রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
যুক্তিবাদ বলতে দর্শনের ছাত্রছাত্রীরা প্রথমেই মনে করেন সতেরো শতকের ইওরোপে প্রত্যক্ষবাদ (এম্পিরিসিজম) বনাম যুক্তিবাদ (র্যাশনালিজম)-এর কথা। কিন্তু উনিশ শতকের শেষ থেকেই র্যাশনালিজম শব্দটি অন্য এক অর্থে ব্যবহার হতে শুরু করে। সেটি হল: মতামত বা কাজকর্মর ব্যাপারে ধর্মবিশ্বাস বা আবেগের ওপর ভরসা না করে যুক্তি ও জ্ঞানের ভিত্তিতে আচার-আচরণ ও নীতি ঠিক করা। এর জন্য খুব বড় অভিধান দেখার দরকার নেই; কনসাইজ অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি, দ্বাদশ সংস্করণ, ২০১১ দেখলেই চলবে।
হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১) ছিলেন এই ধরণের যুক্তিবাদী। ভগবান আছেন না নেই এই নিয়ে তিনি কোনো নির্দিষ্ট মত দিতেন না, প্রচার করার তো প্রশ্নই ওঠে না। তবু তাঁকে নাস্তিক বলে দাগা মেরে হিন্দু কলেজের শিক্ষক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ডিরোজিও কিন্তু তাঁর ছাত্রদের একটা কথাই বলতেন: কোনো বিষয়ে মত স্থির করার আগে তার পক্ষে ও বিপক্ষে যত যুক্তি আছে সেগুলো জেনে বুঝে বিচার করে তবে নিজের মত ঠিক করবে। এই শিক্ষাই ডিরোজিওর স্বল্পায়ু জীবনের সবচেয়ে বড় কীর্তি। কারুর কথা শুনে বা আবেগের বশে কোনো মতের প্রতি পক্ষপাত দেখানো উচিত নয়; বরং নিজের বোধবুদ্ধির ওপর ভরসা রেখে পক্ষে-বিপক্ষে যা বলার আছে সেগুলো নিক্তিতে ওজন করে ঠিক করো: কার পাল্লা ভারী। ছাত্রদের তাই যে কোনো বিষয়ে বিতর্ক করতে উৎসাহ দিতেন তিনি। নিজেরা মাথা খাটিয়ে, দরকার মতো পড়াশুনো করে তারা যেন ঠিক-ভুল পরখ করতে শেখে।
উনিশ শতকের প্রথম ভাগে ডিরোজিওর ছাত্ররা দেখা দিয়েছিলেন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতবিদ্য ও কৃতী মানুষ হিসেবে। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রাধানাথ সিকদার, রামগোপাল ঘোষ, হরচন্দ্র ঘোষ — এঁদের নাম বাঙলার ইতিহাসে, বিশেষত শিক্ষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে, সদাস্মরণীয়। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও এঁদের কয়েকজনের নাম অক্ষয় হয়ে আছে। বাড়ির মেয়েদের পড়ার জন্য মাসিক পত্রিকা বের করা কম গৌরবের বিষয় নয়। তার সম্পাদক ছিলেন রাধানাথ সিকদার ও প্যারীচাঁদ মিত্র। বাঙলা সাহিত্যিক গদ্যর বিকাশে তাঁদের অবদান এখনও বোধহয় ঠিকমতো বোঝা হয়নি। টেকচাঁদি ভাষা দাঁড়িয়ে থাকে বিদ্যাসাগরি আর হুতোমি ভাষার ঠিক মাঝখানে। উঁচু আর নিচু রীতির মধ্যে মাঝারি রীতি। একেও বলা যেতে পারে ডিরোজিওর পরোক্ষ প্রভাব।
হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা (১৮১৭)-র আগে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে বোঝাত: একজন সায়েব (বা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান)-এর কাছে কাজ চালানোর মতো ইংরিজি শেখা। অন্য কিছু স্কুলে (বাঙালি-পরিচালিত) একই ধরণের ইংরিজি শিক্ষা হতো: ছড়া কেটে ইংরিজি শব্দ ও তার বাঙলা প্রতিশব্দ মুখস্থ করানো। তার পরেও, আরও উঁচু ক্লাসে ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞানের কিছু তথ্য মনের মধ্যে গেদে দেওয়া হতো।
