মোজাফফর হোসেন
সেদিন ঘুমটাকে কিছুতেই বাগে আনতে পারছিলাম না। ঘড়ির নেতা গোছের কাঁটাটা ২-এর বুকের উপর কিছুক্ষণ থেমে আবার চলা শুরু করল। সিসিফাসের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ঘড়িটা। খুব ভোরে কোথায় যেন যেতে হবে! ঘুমুতেই হবে ভেবে খুব অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। ঘরের আলোটা নিভানো। বাইরেও কোনও বাতি জ্বলছে না শুধু চাঁদ আর জোনাকি ছাড়া। প্রকৃতির সুইচ অন্য কারও হাতে। চাঁদের আলোর কারণে ঘরের সবগুলো ছিদ্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। কয়েকটি জ্যোৎস্না জঙ্গল ভেবে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। আলনার জামাকাপড়ের ভেতরে ‘কানা মাছি ভোঁ ভোঁ যাকে পাবি তাকে ছোঁ’ খেলছে। কিছুক্ষণ পরপর একটা মৃদু মরুৎ এসে আমার মশারিটাকে মাঝারিভাবে নাড়িয়ে যাচ্ছে। বিপরীতের দরজাটা বন্ধ, যে জানালা দিয়ে ঢুকেছিল সেই জানালা দিয়েই আবার লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে দুষ্টের দলেরা। ভেতরে আমি একা। একাই তো? হঠাৎ করেই একদল দস্যু হাওয়া হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতরে। মশারির সমস্ত শরীরে ঢেউ খেলে গেল সমুদ্রের। খট করে শব্দ করে সদর দরজাটা আলগা হয়ে গেল। বের হবার একটা যুতসই রাস্তা করতেই দল পাকিয়ে এসেছিল ওরা। সামনে খাঁ খাঁ মাঠ। দাদি থাকেন একেবারে কোনার ঘরটাতে। ওখান থেকে বাজ্জি করাটা সুবিধে হয়। দরজাটা হা হয়েই রইল। একটা ধবধবে ধলা বেড়াল দরজার ফাঁক গলিয়ে দৃষ্টি চুবিয়ে ভেতরটা দেখে আবার কোথায় যেন নেই হয়ে গেল। বেড়ালটি বোধহয় ভেতরে কাউকে দেখেছে। না, আমাকে না, অন্য কাউকে। কেউ একজন আছে ভেতরে। চেয়ারটি অলসভাবে দুলছে। কেউ না সঙ্গ দিলে ও এমন করে অযথাই দুলবে কেন! আমি তার গরম নিঃশ্বাসের উপস্থিতি টের পাচ্ছি। দক্ষিণের দেয়ালে লেপ্টে থাকা ছবিটা পূবের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে মেঝেতে আঁচড়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর ছবিটা মেঝেতে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে কোথায় যেন যেতে চাচ্ছে। একটা বাচ্চা ছেলে ওটা নিয়ে খেলছে এখন। আমি দেখতে পাচ্ছি না তাকে। কিন্তু খেলছে যে সেটা দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। একসময় মনে হল সমস্ত ঘর ‘অন্য কেউ’-এ ভরে গেছে। আমি তাদের ফিসফাস শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কেউ একজন আমার বালিশটার আদ্ধেকে মাথা দিয়ে আড়মুড়া পাড়ছে — তার শরীরে ধাক্কা খেয়ে বাতাস গলে বিছানাকে স্যাঁতসেঁতে করে তুলছে। আমার হাত পা অবশ হওয়ার উপক্রম। এখন যে করেই হোক, বাইরে বেরুতে পারলেই প্রাণে বাঁচি। আমার ঘরটা চোখের সামনে কেমন বেদখল হয়ে গেল! ছায়ার মতো নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম। আসবার সময় আলনা থেকে সাদা শার্টটা উঠিয়ে আনলাম। বুক পকেটে একটা হালকা আলো জ্বলছে আর নিভছে। একটু হা করে দিতেই কয়েকটি জোনাকি পোকা ভেসে উঠল বুদবুদ করে তারপর আমার গালে মুখে আলো ঘষে টর্চ মেরে মেরে অন্ধকার খুঁজতে খুঁজতে দাদির ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল।
এখন আমি মুক্ত। সামনে পিছনে প্রান্তহীন মাঠ। যতদূর চোখ যায় কেবলই হু হু শূন্যতা। ভোর বেলায় সমুদ্রের ভাটায় দাঁড়িয়ে বাতাসের ভাটিয়ালি গান শুনলে মনের ময়দানে এমন শূন্যতা অনুভূত হয়। আকাশে খামচা খামচা মেঘ ধরেছে। চাঁদটা মেঘের আড়াল থেকে কার সাথে যেন লুকোচুরি খেলছে। তার মানে আমি বাদে অন্য কেউ আছে এখানে। সমস্ত মাঠ ফাঁকা, কারা যেন যুক্তি করে রাতারাতি সমস্ত ফসল চেটেপুটে সাবাড় করেছে। এ নির্ঘাত কোনও জাদুকরের কাজ। জাদুকরটা আবার আমাকে গায়েব করে দেয়নি তো? কে জানে! কিছুক্ষণ পূর্বে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আকাশ দেখে বুঝবার জো নেই। বাতাসটা এখনও ভেজা। মাটি থেকে বরফ গলা ভাপ বেরুচ্ছে যেন! আমার শীত ধরে গেল। ভয়ে না ঠান্ডায় বোঝা মুশকিল। এত রাতে আমি কখনও বাইরে আশ্রয় নিইনি। রাত খুব একটা সুবিধের না, সমস্ত কাল এটাই জেনেছি।
‘চলো একটু হাঁটি।’ নিজেকে নিজে বললাম আমি।
তারপর হাঁটা শুরু করলাম। চাঁদের আলোয় একটা ঘোলাটে ছায়া আমার সাথে সাথে হাঁটতে শুরু করলো। ছায়াটি আমার নয়, অন্য কারও, কিংবা আমার মতোই স্বতন্ত্র, এখন সে আমার পিছু লেগেছে। এভাবে পিছনে ছ্যাবলার মতো লেগে থাকে বলে আমরা ওকে নিজের ভেবে ভুল করি। মাঝে মাঝে আমরা আলাদা হয়ে হাঁটছি। কখনও কখনও ও আগে, আমি ওর ছায়া হয়ে পেছনে পেছনে। এমন ভরাট রাত কতকাল দেখিনি! মা যখন ভয়ঙ্কর সব রাক্কস খোক্কসের গল্প বলতেন, তখন ভয়ে মা-র বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে এমন গুণ্ডা মার্কা রাতের উপস্থিতি টের পেতাম।
মাকে একদিন ভয় কাটাতে বলেছিলাম — ‘মা, আমি শয়তান হব!’
‘ধুর পাগল! শয়তান হতে হয় নাকি।’
‘তবে যে আমার অন্ধকারে যেতে ভয় করে?’
