Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গুমঘরে বৃষ্টি

তৃষ্ণা বসাক

 

আমার বেশিরভাগ কবিতাই পুরনো, অপ্রকাশিত। আমার বেশিরভাগ বৃষ্টিও তাই। পুরনো, অপ্রকাশিত। তাই কবিতার মতো আমার বৃষ্টিও কখনও ফুরোয় না, অঝোরে ঝরতে থাকে। বাইরে তখন হয়তো নির্মেঘ আকাশ। আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর থেকে জানাচ্ছে বর্ষা এবার দেরিতে আসবে। ১৫ ই জুনের আগে… কিন্তু তাতে আমার রসদে কম পড়ে না। সেই যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন– কোথাও কিছু কম পড়েনি!

একটা সময় ছিল যখন বৃষ্টি মানেই রুপোর কুচি। চিলেকোঠার ঠাকুরঘরে নিরীহ চেহারার কয়েকজন ঠাকুরকে জল ছোলা খাইয়ে আমি যখন কব্জি ডুবিয়ে লিখতাম, তখন জানলার আড়াআড়ি শিকে থুতনি ঠেকিয়ে আমার দিকে অপলক চোখে চেয়ে থাকত বৃষ্টি। রাসমাঠের নহবতখানা আর কোষাঘাটের মাঝখানে দাঁড়ানো সারি সারি পামগাছের মাথায় থমকে থাকত মেঘ। আমি কবিতা থেকে চোখ না তুললে বৃষ্টি নামত না। ‘পিয়া তোরা ক্যায়সা অভিমান…’

না, আমাদের সেইসময় কোনও রেনকোট ছিল না, না সিনেমায়, না বাস্তবে। একটা লাল নীল হলুদ ছাতা ছিল, কিন্তু খুব শিগগিরি তাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল আমার মাথা। তারপর থেকে দীর্ঘদিন আমার কোনও ছাতা ছিল না। নৌকো ছিল। সমস্ত কাগজের নৌকো অঙ্কের খাতা থেকে ছিঁড়ে বানানো হয়– এটা একটা মিথ। আমার নৌকো ইতিহাস ভূগোলের পাতা থেকে বানানো। আর সেই কারণেই শ্রাবণে শ্রাবণে, বিস্মৃতি স্রোতের প্লাবনে ভেসে গেছে আমার সব ইতিহাস, ভিজে গেছে সমস্ত পানিপথের যুদ্ধ, অক্ষাংশ দ্রাঘিমা, রূঢ় উপত্যকা।

পৃথিবীর মতো একটা ছাদ ছিল ইটের রেলিং ঘেরা, ফাঁক ফাঁক। রং করার প্রয়োজন হত না, নতুন নতুন শ্যাওলায় সবুজ হেলিপ্যাড যেন, যেকোনও মাপের, যেকোনও দেশের বৃষ্টি নামতে পারে অনায়াসে। আর বৃষ্টির জল ধরে রাখার জন্য কচুপাতাই যথেষ্ট ছিল। অন্য কোনও প্রযুক্তি জানা ছিল না আমাদের। জল জমত খেলতে খেলতে তুলতে ভুলে যাওয়া খেলনাবাটিতে। তা নিয়ে পুরসভার কখনও কোনও মাথাব্যথা দেখিনি।

যেমন ঝুঁঝকো বৃষ্টি, তেমনি আষাঢ়ে গল্প। তার সবচেয়ে বেশি ৭৮ সালের বৃষ্টি নিয়ে–

’৭৮ সালের বৃষ্টিটার কথা
কেউ ভুলতে পারছে না,
চারদিন ধরে বৃষ্টি হয়েছিল,
খাটের নিচে পাওয়া গিয়েছিল তিমি মাছ!
মেঘের ঘন বুনট মশারির মধ্যে বসে
সবাই কি সুন্দর
তিমি মাছ ভাজা দিয়ে খিচুড়ি খেত!

