সুজন ভট্টাচার্য
না, এটি কোনও বে-সরকারি বাণিজ্যিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গল্প নয়, যেখানে মুনাফার জন্য মালিকপক্ষ যা খুশি তাই বিজ্ঞাপন দিয়ে দেবে। এটি একটি কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান। কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে এর নাম আছে, Central Funded Institute of Technologyর তালিকায় Other Central Institute হিসাবে। কী মনে হয় এইটুকু দেখে? আহা, এমন একটা প্রতিষ্ঠানে যদি আমার ছেলেমেয়েও চান্স পেত! দাঁড়ান, হড়বড় করবেন না। নিচের ঘটনাক্রমটা পড়ুন। তারপর সিদ্ধান্ত নিন।
অসাধারণ কালপঞ্জি
২০১০ সাল। কেন্দ্রীয় সরকারের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি দুর্গাপুরের অধীনে মালদহে গনি খান চৌধুরী ইন্সটিটিউট অব এঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটের ভাষণ অনুযায়ী, ‘The Institute’s main objectives are (i) to offer flexible, modular, credit based multi-point entry programs in engineering and technology’।
এই Modular শব্দটি শিক্ষাক্ষেত্রে ছিল এক নতুন সংযোজন, যাকে নিয়েই পরবর্তীকালে দেখা দিল সমস্ত ঝামেলা। যাই হোক, মোদ্দা কথা হল, মাধ্যমিক বা সমতুল পরীক্ষা পাশের পর সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে যারা এখানে ঢুকবেন, তাদের শিক্ষাক্রম হবে —
- প্রথম ২ বছর — সার্টিফিকেট যা ভোকেশনাল কোর্সে উচ্চ-মাধ্যমিকের সমতুল।
- দ্বিতীয় ২ বছর — ডিপ্লোমা অর্থাৎ পলিটেকনিকের সমতুল।
- তৃতীয় ২ বছর — বি টেক ডিগ্রি।
অর্থাৎ খানিকটা ইন্টিগ্রেটেড সিস্টেমের ধাঁচে মাধ্যমিকের পর থেকেই টানা পড়াশুনা করে বি টেক ডিগ্রি পাওয়ার ব্যবস্থা। তবে যে কোনও ছাত্র ইচ্ছে করলে প্রথম বা দ্বিতীয় ধাপের শেষে পড়া ছেড়ে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে তাকে সার্টিফিকেট বা ডিপ্লোমা দেওয়া হবে। আবার পরবর্তী দুটি ধাপেই নতুন ছাত্র ভর্তি হতে পারে। ইন্টিগ্রেটেড ব্যবস্থার সঙ্গে একমাত্র পার্থক্য এটাই। এইজন্যই এই সিস্টেমের নাম দেওয়া হল মড্যুলার।
২০১০ সালেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং মালদহের নারায়ণপুরে মূল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। মাধ্যমিক উত্তীর্ণদের নিয়ে সার্টিফিকেট স্তরের পঠনপাঠন শুরুর জন্য GET পরীক্ষার বিজ্ঞাপনও প্রকাশ করা হল। সেই বছরই শুরু হল সার্টিফিকেট স্তরের পঠনপাঠন।
২০১২ সালে সার্টিফিকেট প্রাপক ও GET পরীক্ষার মাধ্যমে আসা নতুন ছাত্রদের নিয়ে শুরু হল ডিপ্লোমা কোর্স। বিল্ডিং নির্মাণের কাজ পুরোদমে চলছে। বুকভরা আশা নিয়ে ছেলেমেয়েরা আসছে, রাতজেগে পড়ছে। ২০১৪। রাষ্ট্রপতি ডঃ প্রণব মুখার্জী নবনির্মিত ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করলেন। আর সেই বছরই ডিপ্লোমাহোল্ডার ও নতুন ছাত্রদের নিয়ে শুরু হল বি টেক কোর্স।
দু’ বছর পর অর্থাৎ ২০১৬ সালে প্রথম বি টেক ব্যাচ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল। আর তখনই জানা গেল ইন্সটিটিউটের কোনও অ্যাফিলিয়েশন নেই। আকাশ ভেঙে পড়ল সবার মাথায়। শুরু হল দৌড়ঝাঁপ। ছাত্রদের লাগাতার চাপে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ২০১৭ সালে জানাল NIT দুর্গাপুর অ্যাফিলিয়েশন দেবে। কিন্তু দীর্ঘ টালবাহানার পর দুর্গাপুর জানিয়ে দিল, স্বীকৃতি দিতে তারা অপারগ।
জুন, ২০১৮। লাগাতার ছাত্র আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি স্বীকৃতি দিল। দিল কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন। তার নিট অর্থ হল ২০১৮ থেকেই JEXPO-র মাধ্যমে ডিপ্লোমাস্তরে ও WBJEE-র মাধ্যমে ডিগ্রি স্তরে ভর্তি হতে হবে। অতএব GKCIET বৈধ ডিপ্লোমা ও ডিগ্রি দিতে পারবে। তাহলে সমস্যা মিটল তো? আজ্ঞে না। এইবারে আসল সমস্যা। কী সেগুলো? আসুন, তাহলে দেখা যাক —