‘ভালো মানুষ অন্ধকারে যায় না বাবা।’ একথা বলে মা নিজেই একদিন এক অন্ধকার গর্তে ডুব দিল।
যেদিন শয়তান হব বলেছিলাম ঐ দিন রাতে কে বা কারা যেন উঠিয়ে নিয়ে গেল আমাকে।
‘চলো একটু হাঁটি।’ আমার কানে আগুন মিশিয়ে বলল তারা।
আমার হাত শক্ত করে ধরা অথচ আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না কাউকে। একদল বদমাশ বাতাস বেঁধে ফেলেছিল আমার হাত পা মাথা। অন্ধকার ঘন হতে হতে থকথকে কাদার মতো জমে গিয়েছিল। আমরা হাঁটছি যেন জল ভর্তি পুকুরের বুক ফালিফালি করে। আমি যতবার পড়ে যাই ততবারই হ্যাঁচকা টান দেয় ক্ষুব্ধ বাতাস, গুঁতো দেয় দলা পাকিয়ে অন্ধকার, চাবকাতে চাবকাতে ক্ষত-বিক্ষত করে তোলে আতঙ্ক। আমার পা তখন আকাশে, মাথার ওপর পৃথিবী টলছে ছোট্ট ডিঙার ন্যায়। তারাদের বুক চিরে বেরিয়ে আসছে কোটি কোটি আগুনের চামচিকা।
‘হুকুম করুন মালিক’ — ওদের দলপতি বলল।
আমি ভয়ে ভয়ে পৃথিবীর দিকে তাকালাম। তারা মৌমাছির মতো জটলা পাকিয়ে ছুট দিলো পৃথিবীর দিকে। ছো মেরে ছোট্ট ডিঙাটি ছুড়ে মারল আগুনের সমুদ্রে। আগুন আর পৃথিবী মিশে একাকার। টগবগ করে ফুটছে আকাশ। বাতাস ঘেমে ঘেমে বৃষ্টি হচ্ছে রক্তজবার।
‘আমি শয়তান হব না। আমাকে ছেড়ে দাও, আমি শয়তান হব না।’
আমি হাত পা চোখ নাক কান ছুড়ে মারি ওদের তাক করে।
‘না বাবা, তোকে শয়তান হতে হবে না।’ মা জড়িয়ে ধরে শান্ত করলেন আমাকে।
বাবা গেলেন একাত্তরে, বন্দুক হাতে, আর ফেরেননি। বাবাও শুনেছি অন্ধকারে মিশে গেছেন। আমাদের সাথে থাকতে বাবার অন্ধকারে এলার্জি ছিল। সন্ধেবেলায় ঘোর লাগার সাথে সাথে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়তেন, তারপর যতক্ষণ জেগে থাকতেন বাতি জ্বালিয়ে রাখতেন। একদিন আমরা সবাই ছাদে উঠে গ্রহণ লাগা চাঁদ দেখছিলাম। বাবা ঘরের ভেতর থেকেই জানালার ফাঁক গলিয়ে একবার দেখে নিয়ে বললেন–‘ওহ্, এই জিনিস!’ তারপর আবার শুয়ে পড়লেন। বাবা শুয়ে শুয়ে আমাকে ছেলেবেলার গল্প বলতেন। বাবার বাবা ছিলেন হাজী, এলাকার সবচেয়ে ভালো মানুষ। সবাই একবাক্যে মানত তাঁকে। আল্লাহর সাথে নাকি বাবার বাবার একটা যোগাযোগ ছিল, মানুষজন তাই মনে করত।
‘তিনি বৃষ্টি হবে বললে সেদিন তুমুল বৃষ্টি হত। যে বার বলতেন বৃষ্টি কম হবে সেইবার খরায় মাঠ ঘাট পুড়ে ছাই হয়ে যেত।’ বাবা বলে যেতেন।
‘বাবা, সত্যি সত্যি কি আল্লাহর সাথে দাদার কথা হত?’ আমি জানতে চাইলাম বাবার কাছে।
‘আল্লাহ যেমন সব মানুষের মনের কথা পড়তে পারেন, ভাল মানুষরাও তেমনি আল্লাহর মনের কথা জানেন। তোকে আমার বাবার মতো ভালো মানুষ হতে হবে। পারবি না?’ বাবা বললেন।
‘আমি ঈশ্বর হব বাবা।’
‘ঘুমা। অনেক রাত হল।’ বাবা হাসতে হাসতে বললেন।
আমার আর ঘুম আসল না। কী যেন ভাবছিলাম! কিংবা কিছু না ভেবে কিভাবে থাকা যায় সেটা ভাবছিলাম।
একদল মেঘ দলা পাকিয়ে এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। রাত তখন একটু একটু করে গাড় হচ্ছে। একটা মিষ্টি গন্ধে ভিজে গেছে বাতাস, মনে হচ্ছে যেন পাশেই কোথাও হাসনাহেনার বন আছে।
মেঘের দলা আমার দুই দিক থেকে দুই হাত ধরে বলল — ‘চলো একটু হাঁটি।’
‘কিন্তু বাবা জানতে পারলে রাগ করবে যে!’ বললাম আমি।
‘তুমি না ঈশ্বর হবে?’
