দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বৃষ্টি নয়, অনাবৃষ্টিই আমাকে ঘিরে থাকে। জীবনে হাতে গোনা কয়েকটি দিন এসেছে এক্সখন বৃষ্টি আমায় তৃপ্ত করতে পেরেছে। গভীর, অনপনেয় এক অতৃপ্তি নিয়ে এক শ্রাবণ থেকে আর এক শ্রাবণের দিকে চলে যাওয়াই আমার নিয়তি। এই নিয়তিকে মেনে নিয়েছি, অথচ প্রতিবার উল্লাসে উপচে উঠি, সুখে ভেসে যাই।
আমার প্রথম বৃষ্টির স্মৃতি আমার মায়ের সঙ্গে। বলা ভালো, মায়ের গাওয়া একটি গানের সঙ্গে। আমাদের খড়ে ছাওয়া মাটির বাড়িটি ছিল দো-মহলা। ভেতর আর বাইরের মহলের মাঝখানে একটি দরজা, আমরা বলতাম মাঝের দরজা। একদিন দুপুরবেলা সেই মাঝের দরজায় বসে আছি মায়ের গা ঘেঁষে। খুব খর একটা জৈষ্ঠ্যের দুপুর ছিল সেটা। বাড়ির পিছনদিক থেকে মেঘ এল একসময়। মা বলত আকালকুড় করে মেঘ এল। সঙ্গে একটা ঠান্ডা বাতাস। আমাদের সামনে বাইরের বড় উঠোন, আমরা বলতাম খামার। গ্রীষ্মে খামারের রং ধূলিধূসর। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। মা নিচু স্বরে গাইছে ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে’। আমিও গাইছি মায়ের সুরে সুরে। সন্ধ্যা মুখার্জির গাওয়া গান পরে শুনেছি। সেই সুর না, কেমন একটা ঘুমপাড়ানি সুর। মনে হচ্ছিল বৃষ্টি বোধহয় শুনতে পাচ্ছে আমাদের কথা। কাঠফাটা রোদের আগুন থেকে আমাদের বাঁচাতে আসবে কি সে? আসবে? বাতাসে সোঁদা গন্ধ পাচ্ছি, ভেজা হাওয়ার গন্ধ। আমার মনে আছে সেই প্রথম আমার বৃষ্টিকে একজন মানুষ মনে হয়েছিল, যাকে ধান মেপে দিতে হয়, যাকে এসো এসো বলে ডেকে আনা যায়। আজ আর মনে নেই সেদিন আমাদের মা-ছেলের ডাকে বৃষ্টি সাড়া দিয়েছিল কিনা। দেয়নি বলেই আমার বিশ্বাস। সাড়া সে দেয় না খুব একটা। তবু সাড়া দেবে এই আসায় তাকে ডেকে চলায় কোনও বিরাম নেই আমাদের।
বৃষ্টিকে ডাকতে ডাকতে কতবার ঘুমিয়ে পড়েছি— ছুটির দুপুরে, ঝিঁঝি-ডাকা মধ্যরাতে, শিরীষফুলের গন্ধমাখা ভোরবেলায়। একদিন তো গাছতলায়— শতাব্দী-প্রাচীন এক তেঁতুলগাছের নৈশছায়ায়। বিদ্যুতের তীব্র আলোয় আর বাজের শব্দে ঘুম ভেঙেছিল। বৃষ্টিকে সেদিন খুব কড়া, খেপচুরিয়াস এক অভিভাবকের মতো মনে হয়েছিল আমার। মনে আছে, ঘুমিয়ে পড়ার আগে দেখেছিলাম তেঁতুলগাছের ঘন অন্ধকারের ভেতর জোনাকিদের রহস্যময় আলো খেলা করছিল। বৃষ্টির পর কোথায় গেল তারা, সেই জোনাকিগুলো?
আষাঢ় এলে আমার চিরকাল মনে হয়েছে, ঈশানকোণ থেকে মেঘ আসুক। দিগন্ত ভাসিয়ে আসুক হাওয়া, ঠান্ডা হাওয়া। এখনও ইচ্ছে করে হাওয়ার মুখোমুখি চিৎকার করে বলি— ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে।
আসে, আসে। বর্ষা এলে বৃষ্টিও আসে এক একদিন। পুবদিকের গাছগুলোকে সাদা চাদরে ঢেকে দিয়ে সে আসে যেন আমারই ডাকে সাড়া দেবে বলে। ছাঁচ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে পুরনো খড়ের মর্চে রং। ভেতরের ছোট উঠোন জুড়ে সেই লালচে জলের ওপর ভাসতে শুরু করে সাদা বুদবুদ। আর কে না জানে, এ আসলে আরও আরও বৃষ্টির অব্যর্থ সংকেত। রাস্তায় বেরিয়ে এবার তাহলে দেখা যাবে নদীর মতো কুলি বইছে। মাঠে বেরিয়ে দেখা যাবে জলে জলাক্কার দেশ। কিন্তু হয় আর কই? আমার আশ মিটিয়ে বৃষ্টি পড়ে না কোনওদিন। রাত্রে স্বপন দেখি— জলে ভেসে যাচ্ছে বাইদ, বহাল, কানালি। এক খেত থেকে জল উছলে চলেছে অন্য খেতে। টামটাম ভরে গেছে আমার সোনামুখি বাঁধ। শাক তুলতে এসে শুশারি বুড়ি শুষনি শাকের সঙ্গে পুঁটিমাছ ধরেছে একহালা। মাথার জল মুছতে মুছতে পরেশকাকা বলছে, জলটো ভাল হল্য ব।
আমার বৃষ্টি কিছুটা বাস্তব, বাকিটা স্বপ্নের।