ঠিক যেমনটি অর্থশাস্ত্রে লেখা আছে। আর ধরেই দে দমাদম! আর একটাই প্রশ্ন “হার কই? আর চুরি করলি কেন?” তখন সাময়িকভাবে মারের হাত থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য ঐ নাগরিক মিথ্যা স্বীকার করে নেয় যে তিনি চুরি করেছেন, কিন্তু নিজের জন্য নয় এক শ্রেষ্ঠীর জন্য। কৌটিল্য ও এই একি ভয় পেয়েছেন, তাই খুব বিচক্ষণতার সাথে জেরা করার নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর বইতে। বাকি কাহিনী সংক্ষেপে শোনাচ্ছি, যাতে আপনারা বোর না হয়ে যান তাই। একইভাবে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে শ্রেষ্ঠী দোষ চাপায় এক পুরোহিতের উপরে, পুরোহিত চাপায় এক গন্ধর্বের উপর, আর গন্ধর্ব দোষ দেয় এক বেশ্যাকে। নাগরিক, শ্রেষ্ঠী, পুরোহিত, গন্ধর্ব আর বেশ্যাকে জড়ো করতে করতে সেদিন রাত হয়ে যাওয়ায়, মামলা মুলতুবি থাকে। এই সুযোগে তদন্তের দায়িত্বে থাকা বোধিসত্ত্ব নিজের মগজাস্ত্র খাটিয়ে বুঝে ফেলেন, যে এরা কেউই আসল চোর নন স্রেফ নিজের পিঠ বাঁচাতে এই চুরির দায় মাথায় নিয়েছিল। কারণ মূল ঘটনা ঘটেছিল বাগানের মধ্যে আর প্রথম সাস্পেক্ট ছিল বাগানের গেটের বাইরে, আর গেটে প্রচুর পাহারা ছিল তাই তার পক্ষে চুরি করা অসম্ভব। তবে কিভাবে সেটা রাজার সামনে প্রমাণ করেছিলেন সেটা অন্য কোনওদিন শোনাব।

এর পরে আসা যাক জাল দলিলের ব্যাপারে। কোনও সম্পত্তির লেনদেনের ক্ষেত্রে দলিলের মাহাত্ম্য অনস্বীকার্য।আর এর সাথে যেহেতু প্রচুর পরিমাণে সম্পদ জড়িত তাই দলিল নকল করে কোনও এক পক্ষকে পথের ভিখিরি করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র কারও পক্ষে করা খুবই স্বাভাবিক। এইরকম চক্রান্ত যাতে সফল না হয় সেজন্য বিষ্ণু সংহিতার সপ্তম অধ্যায়ের শেষ কয়েকটি শ্লোকে একটি দুর্দান্ত নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, কোন সন্দেহভাজন দলিল এলে, সেই ব্যক্তির অন্য কোনও লেখা বা তার করা সই দেখে মিলিয়ে নেবেন তারপর সন্দেহমুক্ত হবেন। আর যদি দলিল লেখক মৃত হন তাহলে তার আগে লেখা কোনও চিঠির সাথে মিলিয়ে নেবেন।