ফরাসি লেখক আনাতোল ফ্রাঁস চেয়েছিলেন: আমাদের শিক্ষণ ভরা হোক ভাবনায়। এতকাল এটি শুধু তথ্য দিয়ে ঠাসা হয়েছে’ (Let our teaching be full of ideas. Hitherto it has been stuffed only with facts)। অবশ্যই এ এক নতুন শিক্ষাদর্শ। এখনও পর্যন্ত বাস্তবে তার নমুনা চোখে পড়ে না। কোনো কোনো মনীষী এর জন্যে নিজেরাই আলাদা আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথ ও বারট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russel)-এর কথা অনেকেই জানেন। কিন্তু প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতির ভেতরে থেকে, প্রাতিষ্ঠানিক বিধিবিধানের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েও ডিরোজিও চেয়েছিলেন কিশোর ছাত্রদের মনে অন্ধবিশ্বাসের জায়গায় পক্ষপাতহীন যুক্তিবুদ্ধির বীজ রোপণ করতে। তার জন্য তাঁকে মূল্যও দিতে হয়েছিল। কুৎসা রটনা ছাড়াও তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। হিন্দু কলেজের পরিচালকরা রীতিমতো কোমর বেঁধে, প্যাঁচ কষে ডিরোজিওকে তাঁদের প্রতিষ্ঠান থেকে সরালেন।
এর থেকে একটা জিনিস বোঝার আছে: প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র আর যুক্তিবুদ্ধির সহাবস্থান অসম্ভব। মুক্তচিন্তা আর পাঠক্রম মেনে পরীক্ষা-কেন্দ্রিক শিক্ষা ও তার ফল – দুটো একযোগে চলে না। ডিরোজিও-ও সে কথা বুঝতেন। তাই হিন্দু কলেজের বাইরে, নিজের বাড়িতে ও মানিকতলায় শ্রীকৃষ্ণ সিংহ-র বাগানবাড়ির ঘরে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন গড়ে মুক্ত চিন্তা বিকাশের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। রেভারেন্ড লালবিহারী দে লিখেছেন: ‘The young lions of the Academy roared out, week after week, “Down with Hinduism! Down with orthodoxy!’’’
হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাঙালি সমাজে তথ্যর পাশাপাশি ভাবনাচিন্তার একটা জায়গা হলো। যত সঙ্কীর্ণই হোক তার সীমা, বাঙালি সমাজের ওপরের স্তরে তার থেকেই একটা কাঁপন ধরল। তার উদ্যোক্তা সব ক্ষেত্রেই ডিরোজিয়ান বা ইয়ং বেঙ্গলরা নন। তাঁদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কহীন বেশ কিছু মানুষ, তাঁদের সকলেই অবশ্য ইংরিজি শিক্ষিত, ঢাকঢোল না-পিটিয়েই, শাঁখ-ঘণ্টা না বাজিয়েই একটি একটি করে প্রথাবিরোধী কাজ শুরু করলেন। এগুলোর সাথে ডিরোজিও কেন, কোনো ডিরোজিয়ানেরও সাক্ষাৎ যোগ ছিল না। তবু কলকাতা ও মফস্বলে যুক্তিবুদ্ধির প্রসার এইভাবেই হয়েছে। এঁরাও ডিরোজিওর–ই সন্ততি।
রামমোহন রায় যখন সতীদাহ-র বিরুদ্ধে তাঁর প্রথম পুস্তিকাটি লিখলেন (১৮১৮) সেখানেও বিষয়টি উপস্থিত করা হয়েছিল তর্ক-র আকারে: প্রবর্তক (যিনি সতীদাহ চান) আর নিবর্তক (যিনি তা বন্ধ করতে চান) এমন দুজন কাল্পনিক ব্যক্তির ‘সম্বাদ’ বা ডায়ালগ (ঠিকমতো বললে: ডুওলোগ) হিসাবে। এখানেও সেই দুটি পরস্পর-বিরোধী মতের দ্বন্দ্ব। রামমোহন নিজে কোনো সিদ্ধান্ত দেন নি, সে-বরাত পাঠকের ওপরে।
বাঙলা তথা ভারতের ইতিহাসে এই ঘটনাটিও চিরস্মরণীয়। তক্কাতক্কি তো ভারতের লোকে বহুকাল ধরেই করে আসছেন। কিন্তু সে হলো শখের তক্ক। তার মীমাংসার ওপর জগৎ-জীবনের কিছুই নির্ভর করে না। অমর্ত্য সেন যাদের ‘তর্কপ্রিয় ভারতীয়’ (আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান) বলেছেন, তাদের সঙ্গে রামমোহনের সময় থেকে যে সব তক্কাতক্কি শুরু হলো, তার তফাত অনেক। সতীদাহ থাকবে না বন্ধ হবে, বিধবার আবার বিয়ে দেওয়া যাবে, না যাবে না; একজন লোকের অনেক বউ থাকা উচিত না অনুচিত — এই ধরণের বিষয়ে তক্কাতক্কির একটা ব্যাবহারিক গুরুত্ব আছে। এগুলো শুধুই ‘সুখপাঠ্য লাঠালাঠি’ নয়, এগুলোর মীমাংসার ওপরে মেয়েদের — সব জাতের, সব অবস্থার মেয়েদের — বাঁচা-মরা জড়িয়ে আছে।
