Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

একজন মহান(!) পুস্তক তস্কর এবং সমসাময়িক ভাবনার জট

নাহার তৃণা

 

‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’ বলে একটা প্রবাদ চালু আছে বাংলায়। অর্থাৎ, এ পৃথিবী বীরদের কুর্নিশ জানায়। সে বীরত্ব হতে পারে যুদ্ধের ময়দানে, হতে পারে জীবন বাজি রেখে অন্যের জীবন বাঁচাবার মতো কোনও মহত্ত্বে। কিংবা চরমতম দুঃসাহসিক কোনও অভিযানে পা বাড়ানোয়। এর বাইরে বাঁকা পথে নিজের সাহস ব্যবহার করে পৃথিবীকে ঘোল খাইয়ে নিজের স্বার্থ হাসিলের বিষয়টা ঠিক বীরত্বের পর্যায়ে না গেলেও, সময়ে কিছু মানুষ ছলে বলে এবং কৌশলে কেমন বাহবা কুড়িয়ে নিতে জানেন। আর তিনি যদি একই সাথে ক্ষমতাবান এবং জ্ঞানতাপস জাতীয় কেউ হন, তবে তাকে ‘কেষ্ট ব্যাটা’র মতো সপাটে চোর সাব্যস্তে আমাদের কেমন জানি বাধো বাধো ঠেকে। নানান অজুহাত দাঁড় করিয়ে তাকে চোর হবার হাত থেকে রক্ষার জন্য আমাদের, বিশেষ করে তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের মন কেমন জলীয় হয়ে ওঠে। একই কাজ কোনও রাম কিংবা রহিমের দ্বারা সংঘটিত হলে তাকে তুলোধুনো করবার লোকের খুব একটা অভাব পড়ত না। অথচ বর্তমান আলোচনার ব্যক্তিটি ‘চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা’র মতো কার্যটি সমাধানপূর্বক দিব্যি পায়ের উপর পা তুলে চমকদার একটা জীবন কাটিয়ে, সময়মতো যমের ডাকটি শুনে টুপ করে পরপারে চম্পট দিয়েছেন। জীবিত অবস্হায় কেউ তার টিকিটিও স্পর্শ করতে পারেনি। বোঝাই যাচ্ছে, ধরা না পড়বার শিল্পিত কৌশলটি তিনি বড়ই পারঙ্গমতার সাথে আয়ত্ত করেছিলেন।

ঠিক কার সম্পর্কে বলবার জন্য এতটা গৌরচন্দ্রিকা টানা হচ্ছে সেটি জানবার জন্য পাঠকের কৌতূহলের মাত্রা চড়চড় করে যে এতক্ষণে মগডালে উঠে বসেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। যাকে নিয়ে এই দীর্ঘ ভণিতা তার কৃতকর্মের বিবরণ জানিয়ে বরং পাঠকের কৌতূহল নিবৃত্ত করা যাক।

যে তস্কর জ্ঞানতাপসের কথা এখন বলব তার পরিচয়টি বেশ অম্লমধুর এবং তিনি বেশ প্রাচীন মানুষ, অথচ বর্তমানেও রয়েছে তার উপস্হিতি। সেটা কীভাবে? আসুন একটু খোঁজ নেয়া যাক….

২০১৩ সালে নিউইর্য়কের এক প্রাচীন বইপ্রেমী সংগঠন Grolier Club অদ্ভুত একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। এই প্রদর্শনীর আয়োজনটি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে খ্যাতিমান চোরের চুরি করা কিছু দুর্লভ বইপত্র নিয়ে। গ্রোলিয়ার ক্লাব তাদের ক্যাটালগে চোরের পরিচয় দিয়েছে এভাবে ‘Mathematician, Journalist, Patriot, Historian of Science, Paleographer, Book Collector, Bibliographer, Antiquarian Bookseller, Forger and Book Thief.’