তিমি মাছ না হোক, পেছনের বাগানে শোল আর কই পাওয়া গেছিল অনেক। সেগুলো পাশের পুকুর উপচে উঠে আসা। সেই পৃথিবীতে এইরকম উপচে ওঠা ব্যাপার অনেক ছিল, আর ছিল বৃষ্টির নিজস্ব পাঠক্রম। হারিকেনের আলোয় ইলিশ মাছ কাটতে কাটতে আমার চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট কাম কবি বাবার রানিং কমেন্টারি– এটা ব্রাহ্মণের পইতে, এটা কাঠকয়লা, এই বলে ইলিশের সামান্য তাজ্য আংশ ফেলে দিতেন। আর বৃষ্টির গন্ধে মিশে যেত ইলিশের রক্তের গন্ধ।

রক্ত, হিংসা, পাপ। বৃষ্টি আমার প্রথম পাপও। বাউন্ডারি বর্জিত যে স্কুলে পড়া ক্লাস ফোর পর্যন্ত, তার নাম আনন্দময়ী পাঠশালা–

‘যেখানে বিদ্যে হবে কাঁচকলা
বেঞ্চিগুলো সরু সরু
মাস্টারগুলো আস্ত গরু’

তো সেই গো-পণ্ডিতদের ল্যাজের ঝাপ্টানি খেতে খেতে আমরা বেশ তৈরি হয়ে উঠছিলাম। একদিন ঝেঁপে বৃষ্টি এল। পাঠশালার পেছনের পুকুর টইটুম্বুর। হঠাৎ শুনলাম, পাঠশালার একটি ছেলে সেখানে ডুবে গেছে, তাকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শোনার পর থেকে উৎকণ্ঠা, ছেলেটা মারা যাবে তো? মারা গেলেই ছুটি নিশ্চিত। পদাবলি অনেক শ্রাবণে ধুয়ে গেলেও ব্যথার স্মৃতিতে লেগে থাকা অপরাধবোধ ধোয় না কখনও।

উদয় প্রকাশের পিলি ছত্রিবালি লড়কি অনেক পরে পড়েছি। আমাদের সেই গূঢ় মফস্বলে হলুদ ছাতা ছিল না কারও। কিন্তু সব্জেটে হলুদ আঁশফলে ছাওয়া বিশাল গাছ ছিল হলুদ ছাতার মতোই। রেনি ডে হয়ে গেলে তার তলায় দাঁড়ানো যেত ভিজে ঝুপসি হয়ে। এ যেন অক্ষয় মালবেরির মতো, যাকে ঘিরে আমাদের অনন্ত খেলা, অনন্ত লীলা। সেইরকম এক লীলায়িত বৃষ্টির দিনে আমাদের মফস্বলের এক জাদুকরী, আমাকে শিখিয়েছিল সৃষ্টির আদি কথা। রাসমাঠে ফি বছর সার্কাসে যে কসরত হয়, তার থেকেও অদ্ভুত জটিল শারীরিক কসরত নারী পুরুষের। তার যেমন বাবার নাম ছিল না ইস্কুলের খাতায়, তেমনি একটা ভালো নামও ছিল না। সবাই থ্যাবা বলে ডাকত। সেই থ্যাবার গায়ের রঙ ছিল বৃষ্টি ভেজা আঁশফলের মতো, তেলহীন লালচে চুলে লম্বা বিনুনি বাঁধা, ওর মা মাসি সেদিন অব্দি নাকি সন্ধেবেলা লম্ফ নিয়ে দাঁড়াত শাসনের খারাপ পাড়ায়। আমি কিন্তু থ্যাবার চোখে সোনালি সাপের মতো এক সুদূর রহস্যময় দেশ দেখেছিলাম, বৃষ্টি মাথায় বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেই সদ্য জানা দেশ সযত্নে রেখে দিয়েছিলাম অলীক ভূগোল বইয়ের খাঁজে।

তারপর তো পৃথিবীতে কত বৃষ্টি ঝরেছে, বৃষ্টির মধ্যে হাঁটার সুবিধেগুলোও জানা হয়ে গেছে এতদিনে, সেই পৃথিবীর মতো ছাদ, আজও একা একা ভেজে। আমি দূর থেকে দেখি তারে মেলা জামাকাপড়গুলো ভিজছে।  কিন্তু ওগুলো কাদের চিনতে পারি না। কোষাঘাটের পাশের বকুলগাছটা ঊরুভঙ্গ দুর্যোধনের মতো পড়ে। পামগাছগুলো এখনও আছে, আর তাদের মাথায় ঘুড়ির মতো আটকানো ঘন নীল মেঘ। ওদের পেরিয়ে, নহবতখানা, শিবমন্দির, আনন্দময়ী তলা, রাধামাধবের মন্দির পেরিয়ে, পোড়ো গুমঘরের পাশ দিয়ে আমি হেঁটে চলি আর ভিজতে থাকি অবিরাম।