Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ইট’স নট আ লভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট

সোহম দাস

 

“ক্রিকেট মানে ছয়, চার, আউট! আর ফুটবল মানে শুধুই গোল!”

মা শিখিয়েছিল! একটা বয়স অবধি মায়েরাই সবকিছু শেখায়! যেগুলোতে তাদের বিশেষ দখল থাকে না, সেগুলোও! আমার সাইকেলেও হাতেখড়ি মায়ের হাতে! মা আরও শিখিয়েছিল — ফাউল মানে ইচ্ছে করে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়া! অথচ, মায়ের সাথে ফুটবলের বিশেষ সখ্যতা কোনোদিন ছিল না! ছোটবেলায় গ্রামে থাকাকালীন বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে ক্লাবের কয়েকটা ম্যাচ মাঠে বসে দেখা ছাড়া ফুটবলটা মায়ের ওই আমার জন্য সকাল সাতটার ভাত কিংবা বাবার জন্য দশটায় অফিসের ভাত, দুপুরের সিরিয়াল বা সন্ধের আমাকে পড়ানো, বকুনি এসবের ঘুলঘুলি দিয়ে সেরকম ঢোকার সুযোগ বা সাহস কোনটাই পায়নি! অথচ সেই মা-ই শৈশবের আমি-কে ফুটবলের দুটো ধ্রুব সারাংশ বুঝিয়ে দিয়েছিল তার ওই স্বল্প জ্ঞান দিয়েই!

আবছা কয়েকটা স্মৃতি! যেমন শিউ মেওয়ালাল! ওই গ্রামের মামারবাড়িতে সেবার ভাগ্যধর শীল্ডের বিশেষ অতিথি হয়ে এসে দাদুর বাড়িতেই মধ্যাহ্নভোজ সেরেছিলেন যিনি! ভারতের সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকার! দু’পায়েই গোলার মত শট নিতেন শুনেছি! নামটাও জেনেছি ঠিক আটবছর পরে যখন মেওয়ালাল পরপারে চলে গেলেন তখন! সেই মেওয়ালালের নাতি বিবেকলালকেই বেশি মনে আছে! যে বারবার ফোন নাম্বার নেওয়ার কথা বলছিল ম্যাচটা দেখতে দেখতে! ‘হাথ দে, লিখ দিছি!’ কিংবা আরেকটু পরে! যখন টিভি বলতে শুধুই টম অ্যান্ড জেরি! অথবা স্কুবি ডু! রবিবারের দুপুরে টম অ্যান্ড জেরি! বিকেলগুলোতেও! সেই বিকেলগুলো হঠাৎ দেখলাম আমার থেকে হারিয়ে গেল! তার বদলে এল একটা জটিল উন্মাদনার বহর! সেটাও একটা রবিবারই ছিল! প্রায় সন্ধে নেমে আসার মুখে। চিৎকার শুনছি পাড়ার এখান-ওখান থেকে! অথচ ইন্ডিয়ার খেলা নয়! মায়ের ডাক ওপর থেকে! একটা লোক! মাথার সামনের দিকটায় শুধু চুল! আমার লুটোপুটি খাওয়া হাসিতে! গোলকিপারটা ধরতে পারেনি বলটা! আচ্ছা, একেই তাহলে গোলকিপার বলে! গোল আটকায় যে! ক্রিকেটে উইকেটকিপার যেমন গ্লাভস পরে থাকে! গোলকিপার-উইকেটকিপার! কিপার মানে রক্ষক! শিখে নিলাম, শিখে যাচ্ছি! ও, ওই অদ্ভুত চুলের স্টাইলওয়ালা লোকটার কথায় ফিরি! লোকটা একটা গোল করে দিয়েছে! সেটাকে আরেকবার দেখাচ্ছে! তখনও রিপ্লে কথাটা শিখিনি যে! কিছুক্ষণ বাদেই আবার একটা দিল! গড়িয়ে গড়িয়ে বলটা ধরতে পারল না? ধুস! সাথে আমার ঘ্যানঘ্যানানি! “কার্টুন নেটওয়ার্কটা একবার দাও না, পাওয়ারপাফ গার্লস হচ্ছে তো!” আর ওদিকে চিৎকার! মায়ের বোঝানো — “এই দ্যাখো না, ব্রাজিল জিতল বিশ্বকাপ!” ধুত্তেরি নিকুচি করেছে ব্রাজিল! ওদিকে মোজোজোকে ওরা কী করে ঘায়েল করবে আমার সেই চিন্তা! তবে ওই কাঁচা বয়সে আমি একটা জিনিস বুঝেছিলাম — ব্রাজিল খেললে আমার পাড়ার রাস্তা ফাঁকা হয়ে যাবে, ব্রাজিল গোল দিলে চিৎকার উঠবে থেকে থেকে, ব্রাজিল জিতলে বিজয়মিছিল বেরোবে! সেই ব্রাজিল! সেই লোকটা, দুটো গোল করল যে, পতাকাটাকে সারা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিল! তার ভালোবাসার ব্রাজিল! আমার ভালোবাসার ব্রাজিল! তবু ভালোবাসা একদিনে আসেনি! আমি যে অনেকদিন, অনেকদিন কেন, অনেকবছর অবধিই জানতাম, ম্যাচটা হয়েছিল ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার! জার্মানি বলে যে একটা দেশ খেলে সেটা পরে, অনেক পরে!