একসাথে এতগুলো গুণ নিয়ে মানব ইতিহাসে খুব কম মানুষই জন্মেছেন। আলোচ্য এই গুণধর ব্যক্তির নাম গুগলিয়্যালমো লিব্রি (Guglielmo Libri)। জন্মেছিলেন ইতালির ফ্লোরেন্সের এক সম্ভ্রান্ত কাউন্ট পরিবারে ১৮০৩ সালে। মজার ব্যাপার হল তার ডাক নাম ‘Libri’ শব্দের অর্থ হল পুস্তক বা বই। সেকারণেই কিনা জানা নেই, বইয়ের প্রতি ছিল তার তীব্র আকর্ষণ। বিশেষত দুর্লভ বইসমূহের প্রতি। বাল্যকালে লিব্রির চৌর্যবৃত্তির অভ্যেস ছিল কিনা জানা যায় না, তবে ১২ বছর বয়স থেকে দুর্লভ জিনিসপত্র সংগ্রহের নেশা ছিল বলে জীবনী থেকে জানা যায়। সেই বয়সে, তার সে নেশার ক্ষিদে কতটা সোজা পথে মিটেছিল সেটি জানা না গেলেও, তার মহিমান্বিত স্বভাবের কারণে মনে কেমন একটা বিষের কাঁটা বিঁধে থাকে যেন।

গুগলিয়্যালমো লিব্রি

লিব্রি ১৮২০ সালে ইতালির পিসা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে পাশ করার পর ১৮২৩ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে পিসা বিশ্ববিদ্যালয়েরই গাণিতিক পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হয়েছিলেন। কিন্তু ১৮৩০ দশকের শুরুতে রাজনৈতিক কারণে স্বদেশ ছেড়ে ফ্রান্সে পালিয়ে যেতে হয় তাকে। তবে ফ্রান্সে গিয়েও সমস্যা হয়নি তার। যেহেতু তার বগলদাবা ছিল চমকদার জ্ঞানের সার্টিফিকেট, যে কারণে ফান্সের গুণীজনেরা তার সমাদরে কার্পণ্য দেখাননি প্রাথমিক পর্যায়ে। আর সেজন্যই মাত্র তিন বছরের মাথায় ফরাসি নাগরিকত্বটিও তার হস্তগত হয় অনায়াসেই। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ হিসেবে ফ্রান্সেও বিশেষ সম্মান ও উন্নতি লাভ করতে থাকেন। ফ্রান্সে অবস্থানকালে তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিকর্ম হল ১৮৩৮-৪১ সালের মধ্যে চার খণ্ডে প্রকাশিত ‘History of the Mathematical Sciences in Italy from the Renaissance of literature to the 17th Century.’ এই কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন লাইব্রেরি থেকে তাকে প্রচুর বইপত্র, প্রাচীন দলিল দস্তাবেজ সংগ্রহ করতে হয়েছিল যার মধ্যে গ্যালিলিও বা দেকার্তের মতো বিখ্যাত মানুষদের দলিলপত্রও ছিল। এসব তথ্যাদির পরিণতি শেষমেশ শেয়ালের কাছে মুর্গি বর্গা দেবার গল্পের মতোই হয়েছিল, সেটি বলাই বাহুল্য।

