Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ক্যাপ্টেন দুপুরে ভাত খেতে গেছে আর নাবিকেরা দখল নিয়েছে জাহাজের — দ্বাদশ পর্ব

চার্লস বুকাওস্কি

 

অনুবাদ : শুভঙ্কর দাশ

একাদশ পর্বের পর

১/১৮/৯২
রাত ১১টা ৫৯ মিনিট

আমি একবার কবিতা, একবার উপন্যাস, একবার ঘোড়দৌড়ের মাঠের কাছে ফিরে ফিরে যাই আর এ করেও আমি এখনও বেঁচে আছি। খুব একটা কিছু ঘটছে না ঘোড়দৌড়ের মাঠে, আমি স্রেফ আটকে আছি মানবিকতায় আর এভাবেই আমি। আর আছে ফ্রিওয়ে, ওখানে যাওয়া আর ফিরে আসা। ফ্রিওয়ে সব সময় মনে করিয়ে দেয় বেশিরভাগ মানুষজন কেমন। এটা একটা প্রতিযোগিতার সমাজ। ওরা চায় আপনি হেরে যান যাতে ওরা জিততে পারে। এটা সহজাত প্রবৃত্তি আর তা অনেকটাই প্রকাশিত হয় ফ্রিওয়েতে। ধীরে চলা ড্রাইভাররা আপনাকে আটকাতে চায়, আর দ্রুত যারা চলছে আপনাকে টপকে এগিয়ে যেতে চায়। আমি ৭০-এ ধরে রাখি তাই আমি পাশ কাটিয়ে বেরোই আর আমাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় অনেকেই। দ্রুত যারা চালায় তাদের নিয়ে আমার চিন্তা নেই। আমি সরে এসে ওদের যেতে দি। বিরক্তিকর হচ্ছে ওরা যারা ধীরে চলে, যারা প্রথম লেনে ৫৫-তে চালায়। কখনও কখনও আপনি গোঁত্তা মেরে বসবেন। আর ব্যাপারটা ঠাওর পেতে আপনি ভালোই দেখতে পাবেন ড্রাইভারের মাথা আর গলা যে আপনার সামনে আছে। এটাই বুঝবেন যে লোকটার আত্মাটা ঘুমোচ্ছে আর একই সাথে সে বিরক্তিকর, গান্ডু, নিষ্ঠুর আর বোকা।

আমি একটা গলা শুনতে পাচ্ছি এখন যা আমাকে বলছে, ‘তুমি এটা বোকার মতো ভাবছ। তুমিই বোকা আসলে।’

সমাজে এই সব হাঁদা বা সাবনর্মালদের সমর্থন করার লোক জুটে যাবে সবসময় কারণ বুঝতে পারে না এই হাঁদাগুলো আসলে হাঁদা। আর তারা বুঝতে পারে না এ কারণে যে তারাও আসলে সব হাঁদা। আমাদের সমাজটা সাবনর্মাল বা হাঁদাদের সমাজ আর তাই তারা ওরকম আচরণ করে একে অপরের প্রতি। কিন্তু ওটা ওদের ব্যাপার আর আমি তাতে কিছু মনে করি না শুধু ওদের সাথে থাকতে হয় বলে অসুবিধা হয় আমার।

মনে পড়ছে একবার এক দল লোকের সাথে ডিনার সারছিলাম। কাছেই একটা টেবিলে বসেছিল আরেক দল লোক। ওরা চেঁচিয়ে কথা বলছিল আর হ্যা হ্যা করে হাসছিল। কিন্তু ওদের হাসিগুলো ছিল পুরো মিথ্যে, জোর করে হাসা। আর সেটা ওরা চালিয়েই যাচ্ছিল সমানে।

শেষমেশ আমাদের টেবিলে বসা লোকজনকে আমি বললাম, ‘ব্যাপারটা কুৎসিত, তাই না?’