হাতের লেখা নকল এবং নকল স্বাক্ষর করে ঠকানো ছাড়াও আর এক প্রকারের জাল দলিলের কথা জানা যায়, যেখানে বক্তব্যের সামান্য হেরফের করে সাধারণ মানুষের সম্পত্তি লুট করে নেওয়া হত। এই জন্য কৌটিল্য লেখ্যাগারের রাজলেখকের অন্যগত যোগ্যতা হিসাবে বলেছিলেন, তার ভাষা ও ব্যাকরণ জ্ঞান ভালো হতে হবে। এমনি একটি ভাষাগত জাল দলিলের ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, কলহন রচিত রাজতরঙ্গিনীর ষষ্ঠ তরঙ্গে। যেখানে এক ধূর্ত বণিক এক ব্রাহ্মণের সাথে কুয়ো ছাড়া বাড়ি কেনার অঙ্গীকার করার পড়ে রাজলেখ্যাগারের অধিকরণ লেখককে দশ হাজার দিনার ঘুষ দিয়ে হাত করে দলিলে লেখায় যে, সোপানকুপসহিতম বিক্রিতম গৃহম (কুয়ো সহিত বাড়ি বিক্রি করলাম)। যেখানে আসলে লেখানো উচিৎ ছিল এটা– সোপানকুপ রহিতম বিক্রিতম গৃহম (কুয়ো ছাড়া বাড়ি বিক্রি করলাম)। পরে প্রতারিত ব্রাহ্মণ রাজা যশস্করের দরবারে গান্ধিজির মতো অনশনে প্রাণত্যাগের হুমকি (হুম, ঠিকই শুনছেন, অনশন। প্রাচীন কাশ্মীরে সুবিচার পাওয়ার এটা খুব কার্যকরী উপায় ছিল, অন্তত কলহন মশাই তাই লিখেছেন) দিয়ে সুবিচার চাইলে রাজার বিচারপতিরা প্রথমে দলিল দেখে বলেছিলেন, “এই তো দলিলে পষ্ট করে লেখা আচে যে, তুমি কুয়ো শুদ্ধু বাড়ি বেচেছ, তাহলে এত কান্নাকাটি কেন বাপু?” কিন্তু ব্রাহ্মণের কথাবার্তা শুনে রাজার মনে হয়েছিল, ডাল মে কুছ কালা জরুর হ্যা, ব্রাহ্মণ মিথ্যে বলছে বলে মনে হয় না। তখন রাজা গোপনে হিসাবের খাতা আনিয়ে মিলিয়ে দেখেন যে, যে তারিখে দলিল লেখা হয়েছিল, সে তারিখেই দলিল লেখকের খাতায় দশ হাজার দিনার জমা পড়েছে, যা সাধারণত একটি দলিল লেখার মজুরী থেকে অনেক বেশী। দলিল লেখককে (অধিকরণ লেখক) জেরা করতেই বণিকের ধূর্তামি কবুল করে এই কেসের সাক্ষী বনে যায়, এর ফলে ঐ ব্রাহ্মণ তার বাড়ি ফেরত পায়, আর বণিক নির্বাসিত হয়।

এরপর আর মাত্র দুটো অপরাধ ও তার তদন্ত পদ্ধতি বলে আমার আজকের এই লেখায় ইতি টানব। আর এই দুটি অপরাধ প্রাচীন সময়েও ততটাই জঘন্য অপরাধ বলে ধরা হত যতটা আজকের সময়েও ধরা হয়। অপরাধ দুটি হল-– হত্যা ও ধর্ষণ।

প্রথমে আসি হত্যা তদন্তের কথায়। হত্যা সংক্রান্ত সমস্ত তদন্তের পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দিয়ে গেছেন কৌটিল্য তার কালজয়ী গ্রন্থের চতুর্থ পুস্তকের সাত নম্বর অধ্যায়ে। অধ্যায়ের নাম আশুমৃতক পরীক্ষা। সেখানে উনি সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন কোন কোন পদ্ধতিতে একটি হত্যার তদন্ত করতে হবে। তিনি বলছেন– কোথাও কোনও অপমৃত্যুর খবর পাওয়ার সাথে সাথে ম্যাজিস্ট্রেট ঐ স্থানে গিয়ে দেখবে মৃতদেহ কী অবস্থায় আছে, কারণ এর থেকে হত্যাপদ্ধতি ও মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধে জানা যাবে। অপমৃত্যু সাধারনত তিন প্রকারে হয়– ১) শ্বাসরুদ্ধ হয়ে; ২) শারীরিক আঘাতজনিত কারণ; আর ৩) বিষ বা অতিরিক্ত ড্রাগের কারণে।

তাই তদন্তকারী অফিসার যদি ঘটনা স্থলে গিয়ে দেখেন মৃতদেহের চারপাশে মল মূত্র ছড়িয়ে আছে, মৃতদেহের হাত, পা, পেট ফুলে আছে, চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে এবং গলায় দাগ আছে, তাহলে বুঝবে তাকে, মারা হয়েছে। কিন্তু তার সাথে যদি দেখা যায় যে লাশের বাহু আর উরু সংকুচিত হয়ে আছে তাহলে তাকে গলায় দড়ি দিয়ে মৃত বলে ধরবে।