সময়মতো লিব্রি তার স্হানীয় ক্ষমতাশালী বন্ধুদের সহায়তায় লাইব্রেরিসমূহের শীর্ষ পরিদর্শকের পদটি পেয়ে যান, যা তার জন্য ঐতিহাসিক চৌর্যবৃত্তির মহাদুয়ার খুলে দেয়। আর সে পদাধিকারে তিনি ‘ওলট পালট করে দে মা লুটে পুটে খাই’-এর সবটা সুযোগ সুচারুভাবে কাজে লাগান। নিজের পদমর্যাদার সম্মানকে কাজে লাগিয়ে তিনি দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন লাইব্রেরি থেকে দুর্লভ সব বইপত্র সরাতে শুরু করেন। আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও বাঘা একবারটির জন্যেও ‘কত নিলে শুনি!’ গেয়ে ওঠবার সাহস পায়নি। অভিনবভাবে তিনি তার বিশাল আলখেল্লার নিচে মূল্যবান পুস্তক, দলিল ইত্যাদি বগলদাবা করে নিয়ে যেতেন, যে কারণে তার এহেন কার্যপ্রণালীর কোনও চাক্ষুষ সাক্ষীও ছিল না। তাছাড়া লাইব্রেরিসমূহের ব্যবস্থাপনা এবং ক্যাটালগিং তখন খুব অনুন্নত ছিল। কেউ কেউ দু একবার সন্দেহ করলেও পদমর্যাদার সৌজন্য হেতু লিব্রিকে চ্যালেঞ্জ করবার মতো সাহস সন্দেহকারীদের পক্ষে দেখানো সম্ভব হয়নি। তবে চোরাই বাজারে তার কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী সৃষ্টি হয়েছিল, লিব্রির কারণে যাদের ব্যবসার পেটে লাথি পড়বার আশঙ্কা তৈরি হয়। নিজেদের স্বার্থরক্ষার তাগিদে তারাই স্বপ্রণোদিত হয়ে কর্তৃপক্ষকে যথেষ্ট প্রমাণাদি সরবরাহ করে লিব্রির বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য।

ততদিনে চুরিতে সিদ্ধহস্ত এবং পরিস্হিতি বুঝে নিতে বিচক্ষণ লিব্রি বিপদ টের পেয়ে গেলে ফ্রান্স থেকে ‘ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান’ সিনেমার নায়কের মতোই খানিকটা নাটকীয়ভাবে সটকে ইংল্যান্ডে চলে যান এবং যাবার আগেই ১৮টি ট্রাঙ্কে করে ৩০ হাজার বইপত্র পাঠিয়ে দেন। তার অনুপস্থিতিতে মামলায় ১০ বছরের সাজা হলেও ইংল্যান্ডে অবস্হানের কারণে তাকে একদিনও জেলের ভাত খেতে হয়নি। অতঃপর লিব্রি নামের এই চোরের রাজার হস্ত করে সমস্ত সাত রাজার ধন চুরির বইপত্র দলিল-দস্তাবেজ বিক্রির টাকায় রীতিমতো মিলিওনিয়ার হয়ে শেষ জীবনটা ইতালির থাসকিনে (Tuscany) কাটিয়ে ১৮৬৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।

তার চুরি করা দুর্লভ সামগ্রীর মধ্যে ছিল ফরাসী দার্শনিক রেনে দেকার্তের (René Descartes) ৭২ খানা চিঠি। এইসব চুরিকৃত বইপত্র বিক্রি হবার পর সারা পৃথিবীতে এত বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে গেছে যে গত দেড়শো বছর ধরে তা উদ্ধার করেও শেষ হয়নি। গ্রোলিয়ার ক্লাবের হিসেব মতো তার চুরি করা সামগ্রীর বর্তমান মূল্য বিলিয়ন ডলারের বেশি হবে। লিব্রি কর্তৃক হাতানো সপ্তদশ শতকে লেখা রেনে দেকার্তের ৭২টি চিঠির ১টি সম্প্রতি Haverford College in Haverford, Pennsylvania ফেরত দিয়েছে Institut de France-কে। কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ Institut de France পনেরো হাজার ইউরো পুরস্কার দিয়েছে হেভারফোর্ডকে।

ক্যালিফোর্নিয়ার এক ইতিহাসবিদ এবং বইবিক্রেতা জেরেমি নরম্যান বলেন, “এটা খুব আশ্চর্যের নয় কি এই নিকৃষ্ট চৌর্যবৃত্তি সত্ত্বেও পৃথিবীর কিছু অংশে তার সুনাম এখনও অক্ষুণ্ণ আছে?” তিনি ইঙ্গিত করছিলেন গ্রোলিয়ার ক্লাবের আয়োজন ও আমেরিকায় লিব্রি’র সমর্থকগোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের দিকে।

তা সত্ত্বেও জীবনীকার খানিকটা অপরাগ হয়েই যেন শেষপাতে তার সম্পর্কে অম্লমধুর বৃত্তান্ত পরিবেশন করেন:

“Shameful as his exploits were, knowledge of the fact that the ‘Affaire Libri’ contributed to the improvement of the state of libraries in France and throughout the world, would have given some comfort to the ashes of Guglielmo Libri, who had known full well that, when all is said and done, he had indeed been a thief.”