‘হবই তো! বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম।’
তারপর আমরা হাঁটা শুরু করলাম। মেঘের দলেরা এখন আমার গার্ডিয়ান এঞ্জেল। আমাদের আগে আগে বাতাস সরিয়ে সরিয়ে হাঁটছিল কেউ একজন। আমাদের সামনে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বুঝেছিলাম আমি।
‘এমন সুন্দর রাত কতকাল দেখিনি!’ আমি বললাম।
‘তুমি ঈশ্বর হলে প্রতিদিনই দেখবে। তখন তোমার আর এত ভালো লাগবে না হয়ত।’
‘আমি গান গাইতে পারব?
‘হ্যাঁ। তোমার কণ্ঠ দিয়ে তখন বর্ষার মতো সঙ্গীত ঝরবে। অথচ তুমি গাইবে না, কেননা তোমার গান শোনার মতো কেউ আর থাকবে না।’
‘আমি আঁকতে পারব তো?’
‘অতি চমৎকার আঁকবে তুমি। পৃথিবীর বিখ্যাত শিল্পীরা তোমাকে নকল করতে চাইবে কিন্তু পারবে না কিছুতেই। অথচ তুমি নির্বিকার বসে থাকবে, কেননা তোমার কোনও রঙ তুলি লাগবে না। তুমি চোখ বন্ধ করে ইশারা করলেই মজার মজার সব ছবি আঁকা হয়ে যাবে। তুমি দেখবে যে, তোমার ভালোলাগবে না! কারণ তুমি জানো তুমি এর চেয়েও ঢের ভাল আঁকতে পারো।’
‘তুমি ইচ্ছেমতো সমস্ত পৃথিবীটাকে নড়াতে চড়াতে পারবে। তোমার ইচ্ছায় পৃথিবীর সকল পাখি গান গায়বে, ময়ূর তোমার ইচ্ছাতেই পেখম তুলে দাঁড়িয়ে থাকবে অনন্ত কাল। তোমার খুব ভালো লাগবে কিন্তু সেই ভালোলাগা তখন আর তুমি অনুভব করতে পারবে না।’
‘সাগরের ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব ঢেউ তোমার পায়ের কাছে গড়াগড়ি খাবে নির্দেশের অপেক্ষায়। কি ভয়ঙ্কর দেখতে তারা অথচ তোমার আর তখন ভয় পাবে না। কারণ তুমি জানো, তুমি ওদের চেয়েও ভয়ঙ্কর হতে পারো।’
‘আমি উড়ে বেড়াতে পারব তো?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু তার আর কোনও প্রয়োজন হবে না। কেননা তুমি চোখ বন্ধ করলেই পৌঁছে যাবে তোমার গন্তব্যে।’
‘আমি ইচ্ছেমতো খেতে পাবো তো ?’
‘পাবে। তুমি চাইলেই তোমার চতুর্দিক দিয়ে চকোলেট, আইসক্রিম আর কিসমিসের নদী বয়ে যাবে। তোমার আঙুলের ইশারায় পৃথিবীর সমস্ত বন ফলের বাগানে পরিণত হবে। অথচ তোমার কিছুই খেতে ভাল লাগবে না। কেননা তোমার আর তখন ক্ষুধা থাকবে না। জিহ্বায় থাকবে না কোনও জাগতিক স্বাদ।’
‘আমাকে তখন কেউ হারাতে পারবে না তো? ক্লাসে প্রতিদিন পড়া পারব তো?’
‘তুমি তখন চাইলেই হারতে পারবে, চাইলেই পারবে জিততে। তোমার তখন অনেক মজা। কিন্তু তুমি কাউকে হারিয়ে আর মজা পাবে না। কেননা তখন তোমার সমকক্ষ আর কেউ রইবে না।’
‘আমার মা সাথে সাথে থাকবে তো? তাঁর কোনও অসুখ হবে না তো?’
