কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়
মৌসম ভিগ্ইয়ান বিভাগ কে অনুসার শহর মে আজ ভারি বারিষ কি সম্ভাওয়ানা হ্যায়।
এটা একশো দুই দশমিক ছয় কিংবা একশো ছয় দশমিক চার। এ আই আর এফ এম রেনবো বা গোল্ড। আমার ফোনের রেডিও নয় যে বাটনে চাপ দিয়ে স্ক্রিন আলোকিত করে নিয়ে চট করে চ্যানেলের নাম দেখে নেব। তবে সরকারি চ্যানেল যে শিওর। বেসরকারি চ্যানেল হলে ‘হেভি রেনফল কি চান্সেস হ্যায়’ জাতীয় হিন্দিতে খবরটা দিত। গলাটাও লো পিচ, ঘুমন্ত। ঘোষকের যৌবনসূর্য অস্তমিত হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রোফাইল পিক হয় তোয়ালে-মাথায় স্বাস্থ্যবান শ্বেতাঙ্গ শিশু নয়তো বনফুলের ক্লোজ আপ। জীবনে মোমবাতি মিছিলে অংশগ্রহণ করার সংখ্যা, শূন্য। বেসরকারি চ্যানেলের আর জে হলে কণ্ঠস্বরে মিনিমাম তিনশো গুণ এনার্জি থাকত, শুনলেই বোঝা যেত রাষ্ট্র ও বিশ্বের অন্যায়অবিচারে নিয়মিত কুপিত হন এবং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করেন। বছরে দুটো করে প্রতিবাদসূচক মিছিলে যোগ দেন। তাছাড়াও বেসরকারি চ্যানেল হলে ঘোষণার পর উল্লাসব্যঞ্জক হুপহাপ ধ্বনির পর টায়ারের বিজ্ঞাপন শুরু হত, তারপর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির, তারপর ছাতুর অথবা মুয়েসলির। তারপর বাজত পাঞ্জাবি পেপি মনসুন নাম্বার।
ওলা ভাইসাবের রেডিওতে মান্না দে গান ধরেছেন। পেয়ার হুয়া ঈকরার হুয়া হ্যায় পেয়ার সে ফির কিঁউ ডরতা হ্যায় দিল।
সরকারি চ্যানেল মারফত হোক বা বেসরকারি, রেডিও হয়ে বা ইন্টারনেট ঘুরে, সকলেই খবরটা পেল। উবারপুলের সহযাত্রী তো আমার সঙ্গেই পেলেন। গন্তব্যের দু’মিনিট বাকি থাকতে ফোন করে কাকে বললেন, “ভেজ দো।” দশবার মরে এগারোবার জন্মালেও আমার গলায় ওই দাপট আসবে না। ওই দাপট নিয়ে আদেশ দিলে অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। দূর থেকে দেখা গেল ওঁর ড্রপ পয়েন্টে একজন অপেক্ষা করছে। এ যে বাড়িতে জন্মেছে সে বাড়িতে কোনও পুরুষ সাড়ে পাঁচ ফুটের বেশি লম্বা হয় না আর মেয়েরা পিউবার্টিতে পা দিতে না দিতে রক্তাল্পতায় ভোগে। দৌড়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে দিল, দাপুটে গলা নেমে গলি দিয়ে হেঁটে গেলেন, পেছন পেছন অ্যাটাচি বয়ে নিয়ে গেল রোগা ছেলে। কান থেকে সস্তা ইয়ারফোনের দড়ি ঝুলছে। ভারিরকম বারিষের সতর্কবাণী ওর কান বাজেনি হতেই পারে না। প্রতিদিন সকালসন্ধে শান্তমুখে জল ছিটিয়ে, ন্যাতা ঘষে পায়রাদের দুষ্কর্ম যিনি ন্যাতা ঘষে সাফ করেন, তাঁর কানেও ইয়ারফোন। অফিসের গেটে সিকিউরিটি ভাইসাবদের কুঠুরিতে রেডিও বাজছে।