আমাদের টেবিলে বসা একজন আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ‘আমার ভালো লাগে যখন মানুষ আনন্দে থাকে।’

আমি উত্তর দিইনি। কিন্তু টের পেলাম একটা কালো গর্ত আমার নাড়িভুড়ির ভেতর পাকিয়ে উঠছে। যাক গাঁড় মারা।

ফ্রিওয়েতে আপনি মানুষকে পড়তে পারবেন, বুঝতে পারবেন তাকে। ডিনারের টেবিলেও বুঝতে পারবেন লোকজনকে। টিভিতে পড়তে পারবেন মানুষকে। সুপারমার্কেটে টের পাবেন, বুঝতে পারবেন তাদের ইত্যাদি ইত্যাদি। সমস্তটাই একই পাঠ। আপনি কী করতে পারেন? মাথা বাঁচিয়ে জাস্ট টিকে থাকা। আরেক পাত্তর ঢালা। আমারও ভালো লাগে যখন মানুষ খুশি থাকে। যদিও আমি খুব বেশি লোককে দেখিনি এমন।  

তো আজ আমি ঘোড়দৌড়ের মাঠে এসেছি বসেছি একটা সিটে। পেছনে একটা লোক দেখি লাল টুপি পরে আছে। ওই যে সব টুপি মাঠে ফ্রিতে দেওয়া হয়ে থাকে। ফ্রিতে দেওয়ার দিন। ওর ছিল একটা রেসিং ফর্ম আর একটা মাউথ অর্গান। ও মাউথ অর্গানটা নিয়ে ফুঁ দিল। কীভাবে বাজাতে হয় ও জানত না। ও শুধু ফুঁ মারল ওটাতে। আর সেটা স্কোয়েনবার্গের ১২ নম্বর স্কেলও ছিল না। ছিল ২ বা ৩ টোনের স্কেল। ওর দম ফুরিয়ে গেল আর তুলে নিল রেসিং ফর্মটা।

আমার সামনে বসে ছি্ল সেই ৩টি লোক যারা পুরো সপ্তাহটাই সেখানে বসে ছিল। একটা লোক যার বয়স ৬০ মতো হবে যে সব সময় পরে থাকে বাদামি পোশাক আর বাদামি একটা টুপি। তার পাশে বসে আছে আরেকজন বৃদ্ধ, ৬৫-র কাছাকাছি বয়স, চুল সব সাদা, বরফের মতো সাদা আর বাঁকা গলা আর গোলচে কাঁধ। তার পাশে একজন এশিয়ান ৪৫ মতো বয়স হবে যে সমানে সিগারেট খেয়ে চলেছিল। প্রতিটা রেসের আগে তারা আলোচনা করছিল কোন ঘোড়ার উপর তারা বাজি ধরবে। এরা অদ্ভুত জুয়াড়ি, অনেকটা সেই পাগলাটে চেল্লারাজের মতো যার কথা আমি আগে বলেছি। আমি বলছি আপনাদের, এরকম আমার কেন মনে হল। আমি ওদের পিছনে বসে আছি গত দু সপ্তাহ ধরে। আর ওদের কেউই এখনও একটাও ঘোড়া বাছতে পারেনি যেটা জিতবে। মানে প্রায় ১৩৫টা বাজি ধরেও একবারও জিততে পারেনি তারা। এটা সত্যি একটা অবাক করা পরিসংখ্যান। ভাবুন এটা নিয়ে। ধরুন ওরা যদি প্রত্যেকে বাছত ১ বা ২ বা ৩ আর সেটাতেই আঁটকে থাকত ওরা খুব সাধারণ ভাবেই একটা জেতার ঘোড়া বেছে ফেলত। কিন্তু এদিক ওদিক লাফিয়ে ওরা মগজের সমস্ত শক্তি আর তথ্য খাটিয়েও সেটা করতে পারল না। ওরা কেন ফিরে আসে বারবার ঘোড়দৌড়ের মাঠে? নিজেদের বোকামির জন্য ওদের কি একটুও লজ্জা করে না। না, কারণ সবসময় আছে আরেকটা দৌড়। কোনও একদিন ওরা মেরে দেবে, জিতবে বিরাটভাবে।

