আকাশ
১
একটা ফাঁকা ফুটবল স্টেডিয়ামে বসে থাকার কথা বলেছিলেন এডুয়ার্দো গালিয়েনো। খেলা শুরুর সময় সেন্টার লাইনের মাঝখানে ঠিক যেখানটায় বল রাখেন রেফারি, সেখানে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে বলেছিলেন। মনখারাপের দিনে আমি এমন বসে থেকেছি, বহুবার। বাবা মারা যাওয়ার দিন বসেছি, প্রেমিকা চলে যাওয়ার দিন বসেছি। প্রিয়তম মানুষকে মিথ্যা বলার পর, বড্ড বেশি ঠকে যাওয়ার পর, বন্ধুত্ব ভেঙে যাওয়ার পর — বসেছি। যেদিন শেষবারের মতো বেরিয়ে এলাম পার্টি অফিস থেকে, গলি পেরনোর পর শেষবারের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলাম রংচটা প্রাণের নিশান, সেদিনও বসেছি। ফাঁকা স্টেডিয়ামের মাঝখানে বসলে মনে হয়, মাটি থেকে উঠে আসছে মায়ের আঁচলের মতো গন্ধ। মাটি মাটি, বিকেল বিকেল। সেই গন্ধ আমায় ছেড়ে যাবে না কখনও। আমিও যাব না তাকে ছেড়ে।
দু’পাশে দু’টো গোলপোস্ট, জাল নেই। হাজার হাজার চেয়ার, শব্দহীন। কোথাও কোনও আওয়াজ নেই, উত্তেজনা নেই, চিৎকার নেই। উল্লাস-কান্না-গালাগালি কিচ্ছুটি নেই। একটা আস্ত ফাঁকা স্টেডিয়ামের ঠিক মাঝখানে আমি বসে থেকেছি, একা।
ফুটবল ঠিক যেন মরে যাওয়া বাপমায়ের মুখ, যে আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে। আমি ধর্ম বদলে ফেলতে পারি, মতাদর্শ বদলে ফেলতে পারি, নাম বদলে ফেলতে পারি, দেশ-বাড়িঘর-প্রেম-সম্পর্ক সবকিছু বদলে ফেলতে পারি, শুধু প্রিয় ফুটবল দলের নাম বদলাব না কখনও। বদলানো যায় না। ফুটবল রক্ত-ঘাম-হাড়েমাংসে মিশে যায়।
২
আমার দাদু আর দিদা একে অন্যকে প্রথম দেখেছিল মনুমেন্টের নীচে। চল্লিশের দশক। রশিদ আলি দিবসের মিছিল ফেরত দিদাকে উয়াড়ি ক্লাবের প্র্যাকটিস সেরে বাড়ি ফেরার পথে দাদু যখন প্রথম দেখে, তখন ময়দান জুড়ে নেমে এসেছে কনেদেখা বিকেল। তারপর মেঘে মেঘে বেলা বেড়েছে। মোহনবাগানের খেলা থাকলে সিপিআইয়ের পার্টি সদস্য আমার দাদু মাঠে যাওয়ার আগে ঠাকুরঘরে ঢুকত একবার। সেদিন সকাল থেকে উচাটন। উল্টো করে বিড়ি ধরত, তাতে নাকি মোহনবাগানের শনি কেটে যায়। দিদার মুখে শুনেছি, ফুটবলের মাঠ থেকে ছেলেরা ঢুকে পড়ত ব্রিটিশবিরোধী মিছিলে। পুলিশ তাড়া করত, ঘোড়সওয়ার পুলিশ…
শুনেছি, দেশভাগ। শুনেছি, দাঙ্গা। শুনেছি, সে সবের পরতে পরতে জড়িয়ে থেকেছে ফুটবল। আমাদের কলেজ স্ট্রিটের বাড়ির আশেপাশে তখন গোপাল মুখার্জির রাজত্ব। ইতিহাস যাঁকে মনে রেখেছে গোপাল পাঁঠা নামে। অনেক পরে গোপালবাবু সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি, ওঁর ঈশ্বর ছিলেন সুভাষচন্দ্র আর মন্দির মোহনবাগান। তখন অবশ্য সকলেই প্রায় মোহনবাগান। ১১-র স্মৃতিতে