অফিসেও শুনেছে সবাই। সারাদিন অনলাইন খবরের কাগজ পড়ে যারা তারাও শুনেছে, পেশাই যাদের নেশা তারাও। প্যান্ট্রিতে অন্যদিন পেপার পাবলিকেশন কিংবা কার অ্যাবস্ট্রাক্টের ছিপ ক’টা সমুদ্র পার করে কোন সেমিনার গেঁথে তুলেছে সেই সব আলোচনা হয়, সেদিন ফাঁকে ফাঁকে বর্ষার কথা ঢুকে পড়ল। ফা-ই-ন্যা-লি। বলল সবাই।
আমি অবশ্য উত্তেজিত হইনি। কারণ রবীন্দ্রনাথের গল্পটা আমার জানা আছে। শান্তিনিকেতনের পথে সান্ধ্যভ্রমণরত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একদিন উল্টোদিক থেকে হেঁটে হেঁটে আসা একজনের দেখা হল। তিনি বললেন, “একী গুরুদেব, ছাতা নিয়ে বেরোননি?” রবীন্দ্রনাথ বললেন, “আবহাওয়া দপ্তর পূর্বাভাসে বলল কি না, তাই।” উল্টোদিকের লোক বললেন, “সেটাই তো, আবহাওয়া দপ্তর তো বলল বৃষ্টি হবেই।” রবীন্দ্রনাথ বললেন, “অত জোর দিয়ে বলল বলেই তো আমি আরও নিশ্চিন্ত হয়ে ছাতা বাড়িতে রেখে বেরিয়ে বেরোলাম।”
বৃষ্টি আসবে কিনা শিওর ছিলাম না, কিন্তু যদি আসে তাহলে কখন আসবে সে বিষয়ে নিঃসংশয় ছিলাম। অফিস থেকে বেরোনোর মুখে। কারণ তখন ওলাউবার পাওয়া যাবে না, পেলেও সার্জ প্রাইসিং-এ দাম হবে তিনগুণ। বুদ্ধি খাটিয়ে আগে থেকে খুঁজতে শুরু করেছিলাম ভাগ্যিস। কুড়ি মিনিট খোঁজার পর, কুড়ি মিনিট দূর থেকে গাড়ি এল। ধুলো আর পাতার টর্নেডোর মধ্যে হেডলাইট জ্বালিয়ে এসে দাঁড়াল। চোখের ভেতর ঢুকে যাওয়া বালি ঘষতে ঘষতে গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করে বললাম, “চলিয়ে, ভাইসাব।”
মেহেরচন্দ মার্কেটে পৌঁছতে পৌঁছতে বৃষ্টি নামল। বাচ্চাগুলো চিৎকার করে দৌড়চ্ছে ছুটন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে। ফলের ঠেলাগাড়ির প্লাস্টিকের চাঁদোয়ার একদিক খুলে গিয়ে উড়ছে পতপত। সবুজ পাতা ছাওয়া একটা বৃক্ষ, উপড়ে পড়েছে রাস্তার ওপর। একটা কুকুর ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার মাঝখানে। দু’দিক দিয়ে সাই সাই করে গাড়ি ছুটছে। কী হয়েছে ওর? এত বৃষ্টিতে ভয় পেয়ে গেছে? নাকি অসুস্থ? নাকি অন্ধ? আমার থেকে বেশি হৃদয়বান কেউ নিশ্চয় থাকবে এ শহরে, যে নিজের কাজ থামিয়ে ওকে সরিয়ে নিয়ে যাবে।