এর পরের শ্লোকে যে মৃতদেহের কথা উনি লিখেছেন,তার মৃত্যুর কারণ নিয়ে অনুবাদক ও টীকাকারেরা দ্বিধাবিভক্ত। কৌটিল্য লিখেছেন–

“শুনপানিপাদোদরমপগতাক্ষমুর্ধত্তনাভিমবরোপিতংবিদ্যাত।।”

অর্থাৎ যে মৃতের হাত পা ও পেট ফুলে গেছে, চোখ ভেতরে ঢুকে গিয়েছে, নাভি ফুলে উঠেছে তাকে অবরোপিত করে মারা হয়েছে। সমস্যা হল এই “অবরোপিত” শব্দটিকে নিয়ে। টি গণপতি শাস্ত্রী এই শ্লোকের টীকা করতে গিয়ে গিয়ে লিখেছেন, মৃত্যুর কারণ শূলে চড়ানো, অর্থশাস্ত্রের বাংলা অনুবাদক এই মানে ধরেই শ্লোকের অনুবাদ করেন শূলে চড়ানো হয়েছে, কিন্তু আরেক অনুবাদক এল এন রঙ্গরাজন, এর অনুবাদ করেন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যু। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার বঙ্গীয় শব্দকোষে এই শব্দের মানে করতে গিয়ে ১)স্থাপন এবং ২) কোনও কিছু পুঁতে ফেলা, এই দুটি শব্দই বলেছেন। এর ফলে দুটো মানেই হতে পারে। অর্থাৎ শূলের উপরে স্থাপন, আবার মাটিতে পুঁতে দমবন্ধ করে মৃত্যু। এবার মৃত্যুর সঠিক কারন কী, বুঝহ সেই লোক যে জানো সন্ধান।

এরপর কোনও মৃতের চোখ ও পায়ু যদি কঠিন হয়ে গিয়ে থাকে, আর তার পেট ফুলে গিয়ে থাকে, তাহলে সে জলে ডুবে মারা গেছে।

আবার যদি লাশ পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা যায় যে তার সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে গেছে, ভেঙ্গে গেছে তাহলে বুঝবে, মৃত ব্যাক্তি গণপিটুনির শিকার হয়ে লাথি বা গদার আঘাতে মৃত। কী ধরনের আঘাতটা বোঝার জন্য মৃতদেহ কে তেল মাখিয়ে পরীক্ষা করতে হবে যাতে আঘাতের ফলে হওয়া দাগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু যদি দেখা যায় যে, মৃত ব্যাক্তির শরীর থেতলে, বা মাথা ফেটে মৃত্যু হয়েছে, তাহলে তার মৃত্যু কোনও উঁচু জায়গা থেকে পড়ে হয়েছে বলে ধরতে হবে।

আর সবশেষে, যদি দেখা যায় যে মৃতদেহের মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে, সারা শরীর কালচে পড়ে গেছে, তাহলে তাকে বিষ দিয়ে মারা হয়েছে বলে ধরতে হবে। কিন্তু যদি তার শরীর পরীক্ষা করে কোন কামড়ানোর চিহ্ন পাওয়া যায়, তাহলে সেই ব্যাক্তি সাপ বা অন্য কোনও বিষাক্ত প্রাণীর ফলে মৃত বলে ধরবে। আর নিশ্চিত হওয়ার জন্য, মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করে তার হৃৎপিণ্ডের সামান্য অংশ, ও ঐ ব্যাক্তির পাকস্থলীর অপাচ্য খাদ্য সংগ্রহ করে আগুনে পুড়িয়ে দেখা উচিৎ। যদি ঐ খাদ্য চটচট শব্দ করে ফাটে আর আগুন রামধনুর রঙে জ্বলে ওঠে আর হৃৎপিণ্ড আগুনে না জ্বলে, তা হলে ঐ ব্যাক্তি নিশ্চিতভাবে বিষে মৃত। প্রসঙ্গত বলে রাখি, প্রাচীন কালে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করাই ষড়যন্ত্রকারীদের সবচেয়ে প্রিয় ও নির্ভরযোগ্য উপায়। মহাভারতে আদিপর্বে ভীমকে হত্যা করার চক্রান্ত থেকে শুরু করে বিশাখদত্তের “মুদ্রারাক্ষস” এ চন্দ্রগুপ্ত কে হত্যার জন্য বিষকন্যা পাঠানো পর্যন্ত প্রাচীন সাহিত্যে ভুরি ভুরি বিষ প্রয়োগের নজির পাওয়া যায়। তাই আয়ুর্বেদে একটি আলাদা বিভাগই ছিল “অগদতন্ত্র” নামে, যা আজকে Toxicology নামে পরিচিত। সেখানে বিষমিশ্রিত খাদ্য, পানীয়কে চেনার থেকে শুরু করে বিষ শোধন করার পদ্ধতিও দেখা যায়ই।

