রূপায়ণ ভট্টাচার্য
৷৷১৷৷
চারটে কুড়ির ট্রেন এল একটু পরের দিকে৷ সন্ধে হয়ে আসছে তখন৷ স্টেশনে ট্রেন থামে দু’মিনিট৷ জানলার পাশের সিটে বসে দেখে যাচ্ছি, প্ল্যাটফর্মের ওপর ছোট্ট কৃষ্ণচূড়া গাছ৷ দূরের বাড়িঘর৷ মিলিয়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে৷ এই স্টেশন, এই কৃষ্ণচূড়া-শীতের সকালে মর্নিংওয়াকে এসে ছুঁয়ে যাওয়ার আকুতি হারিয়ে যাবে৷
কয়লার ইঞ্জিনের মুখটা সুঁচোলো হলে আমরা বলতাম ‘কানাডিয়ান ইঞ্জিন’৷ সেই ইঞ্জিন হুঙ্কার করার পরে, বাইরে থেকে একটা হাত ছুঁয়ে যায় আমার হাত৷ ‘ভালোভাবে থাকিস৷ অনেক বড় হতে হবে তোকে৷’
দেখি, আমার বড় কাকা৷
ট্রেন এগিয়ে যায় আস্তে আস্তে৷ পিছনে সরে যেতে থাকে আমার স্বাধীনতা সংগ্রামী কাকা৷ তার সবুজ সাইকেল হেলান দেওয়া আছে স্টেশন মাস্টারের অফিসের গায়ে৷ অফিস করে সাইকেলে বাড়ি চলে যাবে কিছুক্ষণ পরে৷ সন্ধ্যে হলে সবুজ ফতুয়া আর সাদা লুঙ্গি পরে কালী মন্দিরের সামনে ঘণ্টা বাজিয়ে গান গাইবে, ‘শিবকালী শিবকালী কালী কালী শিব শিব’৷ আমি তখন কোথায়?
৷৷২৷৷
অন্য কারও হাতে দস্তানা না থাক, ওর হাতে থাকবেই৷ আর শীত কালে ফুল হাতা জার্সি৷ লাল-কালো ডোরা কাটা এসি মিলাম জার্সিতে বল নিয়ে এগোলে মনে হয়, বল তার পায়ের গোলাম৷ হাসিটা কী নির্মল ও চমত্কার! দেবদূত দেবদূত দেখায়৷ পৃথিবীর সুন্দরতম ফুটবলার এই!
কাকা! কাকা!
সামনে শেভচেঙ্কো৷ পাশে রুই কোস্তা, আন্দ্রে পির্লো৷ একটু পিছনে গাতুসো, সিডর্ফ৷ কাকাকে তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে মন কাড়া দেখায়৷ ব্রাজিলিয়ানদের উপর ভালোবাসা বেড়ে যায় কাকার ফুটবল দেখলে৷
তবু মাঝরাতে আমি বেশিক্ষণ দেখতে পারি না কাকার মিলানকে৷ একে দেখলে আমার হারিয়ে যাওয়া কাকাদের জন্য মন কেমন করে! টিভি বন্ধ করে দিই!
৷৷৩৷৷
ক’দিন আগে হাবুদাদের নতুন বাড়িতে কলকাতা থেকে ফোন করেছিল সেজ কাকা৷ তখন গ্রামের দিকে ফোন এসেছে সবে৷ আমাদের বাড়িতে ফোন নেই৷ জমিদার বাড়ির ফোন নম্বর হল ১৷ হাবুদার বাড়ি ফোন নম্বর ৫৷ কলকাতা থেকে সেই পাঁচ নম্বরে ফোন করে সেজকাকা ডাক পাঠাল আমায়৷ মাধ্যমিকের রেজাল্ট শুনিয়ে ফোনে সোজা কথা, ‘চলে এসো কলকাতায়’৷
সেজকাকা যা বলবে, তার ওপরে কথা হয় না৷ কলকাতায় কাকার বাড়িতে থেকেই সব দাদা, দিদিরা পড়েছে৷ এটা যেন ঠিক করাই আছে৷ আমের মরসুমে সকালে দুধ মু্ড়ির সঙ্গে আম খাওয়ার মতোই স্বাভাবিক ব্যাপার৷ অত্যন্ত গম্ভীর হেডমাস্টার মশাই সেজকাকা হঠাত্ই একদিন বৃষ্টি আসার পরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গান গেয়ে উঠবেন, ‘বরষ রে’৷ বৃষ্টিকে এমন উদাত্ত আবাহন শুনিনি কোথাও৷
একদিন বাড়ির সবাইকে নিয়ে জ্যোত্স্না রাতে নদীতে নিয়ে যাবেন নৌকোয়৷ আর একদিন সবিতাব্রত দত্ত বা দেবব্রত বিশ্বাসের ‘আসিছে নামিয়া ন্যায়ের দণ্ড’ রেকর্ড শুনে গলা মেলাবেন ওই জায়গায় এসে৷ যেখানে গায়করা গলা তুলে বলছেন, ‘সাবধান, সাবধান’৷ বাকিটা সময় ডুবে থাকবেন পড়াশোনায়৷ লোকে ঘেঁষতে ভয় পাবে সেজকাকার কাছে, এত গাম্ভীর্য!