ভর করে ওড়ে স্বাধীনতার বিজয়কেতন। দাদুর বন্ধু নাসিমসাহেব মহামেডান ক্লাবের কর্তা ছিলেন। ইস্টবেঙ্গল তখনও সে অর্থে বড় দল নয়। দেশভাগের পর আচমকা বদলে গেল শহরটা। অদ্ভুত ধরনের বাংলা বলা হাজার হাজার লোক ভিড় করল শিয়ালদহ, হাওড়া স্টেশনে। আগে শহরে বাড়িওয়ালারাই তোয়াজ করতেন ভাড়াটিয়াদের। এবার ভাড়া পাওয়ার মতো বাড়ি মেলাই হয়ে উঠল দুষ্কর! কোথায় যাবেন এত মানুষ! কোথায় মাথা গুঁজবেন! শহরের আদি বাসিন্দাদের একাংশের অনুযোগ, লাখ লাখ উদ্বাস্তুর ভিড় শহরটাকে নোংরা করে তুলছে। কথাটা মিথ্যেও তো নয়। যে মানুষের থাকার জায়গা নেই, যাকে সাত পুরুষের ভিটে থেকে উপড়ে ফেলা হয়েছে, সে শুরু করল জবরদখল। বাগানবাড়ি, ফাঁকা জমি, খালপাড় — সব। হাতে হাতে বসতি গড়ে উঠল। জঙ্গল সাফ হল। তৈরি হল দরমার বেড়া দেওয়া স্কুলঘর। সন্ধ্যা গড়ালে সেই দাওয়ায় আড্ডা বসল — ‘আমাদের পুকুর আছিল, পুকুরে মাছ আছিল, বাগান আছিল! কত গাছ, কত গরু, কত দুধ! আর এখন……।’ কেউ বিশ্বাস করে না সে সব কথা। হাভাতের প্রলাপ। অফিসকাছারিতে খিল্লি হয়। কয়েকজন বুদ্ধিমান আগে থেকেই আঁচ বুঝে প্রপার্টি এক্সচেঞ্জ করে ঠাঁই পেয়েছে ভদ্রপাড়ায়। তাদের মুখেও মাঝেমধ্যে ফেলে আসা ঐশ্বর্যের গল্প। সে নিয়ে হাসাহাসি। ভাষাটাও যেন কেমন! খিল্লি। এই সব শুনে গজরাতে থাকা বরিশালের মানুষ, ঢাকা, বিক্রমপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ, ফেনি, রংপুরের মানুষ ফুটবল ময়দানে ঢুকে পড়ল। সুরেশ চৌধুরির ক্লাবের হয়ে গলা ফাটাল। গালাগালি দিল। রোজকার জীবনের হাজার না-পাওয়া মুছিয়ে দিল লাল-হলুদ জার্সির নায়করা। জন্মের কয়েক দশক পর নতুন করে জন্মাল ইস্টবেঙ্গল ক্লাব।
৩
ফুটবলের ঠিক কত শতাংশ ওই চৌকো মাঠটায় খেলা হয়? জানি না। সেন্টার লাইন পেরিয়ে, কর্নারের দাগ পেরিয়ে আশ্চর্য সাবলীলতায় মাঠের গণ্ডি পেরিয়ে ফুটবল ঢুকে পড়ে জীবনের রঙ্গমঞ্চে। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। ফুটবল এই দুনিয়ার সব হেরে যাওয়া মানুষের বেঁচে থাকার, বাঁচিয়ে রাখার অভিজ্ঞান। কখনও কখনও মৃত্যুরও বটে। সাদা চামড়ার তাড়া খেয়ে ঝোপজঙ্গল পেরিয়ে পালাতে পালাতে রঙিন মানুষেরা একটা আস্ত ফুটবল দর্শনের জন্ম দিতে পারে। দুনিয়া কাঁপানো বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে শত্রুপক্ষের সৈন্যের সঙ্গে ফুটবল খেলা যায়। বন্ধ কারখানার শ্রমিকের ছেলে ঘাস উঠে যাওয়া এক টুকরো জমিতে ড্রিবল করতে করতে টপকে যায় তার স্কুলে না যাওয়া শৈশব, প্রেমিকাকে হারিয়ে ফেলার ক্ষত, যে ছেলেটির চাকরি চলে গিয়েছে, যে বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পায় প্রিয় দলের গোলে। মানুষকে মেরেও ফেলে ফুটবল। পুড়িয়ে পুড়িয়ে আংরা করে দেয় তাকে।