দিল্লি কলকাতা মুম্বাই নয়, বৃষ্টি হ্যান্ডল করতে পারে না। দশ মিনিট মোটামুটি জোর বৃষ্টি হলেই ম্যানহোল জ্যাম, সিগন্যাল দপদপ। জ্যামে দাঁড়িয়ে দেখছি মেট্রোরেলের ব্রিজের তলায় কোটি কোটি মোটরবাইক। পরাজিত, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাদা বৃষ্টির দিকে। আমিও দাঁড়িয়ে আছি, আমারও দেরি হচ্ছে তবু উল্লাস হল। বেশ হয়েছে। আমার যদি ক্ষমতা থাকত আমি সকালবিকেল কয়েকঘণ্টা শহরের রাস্তা মোটরবাইক মুক্ত রাখার নিয়ম করতাম। এরা ফাঁক পেলে লাইন ভেঙে যেখানসেখানে ঢুকে পড়ে, অসভ্যের মতো হর্ন দেয়, ফুটপাথের ওপর চালিয়ে ফুটপাথ ভেঙে দেয়। এরা শহরের পরিবহন ব্যবস্থার গুণ্ডা।
জোর নেমেছে বৃষ্টি। ফোন ইন প্রোগ্রামে আর জে সবাইকে জিজ্ঞাসা করছেন পকোড়া খাওয়ার মন করছে কি না। আমারও করছে। পকোড়া নয়, বেগুনির। দু’নম্বর মার্কেটের খোলা আকাশের নিচের স্টলগুলো এই বৃষ্টিতে উঠে যাবে, কিন্তু পাকা দোকান, যেমন দাদুর চপের দোকান থেকে নেওয়াই যায়।
মূলচন্দ ব্রিজের নিচের সিগন্যালটা ফাঁকা এবং বন্দি মোটরবাইকের জটলা। ডবল আনন্দ। দুয়েকটা খাবারদাবারের দোকান আছে এখানে। অন্য জায়গায় নান বিক্রি হয়, এখানে চুরচুর নান। লিজেন্ড বলে এই জায়গায় ঠেলাগাড়িতে চুরচুর নান নিয়ে বসতে বসতে একজন এসি দোকান দিয়ে ফেলেছে। জোম্যাটোতে সে দোকানের নিয়মিত চারপাঁচ রেটিং। তার অনুপ্রেরণাতেই সম্ভবত এখানে এখন চারপাঁচটা চুরচুর নানের দোকান। ডিমের খোলা, পেয়াজের খোসা, থকথকে ডাল গড়িয়ে ম্যানহোলের মুখ জ্যাম। জমা জলে সাদা থার্মোকলের থালা মৃদুমন্দ ভাসছে।
দু’নম্বর মার্কেটে চুরচুর নান নেই, কিন্তু চপ আছে, শোয়ারমা আছে, ফুচকার এঁটো শালপাতা, মোমোর চাটনি লাগা সাদা প্লাস্টিক, কচুশাকের পচা ডাঁটা, ভেপসে ওঠা মাছের পিত্ত, আর এইসব দেখে গা গুলিয়ে উঠলে থকথকে ফেনিল থুতুও আছে।
চপের আইডিয়া বাতিল করলাম। বৃষ্টি থেমে গেছে। গাড়িতে উঠেছিলাম পাঁচটা তেত্রিশে, নামছি ছ’টা সাতচল্লিশে। এর মধ্যে জোরে বৃষ্টি হয়েছে টানা তিরিশ মিনিট মতো। লাজপত নগর থেকে উঠেছেন আমার সহযাত্রী। জিমে যাচ্ছেন। ডেডিকেশন দেখে শিখতে হয়। ফোনে বলছেন, “ইট রেইন্ড সো মাচ ইয়া।”