দুঃখের বিষয়, রামমোহন রায়ের সঙ্গে ডিরোজিওর পরিচয় হয়নি। অনেক বছরই তাঁরা এক শহরে বাস করেছেন। কিন্তু ফিরিঙ্গি সমাজ আর বাঙালি সমাজের মধ্যে তেমন যোগ ছিল না, বরং বিয়োগই ছিল বলা যায়। বোধহয় সেই কারণেই ডিরোজিওর শিক্ষক ড্রামন্ড বা তাঁর কোনো ছাত্রের সঙ্গে রামমোহন রায়ের পরিচয় হয় নি।
সতীদাহ বন্ধ করার আইন, ১৮২৯-এর ১৭ নং রেগুলেশন জারি হলো। রামমোহন অবশ্যই তাতে খুবই খুশি হয়েছিলেন। তাঁর সমর্থনে খুব অল্প লোকই ছিলেন, এগিয়ে এসেছিলেন আরও কম লোক। গণভোট নিলে সতীদাহ সমর্থকরাই বিপুল ভোটে জয়ী হতেন। (বিধবা বিবাহের ক্ষেত্রেও কথাটি সমানভাবে সত্যি; প্রগতিশীলরাই এখানে সংখ্যালঘু, রক্ষণশীলরাই সংখ্যাগুরু)। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটি জায়গা থেকে সতীদাহ বন্ধ করার সমর্থন এসেছিল। ক্যালকাটা মান্থলি জার্নাল (ডিসেম্বর ১৮২৯)-এ একটি কবিতা বেরোল; ‘অন দ্য অ্যাবলিশন অব সতী’। কবির নাম হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। পত্রিকার সম্পাদক লিখেছিলেন; ‘বিষয়টি কবিরই যোগ্য; আর কবি দেখিয়েছেন যে তিনিও এই বিষয়ে (কবিতা রচনায়) অনুপযুক্ত নন।’
সমাজ সংস্কারের মতো চিন্তাসংস্কারও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বাঙলায় পরবর্তীকালে যাঁরা সেই কাজে হাত দিয়েছেন তাঁদের সবাই ডিরোজিওর কাছে — আর তার সঙ্গে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের কাছেও — প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঋণী। ডিরোজিওর সাক্ষাৎ ছাত্ররা তাঁর যুক্তিবাদের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যান নি। দিলীপকুমার বিশ্বাস দেখিয়েছেন একজন ডিরোজিয়ানও ‘উত্তর জীবনে নাস্তিকতা প্রচার করেন নি।’ কথাটি ঠিক। ডিরোজিয়ান তথা ইয়ং বেঙ্গল-এর মধ্যে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ও মহেশচন্দ্র ঘোষ খ্রিস্টান হয়েছিলেন, হরচন্দ্র ঘোষ নিষ্ঠাবান হিন্দু-ই থেকে যান, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, চন্দ্রশেখর দেব, শিবচন্দ্র দেব ব্রাহ্ম হন, প্যারীচাঁদ মিত্র ব্রহ্মবিদ্যা বা থিওজফি আন্দোলনে যোগ দেন, আর রসিককৃষ্ণ মল্লিক এক সর্বজনীন ধর্ম-য় বিশ্বাস করতেন।
বরং নাস্তিকতার ধারাটি প্রচার হয়েছিল অক্ষয়কুমার দত্ত মারফত। ধ্রুববাদী (পজিটিভিস্ট) আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সকলেই নিরীশ্বরবাদী ছিলেন। বিশেষ করে কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যর নাম করা যায়। এঁরা কেউই সরাসরি ডিরোজিও-প্রভাবিত ছিলেন না। তবু বাঙলায় যুক্তিবাদী আন্দোলনের হাতেখড়ি হয়েছিল ডিরোজিওর কাছে — এই সত্যটি অস্বীকার করা যাবে না। বাঙলা সাহিত্যে ধ্রুববাদী আন্দোলনের দিকচিহ্ন ধরা আছে রবীন্দ্রনাথের চতুরঙ্গ-য়। জ্যাঠামশায় এক আশ্চর্য চরিত্র। ইতিহাসের ধারায় দেখলে তিনিও কিন্তু ডিরোজিও-রই উত্তরসূরি।
আর একটি কথা বলে আলোচনা শেষ করি। ডিরোজিওকে লোকে চেনেন অ-সাধারণ শিক্ষক আর কবি বলে। এখানে তুলনায় কম পরিচিত একটি কবিতা উদ্ধৃত করা হলো:
ক্রীতদাসের মুক্তি
গোলামির পালা শেষ। কি এক বিচিত্র অনুভূতি!