আপাতদৃষ্টিতে প্রথম দর্শনে কোনও কোনও মৃত্যু আত্মহত্যা বলে মনে হলেও কৌটিল্য সেই মৃত্যুরও যথাযথ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন, কারণ আততায়ী গোয়েন্দার চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য খুনকে আত্মহত্যা দেখানোর চেষ্টাও করতে পারে।

হত্যা পদ্ধতি জানার পর, তদন্তের পরের ধাপ হল, মৃতের পরিচয় জানা। মৃত ব্যাক্তি অচেনা হলে, বা ঐ ঐ শহরের বাসিন্দা না হলে তার পরিহিত পোশাক পরিচ্ছদ, গয়নাগাটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে সেই সেই দ্রব্যের (মানে মালা, গয়না, পোশাক) ব্যবসায়ীদের জেরা করে মৃত ব্যাক্তির পরিচয় পেশা ইত্যাদি জানার চেষ্টা করতে হবে, অর্থাৎ যদি কোনও অজানা মৃতদেহ পাওয়া যায় যার গলায় ফুলের মালা, এবং মুখে মদের গন্ধ, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট শহরের সকল মালাকার আর মদ ব্যবসায়ীদের একে একে জেরা করে ঐ মৃতের পরিচয়, তার পেশা, ঐ শহরে কোথায় উঠেছিল, এই সব জানবে।

হত্যা পদ্ধতি, মৃতের পরিচয় জানার পর অন্তিম আর আসল কাজ, আততায়ীকে ধরা।

খুনিকে ধরার জন্য কৌটিল্য প্রথমে খুনের মোটিভের ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। তিনি বলছেন—

১) প্রথমেই দেখতে হবে, মৃতের কোনও চাকর অদূর অতীতে মৃতের থেকে শারীরিক বা মানসিকভাবে অপমানিত হয়েছে কিনা?

২) মৃতের স্ত্রীর অন্য কোনও ব্যাক্তির সাথে কোনও চক্কর চলছে কিনা?

৩) এই মৃত্যুতে কারও কোনও আর্থিক লাভ হচ্ছে কিনা?

৪) মৃত ব্যাক্তির সাথে তার কর্মক্ষেত্রে, বা ব্যবসা সূত্রে কারও সাথে ঝগড়া ছিল কিনা?

এই সমস্ত মোটিভ খতিয়ে দেখতে হবে। এছাড়া আর যে জিনিস মৃতের আত্মীয়দের জেরা করে জানতে হবে যে-– মৃত ব্যাক্তিকে কেউ ডেকেছিল কিনা? ডাকলে কে ডেকেছিল? সঙ্গে আর কেউ ছিল কিনা? অকুস্থলের আশপাশের লোকেদের সাথে কথা বলে জানার চেষ্টা করবে– মৃত ব্যাক্তিকে জীবিত অবস্থায় এখানে আসতে কেউ দেখেছে কিনা? দেখে থাকলে, তার সাথে কেউ ছিল কিনা? অথবা, তারা এমন কোনও ব্যাক্তিকে কি দেখেছেন, যার হাতে অস্ত্র ছিল বা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে হাঁটাচলা করছিল? এই সব প্রশ্নের যে উত্তর হবে তার উপর ভিত্তি করে পরবর্তী তদন্ত এগোবে

