Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নিহিত কোমলগান্ধার : সিনেমা সঙ্গীত ও ঋত্বিক ঘটক — নয়

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

 

অষ্টম পর্বের পর

রামকিঙ্কর (১৯৭৬)

বিদায়লগ্ন আসন্ন। আর বেশি দেরি নেই। ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি শেষ হবে ঋত্বিকের পথচলা। কিন্তু নিভে যাওয়ার আগেই প্রদীপ শিখা শেষবার দপ করে জ্বলে ওঠে৷ শেষবার ছড়িয়ে পড়ে আলো। অন্ধকারে মিশে যাওয়ার আগে। ‘রামকিঙ্কর’ ঠিক তেমনই একটি ফসল।

শেষ হুইসল বাজার ঠিক ৮ মাস আগে ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে ‘রামকিঙ্কর’ নিয়ে খনন শুরু হয় ঋত্বিক কুমার ঘটকের। ‘রামকিঙ্কর’ নিয়ে অনেকদিন ধরেই চলছিল তার চিন্তাভাবনা। ঋত্বিক নিজে ছিলেন প্রবল রামকিঙ্কর অনুরাগী। রামকিঙ্করের চারুকলা, স্থাপত্য ও তার নেপথ্যে যে দর্শন তার একনিষ্ঠ গুণমুগ্ধ ছিলেন ঋত্বিক। তাই ‘মাইহার’ ঘরানার স্রষ্টা কিংবদন্তি সঙ্গীত শিল্পী ও সঙ্গীতাচার্য ‘আলাউদ্দিন খাঁ’-কে নিয়ে তার ‘ডকুমেন্টশেনে’র সময়ই ‘রামকিঙ্কর’ তথ্যচিত্রের পরিকল্পনা নিয়ে ফেলেছিলেন ঋত্বিক। কিন্তু করে উঠতে পারেননি। মাঝে অতিক্রান্ত হয়েছে বেশ কিছু সময়। অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। অবশেষে অনেক ঝক্কি পুইয়ে প্রোডাকশনের কাজ সামলে ১৯৭৫-এ বর্ষার সময়ে শান্তিনিকেতনে গিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। আগাগোড়া শান্তিনিকেতনেই তখন রয়েছেন রামকিঙ্কর। তাই চটজলদি তল্পিতল্পা গুটিয়ে শান্তিনিকেতনে হানা দেন ঋত্বিক। জুলাই’র শেষ সপ্তাহে চারদিন ধরে লাগাতার শুটিং করেন ঋত্বিক। শুটিং আরও বাকি ছিল। অল্প অল্প করে শুটিং সারলেও শেষ পর্যন্ত তা সম্পূর্ণ করতে পারেননি তিনি। তার মৃত্যুর পর পুত্র ঋতবান এটি সম্পাদনা করেন ‘ঋত্বিক মেমোরিয়াল ট্রাস্টে’র মাধ্যমে সম্পূর্ণ করতে। তিনি কতটা সফল হয়েছেন তা তর্কের বিষয়। অসম্পূর্ণ হলেও তবু বলা যায় ‘রামকিঙ্কর’ ঋত্বিকের শেষ প্রচেষ্টা।

‘রামকিঙ্কর’-এর সিনেমাটোগ্রাফির দায়িত্বে ছিলেন সুনীল জানা, সহকারী পার্থপ্রতিম চৌধুরী, সঙ্গীতে অজয় রায়, সরোদে পার্থসারথি, বাঁশিতে মানব মুখার্জী ও পাখোয়াজে বাবলু বিশ্বাস। ‘রামকিঙ্কর’ তথ্যচিত্রটির নির্দেশনা ও সম্পাদনার দায়িত্ব নিজের কাঁধেই নিয়েছিলেন ঋত্বিক কুমার ঘটক। শেষবারের মতো।

তথ্যচিত্রের শুরুটিও ভারি অভিনব করেছিলেন ঋত্বিক। সাদা পর্দার (স্ক্রিন) উপর নানা রঙের ছিঁটে। একটু একটু করে ফুটে ওঠা অবয়ব। ‘ব্যাকগ্রাউন্ডে’ মাদল বাজে। বাজে পাখোয়াজ। রামকিঙ্করের বিভিন্ন স্থাপত্যের ‘মন্তাজ’ দেখা যায়। এরই পাশাপাশি উঠে আসে পাখোয়াজ-সরোদের যুগলবন্দি। পরের দৃশ্যে উঠে আসে শান্তিনিকেতন। দেখা যায় খোয়াইয়ের ধার। এই দৃশ্যে অঞ্চলের গ্রামীণতা তুলে ধরতে বাঁশি ব্যবহার করেন ঋত্বিক। পল্লীসুরে মেঠো তান ভেসে ওঠে। দেখা যায় গ্রাম, আদিবাসী গ্রাম। বেজে ওঠে ধামসা নেপথ্যে। এই আদিম সুন্দরতার প্রতিচ্ছবি ঋত্বিক তুলে ধরেন হাসিমুখে এক আদিবাসী মহিলার তাকিয়ে থাকার দৃশ্যে। তিনি তার শিশুকে স্তন্যদান করছেন। বাঁশির শব্দ, ধামসা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