ট্যাক্সি থেকে নেমে চল্লিশ সেকেন্ড দাঁড়াতে হল। এক হাতে ব্যাগ, অন্য হাতে সালওয়ার টেনে রাখতে হয়েছে। ছাড়লেই নোংরা জল লেগে নিচটা লতপত করবে। পৃথিবীর প্রথম তিনটে জঘন্যতম অনুভূতির মধ্যে একটা। অর্থাৎ চড়া এসি থেকে বেরোনোর পর সম্পূর্ণ ধোঁয়া চশমার কাঁচ মোছার জন্য একটাও হাত খালি নেই। চল্লিশ সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকতে হল যতক্ষণ না অন্তত কোথায় পা ফেলছি দেখার দৃষ্টি ফোটে। বাজারের সামনে জায়গা নেই বলে মাছের লরি এই মোড়ে পার্ক করা থাকে। তার নীল প্লাস্টিক ত্রিপলের ভেদ করে মাছের বোটকা গন্ধ ভ্যাপসা বাতাসে মাখামাখি। গরম তো কমেইনি, বরং বৃষ্টির গুঁতোয় মাটির নিচে আটকে থাকা উত্তাপ হই হই করে বেরিয়ে এসেছে।
বাড়ির ভেতরের অবস্থা তার থেকেও খারাপ। ট্যাক্সি থেকে নেমে চল্লিশ সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকার সময় গাছের পাতা থেকে দু’চার ফোঁটা জল মাথায় পড়েছিল, না হলে আমার প্রমাণ করার কোনও উপায়ই থাকত না যে বৃষ্টি হয়েছে। এই বাড়িগুলো খুব আগুপিছু ভেবে, চিন্তা করে বানানো। জানালার পর্দা উড়ে যেখানসেখান থেকে জল ঢুকে বালিশের ওয়াড় কিংবা শুকোতে দেওয়া জামা ভিজিয়ে দিয়ে যাবে, সে হবে না। বারান্দা আছে, কিন্তু তার কোমরছোঁয়া রেলিং থেকে সিলিং পর্যন্ত লোহার গ্রিল। প্রতি জানালা ঘিরে এগিয়ে থাকা কার্নিশ। এ সব পাড়ার শুরু এবং শেষ কথা সিকিউরিটি। মানুষের থেকে, কুকুরবেড়াল থেকে, বৃষ্টিবাদলার থেকেও।
তবু মানুষের হাতে তৈরি/বানানো জিনিসে খুঁত থেকেই যায়। জুন মাসের শনিরবির পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রির দুপুরবেলায় পর্দা টেনে শুলে ঘন নীল পর্দার একটা জায়গার একটা ছোট্ট কড়ে আঙুলের সাইজের ফ্যাকাসে বৃত্ত ধীরে ধীরে ফ্যানের হাওয়ায় দোলে। ঢোকার সময় এজেন্টকে আমরা ওটা দেখিয়ে নিয়েছিলাম।
“এই জায়গার জানালার কাঁচটা কিন্তু অলরেডি ফাটা, দেখবেন যেন পরে আমাদের দোষ…”
“না না, মাসিমা জানেন,” বরাভয় দিয়েছিলেন এজেন্ট।
তা বলে কি আর সব মেপেজুকে ঢুকতে পেরেছি? খুব টেনে ছিটকিনি লাগিয়ে বন্ধ করলেও একটা জানালার পাল্লা আর ফ্রেমের ফাঁকে সেন্টিমিটার ফাঁক থেকে যায়। এসিওয়ালা সার্ভিসিং করাতে এসে বলে গেছেন, ঠান্ডা না হলে যেন আমরা তাঁকে দোষ না দিই।
“ঘরকি ইনসুলেশন সহি নহি হ্যায়।”
বৃষ্টি পারেনি, কিন্তু সেই সব ফাঁকফোকর দিয়ে ধুলো এসে ঢুকেছে। মেঝে কিচকিচ। এঞ্জিনিয়ারড কাঠের কালো বুককেসের গায়ে ধুলোর পরত।