মনে করুন উরুগুয়ের কিংবদন্তী আবদিয়ন পোর্তেকে। আজ থেকে প্রায় ১০৮ বছর আগের কথা। ১৯১০ সাল। পোর্তে খেলতেন মাঝমাঠে। প্রথম বছর কোলন ক্লাব। সেখানে এক বছর কাটিয়ে লিবের্তাদ ক্লাবে। তারপর ১৯১১ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত একটানা নাসিওনাল ক্লাবে। ১৯১৭ সালে সাউথ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা উরুগুয়ের অন্যতম নায়ক পোর্তেকে আদর করে সমর্থকেরা ডাকতেন ‘এল ইন্দিও’ বলে। ক্লাবের হয়ে ২০৭টি ম্যাচ খেলা, ১৯টি ট্রফি দেওয়া পোর্তের জীবনটা বদলাতে শুরু করল আঠেরো সালেই। সে বছর বুড়ো কিংবদন্তীর বদলি খুঁজে নিলেন কর্তারা। তাঁকে রিজার্ভ বেঞ্চে পাঠিয়ে প্রথম দলে চলে এলেন আলফ্রেদো সিবেচি। বসে থাকতে থাকতে ভিতরে ভিতরে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলেন পোর্তে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীল করলেন, নিংড়ে দিলেন নিজেকে। লাভ হল না। ৪ মার্চ, ১৯১৮। শেষ ম্যাচ খেললেন নাসিওনালের হয়ে। দল জিতল ৩-১ গোলে। কিন্তু পোর্তে গোল পেলেন না। বুড়ো, বাতিল হয়ে যাওয়া ঈশ্বরের দিকে সমর্থকেরা টিটকিরি ছুঁড়ে দিলেন। বললেন, ‘ও এখন একটা কচ্ছপকেও কাটাতে পারে না।’ মাথা নীচু করে সবকিছু মেনে নিলেন হেরে যাওয়া, শেষ হয়ে যাওয়া কিংবদন্তী ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার।
৪
ম্যাচের পর অনেকগুলো ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে। অবসন্ন, একা পোর্তে একটা ট্রামে উঠলেন। তখন মাঝরাত। গন্তব্য, এস্তাদিও গ্রান পার্কে সেন্ত্রালে — নাসিওনাল ক্লাবের তাঁবু। ক্লাব শুনশান, একটা আলোও জ্বলছে না। বাইরে বসে ঢুলছেন একজন সিকিউরিটি গার্ড। পোর্তে ধীর পায়ে মাঠের ঠিক মাঝখানে পৌঁছলেন। গালিয়েনো যেমন বলেছিলেন, ঠিক তেমনই। তারপর বসে পড়লেন সেন্টার লাইনের মাঝখানে। মাথা নীচু। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকলেন চুপ করে। তারপর পকেট থেকে রিভলভার বের করলেন। মাথায় ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপলেন।
গুলির আওয়াজ কেউ শুনতে পায়নি। পরদিন সকালে স্টেডিয়ামে হাঁটতে এসেছিলেন সেভরিনো কাস্তিত নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা। তাঁর কুকুরই প্রথম দেখতে পায় এল ইন্দিও’কে।
৫
অনেক পরে গালিয়েনো লিখেছিলেন, “ফুটবল মাঠই হল সেই জায়গা, যেখানে অতীত এবং বর্তমানের দেখা হয়ে যায়। তারা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হয়। পরস্পরকে বুকে টেনে নেয়।”