জার্মানিকে কবে খেলতে দেখলাম প্রথম? ২০০৬! আমার জন্মদিন! সেদিনই খেলা শুরু! নাঃ, তারও আগে কিছু আছে! ওই বিক্ষিপ্ত, তবে টাটকা! আবছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারব সহজেই! কারণ তখন আমি সেকেন্ডারিতে উঠেছি! পেকে ঝানু হওয়ার প্রথম ধাপ! যে বয়সে আমার পাগলা দাশুতেও হাতেখড়ি হয়েছিল! যে বয়সে আমি ক্রিকেট গুলে খাচ্ছি! ভারতের ম্যাচ না হলেও চলে! যেকোনো প্রান্তের ম্যাচ! কাউন্টি, দলীপ, রঞ্জি — সব চলে আমার! ক্লাস ফাইভ! ও-এ-এ-এ-ও! এরকম একটা সুর! রোজ সকালে বন্ধুরা এটা গাইত! চেষ্টা করত! অনাবিল! খুব খেলা বুঝত ওই বয়সেই! ২০০৩ বিশ্বকাপটা ওর বোঝার চোখ দিয়েই অনুধাবন করেছি! সেই অনাবিল! স্কুলবাস! আমাদের চলন্ত রোয়াক! একবছরের জুনিয়র দেবম! দেবমকে বলছে, আমার মনে হচ্ছে ইউরো কাপটা জিততে পারে গ্রিস! দেবম মানতে নারাজ! না না, কী করে পারবে! স্পেন আছে না, ফ্রান্স-ইংল্যান্ড এরা আছে না! শেষপর্যন্ত অনাবিলের কথাই সত্যি হল! আমার গুটিয়ে যেতে ইচ্ছা হত! আমি যে ক্রিকেট ছাড়া অন্য কিছু বুঝি না! ওদের মতো আলোচনা করতে পারি না! জানিই তো না আদ্ধেক প্লেয়ারের নাম! আমি আসলে আরও অনেক কিছুই জানতাম না! খেলা দেখতাম না! কী করে দেখব! সব খেলা হয় তো রাত্রে! রাত জেগে দেখলে পরদিন সকালে ওঠা অসম্ভব! তাই বুধবার রাতটা বেছে নেওয়া! বৃহস্পতিবার ক্যাথলিক স্কুলের বন্ধ থাকার দিন! অতএব, মিশন সেমিফাইনাল! পর্তুগাল আর, আর, এটা আবার কী নাম রে বাবা! নেদারল্যান্ডস! তবে কাগজে যে দেখলাম হল্যান্ড লেখা! আর ওদের তো কমলা রঙের ড্রেস দেখলাম! এরা আবার সাদা পরেছে কেন! কী ভজকট ব্যাপার! এদের একটা ক্রিকেট দলও আছে না? দুটো গোল! নেদারল্যান্ড না হল্যান্ড, ওই কী দেশ যেন, ওদের গোলটা পর্তুগালেরই কার একটা পায়ে লেগে ঢুকে গেল! মাঝরাত্রে ঘুম-জড়ানো চোখে বাবা এল! ‘নেদারল্যান্ড মানেই তো হল্যান্ড!’ যাব্বাবা, একই দেশের দুটো নাম! আমাদের দেশেরও দুটো নাম, ইন্ডিয়া বলি ইংরাজিতে, ভারতবর্ষ বলি বাংলায়, ইজিপ্ট বলি ইংলিশে, মিশর বলি বাংলায়! ২-১! ধুর, ও স্কোরে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই! আমি বন্ধুদের বলতে পারব, আমিও রাত জেগে খেলা দেখেছি, জানিস! তবে একটা নাম খুব মনে গেঁথে গেল! লুইস ফিগো! একটা গোলও করেছিল বোধহয়! এটা আরও স্পষ্ট মনে আছে, কারণ, পরেরদিন মা দুপুরে একটা ক্যুইজ কন্টেস্ট দেখছিল টিভিতে! সঞ্চালিকা জিজ্ঞাসা করছেন, লুই ফিগো নামটি কোন খেলার সাথে যুক্ত? আমার লাফিয়ে ওঠা! উত্তরটা যে আমি কাল রাত্রেই পেয়ে গেছি! ‘মা, ফুটবল! কালকে একটা গোল করেছে! ফুটবল, ফুটবল!’ মায়ের নির্লিপ্ত জবাব — জানি রে বাবা, আজকে পেপারে বেরিয়েছে!

সেবার ইউরোর সাথেই কোপা আমেরিকাও চলেছিল! ওটার শুধু নামটাই শুনেছিলাম! বস্তুটা কী আর দেখিনি! পরে যখন ভূগোলে জেনেছি ব্রাজিল, আর্জেন্তিনা এগুলো দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর আবিষ্কার করেছি, ইউরোপের ‘প’-টা বাদ দিলে ইউরো হয়ে যায়, তখন নিজেই বুদ্ধি খাটিয়ে বার করে ফেলেছি কোপা আমেরিকায় ব্রাজিল-আর্জেন্তিনা খেলে আর ইউরোতে খেলে ইউরোপের দলরা! তারপর ইএসপিএন! একটু ক্রিকেট দেখার আশায়! নাঃ! কীসব বার্কলে’স ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ হাবিজাবি দেখায়! দুটো দলের নাম প্রথম জেনেছিলাম! চেলসা আর ওয়েস্ট ব্রম! আমার ‘চেলসা’ থেকে ‘চেলসি’ হয়েছে আরও পরে, আর ওয়েস্ট ব্রম থেকে ব্রমউইচ এইতো সেদিন! রোনাল্ডো নামটার প্রতি একটা তৈরি হওয়া টান! ব্রাজিলেও খেলে, পর্তুগালেও খেলে! বাহ, দুটো একই নামের প্লেয়ার দুটো দলে! আবার আকাশদীপ বলে দিল, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডেও খেলে! বাবাহ, তিনজন রোনাল্ডো! ওই তিনজনটা দুজন হয়েছে চেলসা চেলসি হওয়ার সময়েই! কাট টু ২০০৫-এর মে মাসের একটা গরম রাত্রি! মামারবাড়ির দালানে! বড়মামা বলল, চল আজকে খেলা আছে দেখব! গরমের ছুটি! অতএব, রাত জাগতে কোনও বাধা নেই! লিভারপুল আর এসি মিলান! তিন গোল দিয়ে দেওয়া! প্রথম মিনিটেই চুলওড়া একটা লোকের গোল! মামা সমানে বলে যাচ্ছে, নাঃ, আর দেখে কী হবে! তিন গোলে পিছিয়ে গেছে আর কিছু হবে না! আমিও সেরকমই ভাবছি! হাফ টাইম চলাকালীন মামা ঘুমে ঢুলে পড়ছে! হাফটাইম শুরু হল! কিছুক্ষণ বাদেই মেঝেতে বসা আমি — “বড়মামা, গোল! ওঠো!” আমার চেঁচানিতে মামার তন্দ্রা ছুটে গিয়ে ভ্রূকুঞ্চন! মামা জিগ্যেস করছে — কে গোল করেছে? আমি পিঠের জার্সিটা দেখে বললাম, গেরার্ড নামের একজন! মামা আরেকটু ভালো করে দেখে নিয়ে বলল, জেরার, জেরার, ওদের ক্যাপ্টেন! তারপরেই বেশ একখানা ব্যাপার! ওই গেরার্ড নামের লোকটা, লোক বলব নাকি ছেলে, কি বাচ্চা বাচ্চা দেখতে, যাইহোক, সে দেখি দৌড়চ্ছে হাতদুটোকে চিয়ার আপ করতে করতে! ওই সদ্যকিশোর বয়সেই কিন্তু ওই দৃশ্যটা আমার গায়ে কাঁটা ধরিয়ে দিয়েছিল! স্টিভেন জেরার, হ্যাঁ, স্টিভেন জেরারই আমার এই জার্নির পথটাকে দীর্ঘ হতে দিয়েছেন! প্রথম ভালো লাগাটা আমায় স্টিভেন জেরারের ওই হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে দৌড়টাই এনে দিয়েছিল, প্রথম দেখা অদ্ভুত চুলের স্টাইলওয়ালা রোনাল্ডো নাজারিওর পতাকা জড়িয়ে নেওয়াটা নয়! তারপরের গোলটা! স্মাইসার না কী একটা নাম! পরে জানলাম স্মিৎসার, ভ্লাদিমির স্মিৎসার! শেষ ম্যাচ ছিল! লিভারপুলের হয়ে! পরে জেনেছি, প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, শেষ ম্যাচটা স্মরণীয় করে তবেই মাঠ ছাড়বেন! ২০ ফুট দূর থেকে মারা ওই স্মারকলিপিটা! মামা শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসেছে ততক্ষণে! তারপরে একটা পেনাল্টি! পেনাল্টি কখন হয়? মামা বলল, ওই দ্যাখ চারকোণা বক্সটার মধ্যে ওর পায়ে মেরে ফেলে দিল বলে পেনাল্টি দিল! জাবি আলন্সো! ডান পা দিয়ে মারা শট আটকে দিল, ছুটে গিয়ে বাঁ পায়ে গোল! বাবাহ, এরা দুটো পায়েই সমান দক্ষ! পরেরদিন স্টার আনন্দে খেলার নিউজে ওই একটা খবর সরতে সরতে যাবে — চ্যাম্পিয়ন্স লিগে লিভারপুলের খেতাব জয়। তারপর দেখব ওদের গাড়ি যাচ্ছে লাল ফিতেয় মোড়া! গোলকিপারটার নাম কী, না দিদা! ট্রাইবেকার! চেষ্টা করতে হয়, মানে ওই পেনাল্টিগুলো চেষ্টা আরকি! তাই তো নাম দিয়েছি ‘ট্রাইবেকার!’ কিন্তু সেসব ভুলে গিয়ে পরেরদিন সকালে উঠে দিদিমার সাথে মস্করা করার সুবর্ণ সুযোগ খুঁজছে তখন কিশোর — ‘তুমি কাল কী বাজে গোলকিপিং করলে গো!’