মুক্তি পেয়ে সমুদ্বেল বুক ভরে গর্বের স্পন্দনে
সহসা ভাস্বর হল অন্তরের মহৎ প্রস্তুতি
নতজানু-দাসত্বের ক্রান্তির ঘোষণা সেই ক্ষণে:
নিজেকে চিনেছে দাস মানুষের আত্মার সম্মানে,
আকাশে তাকিয়ে নেয় নন্দনের বাতাসে জীবন,
বুনোপাখিদের ঝাঁক উড়ে যায়, দেখে ঊর্ধ্বপানে,
মৃদু হাসি মুখে মেখে নিজেকেই জানায় বন্দন!
ওদিকেতে চেয়ে দেখে কলস্বরে ঝর্ণা চলে নেচে,
বাতাস — পাখিরা — ঝর্ণা দেখে ভাবে কি খানিক
“আমিও ওদের মতো মুক্ত হয়ে রয়েছি ত বেঁচে!”
সহসা চেঁচিয়ে ওঠে অতঃপর ভুলে দিগ্বিদিক।
মুক্তি! নাম থেকে ঝরে সুনিবিড় মাধুর্য তোমার,
হৃদয়ের বেদীতটে জ্বেলেছ যে শিখা অনির্বাণ,
স্বদেশের মুক্তিযজ্ঞে উদ্ভাসিত খোলা তলোয়ার
শোণিতের পুণ্য-অর্ঘ্যে এনেছ কি মুক্তির সম্মান!
ধন্য হোক সেই হাত যে-হাত করেছে খান খান
শোষণের শিকলকে; ধন্য হোক সে-আত্মপ্রসাদ
নিপীড়িত মানবাত্মা যার বলে হল বলীয়ান
ক্রীতদাস পেল যাতে অবশেষে মুক্তির আস্বাদ।
ফেব্রুয়ারি, ১৯২৭
অনুবাদ : পল্লব সেনগুপ্ত
(ডিরোজিও: সময়ের এ্যালবাম, শক্তি সাধন মুখোপাধ্যায় ও অধীর কুমার সংকলিত, ডিরোজিও স্মরণ সমিতি, পাত্র’জ পাবলিকেশন, ২০০৩)
ডিরোজিওর অন্য একটি পরিচয় আড়ালেই থেকে যায়। তিনি যে সাংবাদিকও ছিলেন, অনেককটি পত্রপত্রিকার সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগ ছিল — এই কথাটি খেয়াল করা হয় না। অথচ বাঙলা তথা ভারতে সাংবাদিকতার ইতিহাসে ডিরোজিও-র নাম রেডিয়ামের অক্ষরে লিখে রাখার কথা। কটি কাগজের তিনি সহ-সম্পাদক বা সম্পাদক ছিলেন সে নিয়ে বিতর্ক আছে। এমনকি দ ক্যালাইডোস্কোপ, যে মাসিক পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় ‘আমার ছাত্রদের প্রতি’ (টু মাই পিউপিলস) কবিতাটি বেরিয়েছিল, তাতেও স্বাক্ষর ছিল: এইচ সি।
হিন্দু কলেজের ছাত্রদের জন্য সনেট
ফুলের তরুণ কলি যেভাবে ছড়ায় পাপড়ি তার
সেইমতো দেখি মৃদু খুলে যায় তোমাদের মন,
আর কী মধুর খোলে সেই সব সম্মোহন ভার
বেঁধে রেখেছিল যারা তোমাদের সমর্থ মনন,
যে মনন করে দেয় তার সব ডানা প্রসারণ
(গ্রীষ্মের প্রহরে যেমন পাখির শাবক) উড়বার
শক্তির পরখ করে। অভিঘাত কত না হাওয়ার,
প্রথম জ্ঞানের কত বৈশাখের নবীন বর্ষণ।
অগণ্য নতুন কত বোধ — সবই চিহ্ন রেখে যায়
তোমরা নিরত থাকো সর্বশক্তি সত্যের পূজায়।
কত যে আনন্দধারা আমার উপরে পড়ে ঝুরে
যখন তাকিয়ে দেখি যশোদেবী ভবিষ্যমুকুরে
গেঁথে চলেছেন মালা কখনও যা পাবে তোমরা, তাই
সে-সময়ে মনে হয় এ জীবনে বাঁচিনি বৃথাই।
অনুবাদ : শঙ্খ ঘোষ
(ভারত-বীণা ও অন্যান্য সনেট-কবিতা, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, প্রোগ্রেসিভ পাবলিশার্স, ২০০২)