সেই সেজকাকার ফোন এসেছে কলকাতা থেকে, ‘চলে এসো!’
৷৷৪৷৷
রিয়াল মাদ্রিদ জার্সির রং সাদা৷ ওটা পড়লে যেন কাকাকে আরও সুন্দর দেখায়৷ রূপ ফেটে বেরোয়৷ ক্রিস্তিয়ানোর রোনালদোর জন্যও করুণা হয়, এত সুন্দর লোকটার পাশে তাঁকেও তো সাধারণ দেখাচ্ছে৷ টিভিতে ম্যাচ দেখতে দেখতে মনে হয়, সব গোল কাকাই করুক৷ এত নিষ্পাপ মুখ৷ প্রিয়তম ফুটবলার হয়ে ওঠে৷ এক যুগ আগে কোরিয়ার উলসান শহরের পাহাড়ে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ ট্রেনিং সেন্টারে প্রথম দেখেছিলাম৷ স্কোলারি বলতেন, কাকা তাঁর ছোট ছেলের খুব প্রিয়৷ কাকার মুখের নিষ্পাপ সারল্যটা এখনও এক রকম৷ বদলায়নি এত বছরেও৷
বেশিক্ষণ দেখতে পারি না৷ এই কাকাকে দেখলে আমার হারিয়ে যাওয়া কাকাদের জন্য মন কেমন করে! টিভি বন্ধ করে দিই! আমারও তো নিজের কাকা ছিল! বড়কাকা, সেজকাকা, ছোটকাকা৷
৷৷৫৷৷
বাবা আছেন৷ কিন্তু কাকারাও এক এক জন বাবা৷ আক্ষরিক অর্থেই পিতৃব্য৷ বাবার খুড়তুতো ভাইরাও আমার নিজের কাকা৷ কোনও ফারাক নেই সেখানে৷ কাকীমারাও এক এক জন নিজেরই মা৷
বড়মা৷ মেজমা৷ সেজমা৷ ছোটমা৷ এঁরা একসঙ্গে ৫০ জনের পরিবারকে এক করে রেখে দেন ঐশ্বরিক ও অলৌকিক দক্ষতায়৷
মার শেষকৃত্য করে সেজকাকার বাড়িতে ফেরার পরে বড়মার বুকে মুখ গুঁজে কান্না৷
বাবার অ্যাক্সিডেন্টের পরে মা যখন কাটিহারে গেল, তখন মেজমার বুকে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়া৷
পাশের বাড়ির হেমুকাকা, অবুকাকা, মণিকাকা, পঞ্চুকাকা-সবাই তো খুব কাছের৷ একেবারে নিজের৷ এখনকার দিন, এখনকার প্রজন্ম এ সব কাছের লোকদের জানল না৷
ক’দিন আগে চেনা এক কিশোরকে কী কুক্ষণে যে প্রশ্ন করেছিলাম, বাড়িতে কে কে আছে? শুনে অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘বাবা-মা৷ এ ছাড়া কে থাকবে?’
কাকা নেই?
সরল কিশোর একদৃষ্টিতে থাকিয়ে হেসে ফেলে, ‘কাকা! কাকা তো ফুটবল খেলে৷’
আমি জানি, সে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার কাকার কথা ভাবছে৷ ফর্সা ধবধবে৷ দেবদূতের মতো দেখতে৷ কাকা বলতে ওই এক জনকেই চেনে পৃথিবী৷
কাকা বলতে আমি কার কথা বলছি, সেটা বোঝাতে সে আবার মজা পেয়ে হাসে, ‘ও আঙ্কল! তুমি আঙ্কলের কথা বলছো৷ আমার বাড়িতে কোনও আঙ্কল নেই!’