***

লিব্রি নামের মহান(!) তস্করের জন্মের বত্রিশ বছর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের ছোট্ট শহর ফ্লোরিডায় ১৮৩৫ সালে স্যামুয়েল ল্যাঙ্গহোর্ন ক্লিমেন্স (Samuel Langhorne Clemens) নামে এক ব্যক্তির জন্ম হয়।

কালে দিনে তিনিও জগত মাঝে বিখ্যাত হিসেবে নিজের নামটি স্বর্ণাক্ষরে লিখে যেতে সক্ষম হন। যা ভাবছেন, একদমই তা নয় পাঠক। লিব্রির মতো নিজের সমস্ত অর্জনের মুখে চৌর্যবৃত্তির কালি লেপে তিনি মোটেও বিখ্যাত হননি। তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন তাঁর কলমের জোরে, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিভার কারণে। একাধারে লেখক, রম্যরচয়িতা, উদ্যোক্তা, প্রাজ্ঞ বক্তা, এই মানুষটি তাঁর পৈতৃক নামে ততখানি পরিচিত হয়ত নন। যেকারণে অনেক পাঠকই ‘ইনি আবার কে রে বাবা’ জাতীয় প্রশ্নে আক্রমণ করতে পারেন। তাঁর সম্পর্কে ছোট্ট একটি ক্লু হচ্ছে, ‘মিসিসিপি’ নদীটি এই মানুষটির নামের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। সে ছদ্মনামটি বলামাত্রই ‘তুমি আমার কত চেনা’ বলে সব বয়সী অনেক পাঠক লাফিয়ে উঠবেন বলাই বাহুল্য। জ্বী, ঠিক ধরেছেন, তাঁর নাম মার্ক টোয়েইন (Mark Twain)।

কিন্তু লিব্রির সাথে মার্ক টোয়েইনের সম্পর্ক কী! নাহ্, সেভাবে সম্পর্ক নেই, আবার যেন আছেও। কী গোলকধাঁধা! কীভাবে? মার্ক টোয়েইনের জন্মের প্রায় ৩৪ বছর পর লিব্রি এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। মার্ক টোয়েইনের পক্ষে কোনওভাবে লিব্রির বইচুরির কাহিনি জানা সম্ভব হয়েছিল কিনা, সে ইতিহাস আমার জানা নেই। খুব সম্ভবত তিনি লিব্রি সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন না। প্রায় ৩৪ বছর একই পৃথিবীর আলো হাওয়া ভাগাভাগির ছোঁয়াচের কারণে মার্ক টোয়েইন নামের প্রাজ্ঞ মানুষটিও বই গপাংয়ের ব্যাপারে দুর্বল ছিলেন, অন্যের বই পড়তে নিয়ে ফেরত না দেয়া বা নিজের করে নেয়াকে ঠিক অপরাধ মনে করতেন না, এমনটা ভাবলে তা বেশ হাস্যকর এবং অযৌক্তিক হবে। কিন্তু যেভাবেই বলি না কেন, মার্ক টোয়েইনও অন্যের বই বগলদাবায় আক্রান্ত ছিলেন। যদিও লিব্রির চুরির ধরনধারণের সাথে তাঁর ধরনের কোনও মিলই ছিল না। অন্যের জিনিস না বলে নেয়া, বা অনুমতি ছাড়া নিজের ভেবে নেয়া অন্যায় বলেই তো বিবেচনার কথা। কিন্তু ওই যে বললাম, ক্ষেত্রবিশেষে আমরা এ বিষয়ে ছাড় দেবার পক্ষেই। সে কারণে আমাদের পাঠ্যবইতে মার্ক টোয়েইনের এই বই মারিংয়ের কাহিনি আহ্লাদ করেই লেখা হয়েছিল। সেই আহ্লাদে ভেসে গিয়ে আমরা অনেকেই মার্ক টোয়েইনের বাকি সব প্রতিভা ‘দেখতে আমি পাইনি’ বিবেচনা করে কেবল মাত্র বই গপাংয়ের প্রতিভা বগলদাবা করেছি। কতশত কায়দায় মার্ক টোয়েইনের যোগ্য চর হবার আরাধনায় বন্ধু থেকে শুরু করে লাইব্রেরি, দোকান, ইত্যাদি থেকে বই গপাং বা চুরিতে লিপ্ত হয়েছি। তৃপ্ত হয়েছি। ভাগ্যিস ব্রাত্যজনের কাহিনি ইতিহাসে ঠাঁই পায় না! নইলে পৃথিবী জুড়ে ঘটে যাওয়া শত শত বই গপাংয়ের কাহিনির দৈর্ঘ্য চীনের প্রাচীরকে ভেংচি কাটত।