হত্যা তদন্তের পরে আসি আমার এই প্রবন্ধের শেষ টপিকে, অর্থাৎ ধর্ষণে। ধর্ষণ শব্দের ব্যুৎপত্তি “ধৃষ” ধাতু থেকে, যার মানে হিংসা, অর্থাৎ বলপূর্বক কোন নারীর সতীত্ব নাশ করা। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যগুলি ঘাঁটলে ভুরি ভুরি এই জঘন্য অপরাধের উদাহরণ পাওয়া যায়, যার মধ্যে ইন্দ্র কর্তৃক অহল্যার ধর্ষণ, এবং দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের কাহিনী কমবেশি সবাই জানে (আরও জানতে “মহাভারতে যৌনতা” বইটি দ্রষ্টব্য), আর পাওয়া যায় ধর্ষকের শাস্তির লিস্ট, একেক আইন প্রণেতা একেক রকম শাস্তির বর্ণনা করেছেন তার নিজস্ব গ্রন্থে, যেমন-– মনুসংহিতায় মনু গুরুপত্নীর সাথে গমন করলে, গমনকারীকে উত্তপ্ত নারীমূর্তি ধারণ করে মৃত্যুবরণ করতে হবে। কৌটিল্য লিখেছেন, “যদি কোনও ব্যক্তি তার বাড়িতে কর্মরত অক্ষতযোনি ক্রীতদাসীর ধর্ষণ করে তাহলে তাকে সেই মেয়ের বিয়ের কন্যাপণ, যে দামে মেয়েটিকে তিনি কিনে ছিলেন, এবং কন্যাপণের দু গুণ পরিমাণ জরিমানা দিতে হবে। যদি কেউ তার দাসীকে করে তাহলে ৪৮ থেকে ৯৬ পন জরিমানা, অন্য কারও দাসীকে করলে ২০০ থেকে ৫০০ পন জরিমানা। যদি কোনও বন্দি কোনও বন্দিনীকে ধর্ষণ করে, তাহলে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু, যদি জেলার কোনও আর্য বন্দিনীকে করে তাহলে জরিমানা ৫০০ থেকে ১০০০ পন হবে।”

কিন্তু কথাটা হল গিয়ে, অপরাধের বর্ণনা ও তার শাস্তির লম্বা লিস্ট থাকলেও, অপরাধীকে শনাক্ত করার কোনও পন্থা কোনও স্মৃতিগ্রন্থে লিপিবদ্ধ নেই। এখানেই লাগে আসল খটকা কারণ, চুরি, ডাকাতি, জাল দলিল, খুন আত্মহত্যা, প্রভৃতি অপরাধ শনাক্তকরণে যে উন্নত জ্ঞানের দেখা পাই, সেই জ্ঞানের ছিটেফোঁটাও এই অপরাধের শনাক্তকরণে পাই না কেন? তা জানার আজ কোনও উত্তর হয়তো নেই কিন্তু এই অপরাধ শনাক্তকরণের উপায় সম্পর্কে চিকিৎসকেরা যে অনভিজ্ঞ ছিলেন না, তা সুশ্রুত লিখিত সুশ্রুত সংহিতা, চরক লিখিত চরক সংহিতা ঘাঁটলেই বোঝা যায়।