কাকা নয়৷ আঙ্কল৷
মন খারাপ হয়ে যায়৷
ক’দিন বাদে অটোস্ট্যান্ডে শুনি, উপহাস করে কেউ কাউকে বলছে ‘কাকা’ বা ‘মামা’৷ ওটা যেন বিদ্রুপেরই অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে কারও কারও কাছে৷ আমি মজা করেও কাউকে ‘কাকা’ বলতে পারি না৷
মামাও না৷ তা হলে কি এরা ভবিষ্যতে ব্যঙ্গ-কৌতূকের লোককেও ‘বাবা’ বলে ডাকবে?
মনকে সান্ত্বনা দিই, এ সব হয়তো ব্যতিক্রমী সংলাপ৷ আর সবাই কাকা ব্যাপারটা জানে৷ কাকাকে ভুলে যায়নি৷
‘কাকা’ উচ্চারণটার মধ্যে ‘কা কা’ কর্কশ ডাক ভেসে আসে না, মনে পড়ে এক সমুদ্র আন্তরিকতা৷
কোনও কোনও দিন খুব ভোরে হঠাৎ একা হয়ে যাওয়া আলোর মধ্যে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গান ভেসে এলে হঠাত্ মনে পড়ে ছোটকাকাকে৷ মানবেন্দ্রর মতো ওই রকমই ব্যাক ব্রাশ চুল রাখত ছোটকাকা৷ ওই রকমই সরু গোঁফ৷ গিলে করা পাঞ্জাবি৷ ও রকমই রেওয়াজি সরগম করে রেলের অফিসে যাওয়ার আগে হারমোনিয়ামে ধরত গান৷ বারান্দার টিয়াপাখি দুটো ছটফটানি থামিয়ে বসে থাকত শান্ত হয়ে৷ বিহারের রেলশহরে কোনও ফাংশান হত না ছোটকাকাকে ছাড়া৷ অনেক পরে বুঝেছি, মানবেন্দ্রকেই নকল করত ছোটকাকা৷
কোনও কোনও দিন সকালে পদ্মশ্রী সিনেমার বাসস্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে গেলে মনে হয়, এই বুঝি নস্যি জওহর কোট, ইস্ত্রি করা ধুতি পাঞ্জাবির কেউ হেঁটে আসছে দীপ্তভঙ্গিতে৷ হাতে চামড়ার ব্যাগ৷ মারাত্মক গম্ভীর ছিল আমার সেজকাকা৷ চারপাশের সবার মধ্যে সম্ভ্রম-ওই যে হেডমাস্টার মশাই যাচ্ছেন স্কুলে৷ জানো তো, উনি স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন! আমাদের কৈশোরে জানাই ছিল না স্বাধীনতা সংগ্রামের মাহাত্ম্য৷ এখন নিজের ওপর ধিক্কার জন্মায়, বড়কাকা, সেজকাকার কাছে স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের লড়াই, জেল খাটার গল্প শোনাই হল না৷
কোনও কোনও দিন রাতে সাইকেলের ঘণ্টার মৃদু আওয়াজ শুনে ভাবি, এই বুঝি বড়কাকা স্টেশন থেকে ফিরল৷ সাইকেলটা বারান্দায় তুলে দেবার জন্য এখনই আমায় ডেকে উঠবে, ‘ভূত!’
বয়স বাড়ছে দ্রুত৷ আমার কোনও কাকা নেই৷ শীত যায়, বসন্ত আসে৷ কাকারা ফেরে না৷ ফুটবলার কাকাও ইতালি, স্পেন ছেড়ে চলে গিয়েছে ব্রাজিলে৷ সাও পাওলো ক্লাবে৷ ভালো খেলার খবর ইন্টারনেটে এলে ভালো লাগে৷ যাক, কাকা হারিয়ে যায়নি এখনও৷ এই তো দুঙ্গা আবার জাতীয় টিমে নিতে বাধ্য হল কাকাকে৷ ব্রাজিল লিগের খেলা দেখায় না টিভিতে৷ আমার কাকাকে বেশি দেখা হয় না৷ খেলা দেখতে দেখতে টিভি বন্ধ করে দিতেও হয় না৷
আমার কাকাদের গল্প মনে পড়ে৷ সে অনেক গল্প৷ অনেক গল্প৷ অনেক গল্প৷ বড় হওয়ার গল্প৷ বড় না হওয়ার গল্প৷ ভালোবাসার গল্প৷ ভুল বোঝার গল্প৷ চোখে জল আসার গল্প৷ স-ব-বই বুকের মধ্যে রেখে দিই৷ আবার তো ওদের সঙ্গে দেখা হবে কোনও দিন না কোনওদিন৷ তখন সব বলব!
‘এই সময় ইন্ডিয়াটাইমস’ ওয়েব-এর ব্লগে প্রকাশিত, ও লেখকের অনুমতি-ক্রমে পুনঃপ্রকাশিত…