নাম-মাহাত্ম্য! রস-রসিকতা! তার কয়েক মাস বাদেই আরেকটা অমন নাম! কাকা! পেপারে চুনী গোস্বামীর কলাম! কাকা আবার কে? কার কাকা? বাবা বলল, কাকা প্লেয়ার! ও, আমার ব্রাজিল! আর্জেন্তিনাকে ৪-১! কনফেডারেশন কাপ! তারপর ফুটবল মানে আমার কাছে বহুদিন ছিল কমল গুহর দাঁতে দাঁত চাপা লড়াই! ও, জার্মানির কথা বলছিলাম না? সেই জার্মানি! জন্মদিন! ৯ই জুন! বারো! সাঁতারের পুলে অনাবিল বলল, আজকে জার্মানি আর কোস্টা রিকা! মায়ের কিনে দেওয়া ফুটবলটা! ঠাকুমার সাথে শেষ জন্মদিন! আর জার্মানি! দুটো নাম! ফিলিপ লাম! কাট করে ঢুকে এল! গোল! আর একটা ক্লোজ! কিন্তু বানানটা তো ইংরাজি ‘close’-এর মত নয়! যাইহোক, সুবিধাই হল ‘C’-র বদলে ‘K’ মানেই ওই জার্মানির প্লেয়ারটা! ওই বিশ্বকাপটা! দাঁতউঁচু রোনাল্ডিনহোর সাথে পরিচয়, পরিচয় সুদর্শন কাকা, পরিচয় ক্যাপ্টেন কাফুর সাথেও! ‘রোনাল্ডিনহো আঙুলটাকে এইরকম করে একটা সেলিব্রেশন করে না?’ সাথে সাথে জীবনে ক্ষয়ে ক্ষয়ে আসা একটা মানুষ! এক সপ্তার জ্বর! কীরকম যেন সবাই বুঝতে পেরে গিয়েছিল এই বুঝি শেষ! ২১শে জুনটা মনে আছে! ভূগোলে সদ্য পড়া কর্কট-সংক্রান্তি! ঠাকুমা নেই! ক্যাওড়াতলা থেকে ফিরে এসে নেদারল্যান্ডস-আর্জেন্তিনা! দাদুর সাথে! মেসি খেলেছিল কি? না বোধহয়! তবে যে খুব শুনছি ওর নাম! কৌস্তভ আর্জেন্তিনার বড় ভক্ত! ক্লাস মনিটর! জেল পেন দিয়ে হাতে লিখেছিল মেসির নাম! তারপর স্যার এসে সকলকে যখন ধরছে, কৌস্তভ আস্তে করে বেঞ্চে বসে ঘষে ঘষে তুলে ফেলছে নামটা! মনিটর হয়ে শাস্তি পেলে প্রেস্টিজ পাংচার! স্বপ্নের নায়ক স্বপ্নেই থাক! ম্যাচ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়া! ঠাকুমাকে মনে করতে করতে কি? মনে নেই আর! তারপর সেই ম্যাচ! যে দু’দলের ম্যাচ দিয়ে আমার রাত জেগে ফুটবল খেলা দেখার উদ্বোধন হয়েছিল, যে দু’দলের ম্যাচ দেখার দিন আমি জানতে পেরেছিলাম হল্যান্ড আর নেদারল্যান্ডস একই বা একই দলের অনেক রঙের জার্সি হয়, যে দু’দলের ম্যাচ দেখে আমি সর্বকালের সেরা প্লেমেকারের নামটা জেনে পরেরদিন ক্যুইজের প্রশ্নে লাফিয়ে উঠেছিলাম, তাদের সেই কালান্তক ম্যাচটা! ষোলোটা ইয়েলো কার্ড, চারটে লাল কার্ড! এবারও পর্তুগালের জয়! তারপর জার্মানি-আর্জেন্তিনা! ড্র! অতএব টিভি বন্ধ! আমি তো জানি না, এটা নক-আউট ফেজের ম্যাচ! এখানে ফলাফল-সর্বস্বতা! মাইকেল বালাক! পরেরদিন স্কুলবাসে শুনলাম আর্জেন্তিনা হেরে গেছে! অনাবিল আর কৌস্তভের উত্তেজিত আলোচনা! পেকারম্যানের ট্যাকটিক্স নিয়ে! বাপরে, কত কী জানে! আমি শুধু জানি, আর্জেন্তিনা ছিটকে যাওয়ার একটা আনন্দ আছে! পর্তুগালকে আবার দেখলাম! ঠাকুমার শ্রাদ্ধের আগেরদিন! ছোট রোনাল্ডোকে প্রথম দেখলাম! বেশ সুন্দর দেখতে, কোঁকড়ানো চুল! আর রুনি! সেই খবরের কাগজের হেডলাইনটা ‘যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন রুনি’ থেকে যার নামটা জানা! এছাড়া বেকহ্যাম, যার নামও ‘স্ত্রীর কাছে দোষ স্বীকার করলেন বেকহ্যাম’ হেডলাইন থেকে জানা, তারপর ইকুয়েডরের বিরুদ্ধে সেই ফ্রি-কিকটা! তারপর ওই জেরার, ল্যাম্পার্ড — সবার নাম তদ্দিনে জেনে গেছি! হঠাৎ করেই ইংল্যান্ডের ভক্ত সংখ্যা বেড়ে যাওয়া! রুনির ধাক্কাটা রোনাল্ডোকে! লাল কার্ড! যেটা নিয়ে পরে আনন্দবাজারে ‘ছোট রোনাল্ডোকে দু’টুকরো করে ফেলার হুমকি রুনির’। অনাবিল বলল, কিছু হবে না, রুনিকে মিডিয়া খেপিয়ে দিয়েছে! বেকহ্যামের চোট পেয়ে বেরিয়ে গিয়ে কান্না! আর সেই ঢ্যাঙা লোকটা! ল্যাকপ্যাক করতে করতে ছুটত! ছ’ফুট সাত ইঞ্চির পিটার ক্রাউচ! তীরকাঠি, লম্বু, কত নাম! পারল না ইংল্যান্ড! টাইব্রেকার! আর আমি ট্রাইবেকার বলি না! দাদুর এই স্বগতোক্তিটা — “বেশ হয়েছে ইংল্যান্ড বেরিয়ে গেছে, বড্ড মারামারি করে খেলে! সেই ৬৬-তে, পেলেকে একেবারে মেরে বার করে দিল! এই ইংল্যান্ড আর ওদিকে নেদারল্যান্ডস!” — এটা থেকেই একটা ধারণা সুস্পষ্ট হয়েছিল! ইংল্যান্ডের ওপর একটা প্রচ্ছন্ন রাগ আমাদের আজন্মলালিত! সেইকারণে ’৬৬-তে ইংল্যান্ড-ব্রাজিল মুখোমুখি না হওয়া সত্ত্বেও, পেলেকে ‘মেরে বের করে’ দেওয়ার পেছনে আসলে বুলগেরিয়ার দব্রোমির জেচেভ বা পর্তুগালের জোয়াও মোরাইসের হাত থুড়ি পা থাকলেও দোষের ভাগী সেই হতে হয় বেচারি ইংল্যান্ডকেই! যেটা পরে বুঝেছি, এটার সৌজন্যে আসলে ওদের ‘খেপিয়ে দেওয়া’ মিডিয়া! তারপর সেইদিন রাত্রে! তার আগে অনেক ম্যাজিক শো দেখেছি! ম্যাজিশিয়ানের ভেল্কি দিয়ে এনে দেওয়া চকলেটও ভয়ে ভয়ে খেয়েছি! কিন্তু সেই রাত্রে দেখলাম অন্য একটা ম্যাজিক! বল নিয়েও ম্যাজিক হয়! যখন একটা লম্বা টাকমাথা লোক, ভাবলেশহীন চোখমুখ নিয়ে দু’পায়ে করে বলটাকে নাচায়, সঙ্গে নাচিয়ে ছাড়ে বিপক্ষ খেলোয়াড়দেরও, তখন সেটা হয় ‘ম্যাজিক উইথ এফোর্টলেস ব্রিলিয়ান্স!’ আমার ব্রাজিল হেরে যাচ্ছে, কিন্তু আমি প্রেমে পড়ছি! প্রেমে পড়ছি এক শিল্পীর, যার শিল্পে স্বর্গীয় নৈবেদ্য! এখনও কানে ভাসে কমেন্টেটরের গলাটা! আকুতি মেশানো! ‘প্লিজ, ডোন্ট গিভ আপ ফুটবল!’ লোকটা নাকি খেলা ছেড়ে দেবে বিশ্বকাপের পরেই! আসলে জানতাম না, শুধু বিশ্বকাপটার জন্যেই আবার ফিরে এসেছিল অবসর ভেঙে, এবার আর ভাঙার কোনও প্রশ্ন নেই! নিয়মভঙ্গের পরেরদিন ফ্রান্স-পর্তুগাল! ছোটমামা! একা খেলা দেখছিল! বলল, জিদান পেনাল্টি থেকে গোল করেছে! আবার সেই লোকটা! পরেরদিন! আমরা সবাই ধরে নিয়েছি জার্মানি জিতবেই! আমাদের কৈশোর চাপল্যের যুক্তি হিসাবে ‘ওদের নিজেদের মাঠ, ওরা সব জানে’! ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! ঘুম ভাঙল, তখন এক্সট্রা টাইমের শেষ! হঠাৎ গোল! জার্মানির কেউ কিছুই করতে পারল না! কিছুক্ষণ পরে আবার একটা! যাঃ, আমাদের যুক্তি খাটল না! তারপর থার্ড প্লেস ম্যাচটা! অলিভার কানের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ! আরে! এই লোকটাকেই চারবছর আগের সেই রবিবারে দেখেছিলাম না? পরেরবছর আমার শহরে খেলতে এল লোকটা! জীবনের শেষ ম্যাচ! মোহনবাগানকে ৩-০ দিল! তুমুল বৃষ্টির মধ্যে মেঝেতে বসে দেখলাম থার্ড-প্লেস ম্যাচটা! পরেরদিন ফাইনালটা! সব আত্মীয়স্বজন চলে গেছে সেদিন! সদ্য মৃত্যু ঘটে যাওয়া একটা বাড়ি! থমথমে! ফ্রান্স তো জিতছেই! জিদান আছে না! পেনাল্টিটা! ওহ, কী সুন্দর চিপ তুলে মারল! তারপর ওদের শোধ! আলো জ্বালিয়ে রেখে একা একা দেখে যাওয়া জীবনের প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনাল! যতবার বাথরুম পেয়েছে, দেওয়ালের দিকে মুখ করে গিয়েছি! বাথরুমের সোজাসুজি ঠাকুমার ঘরটার দিকে তাকাইনি! সাহস হয়নি! কী জানি, যদি দেখি ঠাকুমা এখনও চাদর-মুড়ি দিয়ে…ঢুসোটা লাইভ মনে নেই! রিপ্লেটাই! তারপর সেই লাল কার্ড! হার! ইতালি! আনন্দমেলা! ‘রোমে গেল বিশ্বকাপ’, ‘জিদানের জবাব নেই’! আনন্দবাজারের প্রথম পাতায় ‘লিপ্পির কাজ শেষ, বিদায় নিচ্ছেন ক্লিন্সম্যানও’। বরাবর এই হেডলাইন মুখস্থ করে ফেলার রেওয়াজ! আজও ছাড়তে পারিনি!