কোনো কোনো শিক্ষককে নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখা পদ্যর কথা মাঝে মাঝে শোনা যায়, কিন্তু ছাত্রদের উদ্দেশে শিক্ষকের লেখা কবিতা — তায় আবার এমন চমৎকার কবিতা — বিরল। কবিতাটি যে ডিরোজিওর — তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি যে এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তারও কোনো প্রমাণ নেই। হারিয়ে যাওয়া পত্রিকাটি আগাগোড়া ছেপে বার করেন প্রয়াত অধ্যাপক গৌতম চট্টোপাধ্যায়। পত্রিকার যে নীতি-বিষয়ক বিবৃতি, তার সঙ্গে ডিরোজিও-র নিজের মতামতের কোনো মিল নেই। সুরেশচন্দ্র মৈত্র তাই সঙ্গত কারণেই আপত্তি তুলেছেন ডিরোজিও আদৌ ঐ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন কিনা।
কিন্তু ডিরোজিও যে দ ইস্ট ইন্ডিয়ান নামক পত্রিকাটির প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সেই পত্রিকায় অনেক বকধার্মিকের মুখোশ খুলে দেওয়া হতো। যেমন, অগাস্ট ১৮৩১-এ ভাদ্রোৎসব উপলক্ষ্যে ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে পণ্ডিত বিদায়-এর ব্যবস্থা হয়েছিল। দুশ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও তাঁদের ছেলেদের দু’টাকা থেকে ষোল টাকা হারে দক্ষিণা দেওয়া হয় (১৮৫ বছর আগে টাকার অঙ্কটা তুচ্ছ নয়)। দ ইস্ট ইন্ডিয়ান-এ লেখা হয়েছিল: ‘ব্রাহ্মসভা কি ব্রাহ্মণদের ভেলকিবাজির মঞ্চ? আমরা তো জানতাম, তা নয়। কারণ এই সভার প্রতিষ্ঠাতা হলেন রামমোহন রায়। তিনি মানবপ্রেমের পূজারী, ঈশ্বরোপাসনাকে শুদ্ধতম নীতির উপর স্থাপন করেছিলেন।’ তারপর পণ্ডিত বিদায়-এর খবরটি দিয়ে ঐ পত্রিকায় লেখা হয়: ‘শুনতে পেলাম সমাজের পরিচালকেরা এমন কাজ নাকি হামেশাই করে থাকেন। দয়াধর্ম প্রশংসনীয় কাজ, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের জিজ্ঞাসা: একই সময়ে কাউকে উঁচুতে তোলা আর নিচুতে নামানোর কী অর্থ আছে? আসলে এ হল সম্পূর্ণ আজগুবি কাণ্ড!’
ঐ পত্রিকাতেই হিন্দুসমাজকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছিল: রক্ষণশীল, আধা উদারপন্থী আর উদারপন্থী।
শুধু সাংবাদিকতা নয়, কথায় ও কাজের মিল না থাকলে তার সমালোচনা করাও ছিল দ ইস্ট ইন্ডিয়ান-এর অন্যতম কাজ। তার সম্পাদক সমীপেষু অংশে এমন চিঠি ছাপা হতো। বড়লোকের বাড়িতে দুর্গাপুজোর সময় বড়লাট, ছোটোলাট থেকে প্রধান বিশপ ও অন্যান্য খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের উপস্থিতি নিয়ে এমন একটি চিঠি ছাপা হয়েছিল। সাংবাদিকতার এই ঐতিহ্য, ডিরোজিওকে বিশিষ্ট ও স্মরণীয় করে রেখেছে।