তস্করতা বা চৌর্যবৃত্তিকে ঘৃণ্য অপরাধমূলক কাজ হিসেবে সাব্যস্ত করা হলেও, পুস্তক বা বই চুরির ক্ষেত্রে কেমন একটু আহ্লাদজনিত উদাসীন মানসিকতা কাজ করে আমাদের। সামান্য একটুকরো রুটি চুরির অপরাধে অভুক্ত ছোট্ট শিশুকে ছাড় দেবার নজির না থাকলেও বইচোর মানুষটির পিঠে বাহবার চাপড় দিতে আমরা বেশ অকৃপণ। যে কারণে আমরা অনেকেই বলতে ভালোবাসি, বইচুরিতে কোনও কালিমা নেই। উহ্য বাক্যের আড়ালে সময়ে সময়ে সূর্য অল্পস্বল্প হাসিও দেয় বটে। এ ধরনের চুরির অমঙ্গলকে তাই আমরা ‘হাসিয়া উড়াইয়া’ দেই। মঙ্গল থিতু হয়ে বসে। মুখ ভর্তি হাসির ছবিসহ পত্রিকার পাতায় বই গপাংকারী চিলির বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক রবের্তো বোলাইয়োঁ (Roberto Bolaño)-র বইচুরির সপ্রশংস কাহিনি ছাপা হয়। আমরা জানতে পারি, চুরি করা বইগুলোই রবের্তোর জীবনের শ্রেষ্ঠ বই।