এরপরের সময়টুকু একটা ট্রানজিশন! ওই জিদানের সূত্রে জেনে ফেলা রিয়াল মাদ্রিদ, মেসি-রোনাল্ডিনহোর সূত্রে জেনে ফেলা বার্সেলোনা, বালাক-শেভচেঙ্কোর দৌলতে চেলসা-ও ততদিনে চেলসি! ‘আজ রোনাল্ডিনহো-মেসি বনাম বালাক-শেভচেঙ্কো’। ওই হেডলাইন চিনে চিনেই শিখতে থাকা! ২০০৭-এর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে আবার শুনলাম দু’বছর আগের রিপ্লে হতে চলেছে! এবার অবশ্য এসি মিলানই জিতল! পাওলো মালদিনিকে চিনে ফেলেছি ততদিনে! শুনেছি তাঁর ক্যাপ্টেন্সির কথা! মোটিভেশনাল ক্যাপ্টেন! সেবারের কোপা! ব্রাজিল হেরে গেল মেক্সিকোর কাছে! মেসি ওদিকে চূড়ান্ত খেলছে! কৌস্তভের আকাশে উড়তে থাকা! তারপর রোবিনহো নামের এক ধূমকেতুর উত্থান! চিলির বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিকটা! সেবার চিলিকে যখনই পেয়েছিল, ছিঁড়ে খেয়েছিল! কোয়ার্টার ফাইনালে ৬-১-এর দিনও রোবিনহোর পা থেকে দু’খানা! সেমিফাইনালে মেক্সিকোর বিরুদ্ধে মেসির ওই চিপটা! আহাহা! আনন্দমেলায় ‘নতুন মারাদোনা?’ কৌস্তভ কিনেই আগে ওটা পড়েছিল! তারপর ফাইনালে আয়ালার সেমসাইড! ব্রাজিলের ৩-০ গুঁড়িয়ে দেওয়া আর্জেন্তিনাকে! এই কৌস্তভই খেপে গিয়ে বলে-ক্যাপ্টেন সেমসাইড করছে, এই টিমকে কেউ সাপোর্ট করে! সেবার মহিলা বিশ্বকাপেও ফাইনালে উঠেছিল ব্রাজিল! জার্মানির কাছে হারল! ০-২! মার্তা নামের সেই মেয়েটা! পেনাল্টিটা মিস করেছিল! এই ট্রানজিশন পিরিয়ডে রয়েছে ‘ম্যান ইউ’ মানে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড! ততদিনে আমি এটাও জেনে গিয়েছি, সেবার ওই কোয়ার্টার ফাইনালে দুই ঝামেলাকারীর দুজনই খেলে একই ক্লাবে! ভয়ংকর আক্রমণের পুরোভাগে ওই দুজনই থাকে! দেখতাম ওই ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো উইং ধরে দৌড়চ্ছে! পায়ে চিতার গতি! ‘প্রিমিয়ার দ্বৈরথে জয়ী ম্যান ইউ’। আসলে সেই বয়সে আমার ফুটবলটা জানা বা বোঝা যতটা না দেখে, তার চেয়েও বেশি অনাবিল-কৌস্তভদের আলোচনায় বা আনন্দমেলার সবুজ পাতাগুলো থেকে! তাই হয়ত খেলা না বোঝার আগেই শুধু খেলা দেখে মোহিত হওয়াটা আমার মজ্জাগত হয়ে গিয়েছিল! যেকারণেই আমি একদিকে যেমন স্টিভেন জেরারের ওই হাত ছড়ানো দেখে ভক্ত হয়েছি লিভারপুলের খেলার, আরেকদিকে রোনাল্ডোর গতিময়তা আমাকে ভক্ত করেছে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের!