অগ্রাহ্য করে শোওয়ার ঘরের জানালার কাছে এসে দাঁড়ালাম। নতুন বাড়ির অনেক জিনিসই আমার পছন্দের, কিন্তু সবথেকে পছন্দের এই জানালার পাশটা। জানালা আর পাশের বাড়ির দেওয়ালের মধ্যে ছোট্ট চৌকোটায় একটা গাছ। জানালার ফ্রেমে গাছটার কাণ্ডটুকুই শুধু ধরা পড়ে। পুরোনো গাছ। বাংলাদেশের ম্যাপের নদীনালার মতো কাণ্ড জুড়ে ছোট ছোট ফাটল। শুধু কাণ্ড দেখে গাছ চেনার বিদ্যে আমার নেই। মাসিমার সঙ্গে ছাদে গিয়ে দেখেছিলাম, আমগাছ।
“বাকি সব আমগাছ এখানকার, কিন্তু এটা বাড়ি থেকে আনা।” মাসিমা শান্ত চোখ আকাশের দিকে তুলে ভেবেছিলেন। “বিরাশি… না আশি, হ্যাঁ, উনিশশো আশিতে আমার শ্বশুরমশাই এনেছিলেন। এইটুকু ছিল, আমরা ভেবেছিলাম বাঁচবে না। শ্বশুরমশাই তখন গাছের নেশায় মেতেছেন, ক্যাকটাসের বাগান করেছেন, বনসাই আছে, বললেন, একটা দেশের আমের চারা থাক। এইটুকু চারা,” বাঁ হাতের ফরসা হাতের পাতা অন্য হাতের আঙুল দিয়ে মেপে দেখিয়েছিলেন মাসিমা, “আমরা ভেবেছিলাম বাঁচবে না। বাবা পুঁতে দিলেন, দিব্যি ধরে গেল।”
কানের রেডিওতে তখন উচ্ছ্বাস। নরেলা থেকে, রোহিণী থেকে, দ্বারকা আর কিষণগড় থেকে ক্রমাগত ফোন আসছে। অবশেষে অপেক্ষার অবসান, অবশেষে তৃষ্ণা মেটানো, প্রাণ জুড়োনো বারিষ। ফোন থেকে ইয়ারফোন টেনে খুললাম, রেডিও জোরে বেজে উঠে বলল, কী বৃষ্টি কী বৃষ্টি, “অ্যায়সা কভি নেহি দেখা ইয়ার।”
নিজের গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা শুকনো হাসিটার সঙ্গে সঙ্গে টের পেলাম আরও একটা হাসি হেসেছে কেউ। আমার হাসিটার মতোই শুকনো। এবং সংক্ষিপ্ত। টাইমিংটা আর একটু নিখুঁত হলেই দ্বিতীয় হাসিটা কান ফসকে পালিয়ে যেত।
কে হেসেছে?
খাট হাসেনি, বিছানা হাসেনি, আমার বেডসাইড টেবিলের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা যোগব্যায়ামের আসনের হাসার কারণ থাকলেও হাসেনি, কারণ ও হাসতে পারে না। হাসতে পারার মতো আমি ছাড়া এখানে আর একটাই জ্যান্ত জিনিস আছে। প্রসেস অফ এলিমিনেশনে সে-ই হেসেছে।
ওই গাছটা। এবং বুঝতে পেরেছে যে আমি ওর হাসি শুনতে পেয়েছি। আর হাসছে না। নট নড়নচড়ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি মনের ভুল বলে ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দেব সম্ভবত এই আশায়।
আমি ওর থেকে চোখ সরাচ্ছি না বলেই বোধহয় অবশেষে বলল, “হাসা উচিত নয় অবশ্য। এরা তো আসল বৃষ্টি দেখেনি।”
আমি বললাম, “তুমি দেখেছ?”
“দেখিনি মানে? আষাঢ় মাসে জন্ম আমার। আমার জন্মের বছরে যা বৃষ্টি হয়েছিল, চল্লিশ না পঞ্চাশ বছরে ওইরকম বৃষ্টি আমাদের শহরে, গোটা জেলায় হয়নি।”
“তারপর?”