আপনি তাহলে বুঝতে পারছেন কেন আমি যখন ঘোড়দৌড়ের মাঠ থেকে ফ্রিওয়ে ধরে ফিরে আসি? এই কম্পিউটারটাকে কেন এত ভালো লাগে আমার? একটা পরিষ্কার স্ক্রিন যার উপর সাজানো যায় শব্দদের। আমার বৌ আর আমার ৯টা বিড়াল এই পৃথিবীর জিনিয়াসদের পছন্দ করে মনে হয়।

২/৮/৯২
রাত ১-১৬

লেখকরা কী করে যখন তারা লিখছে না? আমি রেসের মাঠে যাই। বা আগে উপোষ দিতাম বা শরীর নিংড়ানো কাজ সব করতাম।

এখন আমি লেখকদের থেকে দূরে থাকি — বা যারা নিজেদের লেখক বলে তাদের কাছ থেকে। কিন্তু ১৯৭০ থেকে প্রায় ১৯৭৫ অবধি যখন আমি ভাবলাম এক জায়গায় বসে লিখব বা মরব, লেখকেরা আসতে শুরু করল, তারা সবাই কবি। কবি। আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমি আবিষ্কার করলাম, কারওই দৃশ্যত কোনও ভরণপোষণের ব্যবস্থা ছিল না। কারও যদি বই প্রকাশিত হয়ে থাকে তার বিক্রি ছিল না। যদি তারা কবিতা পাঠের আসরে যায় খুব কম মানুষই সে আসরে যেত, মানে ৪ থেকে জনা ১৪ আরও অন্য সব কবি। কিন্তু এরা সবাই থাকে সুন্দর সব অ্যার্পাটমেন্টে আর আমার কোচে বসে থাকার অফুরন্ত সময়, আর আমার বিয়ার টানার আয়েস। শহরে আমার নাম হয়েছে পাগলা-চোদা বলে, আমার বাড়িতে এমন সব পার্টি হয় যেখানে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে আর পাগল রমণীরা নাচে আর জিনিসপত্র ভাঙে, বা আমি আমার উঠোন থেকে তাড়াই লোকজন বা পুলিশ রেড করে বা ইত্যাদি আর ইত্যাদি। এটার অনেকটাই সত্যি। কিন্তু আমার প্রকাশক আর ম্যাগাজিনগুলোর জন্য তো আমাকে কাগজের পাতায় নামাতে হবে এই পৃথিবীটাকে যাতে আমি আমার বাড়ি ভাড়া আর মদের পয়সা জোটাতে পারি, আর তার মানে হল আমাকে গদ্য লিখতে হবে। কিন্তু এই…কবির দল…শুধু কবিতা লেখে…আমার মনে হয় এগুলো খুব হালকা চালে লেখা আর এক ধরনের ভান ছাড়া কিছু নয়… কিন্তু ওরা ওটাতেই মশগুল, বেশ ভালোই সাজুগুজু করে আছে, দেখে মনে হয় ভালোই খেতে পায় আর ওদের আছে কোচে বসে থাকার অফুরন্ত সময় আর কথা বলার সময় — নিজেদের কবিতা নিয়ে আর নিজেদের ব্যাপার নিয়ে। আমি মাঝেমাঝেই জিজ্ঞাসা করতাম, ‘শোনো, আমাকে বলো, কীভাবে তোমার চলে?’ ওরা জাস্ট ওখানে বসে হাসত আমার দিকে চেয়ে আর আমার বিয়ার টানত আর অপেক্ষা করত আমার সেইসব পাগল রমণীর জন্য, আশা করত তারা হয়ত জোটাতে পারবে কিছু — যৌনতা, মুগদ্ধতা, একটা উত্তেজনাপূর্ণ অভিজ্ঞতা বা যা কিছু।

এটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল যে এইসব পচা মালগুলোকে আমায় হটাতে হবে। আর ধীরে ধীরে আমি ওদের রহস্য এক এক করে বার করে ফেললাম। বেশিরভাগ সময়ে তাদের পেছনে, আড়ালে খুব ভালোভাবে লুকোনো আছে তাদের মা। মায়েরা এইসব জিনিয়াসদের দেখাশোনা করে থাকেন। বাড়ি ভাড়া, খাবার, জামাকাপড় জোটান।

মনে পড়ছে একবার, আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেই একদিনের জন্য থাকার দুর্লভ মুহূর্ত, আমি বসে আছি এক কবির অ্যার্পাটমেন্টে। ব্যাপারটা বেশ বোকা বোকা, কোনও মদটদ নেই। সে বসে বসে বকছে যে কী অন্যায় যে তাকে সবাই চেনে না। সম্পাদকেরা, সব্বাই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আমার দিকে আঙুল তোলে সে, ‘তুমিও, তুমি মার্টিনকে বলেছ আমার বই না ছাপতে।’ সেটা সত্যি নয় একটুও। তারপর সে শুরু করল পরনিন্দা পরচর্চা আর বড়বড় করে চলল অন্যান্য ব্যাপার নিয়ে। ঠিক তখন ফোনটা বাজল। সে ফোনটা তুলে আস্তে আস্তে ধীরে ধীরে কথা বলে চলল। সে ফোনটা নামিয়ে ফিরল আমার দিকে।

‘আমার মা, আসছে আমার বাড়িতে। তোমাকে এখন যেতে হবে।’

‘বেশ ঠিক আছে। তোমার মায়ের সাথে দেখা হলে আমার ভালোই লাগবে।’

‘না! না! মা সাঙ্ঘাতিক। তোমাকে যেতে হবে! এখনই! তাড়তাড়ি করো!’

আমি লিফটে চড়ে নীচে নেমে বেরিয়ে এলাম। আর ওকে জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিলাম।

আরও একজন ছিল। তার মা তার খাবার কিনে দিত, ওর গাড়ি, ওর ইনস্যুরেন্স, ওর বাড়িভাড়া এমনকি ওর কিছু লেখালিখিতেও সাহায্য করত। ভাবা যায় না। আর সেটা চলেছিল দশকের পর দশক।

আরেকটা লোক ছিল, ওকে সব সময় খুব শান্ত দেখাত, ভালো খায়দায় মনে হত। প্রতি রবিবার বিকেলে সে একটা চার্চের কবিতার ওয়ার্কশপে পড়াত। ওর একটা দারুণ অ্যার্পাটমেন্ট ছিল। ও ছিল কম্যুনিস্ট পার্টির মেম্বার। ধরা যাক তার নাম ছিল ফ্রেড। আমি একজন বয়স্ক মহিলা যে ওর ওয়ার্কশপে যেত তাকে প্রশ্ন করেছিলাম আর ওর খুব প্রশংসা করেছিলাম। ‘শুনুন, ফ্রেডের চলে কী করে?’ ‘ওহ’, তিনি বলেছিলেন, ‘ফ্রেড চায় না কেউ জানুক কারণ সে গোপন রাখতে চায় এসব কিন্তু সে পয়সা রোজগার করে খাবার ট্রাক বুরুশ দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে।’

‘খাবার ট্রাক?’

‘হ্যাঁ, ওই খাবার গাড়িগুলো যেগুলো অফিসপাড়ায় কফি আর স্যান্ডউইচ দিয়ে বেড়ায় ব্রেকের সময়, দুপুরের খাওয়ার সময়, ফ্রেড ওই গাড়িগুলো পরিষ্কার করে।’