‘পৃথিবীর সমস্ত মা তখন তোমার মা। তুমি চাইলেই জন্ম নিতে পারবে যে কোনও মায়ের গর্ভে। অথচ তুমি আর কাউকে মা ডেকে শান্তি পাবে না। কারণ তুমি জানো তোমার সাথে কারও রক্তের সম্পর্ক নেই। তোমার হাতেই সবার জন্ম। কোনও অসুখ বিসুখই তোমার অসুখের কারণ হবে না। তোমার কান্না পাবে না কিছুতেই। কারণ তুমি জানো তুমি চাইলেই সব ঠিক করে দিতে পারো নিমিষেই।’
আমরা চলতে চলতে কখন যেন দিগন্তের ধারে চলে এসেছি। আমার সামনের জায়গাটা আরো ফাঁকা হয়ে শূন্যে সুড়ঙ্গের মতো উঠে গেছে। চারিদিক থেকে পাঁজা পাঁজা মেঘ পাহাড়ের দল সব মাথা নিচু করে কাঁধে তুলে নিতে চাইছে তাঁকে। ফাঁকা জায়গাটা আস্তে আস্তে ভরাট হয়ে ভরে যাচ্ছে মাংসে।
আমি বলে উঠলাম — ‘এ কি ঈশ্বর?’
‘এ তো তুমি।’
‘আমি ঈশ্বর হব না। না আমি ঈশ্বর হব না।’
বাবা আমাকে বুকে টেনে নিলে সব কেমন শান্ত হয়ে গেল।
নীরা যেদিন প্রথম এলো বাড়িতে, সেদিন ফুটফুটে জোছনা ছিল। জোছনা পোকার বৃষ্টি হচ্ছিল গাছে গাছে ঝোপে ঝোপে। মনে হচ্ছিল যেন, চুমকি গাঁথা অন্ধকারের পোশাক পরেছে প্রকৃতি, চাঁদের আলোয় মাঝে মাঝে ঝিলিক মারছে ওগুলো। এক থালা চাঁদ থেকে চুইয়ে চুইয়ে তামাটে আলোয় ভিজে গিয়েছিল আমাদের সমস্ত এটেল মাটির উঠান। কারা যেন এক আকাশ তারা মেলে দিয়েছিল আকাশময়। যেন চতুর্দিকের সব পাহাড়, মাটি, বন আলো হয়ে গলে যাবে এক্ষুনি। আমি নীরার চুলের ঘন অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে বলেছিলাম — ‘আজ কেবলই আমার আঁধার চাই।’ নীরা জোছনা ভালবাসত। প্রতিদিন কয়েকটি জোছনা পোকা ধরে এনে ছেড়ে দিতো বিছানার তলে, শাড়ির ভাজে ভাজে, আমার বুক পকেটে। আমাকে একদিন বলেছিল–‘আমাকে একটা খাঁচা এনে দিবে, আমি চাষ করব জ্যোৎস্নার।’ একদিন একদল জোছনা পোকার হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নীরা, আর ফেরেনি। আজ খুব নীরার কথা মনে পড়ছে। নীরা কি এখনও তেমন করেই জোছনা ভালোবাসে? কেমন চলছে নীরার জোছনা জোছনা সংসার?