“তারপর ট্রেনে চড়ে দিল্লি চলে এলাম। আজ সাইত্রিশ বছর ধরে এই বৃষ্টি দেখছি।”
তিরিশ মিনিটের বৃষ্টির খেল এখনও চলছে, চলবে সারা রাত, কাল সারা দিনও চলতে পারে। শহরের ট্র্যাফিক প্রায় স্তব্ধ। অর্চিষ্মান ফিরল ন’টা বাজিয়ে। আমরা খেয়েদেয়ে দিন শেষ করলাম।
আর তখন বৃষ্টি এল আবার। তার আগে আকাশ কালো করে মেঘ এল। নারকেলগাছের পাতায় পাতায় ঝড় এল। ধুলোর বদলে হাওয়ায় চড়ে ভেজা মাটির গন্ধ, উড়ন্ত পাখির পালক আর পাশের বাড়ির শুকোতে দেওয়া রুমাল এল। আমাদের রুমালেরও যাতে সে দশা না হয় সে জন্য মায়ের পেছন পেছন দৌড়লাম ছাদে। এদিকে খোলা জানালার কথা খেয়াল নেই, পর্দা উড়ে বিছানার চাদর গোবর। ওই মুহূর্তে প্রায়োরিটি ঠিক রাখা অতি ঠান্ডা মাথার মানুষের পক্ষেও অসম্ভব। বাগানের গাছগুলো আকণ্ঠ ভিজছে। ঝড়ের দাপট কমে যাবে এক্ষুনি। যাওয়ার আগে কারেন্ট সঙ্গে নিয়ে চলে যাবে। কিন্তু বৃষ্টি থামবে না। সবে তো শুরু। ঠায়লয়ে চলবে সারা সন্ধে, সারা রাত। আজ রাতে কেউ পড়তে বসতে বলবে না। আজ আমরা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে মুড়ি খাব, রাত গভীর হলে রুটি তরকারি। বাথরুমে যাওয়ার পথ, কুয়োতলা ডুবে গেছে। হ্যারিকেনের সলতে বাড়িয়ে, ভালো করে দেখেশুনে, সাবধানে পেরোতে হবে পথটুকু। আগের বর্ষায় আরেকটু হলেই একটা এঁকেবেঁকে চলা সাপের ওপর পা পড়ে যাচ্ছিল।
বৃষ্টি চলছে এখনও, পেছনের জঙ্গলের ব্যাঙগুলো ডাকাডাকি থামানোর লক্ষণ দেখাচ্ছে না। জানালা দিয়ে ফুরফুর করে ঠান্ডা হাওয়া এসে হাতের, ঘাড়ের লোমগুলো খাড়া করে তুলেছে। মা বলছে জানালা বন্ধ করে দেবে। বিফল জেনেও প্রবল প্রতিবাদ জানাচ্ছি। জানালার শিকের ওপাশে পেঁপে গাছের পাতার ডগা থেকে ঝুলন্ত জলের ফোঁটায় কুণ্ডুবাড়ির রেলিং-এর ওপর বসে থাকা চাঁদের ঘোলাটে আলো চিকচিকাচ্ছে।
*****
ঘুম ভেঙে গেল। অসহ্য গরম। ভেপসে যাচ্ছি। বৃষ্টি কখন থামল? এসির রিমোট কোথায়? আগে চশমাটা দরকার। এইসময় যেমন হয়, পর্দার নীল অল্প ফিকে হতে শুরু করেছে। চশমা খুঁজে, দাঁত মেজে, ফুটন্ত জল চায়ের ব্যাগে ঢেলে নিয়ে এসে বসলাম।
পর্দা সরিয়ে দিলাম। গাছটার শুকনো গুঁড়ির ফাটলগুলো স্পষ্ট হচ্ছে ধীরে ধীরে। একবার মনে হল জানালা খুলে হাত বাড়িয়ে ছুঁই। ছুঁলাম না। ওর স্বপ্নের বৃষ্টি যতক্ষণ চলে চলুক।