ভাবুন তো একবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ঘানা ভ্রমণের স্মৃতিকথায় বর্ণিত হাউসকিপার বইপ্রেমিক ছেলেটির কথা! লেখক যদি তাঁর হোটেল রুমের চাবি খুলে হাউসকিপার ছেলেটিকে অর্ধেক পড়ে রাখা বইটি সহ না দেখে অন্য কোনও জিনিস সমেত দেখতে পেতেন, তখন তার সাথে ঘটিত ব্যবহারের চেহারা কতটা বদলে যেতে পারত? হাউসকিপার ছেলেটির বইপ্রেমের বিষয়টি নিশ্চিত লেখককে আপ্লুত করেছিল। নইলে পরে তিনি বইখানা পড়া শেষ করে, এবার চাইলে বইটি সে নিতে পারে বলে তাকে সাধতে যেতেন না।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, বইচুরিকে সময় বিশেষে আহ্লাদ করে চুরি বলতে না চাইলেও কাগুজে বইয়ের চেহারা যখন ই বুকে (ইলেক্ট্রনিক বুক) বদলে যায় তখন তার বিশেষণও অনেক সময় কেমন বদলে যেতে দেখি। বিনে পয়সায় ই বুক সংগ্রহকারীদের কেউ যখন নিজেই লেখক বা প্রকাশক হয়ে ওঠেন, তখন তারা কপিরাইট আইন ইত্যাদি নিয়ে অতি সচেতন হয়ে ওঠেন। আর সে কারণে ই বুক সংগ্রাহকরা তাদের কাছে বইচোর সাব্যস্ত হয়ে পড়েন। ব্যক্তিগতভাবে সেরকম কপিরাইট সচেতন একাধিক মানুষকে দেখেছি, তাদের প্রয়োজনের সময় কপিরাইট আইন ভুলে, তাদের কথিত চোরাই বইয়ের ফেসবুক গ্রুপে গিয়ে ‘ই বুক চাহিয়া আবেদন’ করছেন। কী স্ববিরোধিতা! মানুষমাত্রই স্ববিরোধী তো বটেই। নইলে সেই একই মানুষ অতটা নির্দ্বিধায় ইউটিউব খুলে সোনামুখ করে পটাপট পাইরেটেড মুভি দেখেন, গান শোনেন, কীভাবে! সময়বিশেষে কেমন দিব্যি পথে কুড়িয়ে পাওয়া চোদ্দ আনার গন্তব্য নিজ নিজ পকেট হয়ে যায়!

ব্যাপার হল, আজকাল আমরা অনেকেই এই ই-বুক পড়ি। পিডিএফ, ইপাব, মোবি ইত্যাদি নানান ফরমেটের ই বুক ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে। প্রযুক্তির উন্নতির কারণে বই পড়ার সিস্টেম অনেক বদলে গেছে। বলা বাহুল্য, কাগজের বইয়ের কোনও তুলনা হয় না। সেই আনন্দ, সেই বই ছুঁয়ে ছুঁয়ে মুগ্ধতা নিয়ে পড়ার কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু তার বাইরে আমরা নানান রকম ডিভাইসে সংযুক্ত থাকি সারাদিন। কম্পিউটার, মোবাইল, কিন্ডল ইত্যাদি ধরনের আধুনিক প্রযুক্তিতে বই পড়ার সুযোগ রয়েছে। সেই কারণে বেড়েছে ই বুক নামক প্রযুক্তির প্রসার।

অন্তর্জালে এইসব ইবুক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা বিনামূল্যে পেয়ে থাকি। ‘বিনে পয়সায় পেলে নাকি বাঙালি আলকাতরাও খায়’, আর এ তো বই। বই পড়ে মহা বিদ্বান না হই, কিংবা উইপোকার মতো কেটেকুটে খাওয়ার উপায় নাই তো হলটা কী, বগলদাবা তো করাই যায়। তো মনের সুখে হাস্যমুখে বিনে পয়সায় পাওয়া এইসব আন্তর্জালিক পুস্তক আমি আমরা দু’হাতে সপাটে নিয়ে থাকি। যে সাইটগুলোতে ই বুক পাওয়া যায় আমরা সেখান থেকে নামিয়ে বই পড়ি। পড়েটড়ে (হয়ত) আরও বড় (বই) ‘চোর’ হবার উপায় খুঁজি।