দূরের মাঠে একটা গাছ দেখা যাচ্ছে — বাবলা গাছ। মনে হচ্ছে ঘোমটা দিয়ে কে যেন বসে আছে! এগিয়ে গেলাম, গাছটি আমাকে ডাকছে। কয়েকটি আইল পেরিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। ভয় করছিল, গাছটি যদি উল্টোপাল্টা কিছু করে বসে। গাছটি তখন কয়েক কদম এগিয়ে এলো। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম বৃক্ষ হয়ে। আমার পায়ের মোটা রগটা মূল হয়ে গেঁথে গেলো মাটিতে, ছোট ছোট শিরা উপশিরাগুলো কিলবিল করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো ময়দানে।
‘চলো একটু হাঁটি।’ গাছটি বলল।
আমার ভয় কিছুটা কমে গেল। যাক, তাহলে এত রাতে একজন সঙ্গী পাওয়া গেল! হোক গাছ, তবুও।
‘দাঁড়িয়ে রইলে যে? এই রাতে মানুষের চেয়ে গাছের সঙ্গ অনেক বেশি নিরাপদ।’ গাছটি বলল।
আমরা হাঁটা শুরু করলাম। আমি মাটি তুলে তুলে হাঁটছি। গাছটি হাঁটছে বস্তা দৌড়ে পা দুখানি বস্তার ভেতর ডুবিয়ে আমরা যেমন করে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটি তেমন করে। ঘরের দরজা যেমন হা হয়ে ছিল, তেমনই আছে। মাঠটা আস্তে আস্তে কচি ফসলে ভরে উঠল। পোয়াতি মাঠ প্রসব বেদানায় প্রথমে একটু খিঁচুনি দিয়ে জন্ম দানের আনন্দ ছড়িয়ে দিলো বাতাসে। মাটি এখন মা। মা-র বুকের অমৃত পান করে খিলখিল করে হেসে উঠছে কচি কচি সবুজ। ফসলের বুকে নদীর মতো ঢেউ খেলে যাচ্ছে ডবকা হাওয়া।
হাঁটতে হাঁটতে দেখি গাছটি উধাও। অন্ধকারের আলোয় বাড়িটা দূর থেকে মনে হচ্ছিল মেলা দিনের পুরনো একটি ধ্বংসস্তুপ। কয়েকটি ভূত ছাড়া আর কেউ থাকে না ওখানে। আমি ঠিক ঠিক মানুষ তো? একজন মানুষ এই মধ্যরাতে মাঠের মধ্যে কি করবে! ভূতের ভয় ডর নেই, আমার এখনও বেশ ভয় ভয় করছে। চাঁদের আলোয় জ্বলে জ্বলে আকাশের গায়ে হালকা জ্বালানো দুধের মতো সর পড়েছে মেঘের। তাই চাঁদের আলো কেমন ঘোলাটে আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আমার এখন কী করা উচিত
বুঝে উঠতে পারছি না। হাতঘড়িটা ঘরে ফেলে এসেছি। রাত মনে হচ্ছে যেখানে রেখে এসেছিলাম সেখানেই আছে। অন্ধকারকে এভাবে থামিয়ে রাখলে রাত নড়বে না। অনন্ত কাল আমার আশ্রয়হীন অন্ধকারে কেটে যাবে। কতকাল এভাবে এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছি কে জানে!
‘চলো একটু হাঁটি।’ অন্ধকারকে বললাম আমি। এখন আর আমাকে নীরব থাকলে হবে না।
‘আমি কতকাল ধরে হাঁটছি! আজ আমি বড় ক্লান্ত। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, জানো? এখন তোমরাই একটু হাঁটো না হয়। আমি একটু জিরিয়ে নিই।’ রাত বলল।
‘ওমা, সেকি করে হবে? তুমি না জাগলে যে আলো আসবে না! তুমি চাঁদের মতো করে হাঁটতে হাঁটতে না হয় একটু ঘুমিয়ে নিয়ো।
‘ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাঁটবো? এদিকের রাস্তাটা বেজায় খারাপ। যদি পড়ে যাই জলে? পারবে তো অন্ধকার ছাড়া বাঁচতে?’
‘তখন ভেতরের অন্ধকারকে না হয় জাগিয়ে তুলবো বিশ্বময়। আমি কতকাল আলোর মুখ দেখিনি!’