তাঁরা ২০টি যোনি রোগের নাম উল্লেখ করেছেন তাদের গ্রন্থে যার মধ্যে অন্তত ৩টি রোগের লক্ষণ চোখে পড়লে চোখ বুজে বলা যায়, যে সেইসব রোগিণীরা সম্ভবত যৌন নির্যাতিত। রোগগুলি হল-– অতিচরণা, প্রাকচরণা, আর মহাযোনি। অতিচরণা যোনির লক্ষণ হল, অত্যধিক পরিমাণে যৌনসঙ্গমের ফলে যোনি ফুলে ওঠে, অসাড় হয়ে যায়, এবং ব্যথা হয়। এর পর প্রাকচরণা, এর লক্ষণ হল, যদি কোনও অত্যন্ত ছোট মেয়ের সাথে সঙ্গম করা হয় তাহলে তার পিঠ, কোমর, কুঁচকি, আর উরুতে ব্যথা হবে। আর সবশেষে, মহাযোনি, এর লক্ষণ হল– যদি কষ্টদায়কভাবে বা উঁচুনিচু অবস্থায় বা বাজে বিছানায় মৈথুন করা হয়ে থাকে, তাহলে যোনির মুখ ছড়িয়ে গিয়ে মাংস উঁচু হয়ে যায় ও যোনিতে ব্যথা হয়, এবং সেখান থেকে ফেনাযুক্ত রক্ত বের হয়

অপরাধ বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের নানা বিভাগের নানা জ্ঞানের প্রয়োগে একটি অপরাধ ও অপরাধীমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার জন্যেই এই বিষয়ের সূচনা। আর বিষয়টি এত গভীর ও বিস্তৃত যে শুধু প্রাচীন ভারত কেন, কোন সময়েরই অপরাধ বিজ্ঞানের সবদিকের সম্পূর্ণ পরিচয় দেওয়া একটি ক্ষুদ্র প্রবন্ধে অসম্ভব। তাও যদি আপনাদের এই বিষয় সম্বন্ধে সামান্য আভাস দিয়েও মুগ্ধ করতে পারি, তাহলেই আমার পরিশ্রম সার্থক।

 

সূত্র ও তথ্য নির্দেশ-

১) প্রথম অধ্যায় দণ্ডনীতি – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী।

২) ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি – সুকুমার সেন।

৩) খিল হরিবংশ পুরাণ, ভাগবত পুরাণ।

৫) শ্রীরাসপঞ্চাধ্যায় – মহর্ষি বেদব্যাস প্রণীত,

৬) মূল শ্লোক-

नैव पञ्चत्वमापन्नो लक्ष्मणो लक्ष्मिवर्धनः || ६-१०१-२६न ह्य्स्य विकृतं वक्त्रं न च श्यामत्वमागतम् |

सुप्रभन् च प्रसन्नं च मुखमस्याभिलक्ष्यते || ६-१०१-२७पद्मरक्ततलौ हस्तौ सुप्रसन्ने च लोचने |

नेदृशं दृश्यते रूपं गतासूनां विशां पते || ६-१०१-२८विषादं मा कृथा वीर सप्राणोऽयमरिंदम |

বাল্মীকি রামায়ণ, যুদ্ধ কাণ্ড

৭) অপবন্ন জাতক, ফল জাতক, জাতক প্রথম খণ্ড – অনুবাদক – ঈশান চন্দ্র ঘোষ

৮) কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র – কণ্টকশোধন পুস্তকের অন্তর্গত ষষ্ঠ অধ্যায় দ্রষ্টব্য

৯) ঐ – সপ্তম অধ্যায়।

১০) চরক সংহিতা – চিকিৎসা স্থান – অধ্যায় ৩০ – যোনি ব্যাপাত

সহায়ক গ্রন্থ-

১) ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি – সুকুমার সেন

২) দণ্ডনীতি – নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী

৩) জাতক প্রথম খণ্ড – ঈশানচন্দ্র ঘোষ অনুবাদিত

৪) বাল্মীকি রামায়ণ – হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য অনুবাদিত

৫) কথা অমৃতসমান – ২ ও ৩ খণ্ড – নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী

৬) কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র – মূল সংস্কৃত – টি গনপতি শাস্ত্রী, বাংলা – রাধাগোবিন্দ নাথ, ইংলিশ – এল এন রঙ্গরাজন

৭) রাজতরঙ্গিনী – কলহন; অনুবাদ – হরিলাল চট্টোপাধ্যায়।

৮) সুশ্রুত সংহিতা, চরক সংহিতা, অষ্টাঙ্গ হৃদয় – বাগভট

৯) বঙ্গীয় শব্দকোষ – হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়

১০) Crime and Detective sciences in Selected Ancient Indian Literature – U N Biswas