Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মানুষ চেয়ে গোমাতা দামী

রৌহিন ব্যানার্জী

 

“মানুষ চেয়ে ছাগল দামী
খবর গেল বাবার কানে”

এই ছড়াটা আমাদের ছোটবেলায় প্রায়ই দেখতাম পোস্টার হিসাবে– পরে জেনেছিলাম ওটা একটা নাটক। তবে কিনা আমাদের জানার তো শেষ নাই– কবি বলেছেন। কে বা জানত যে আরও পরে জানব যে “মানুষ চেয়ে গরু দামী” নাটক আর মঞ্চে নয়– আমাদের জীবনেই অভিনীত হবে? কে জানত গোরক্ষা সমিতি একদিন আমাদের মরাল গার্জেন হয়ে উঠবে? কী করে জানব যে ভদ্রজন সমাজ উঠতে বসতে ইউপি হরিয়ানার খাপ পঞ্চায়েতকে তুলোধনা করেন, তারা গণপিটুনিতে হত্যার ধারাকে বিভিন্নভাবে জাস্টিফাই করতে মাঠে নামবেন?

বিভিন্ন দেশে একেক সময়ে এক এক রকমের ফ্যাশন বাজারে খুব চলে– আজকালকার চলতি ভাষায় যাকে “ইন থিং” বলি আর কি। তো মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে যে গত তিন/চার বছরে ভারতবর্ষে ইন থিং হল মব লিঞ্চিং। যখন তখন হোয়াটস অ্যাপ বা ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে বার্তা, ভিডিও, আর সেই সামান্য প্ররোচনাতেই জমা হয়ে যাওয়া জনতা কোনও বিচারব্যবস্থার, সত্যি-মিথ্যা যাচাইয়ের তোয়াক্কা না করে নেমে পড়ছে অ্যাকশানে। এবং এই সমস্ত গণপিটুনির কিছু কমন প্যাটার্ন আছে– সবচেয়ে কমন বোধহয় এটাই যে লিঞ্চাররা হিন্দু এবং ভিক্টিমরা গরীব মুসলমান।

এই নতুন ফ্যাশনেরই আপাতত শেষ নমুনা দেখা গেল দিন তিনেক আগে– সেই আলওয়ারে– জনৈক রাকবার খান ওরফে আকবর এবং তার সঙ্গী আসলাম, যারা পৌরসভার থেকে রসিদ সহ একটি গরু নিয়ে জঙ্গলের রাস্তা ধরে হরিয়ানায় তাদের গ্রামে ফিরছিলেন, গ্রামবাসীর হাতে ধরা পড়লেন। একদম ছক মেনে গ্রামবাসীদের মনে হল ওরা গরুটা চুরি করে পাচার করছেন, ছক মেনেই তাদের কারও একবারও যাচাইয়ের কথা মনেও হল না, হোয়াটস অ্যাপে খবর ছড়াল, সবাই জড়ো হয়ে গেল, গণপিটুনি হল, রাকবার মারা গেলেন এবং আসলাম গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হলেন। গত বছর পেহলু খাঁ এই আলওয়ারেই মারা গেছিলেন– ঠিক এইভাবে– যদি মনে না থাকে– https://en.wikipedia.org/wiki/2017_Alwar_mob_lynching এইখানে একবার দেখে নিতে পারেন।

ছকটা খুব চেনা লাগছে না কি? মাত্র কিছুদিন আগে কর্নাটকের বিদার জেলায় মারা গেলেন গুগলের ইঞ্জিনিয়ার মহঃ আজম, গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হলেন তাঁর সঙ্গী কাতারের নাগরিক সালাম ইদ কুবেশী এবং ভারতীয় নূর মহম্মদ। কারণ? গণপিটুনি। কারণ তারা কিছু বাচ্চাদের লজেন্স দিচ্ছিলেন– হোয়াটস অ্যাপে সেই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে এবং গ্রামবাসীরা দ্রুত জমা হয়ে যান। ওদের ছেলেধরা সন্দেহে পেটানো হয়। এক্ষেত্রে একটা ব্যতিক্রম অবশ্য এই যে এখানে গরু ছিল না– ছিল ছেলেধরা। কিন্তু ভিক্টিম সেই মুসলমানই– এবং মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে মুসলমান হবার জন্যই তারা ভিক্টিম। ত্রিপুরাতেও একইভাবে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছে চারজনকে– এই মাসেই।

এখন প্রশ্ন হল, মব লিঞ্চিং কেন হয়, কারাই বা করে, আর কেনই বা গত তিন-চার বছরে এর এত বাড়বাড়ন্ত? তিনটে প্রশ্নের উত্তর মোটামুটি সম্পৃক্ত– মব লিঞ্চিং হয় প্রশাসনের ব্যর্থতায় মূলত। মানুষ যখন প্রশাসনের ওপর ভরসা রাখতে পারে না, তার ভিতরে ক্ষোভ জন্মায়– অন্যায়ের বিচার সে নিজেই করতে চায়। এখন কোনটা অন্যায় আর কোনটা অন্যায় নয়, সেটা বিচার করার সময়ে মানুষের নীতিবোধ কাজ করে– আর সেই নীতিবোধকে কিছু লোক বা গোষ্ঠী বা অনেক সময় এমনকি রাষ্ট্রও নিজেদের স্বার্থে ম্যানিপুলেট করে থাকে– কখনও সূক্ষ্মভাবে, কখনও বা ততটা সূক্ষ্মভাবে নয়ও। আর মানুষ যদি জেনে যায় যে এসব লিঞ্চিং-এর জন্য তাদের তেমন কোনও শাস্তি হবে না, তবে তা করার উৎসাহ আরও বেড়ে যায় স্বাভাবিকভাবেই।