২০০৮-এর বৃষ্টিভেজা ইউসিএল ফাইনালে জন টেরির পেনাল্টি মিসটা, বা স্পেনের ইউরো জেতা থেকে আরেকটা অধ্যায় শুরু! সেই অধ্যায়টাতে থাকছে ফুটবল ম্যাচগুলো দেখে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা! ২০০৯-এর বার্সেলোনার হারিয়ে দেওয়া ম্যাঞ্চেস্টারকে, বা তার কিছু পরেই রোনাল্ডোর রিয়াল-পাড়ি! আনন্দমেলার ক্রেজ তখনও কিন্তু পুরোদমে! রোনাল্ডো তার আগেরবার ফিফার বর্ষসেরা খেলোয়াড়! সাথে সেই মেয়েটা! ফাইনালে পেনাল্টি মিস করেছিল যে! সেই মার্তা! যার সম্বন্ধে ‘ফুটবলে সোনার মেয়ে মার্তা’-র ছোট্ট একটা আর্টিকল পড়েছিলাম! আশ্চর্য এই, এতদিন আগেকার সব ছুটকো-ছাটকা হেডলাইন আজও দিব্যি মনে আছে! মুখস্থ করে ফেলাটা কাজে আসছে! ২০১০ বিশ্বকাপটা আমার কাছে সমগ্র ফুটবলবিশ্বকে নিয়ে এল! ততদিনে আমি রিয়াল মাদ্রিদ! না, রোনাল্ডো, কাকা গেছে বলে নয়! ওই বক্স-টু-বক্স তিন-চারজনের চমৎকার পাসিং গেম খেলতে খেলতে উঠে আসার কয়েকটা ঝলক দেখে! ব্রাজিল, পর্তুগাল, আইভরি কোস্ট, উত্তর কোরিয়া একই গ্রুপে! ‘প্রথম পরীক্ষায় উতরোলেন না দুই বন্ধুর কেউই’। রোনাল্ডো আর কাকা! দুজনের ভূপতিত ছবি! পাশাপাশি! সদ্য-মাধ্যমিক পাশ থেকে তারুণ্যের হাতছানির সময়কার বিশ্বকাপ! উন্মাদনার পূর্বাভাস! জাভি-ইনিয়েস্তার মাঝমাঠ শাসন, ফোরলানের সৃষ্টিশীল প্লে-মেকিংয়ের সাথে ধ্বংসাত্মক ফিনিশিংয়ের অদ্ভুত মিশেল, দাভিদ ভিয়া (ভিলা নয়; ডবল এল থাকলে সাইলেন্ট থাকে জেনে নেওয়া)-র গোলবিপ্লব, জার্মানির পোডোলস্কি, ক্লোজে (আর আমি ক্লোজ বলি না), মুলার, কাকা, ওজিল কিংবা মাইকনের ওই জিরো অ্যাঙ্গেলের গোলটা, ল্যাম্পার্ডের ন্যায্য গোল বাতিল, যার সূত্র ধরে জিওফ হার্স্ট, রবার্ট গ্রিনের বল ফস্কানো — সব তখন এসে মিশ খাচ্ছে ফুটবল-চেতনায়!

ডিটেলিংয়ের সময় পার করে এসেছি! এখন শুধুই টাইম-ট্র্যাভেলের পরাবাস্তববাদিতা! যেখানে আস্তে আস্তে জায়গা করে নিচ্ছে ইউরোপের ক্লাব-ফুটবল! আবার ‘স্ট্রাইকার’ প্রসূনের বাবার অপমানের মধুর প্রতিশোধও থাকছে, কিংবা থাকছে ‘ফেরারী’-র পেনাল্টি মিস করে লুকিয়ে বেড়ানোর সন্ত্রস্ততা! আমাদের খেলার দুনিয়ায় মতি নন্দী বড় বেশি করে ছিলেন! যাইহোক, সেই ক্লাব ফুটবল! ২০১১-র চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালটা! বার্সেলোনা-ম্যান ইউ! ৩-১! সবই জানতাম! যেটা জানতাম না, সেটা হচ্ছে ক্যান্সারকে হারিয়ে ফিরে এসে অসাধারণ খেলা এরিক আবিদালের হাতেই ট্রফিটা তুলে দিয়েছিলেন কার্লেস পুওল! এই সেই পুওল, যার হেডটা…নুয়ের নড়তে পারেনি! সেই বার্সা যারা কখনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নোয়ায়নি! রক্তপিপাসু একনায়ক ফ্রাঙ্কোর বিরুদ্ধে গিয়ে যারা কথা বলেছে কাতালানবাসীর জন্যে, যাদের জন্যে একসময় জোহান ক্রুয়েফ খেলতে এসেছিলেন এই বলে যে ‘রিয়ালের মতো দল যেখানে ফ্রাঙ্কোর প্রতিপত্তি সেখানে আমি যাব না, আমি যাব বার্সেলোনায়’ — এসব আগে কেন যে জানার চেষ্টা করিনি! এই ক্রুয়েফ, অপরিসীম জ্ঞানের আকর, ধ্যানমগ্ন এক ফুটবল-সাধক, যিনি আবার পরবর্তীকালে এটাও বলবেন — ‘স্বৈরাচারীর দেশে বিশ্বকাপ খেলতে আমি যাব না’, আমি নিশ্চিত এঁর সময়ে জন্মালে হয়ত ‘মারামারি’-র নেদারল্যান্ডসের প্রতি এই ঘৃণাটা তৈরি হত না! বললাম যে, টাইম-ট্র্যাভেল! তাই কোনও বিশেষ সময়জ্ঞান রাখবার প্রয়োজনবোধ আমি করব না! যে কারণে ২০১২-র ইউরোতে রোনাল্ডোর নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে ওই ঘুরে দাঁড়ানো খেলা বা পির্লোর পানেনকা কিক আমাকে একইসাথে ইউসেবিও আর চেকোস্লোভাকিয়ার হারিয়ে যাওয়া গরিমায় ফিরে যেতে বলবে! উত্তর কোরিয়ার সাথে ০-৩ পিছিয়ে থাকা অবস্থা থেকে ইউসেবিওর চার গোল আর একটা অ্যাসিস্ট! কিংবা জার্মানির সাথে পেনাল্টি কিকটা! আঁতোয়া পানেনকা! তারপর যেখানে থাকব আবার সেখানে ফিরে এসে ফিরব অতীতে! আমার ফুটবল-যাপন এভাবেই চলে! ওই পির্লো! যাকে আবছা মনে আছে, সেই রাত্রে ঘুম থেকে উঠে এসে দেখেছিলাম একটা পাস দিয়েছিল! ও, দিদিয়ের দ্রোগবা! কী করে ভুলি! চেলসিকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতিয়ে ট্রফিটা নিয়ে সারা মাঠ দৌড়! সেবারেই! এই দ্রোগবাই আবার একদিন যুদ্ধ থামিয়েছিল!