এর কিছু বছ পরে জানা গেল যে ফ্রেডের আরও কয়েকটা অ্যার্পাটমেন্ট আছে আর সে সেগুলো ভাড়া খাটিয়ে দিনগুজরান করে। আমি এটা জানার পর এক রাতে মাতাল হয়ে ধাওয়া দিলাম ফ্রেডের বাড়িতে, সেটা ছিল একটা ছোট থিয়েটারের উপর। খুব আর্টিস্টিক ব্যাপারস্যাপার। আমি গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে বেল বাজালাম। ও সাড়া দিল না। আমি জানতাম ও উপরে আছে। পর্দার আড়ালে ওর ছায়ার নড়াচড়া আমি দেখেছি। আমি গাড়িতে ফিরে গিয়ে তেড়ে হর্ন বাজাতে শুরু করলাম আর চেঁচাতে লাগলাম। ‘এই ফ্রেড, বাইরে বেরিয়ে এসো!’ একটা জানালা তাক করে ছুঁড়ে মারলাম একটা বিয়ারের বোতল। সেটা ধাক্কা লেগে ফিরে এল। ও ঘাবড়ে গেল। ও বেরিয়ে এল ওর ছোট বারান্দাটায় আর আমাকে বলল। ‘বুকাওস্কি কেটে পড়।’

‘ফ্রেড, সোজা নীচে নেমে এসো আর তোমার গাঁড়ে আমি লাথি মারব, শালা কম্যুনিস্ট জমির মালিক।’

ও ছুটে ভেতরে গেল। আমি ওখানে দাঁড়িয়ে রইলাম ওর অপেক্ষাতে। তারপর মাথায় এল ব্যাটা নির্ঘাত পুলিশকে ফোন করছে। এদের তো চিনি আমি। আমি গাড়িতে উঠে বাড়ি ফিরে এলাম।

আরেক কবি নদীর পাশে থাকত একটা বাড়িতে। সুন্দর বাড়ি। তার কোনওদিনই কোনও চাকরি ছিল না। আমি তার পিছনে পড়ে গেলাম। ‘কী করে তোমার চলে? কী করে তোমার চলে?’ শেষে সে বলে ফেলল। ‘আমার বাবা-মা’র প্রপার্টি আছে আর আমি ওদের ভাড়াটা তুলে দি। আর ওরা আমাকে মাইনে দেয়।’ ও খুব ভালোই মাইনে পেত, আমার তাই মনে হয়। যাকগে, তবু তো ও স্বীকার করল।

কেউ কেউ কিছু বলতে চায় না। সেই একজন ছিল যে কবিতাটা খুব খারাপ লিখত না। কিন্তু লিখত বড় কম। ওর ওই সুন্দর অ্যার্পাটমেন্টটা ওর ছিল সবসময়। বা হাওয়াই চলে যাচ্ছে বা অন্য কোথাও। সবার মধ্যে ও ছিল সব থেকে নিরুদ্বেগ। সবসময় নতুন জামাকাপড় পরত সুন্দর করে ইস্ত্রি করা, নতুন জুতো। দাড়ি কাটা বা চুল কাটার দরকার নেই, ঝকঝকে দাঁত। ‘মাইরি বলো না, কী করে চালাচ্ছ তুমি?’ ও কখনওই জানতে দিত না। ও হাসতও না স্রেফ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত।

আরেক ধরনের লোক আছে যারা ভিক্ষার টাকায় বেঁচে থাকে। আমি ওদের একজনকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলাম কিন্তু সেটা আর পাঠাইনি কোথাও কারণ বেচারার জন্য খারাপ লেগেছিল আমার। এখানে তার কিছুটা একসাথে জড়িয়েমড়িয়ে।