মহঃ আখলাক যে কারণে নিহত হয়েছিলেন, রাকবার খানও ঠিক সেই একই কারণে প্রাণ দিয়েছেন– এবং মাঝখানে রেখে গেছেন তাদের মতো আরও অগণিত ভিক্টিমকে– এবং প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই এই হত্যাকারীরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রশ্রয় পেয়েছে। এমনকি এই সর্বশেষ (এখনও পর্যন্ত আশা করি) ঘটনাটিতেও, একদিকে যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জানাচ্ছেন দোষীরা শাস্তি পাবেই, অন্যদিকে রাজ্যেরই এক মন্ত্রী বিবৃতি দিচ্ছেন, গরু খাওয়া বন্ধ করলেই নাকি গণহত্যাও কমে যাবে। সহজ হিসাব। শিব ঠাকুরের আপন দেশে অবশ্যই মানুষের চেয়ে (পড়ুন মুসলমান নাগরিকের চেয়ে) গরুর দাম বেশি। এ কথা না মানলে আপনি দেশদ্রোহী।

গত ১৭ই জুলাই ২০১৮ সর্বোচ্চ আদালত একটি নির্দেশনামা জারি করে যেখানে রাজ্যগুলিকে এই ধরনের গণরোষ রুখতে বিশেষ আইন চালু করার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্টভাবে জানান যে এগুলি বন্ধ করা এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া কেন্দ্রীয় ও রাজ্য– উভয় সরকারেরই দায়িত্ব। এবং কোনও পুলিশ অফিসার যদি এই ধরনের ঘটনায় দ্রুত উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেন, তাহলে তা ইচ্ছাকৃত অবহেলা এবং কর্তব্যে গাফিলতি (deliberate negligence and/or misconduct) হিসাবে গণ্য হবে এবং সেইমতো সেই অফিসারের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।

এখন কথাটা হল সর্বোচ্চ আদালতকে নির্দেশ জারি করে এই সব কথা কেন বলতে হছে? হচ্ছে কারণ যা হবার কথা, তা হচ্ছে না। কেন্দ্র, রাজ্য– কোনও সরকারই তাদের কাজ ঠিকমত করছেন না– এবং পুলিশও না। রাকবার যখন মৃতপ্রায় অবস্থায় ছটফট করছিলেন, তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে প্রায় চার ঘণ্টা লেগে যায়, পুলিশ নাকি তখন “উদ্ধার হওয়া” গরুদুটিকে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠাতে ব্যস্ত ছিল। এবং নিশ্চয়ই আমরা কেউ অবাক হব না একথা জেনে যে এই ঘটনা কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের উপরিউক্ত রায়ের পরবর্তীকালে ঘটেছে। এতে এখন আর আমরা ভারতে বসে কেউ অবাক হই না। আমরা গণতন্ত্র থেকে দ্রুত এবং সাফল্যের সঙ্গে “জনতাতন্ত্রের” (Mobocracy) দিকে এগিয়ে চলেছি।

মব লিঞ্চিং, প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রে, মূলত নির্মিত হয়। সাধারণ মানুষ বেশিরভাগ সময়েই ঝামেলা এড়াতে চান, তাতে জড়িয়ে পড়তে নয়। অথচ এই সব গণপিটুনির সময়ে জনতার অভাব দেখা যায় না। এর কারণ এইসব জনরোষকে একটু একটু করে লালিত করা হয়– এবং কোনও বিশেষ ব্যক্তিবর্গের দিকে– তা সম্প্রদায় হতে পারে, জাত হতে পারে, কোনও নির্দিষ্ট পেশা হতে পারে– এরকম যে কোনও সাধারণীকরণ হতে পারে যাতে ভিক্টিমকে সহজে চিহ্নিত করা যায়– এবং তারপর জনতার বঞ্চনাকে, ক্ষোভকে কাজে লাগানো হয় সেই ভিক্টিমের বিরুদ্ধে। এক ঢিলে তিন পাখি– শত্রুও নিপাত হল, কেউ আলাদা করে অপরাধীও হল না, এবং জনতাও তার পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কিছুটা বার করে দিতে পেরে একটু শান্ত থাকল। কেউ কেউ আবার এই ক্ষোভ বার করার অজুহাতে একটু ক্ষমতার অলিন্দের স্বাদও পেয়ে যান।

আসুন, এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ। আমাদের দেশ। আসুন আমরা সবাই মিলে খুঁজে বেড়াই নতুন নতুন ভিক্টিম– সবাই মিলে একজনকে মারলে খুব একটা রিস্ক থাকে না কিনা। বিনা ঝুঁকিতে কী সুন্দর আমরা ভুলে যাব আমাদের যাবতীয় না পাওয়ার দুঃখ। ভুলে যাব আমাদের লক্ষ লক্ষ বেকারের চাকরি হবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কেউ। ভুলে যাব কেউ প্রমিস করেছিল বিদেশ থেকে সব কালো টাকা উদ্ধার করে এনে আমার আপনার মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হবে। ভুলে যাব কেউ বলেছিল দেশজুড়ে গড়ে উঠবে পাকা শৌচালয়, মেক ইন ইন্ডিয়ার জোয়ারে দেশ হবে স্বনির্ভর। ভুলে যাব তেলের দাম রোজ বাড়ছে, শিক্ষাখাতে স্বাস্থ্যখাতে হুহু করে কমে যাচ্ছে বরাদ্দ। আসুন, এসব ভুলে আমরা গরুচোর খুঁজি। মানুষ চেয়ে গোমাতা দামী আফটার অল!