এই টাইম-ট্র্যাভেলটা আবার অন্যভাবেও ভাবা যেতে পারে! যেমন আমি যদি ফিরি ওই যখন নাৎসি জার্মানি দখল করছে অস্ট্রিয়া, তখন অস্ট্রিয়া ফুটবল দলকেও খেলতে বাধ্য করছে জার্মানির হয়েই! মাথিয়াস সিন্ডেলার তখন হয়ে উঠছেন অস্ট্রিয় জাত্যাভিমানের মুখ, নাৎসি-বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মুখ, তারপর প্রেমিকার সাথে নিজের বাড়িতেই দগ্ধ হয়ে যাওয়া একটা কিংবদন্তী! ষড়যন্ত্র না দুর্ঘটনা না আত্মহত্যা আজ অবধি বোঝা যায়নি! কিংবা আরও একটু আগে যখন শিবদাসের মোহনবাগান এক করে দিচ্ছে বাঙাল-ঘটিকে, বাঙ্গালি-বেহারিকে, হিন্দু-মুসলমানকে, ব্রাহ্মণ-চণ্ডালকে — সবই আসলে একটা সুতোয় বাঁধা! যার এক প্রান্তে ফুটবল আবার এক প্রান্তে বাস্তব! গুলিয়ে যাচ্ছে কেমন! নিজেরই! এই আমি আছি একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকটায়, আবার ঘোরাফেরা করছি বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে, কখনও রিওয়াইন্ড করে চলে যাচ্ছি আরও পিছিয়ে! আসলে আমার কেমন মনে হচ্ছে, ওদেরকে না জানলে হয়ত এখনকার সময়টাকে ধরতে পারব না! যেরকম আমার এটাও বলতে ইচ্ছা করবে, পেশায় ডাক্তার, ১৯৪৮ অলিম্পিকে ভারতের ক্যাপ্টেন তালিমেরেন আওর কথা, যিনি বলেছিলেন — গেমটা ফুটবল, বুটবল নয়! তাই আমরা বুট পরে খেলি না! আবার এই ডাক্তারি আর খেলার কথা উঠলেই আমার, শুধু আমার কেন, অনেকেরই অবধারিত ভাবে বলতে ইচ্ছে করবে সক্রেটিস! গ্রিক দার্শনিকের নামানুসারেই যার নাম রেখেছিলেন তার মুক্তচিন্তার অধিকারী বাবা রেইমান্দো! সেই সক্রেটিস, যিনি কিনা কোরিন্থিয়ান্স যাবেন শুধুমাত্র শ্রমজীবীদের ক্লাবে খেলতে পারবেন এই ভেবে, তারপর নায়ক হয়ে ১০১ গোল করে বন্যা বইয়ে দেবেন, হার-জেতার ওপরে উঠে শিল্পময়তাকে প্রতিষ্ঠা করে কাপ না জিতেও হৃদয়ে জায়গাটা করে নেবেন, আবার পরবর্তীকালে ফিরে আসবেন রাজনীতিতে, ফিফার দুর্নীতির টাকায় বাণিজ্যকরণের প্রস্তাব ফেরাবেন, বিনা পয়সার চিকিৎসা করবেন দুঃস্থ মানুষের, তারপর একদিন হঠাৎই স্ববিরোধিতার জাজ্জ্বল্যতায় অতিরিক্ত ধূমপানের ফলস্বরূপ ঝরে পড়বেন টুপ করে। মাত্র একটা বাক্যে সক্রেটিস! আসলে এগুলো আমাদের অসহায়তা! মুগ্ধতায় যেটুকু ঢাকা পড়ে যায়!

কোথায় ছিলাম যেন, তালিমেরেন না? হ্যাঁ, সেখানেই যদি ফিরি, যেখানে তালিমেরেনের দলের সেরা ডিফেন্ডারটি বাকিংহাম প্যালেসে হাতে স্যান্ডউইচ আর পায়ে বলের ব্যালেন্সের ফাঁকে রাজকুমারী মার্গারেটকে বলবেন, আমরা খালি পায়ে খেলাতেই স্বচ্ছন্দ! রোমান্টিসিজমের পাশাপাশি ফুটবল আবার বাস্তবকেও জাগিয়ে যায়! যে বাস্তবে হাঙ্গেরির ভয়ঙ্কর দল কেবলমাত্র একটা ম্যাচ হারার কারণেই বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ন হওয়া থেকে বঞ্চিত হয় বা, ইতালির অপরাজেয় তোরিনো দল নিমেষে শেষ হয়ে যায় মাত্র আধঘণ্টার একটা বিমানযাত্রার অসম্পূর্ণতায়! আবার বিমান-দুর্ঘটনাকে হারিয়ে এসেই ম্যাট বুসবি গড়ে তোলেন চ্যাম্পিয়ন দল! আসলে দুটো পাশাপাশি! রোমান্স আর রিয়্যালিটির এমন গভীর সহাবস্থান আর কোথায় পাব ফুটবল ছাড়া! ডিফেক্টিভ পা নিয়ে বিশ্বের সেরা ড্রিবলার হয়ে ওঠা ফুটবলের চার্লি চ্যাপলিন, দিদি যাকে ‘ছোট পাখি’ নামটা দিয়েছিল, সেই গ্যারিঞ্চা! প্রায় একার হাতে জেতানো বিশ্বকাপ! অথচ চরম বেহিসেবি জীবন! আরও একজন! সমসাময়িক! পায়ে ক্ষুরধার শিল্প, অথচ যার বিখ্যাত উক্তি ছিল — ১৯৬৯ সালে আমি মাত্র কুড়ি মিনিটের জন্য মদ আর নারীসঙ্গ ত্যাগ করেছিলাম, যে কুড়ি মিনিট ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে জঘন্য কুড়ি মিনিট! আত্মধ্বংসী! মানে এই ব্যাপারটা ফুটবলে চলতেই থাকে, চলতে থাকবেও! এই কখনও বাস্তবকে হারিয়ে জিতে যাচ্ছে রূপকথা, আবার কখনও বাস্তবের কাছে নতিস্বীকার করছে রোমান্টিকতা! যেরকম, একটু আগে ম্যাচে ফেরত আসার সর্বকালের সেরা উদাহরণের কাণ্ডারী, সেই ইউসেবিওর কথা বলছিলাম! উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই ইউসেবিও জীবনেও যে ঘুরে এসেছেন! মোজাম্বিকের রাস্তা থেকে উঠে এসে সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় হয়ে ম্যাচের পর ম্যাচ গোলের ফুলঝুরি ছুটিয়ে যাওয়া! দারিদ্র্য থেকে উঠে এসে নায়ক — এরকম উদাহরণ টেনে এনে এনারা নিজেদের নায়ক করতে চান না, বরং এতে বোধহয় থাকে আরেকটা বার্তা! দারিদ্র্যের চাপা আগুন, অমানুষিক পরিশ্রমের সুপ্ত বাসনাটা — অহংকারে মিশে যাচ্ছেন সবাই! পেলে, গ্যারিঞ্চা, ববি মুর, ইউসেবিও, মারাদোনা, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, আরও যাদের এই মুহূর্তে মনে আসছে না তারাও!