যে বা যাঁরা বই লেখা বা বই প্রকাশনার সাথে জড়িত নন এমন অনেক মানুষের ক্ষেত্রে একটা বই পড়ে ফেলবার আগ্রহ, আনন্দ, যেমন কাজ করে, পাশাপাশি ‘পেলাম তাই নিলাম’ জাতীয় বোধটা কাজ করলেও তারা যে পয়সা খরচ করে বই কেনেন না তাও কিন্তু নয়। বইপ্রিয় মানুষমাত্রই পছন্দের বই পয়সা খরচ করেও সংগ্রহ করে থাকেন। অন্যদিকে যে বা যারা লেখা এবং প্রকাশনার সাথে জড়িত, তারা এই বিনে পয়সায় বই সংগ্রহের বিষয়ে অতটা খুশি হন না। এ নিয়ে যথেষ্ট ক্ষোভবিক্ষোভ সময়ে সময়ে প্রকাশ পাওয়ার ঘটনাও ঘটতে দেখি। ফেসবুকে নানান ইস্যুতে বিপ্লবে ভাসিয়ে দেয়া আমাদের বুক থেকে তখন বিপ্লব সটকে গিয়ে হৃদস্পন্দন বেশ ক্ষীণ হয়ে আসে নানান আশঙ্কায়। এই বুঝি বিনে পয়সার সুখ উবে গেল! আমাদের অনেকের বই না পড়ে তা সংগ্রহের নেশার কপালে এই বুঝি ধরে গেল দাউ দাউ আগুন! এহেন ভাবনা মাঝেমধ্যে পেরেশান করে বটে।

একটা সময় পর্যন্ত যারা লেখক বা প্রকাশকের প্রাপ্য পাওনা বিষয়ে উদাসীন থেকে ‘আমার এই বই নেওয়াতেই আনন্দ’ চিন্তায় বুঁদ থেকে বই নিতেন তাদের মধ্যে থেকে যখন কেউ (সবাই নন) হঠাৎ ছাপা পুস্তকের লেখক বা প্রকাশক হন, তখন তারা কেমন সুর পালটে ফেলেন। তখন বিনে পয়সায় বই নেয়া মানে চুরি, যা অন্যায়। এমন পরিস্হিতিতে একজন নগন্য পাঠক হিসেবে বেশ ধন্দে পড়ে যেতে হয়। কেবলমাত্র পাঠক হিসেবে বিনে পয়সায় বই সংগ্রহ করাটা ঠিক থাকলে, যেমাত্র আমি লেখক বা প্রকাশক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলাম অমনি সেটি অন্যায়, অন্যায্য হিসেবে কেন দেখা দেয়! এমন প্রশ্ন মনে আচ্ছামতো জট পাকায়। সে জটকে জটাজল পাকায় আরও কিছু প্রশ্ন। অন্তর্জাল থেকে এভাবে বই সংগ্রহকে ‘চুরি’ বলা উচিত কি উচিত নয়? কিংবা এই ধরনের বই সংগ্রহের পদ্ধতি উপরোল্লেখিত লিব্রির বইচুরির সাথে তুলনায় নেয়া কতটা সঙ্গত, ইত্যাদি।

অন্তর্জাল জুড়ে বিনে পয়সার ই বুকের যে ছড়াছড়ি, তা তো আসলে আনন্দের খোরাক হিসেবেই দেয়া বা নেয়া হয়। এর মাধ্যমে ফায়দা লোটার মতলব থাকে না বলেই মনে করি। লেখক প্রকাশকের প্রাপ্য পাওনা যেন মার না খায় সেটি বিবেচনায় নিয়ে ই বুকের পেছনে ধাওয়া করলে সব পক্ষেরই লাভ মনে করি। এতে হয়ত মহামতি তস্কর লিব্রি মহাশয়কেও আচ্ছামতো জব্দ করা যাবে। নইলে দু’হাতে ই বুক সংগ্রহরত আমাদের ‘যাত্রী একই তরণীর’ বিবেচনায় নিয়ে তার তস্করতার গপ্পো ‘তারায় তারায় রটিয়ে’ দেবার জন্য লিব্রি মহাশয় ইতিহাসের পাতায় বসে আমার পিণ্ডি চটকাতে চটকাতে মুখ নাড়বেন হয়ত, “তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!” বলা যায় না বাপু, তার যা প্রতিভা! নানান ভুজুংভাজুং করে পিথিমিতে অস্তিত্বহীন ভূতের রাজাকে হাজির করে তার মাধ্যমে আমাদের বিনে পয়সায় ই বুক সংগ্রহের সুখে বজ্রপাত নিক্ষেপ করে বসলে খুব অবাক হব না। আপনি হবেন, বলুন দেখি?