‘বেশ, তবে চলো। চলো হাঁটি দু’জনে।’
আমি হাঁটা শুরু করলাম। আগে পিছে অন্ধকার। অন্ধকারের সাথে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন বহুদূর পার হয়ে এসেছি। এতোক্ষণে আমার বাড়ির চারপাশে আলো ফুটেছে নিশ্চয়। এখন সুযোগ বুঝে অন্ধকারের ভেতর থেকে সটকে যেতে পারলেই হয়।
‘আমি খুব ক্লান্ত। তুমি একটু এগোও, আমি এই ধরলাম বলে।’ বললাম আমি।
‘এদিকে আর এগুবো কোথায়? সামনে তো নদী। চলো বরং তোমার ঘরের দিকে ফিরে যায়। তোমার বিছানায় হাত পা এলিয়ে একটু জিরিয়ে নেব ‘খণ, তারপর চলে যাবো। ওদিকটার নদীটাকে কারা যেন গুম করেছে।’
বলে কি! পড়ে গেলাম বড় বেকায়দায়।
‘তাহলে এক কাজ করি বরং। তুমি এদিকটাই একটু বোসো, নদীটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ওদিকটাই হাঁটিয়ে আনি। এই ফাঁকে তুমি কেটে পড়বে।’
‘সেই ভালো। আমি ততক্ষণ জিরিয়ে নিই এইখানে।’
‘চলো একটু হাঁটি।’ নদীকে বললাম আমি।
‘হাঁটবে? আমার আবার বাতের ব্যথা। যৌবনে কত ছুটোছুটি করেছি, এখন আর পারি না যে! তুমি আমার হাতটা একটু ধরো, চেষ্টা করে দেখি। আমি বাপু চোখেও খুব একটা দেখি না আজকাল। ভাঙ্গতে গিয়ে বাবুদের অট্টালিকা গুড়িয়ে দিই পান্তাবুড়ির ভিটাবাড়ি। বয়স হয়েছে তো!’
নদীটার থলথলে শরীর, হাঁটে আর কেমন ছপছপ শব্দ হয়। গলা পর্যন্ত পানি, কথা বলতে গেলেই ছিটকে বের হয়ে আসে খানিকটা। কয়েকটি পানকৌড়ি আর মেটে বক শেওলা সরিয়ে জলগর্ভ থেকে মধ্যরাতের জলখাবার জোগাড় করছে। জলকল্লোলের তালে তাল মিলিয়ে জলকেলি খেলছে চাঁদের চিকন আলো। মনে হচ্ছে, জলের নিচে যেন আরেকটা চাঁদ ফুটেছে। একে অন্যকে ভেংচি কাটছে পাল্লা দিয়ে কিংবা পত্র লিখছে বন্ধুত্বের। আমি জল নিংড়িয়ে এক আঁজলা জল নিয়ে মুখের ওপর আলতো করে ছুঁড়ে মারলাম। আমার দেখাদেখি জলের মাঝখান থেকে মুখে জলছড়া মারলো জলসিক্ত কে যেন।
‘কে তুমি ঐখানে, জলের পোশাক পরে?’
‘আমি জলদেবতা বরুণ। জলেই আমার বাস। মাঝে মাঝে বৃষ্টির লেজ ধরে মেঘের দেশ ঘুরে আসি। মেঘের গায়ে কখনও হাতির লম্বা শুড় দেখেছ? রাখালের মাথাল? এক দল বাছুর? ওগুলো আমিই এঁকে দিয়ে আসি। মাঝে মধ্যে দেবতা ইন্দ্রও সঙ্গ দেয় আমাকে।’
‘ওহ! তোমাদের আর কাজ নেই বুঝি?’
‘না। আগে ছিল। এখন আর কেউ মানতে চায় না। দেবতা তো, তাই মৃত্যুও হয় না! এখন দেশে নদী নেই, জল নেই, এই অল্প জলেই আমরা গাদা গাদা দেবতা গা ঠাসাঠাসি করে থাকি।’
‘যদি দেশে আর একদম জল না থাকে, তখনও কি তোমাদের মৃত্যু ঘটবে না?’
‘না। দেবতারা মৃত্যুহীন, অভিশপ্ত। তখন হয়ত আমরা মেঘের দেশে হারিয়ে যাবো। অনেকেই তো গা ঢাকা দিলো ওখানে!’
‘চলো একটু হাঁটি।’ জলদেবতা বরুণকে বললাম আমি।
আমরা হাঁটতে থাকি। নদীর সেই লম্বা শরীর! আমরা হাঁটতেই থাকি।
উৎসর্গ : দেবেশ রায়; তাঁর ‘পায়ে পায়ে’ গল্পটির জন্যে।