আবার যদি আমি বর্তমানে ফিরি, যেখানে আমাদের রোজকার ক্লাব ফুটবল ভীষণভাবে প্রভাবিত করে ফেলছে সবকিছুকে! ফিটনেস, গ্রেটনেস — সবের সাথেই জড়িয়ে পড়ছে ক্লাবগুলো! পুরোভাগে দুটি মানুষ! দুজনে সম্পূর্ণ আলাদা! একজন জাত শিল্পী, একজন মেহনতে ভরসা করে! একবার এ ওকে টপকে যায়, একবার ও একে! আর আমরা চায়ের দোকানে কাপ ছুঁড়ে মারাটুকু বাকি রাখি! আবার কী ভীষণ মিল দুজনেরই! একজন রেসিং হার্টকে হারিয়ে ফিরে এসেছিল, একজন গ্রোথ হরমোন ডেফিসিয়েন্সিকে! দশবছর ধরে দুজনের একনায়কতন্ত্রের আড়ালে ঢাকা পড়েছে অনেকেই! তাও সেই বাস্তবে এসে আটকে যায় এরা দুজন! একইদিনে বিশ্বমঞ্চ থেকে ছুটি হয়ে যায় দুজনেরই! তাও কেউই হাল ছেড়ে দিতে চায় না! দুজনেই ঘোষণা করে দেয়, আবারও ফিরে আসবে! আমাদের খেয়োখেয়ির তীব্রতা তলপেটে লাথি খায়, জিতে যায় ফুটবল!

ক্লাবকে আমি বলেছি ফুটবল-খাদক! কিন্তু সেটাও পুরোপুরি কীকরে বলি! কীকরেই বা ভুলি, ৯১ আর ৯৩ মিনিটের দুটো সেটপিস মুভমেন্ট থেকে দুটো গোলের অবিশ্বাস্য জেতার পর কোচের মুখ থেকে ফেটে বেরিয়ে আসা আবেগ — ফুটবল, ব্লাডি হেল! আর ওই কমেন্ট্রিগুলো! অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ! যেকোনো খেলা দেখায় প্রাণ এনে দেয়! মাঠে দেখা খেলায় আকর্ষণ আছে, আর টিভির পর্দায় সেটাতেই আছে রোম খাড়া হয়ে যাওয়ার কার্নিভাল! ‘গিগস উইথ দ্য শট, শেরিংহ্যাম! নেইম অন দ্য ট্রফি! …ইট’স অফ টু শেরিংহ্যাম অ্যান্ড সলস্কজায়ার হ্যাজ ডান ইট! ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড হ্যাড রিচড দ্য প্রমিস মার্ক!’ কিংবা ওই সেই মামারবাড়িতে, ফুটবল বোঝার অনেক দূরের এক গ্রহে থেকে, মামার সাথে বসে দেখা ম্যাচটার ‘আ মিশন ইমপসিবল ইজ অ্যাকমপ্লিশড! …হি’জ সেভড ইট! হি’জ সেভড ইট! দ্য ইউরোপিয়ান কাপ ইজ রিটার্নিং টু ইংল্যান্ড অ্যান্ড টু অ্যানফিল্ড!’ এরকম টুকরো-টাকরা নিয়ে চলতে থাকা একটা যাত্রা! ফুরোয় না! কারণ আমার কাছে একটা মায়াবী জগতের উন্মোচন হয়ে গেছে, আমার অজান্তেই! যেখানে আমি আবার হারিয়ে যাচ্ছি ক্লাব ফুটবলের সর্বময়তা থেকে রজার মিল্লার অবসর ভেঙে ফিরে এসে রোমানিয়ার বিরুদ্ধে ওই গোলদুটোয়, ওই নাচটায়, প্রথম আফ্রিকার দলকে কোয়ার্টার ফাইনালে তোলা আটত্রিশ বছরের একটা বুড়োর উচ্ছ্বাসে, শুধু মাইন্ড গেমের দ্বারা উরুগুয়ে ক্যাপ্টেন অব্দুলিয়ো ভারেয়ার গোলের বন্যা ছোটানো ব্রাজিলকে হারিয়ে দেওয়ায়, গ্রিসের বিরুদ্ধে মারাদোনার ওই পায়ে করে নামিয়ে মারা ভলিটায়, ১৯৭০ এর ফাইনালে বলটা সাতজনের পা ঘুরে পেলে, তারপর বক্সের বাইরে চমৎকার অ্যান্টিসিপেশনে সুপারফাস্ট ট্রেনের স্পিডে ছুটে আসা কার্লোস আলবার্তোর দিকে আলতো করে ঠেলে দেওয়া পেলের নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে, ইট-কাঠ-পাতা দিয়ে ছক বোঝানো অমল দত্তের আজীবন দৌড়ে বেড়ানোয় –সবই যেন কীরকম সাজানো চিত্রনাট্যের নিখুঁত ইম্প্রোভাইজেশন! এমনটাই যেন হওয়ার ছিল! আবার আরও নতশির হই তখন, যখন জানতে পারি, দিল্লি এশিয়াডের ফাইনাল ম্যাচে প্রিয়জনের মৃত্যু সংবাদের পরও জয়সূচক গোল করে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন শিউ মেওয়ালাল, জাকার্তা এশিয়াডের ফাইনালে মাথার ক্ষত নিয়েও জয়সূচক গোল করেছিলেন জার্নেল সিং ধিলোঁ, বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মতো ম্যাচে কলারবোন ভেঙে যাওয়ার পরও মাঠ ছাড়েননি ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, গড়াপেটা-কারাগারের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে দেশকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন পাওলো রোসি, বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারে মাথা ফেটে সমানে রক্ত বেরিয়ে যাওয়ার পরও খেলা চালিয়ে গিয়েছিলেন টেরি বুচার, মেনিস্কাস ছিঁড়ে গিয়েও শুধুমাত্র মনের জোরে পঁচিশ দিন বাদেই ফাইনালটায় খেলবেন বলে মিলান থেকে ক্যালিফোর্নিয়া উড়ে এসেছিলেন ফ্রাঙ্কো বারেসি, দু-দু’বার ক্রুশিয়েট লিগামেন্টের মতো জায়গার চোট সারিয়ে ফুটবলে ফিরেছিলেন রোনাল্ডো নাজারিও ডে লিমা, কিংবা যখন দেখি, লিভার ক্যান্সারকে হারিয়ে এসে ম্যাঞ্চেস্টারের রুনি-হার্নান্ডেজ-স্কোলস-নানিদের আক্রমণবিভাগ একা হাতে রুখে দেন এরিক আবিদাল, চোট পেয়েও অনেক চেষ্টা করার পর অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে মাঠের বাইরে গিয়ে সমানে তাতিয়ে যাচ্ছেন, নির্দেশ দিচ্ছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, এল ক্লাসিকোতে মার্সেলোর কনুইয়ের ধাক্কায় ঠোঁট ফেটে যাওয়ার পর একহাতে ঠোঁট চেপে অবলীলায় কয়েকজনকে কাটিয়ে গোল করে দেন লিওনেল মেসি — ফুটবল শুধু ব্লাডি হেল নয়, গেম অফ লাইফ-ও বটে!