দৃশ্য ঘুরতে থাকে। ক্যামেরা প্যান হয় রামকিঙ্করের বিখ্যাত গান্ধীমূর্তিতে। হাঁটছেন ‘মহাত্মা’। অথচ তার পায়ের তলায় নরমুণ্ড। ঋত্বিকের প্রশ্নে রামকিঙ্কর বলেন, শতাব্দীর পর শতাব্দী দেশের অন্ত্যজ, দলিত শ্রেণির রূপক এই নরমুণ্ড। তার মাথায় পা দিয়েই অধিকাররক্ষার লড়াই লড়ছেন গান্ধী। সেই দৃশ্যেও প্রয়োগ হয়েছে সরোদ। এবার দেখা যায় বিখ্যাত ‘কৃষক দম্পতি’কে। স্থপতি জানান, তারা কুলি। ধানকলে কাজ করে। ভেজা কাপড় হাওয়ায় শোকাতে শোকাতে ছুটে চলেছে কারখানার দিকে। আবারও উঠে আসে সরোদের ধুন৷ লঘু স্বরে। এবার ক্যামেরা ঘোরে ‘মোষ ও মাছে’র দিকে। সুকুমার রায়ের ‘বকচ্ছপ’ বা ‘হাঁসজারু’ প্রভাবিত এই ‘অ্যাবস্ট্র্যাক্ট’ কাজ, জানান রামকিঙ্কর। ঢিমে লয়ে সরোদের মূর্ছনা দৃশ্যটিকে অন্য মাত্রা প্রদান করে। ঋত্বিকের নির্দেশে রামকিঙ্কর একের পর এক কাজ দেখিয়ে যান।

পরের দৃশ্যে দেখা যায় শান্তিনিকেতনের আকাশে মেঘ। রামকিঙ্কর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। ক্যামেরা তাকে অনুসরণ করে। এখানে সরোদ ও পাখোয়াজের যুগলবন্দি উল্লেখ্য। রামকিঙ্কর চুরুট ধরান। শোলার টুপি মাথায় গ্রামের পথে হেঁটে যান তিনি। ভিন্ন ভিন্ন ‘মোমেন্টস’ ধরা পড়ে। কখনও রিক্সায় বসে ‘স্কেচ’ করছেন রামকিঙ্কর। কখনও বা খোয়াইয়ের ধারে বসে ছবি আঁকছেন তিনি। আশ্রমের দৃশ্য। সামনে রামকিঙ্করের একটি অসমাপ্ত কাজ। তার সামনে খালি গায়ে বসে থাকেন রামকিঙ্কর। নেপথ্যে বাঁশির সুর মিশে যায় সরোদের মূর্ছনায়।

অন্য একটি দৃশ্যে দেখা যায়, কথোপকথনে মজেছেন দুই বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব ঋত্বিক ও রামকিঙ্কর। অঙ্গার বা চারকোল নিয়ে চলছে কথা। এরপরেই আসে এই তথ্যচিত্রের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যটি। ঋত্বিক রামকিঙ্করকে তাঁর ‘রবীন্দ্র সান্নিধ্য’ নিয়ে প্রশ্ন করেন। রামকিঙ্কর বড়বড় চোখ করে তার ‘রবিদর্শনে’র স্মৃতি হাতড়ান। তিনি বলেন “কবিগুরু বলেছেন, যখন কোনও কিছু দেখবে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে ঘাড় মটকে ধরবে। পিছনের দিকে আর তাকাবে না।” সাথে সাথে ক্যামেরায় ধরা পড়ে রামকিঙ্কর কৃত ‘রবিচ্ছায়া’। ভেসে ওঠে সরোদের বিলম্বিত আলাপ।

‘রামকিঙ্কর’ তথ্যচিত্রের শেষভাগে ঋত্বিকের কাছে নিজের গল্প শোনান রামকিঙ্কর। ১৯২৫ সালে শান্তিনিকেতনে তার আগমন, কংগ্রেস কর্মী রূপে কাজ, রামানন্দ চটোপাধ্যায়ের ডাকে বিশ্বভারতী আসা, পেনশনের টাকা দিয়ে ঘর সারানো এমনকি ক্যানভাস দিয়ে ফুটো ছাদ সাড়ানোর কথা তুলে ধরেন রামকিঙ্কর।

এখানেই গিয়ে শেষ হয়েছে এই ‘অসমাপ্ত’ তথ্যচিত্রটি। অসম্পূর্ণ হলেও ঋত্বিকের ছোঁয়ায় তা অনেকাংশেই পেয়েছে ‘সম্পূর্ণতা’। স্বল্প হলেও সঙ্গীতের মাধুর্যের দিকটি এখানে যথার্থ বজায় রেখেছেন তিনি।

রামকিঙ্কর হোক বা আলাউদ্দিন, সিনেমা হোক বা তথ্যচিত্র — সাঙ্গীতিক প্রয়োগে ঋত্বিক ঘরানা আজও অবিনশ্বর, অজেয় ও অপ্রতিরোধ্য।

 

(সমাপ্ত)