জ্যাক আর তার ঝুলে আসা চুল, জ্যাক দাবি করছে টাকা, ভুঁড়িওয়ালা জ্যাক। জ্যাক তার তীব্র গলার জোর নিয়ে, লেখার লাইনের লোক জ্যাক, জ্যাক মেয়েদের সামনে উল্লাসে লাফায়, জ্যাক যে নিজেকে জিনিয়াস ভাবে, জ্যাক যে বমি করে ভাসায়, জ্যাক যে ভাগ্যবানদের খিস্তি করে, জ্যাক ক্রমাগত বুড়োচ্ছে আরও, জ্যাক এখনও টাকার দাবি করে, জ্যাক নেমে আসছে বিনস্টক বেয়ে, জ্যাক যে তা নিয়ে কথা বলে কিন্তু করে না তা কখনও, জ্যাক যে খুন করে বেঁচে যায়, জ্যাক যে হাত মারে, জ্যাক পুরনো দিনের কথা বলে, জ্যাক বকে চলে সমানে, ভিক্ষার টাকা নিয়ে জ্যাক, জ্যাক দুর্বলকে ভয় দেখায়, জ্যাক তিক্তবিরক্ত করে তোলে, কফি ঘরের জ্যাক, জ্যাক চেঁচাচ্ছে স্বীকৃতির জন্য, জ্যাক যার কখনও কোনও চাকরি ছিল না, জ্যাক নিজের ক্ষমতাকে অত্যধিক মূল্য দেয়, জ্যাক সমানে চেঁচিয়ে চলেছে তার অস্বীকৃত প্রতিভার জন্য, জ্যাক যে সবাইকে দোষ দেয়।

আপনি জানেন জ্যাক কে, গতকালই তার সাথে আপনার দেখা হয়েছিল, আবার আগামীকাল তার সাথে দেখা হবে, পরের সপ্তাহে দেখা হবে আবার আপনার সাথে।

কিছু না করেই সে চাইছে কিছু হোক, সে চাইছে ফ্রিতে।

চাইছে খ্যাতি, চাইছে নারী, চাইছে সব কিছু।

জ্যাকে ভর্তি একটা পৃথিবী সড়সড় করে নেমে আসছে বিনস্টক বেয়ে।

এখন আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি এই কবিদের ব্যাপারে লিখতে লিখতে। কিন্তু এটা বলা দরকার যে কবি হিসেবে বেঁচে থেকে তারা নিজেদের ক্ষতি করছে। বরং তারা অন্য কিছু করে দেখলে পারত। আমি একজন সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছি ৫০ বছর বয়স অবধি। মানুষের সাথে জড়িয়ে থেকেছি। কখনও নিজেকে কবি বলে দাবি করিনি। অবশ্য আমি এটা বলতে চাইছি না যে বেঁচে থাকার জন্য কাজ করা একটা দারুণ ব্যাপার। বেশিরভাগ সময়ই তা ভয়ঙ্কর ব্যাপার। আর অনেক সময়ই এই ভয়ঙ্কর কাজটাকে টিকিয়ে রাখতে লড়াই করতে হয় কারণ আপনার পিছনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ২৫টা লোক এই কাজটার জন্য। অবশ্যই সেটা অর্থহীন, অবশ্যই সেটা আপনাকে চিড়েচ্যাপটা করে দেয়। কিন্তু এই বিচ্ছিরি অবস্থায় থাকাটা, আমার মনে হয়, আমায় শিখিয়েছে লেখালিখির সময় ওইসব বালের কথাবার্তা বাদ দিতে। আমার মনে হয় মাঝে মাঝে নিজের মুখটা কাদায় রগড়ে আসা উচিত। আমার মনে হয় আপনার জানা উচিত জেল কী, হাসপাতাল কী। ৪ বা ৫ দিন না খেয়ে থাকলে কেমন লাগে সেটা মনে হয় জানা উচিত আপনার। একটা পাগল মেয়ের সাথে থাকা আপনার শিরদাঁড়ার জন্য উত্তম। আমার মনে হয় আপনি লিখতে পারবেন আনন্দে আর নিষ্কৃতিতে এই অনাচারে থাকার পর। আমি এটা বলছি কারণ যে সমস্ত কবিদের সাথে আমার আলাপ হয়েছে তারা সবাই জেলিফিশের মতো নরম, পরগাছা। ওদের কিছুই লেখার নেই একমাত্র স্বার্থপর না-টিকতে পারার কথা ছাড়া।

হ্যাঁ, আমি কবিদের থেকে দূরে থাকি। আমাকে কী দোষ দেবেন আপনারা?

আবার আগামী সংখ্যায়