আবার সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপটার ওই দৃশ্যগুলো! স্পেনের বিরুদ্ধে ছিয়াশি মিনিটের ফ্রি-কিকটা মারতে যাওয়ার আগের মুহূর্তে রোনাল্ডোর চোখদুটো, কিংবা ওই, ওই ফিল্ম ডিরেক্টর ভদ্রলোকের দুটো হাত সেভ করে দিল মেসির পেনাল্টিটা, কিংবা নিশ্চিত জয়ের সেলিব্রেশনে অংশ না নিয়ে নাইজেরিয়ার উইলিয়াম ট্রুস্ট-ইকং এসে পিঠে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন সদ্য-পেনাল্টি মিস করা আইসল্যান্ডের গিলফি সিগুর্দসনের, কিংবা ছোট্ট পাখির ছানাটিকে বাঁচালেন ইস্কো-পিকে, কিংবা রাস্তায় শুয়ে থাকা ছেলেটা বাঁচিয়ে দিল রোনাল্ডোর পেনাল্টিটা, কিংবা চোট পাওয়া কাভানিকে কাঁধের ভর দিয়ে মাঠ থেকে বেরোতে সাহায্য করছেন রোনাল্ডো — সব কেমন মিলেমিশে যাচ্ছে না জীবনের সাথে? লাইফ অফ গেম-ই তো! যেরকম ফ্রান্সের ওরা! বেশিরভাগেরই বাবা-মা পেটের দায়ে অথবা প্রাণের দায়ে চলে এসেছিলেন একদিন! বেলজিয়ামের ওই রোমেলু, বড় কন্ট্র্যাক্ট পেয়েই যে ছেলেমানুষের মতো কিনে এনেছিল ফিফা গেমস আর বড় টিভি! আর যে খর্বকায় লোকটা সোনার বলটা জিতল, আমার ফুটবল-রোমান্টিসিজমে পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নেওয়া লুকা মদ্রিচ! শিশু বয়সে ছাগল চরানো ছেলেটি, যে খুব সন্তর্পণে নেকড়েদের হাত থেকে বাঁচিয়ে আনত পোষ্যদের, যাকে শৈশবে পাহাড়ের ঢালে একদিন ভিডিও ক্যামেরায় ধরেছিলেন নেকড়ে-বিশেষজ্ঞ, ওয়াইল্ডলাইফ কনসারভেশানিস্ট পাভলো ব্যালেনোভিচ! ঢলঢলে নীল জ্যাকেট পরে একটা কঞ্চি নিয়ে চারপাশে নজর রাখতে রাখতে পাথুরে জমির ওপর দিয়ে ছাগলগুলোকে খামারে নিয়ে যাচ্ছে ছেলেটি! পরবর্তীকালে একটা ছোট্ট দেশের দায়ভারও একইভাবে ওইরকম কঠিন রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাবে সে! তাকে সবকিছু শেখাত যে দাদু, সেই প্রিয়তম মানুষটির হত্যা, বাড়িছাড়া হওয়া, উদ্বাস্তুজীবনকে হারিয়ে দিয়েছিল সে ফুটবল দিয়ে! পরিবারকে দিতে পেরেছিল নিরাপদ একটা আশ্রয়! আবার সেই লোকটার বিরুদ্ধেই ওঠে মিথ্যাসাক্ষ্য দেওয়ার অভিযোগ! ওই আবারও, বাস্তবমুখিনতা আর হিরোইজম একসাথেই! শুধু সে-ই নয়, তার দলেরও প্রায় সকলেই সেই অন্ধকার সময় থেকে বেরিয়ে এসে ফুটবলকে ভরিয়ে দিয়েছে বিশ্বাস-দর্শনে!

কিন্তু এই পড়াশোনা বা দেখাশোনাতেই আমার ফুটবল আটকে থাকে না! কিছু মানুষ থাকেন! ছাপোষা! তাঁদের চেতনাও এসে একাকার হয়ে যাওয়া! যেমন সেই টোটোচালক! কাল ক্রোয়েশিয়ার খেলাটা কী হল ভাই? আচ্ছা, উরুগুয়ে আর ফ্রান্স হবে তো? স্পেন ছিটকে গেল, কীসব হচ্ছে! ওদিকে হল্যান্ড নেই, ইতালিও পারল না! সেই হল্যান্ড ছিল! ওঃ সেই গুলিট! গুলির মতো ছুটত পুরো! …মোক্ষম উপমা বটে! গুলিট, রাইকার্ড, ভান বাস্তেন! দেশ, ক্লাব! ত্রয়ীদের আক্রমণ! বা আমার বড়মামা …তোরা দেখিসনি সেসব! খুব ছোট তোরা তখন! হোসনি হয়ত! খেলা দেখিয়ে গেছে ওই গুলিট, তারপর রুমানিয়ার হাজি, তারপর সেই ভালদোরামা, ক্যামেরুনের সেই কি যেন! রজার মিল্লা? হ্যাঁ, মিল্লা! সেসব ছোটা! মাঝমাঠ দিয়ে! …বিশ্বকাপ জেতেননি কেউ এঁরা! নক আউট, কোয়ার্টার ফাইনাল! টিভিতে ক্লাব ফুটবল তখন কয়েক আলোকবর্ষ দূর! শুধুই বিশ্বমঞ্চে দেখা হওয়া! তাতেই এরা স্বরলিপি লিখে দিয়ে যায় ‘তবু মনে রেখো!’ …ফোরলানের শটটা ক্রসবারে লেগে ফেরার পর একবার হেডব্যান্ডটায় হাত বুলিয়ে শূন্যপানে তাকানো, কিংবা গোলটা বাতিল হওয়ার পর ল্যাম্পার্ডের সেই মাথায় হাত রাখার মুহূর্ত, পোস্ট জড়িয়ে ধরে অলিভারের কান্না…বলার মতো আমাদেরও থাকবে…অনেকদিন, অনেক প্রজন্ম ধরে…ততদিন ব্যর্থতা গায়ে মেখে কাপ তুলতে দেখব কাউকে…অনেককে…নতুন…অচেনা…তবু পায়ে বল, স্বপ্নমেদুর…আর ওরা ফেড হতে হতে সামনে আসবে যখন তখন… চলতে থাকে, চলতে থাকবেও! বিশ্বকাপ শুরুর আটদিন আগে জন্ম যে ছেলেটির, যে শিশু সাড়ে ছ’বছরে চাক্ষুষ করেছিল কেরিয়ারে হাজার গোল করা ভারতের সর্বকালের সেরা সেন্টার ফরোয়ার্ডকে, একদিন ব্রাজিলের ফাইনাল জেতার দিন কার্টুন নেটওয়ার্কের ঘ্যানঘ্যানানি ছিল যে শিশুর, বন্ধুদের আলোচনা যাকে হীনম্মন্যতা এনে দিত একসময়, তারুণ্যে এসে সে হঠাৎ এমন একটা জগৎ পেয়ে গেল, সেখানে কেবলই ওই লাইফ, জাস্ট লাইফ!