- ২০১০ থেকে অদ্যাবধি যারা সার্টিফিকেট কোর্স করেছেন, তাদের কোনও মান্যতা নেই।
- ২০১৪ থেকে ২০১৭য় যারা ডিপ্লোমা পাশ করেছেন, তাদেরও কোনও মান্যতা নেই।
- ২০১৬ ও ২০১৭য় যারা ডিগ্রির পরীক্ষায় পাশ করেছেন, তাদেরও কোনও মান্যতা নেই।
- এমনকি যারা এই অস্বীকৃত ডিগ্রি পেয়েছেন, তাদের ডিপ্লোমাহোল্ডার হিসাবে বি টেকে কো-ল্যাটারাল এন্ট্রির রাস্তাও বন্ধ। কারণ তাদের সার্টিফেকেটের কোনও মান্যতা নেই।
- সবমিলিয়ে মড্যুলার ব্যবস্থায় বি টেক ডিগ্রি অর্জন ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন যারা দেখেছিলেন, সেইসব ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ আজ অন্ধকার। ৬ বছর পড়াশুনো করার পর, বি টেক ডিগ্রির পরীক্ষায় পাশ করার পর এরা জানতে পারল এরা আসলে এখনও মাধ্যমিক পাশই আছে।
না, এই প্রতারিত ছাত্ররা চুপ করে বসে নেই। এরা ইন্সটিটিউট কর্তৃপক্ষ, প্রশাসন, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চশিক্ষা দপ্তরের সঙ্গে লাগাতার আলাপ-আলোচনা চালিয়েছেন। এখনও অবধি যেটুকু অগ্রগতি হয়েছে, সেটা এদেরই চেষ্টায়। এরা দিনের পর দিন অবস্থান চালিয়েছেন। ২৩ জুন থেকে এরা আমরণ অনশন শুরু করেন। প্রবল গরমে অনশনকারী অনেক ছাত্র অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৬ দিনের দিন এরা অনশন প্রত্যাহার করেন। সেই দিনটা ছিল ৮ জুলাই। আবার দ্বিতীয় পর্যায়ে জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে এরা লাগাতার অবস্থান শুরু করেছেন, যা এখনও অব্যাহত। এই পর্যায়ে মালদহ সহ অন্যান্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষ এদের পাশে দাঁড়াতে শুরু করেন। সংবাদমাধ্যমও খবর করতে শুরু করে। জুন মাসে যে খবর কেউই রাখতেন না, সেটা খানিকটা হলেও প্রকাশ্যে আসে। তিনদিন আগে, এদের কয়েকজন প্রতিনিধি কলকাতায় এসেছেন। তারা নানা জায়গায় সভা করছেন। একাডেমি অব ফাইন আর্টসের সামনে রাণুছায়া মঞ্চে গতকাল থেকে অবস্থানও শুরু করেছেন।
কিন্তু তাতে কি সমস্যা মিটবে? মনে হয় না। কারণ GKCIETর সমস্যাটা একটা আইনি জটে আটকে গেছে। প্রতিকার কীভাবে সম্ভব, সেটা বের করার জন্য আইনি জটটাকে বোঝা দরকার।
সমস্যা কোথায়
ভারতবর্ষে কারিগরি ও প্রযুক্তিবিদ্যা সংক্রান্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বীকৃতি দেয় All Indian Council for Technical Education। আর কলেজ স্তরে বিশেষ ধরনের শিক্ষাপদ্ধতির স্বীকৃতি দেয় University Grants Commission। GKCIET একদিকে যেমন ছিল নতুন প্রতিষ্ঠান, তেমনি মড্যুলার সিস্টেম ছিল নতুন শিক্ষাপদ্ধতি। ফলে AICTE ও UGC, দুই জায়গারই স্বীকৃতি প্রয়োজন। আর এই জায়গাতেই মার খেয়েছে ৮০০ ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ।
প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থায় পলিটেকনিক ডিপ্লোমা কোর্স তিন বছরের। মাধ্যমিক পাশ করেই তার এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসা যায়। আবার ডিগ্রির সময়সীমা চার বছর। সেক্ষেত্রে উচ্চ মাধ্যমিকের পর তার এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসা যায়। আবার পলিটেকনিক ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত কোনও ছাত্র ডিগ্রিতে সেকেন্ড ইয়ারে কো-ল্যাটারাল এন্ট্রি নিতে পারে। তার মানে মাধ্যমিকের পর পলিটেকনিক হয়ে ডিগ্রি পাবার জন্য ছাত্রের ছয় বছর সময় লাগে। মড্যুলার সিস্টেমেও সেই একই সময় লাগছে। তাহলে তো সমস্যার কোনও কারণ নেই।
আছে, এবং সেটাই এক্ষেত্রে মূল বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পলিটেকনিক সাধারণভাবে তিনবছরের কোর্স। কিন্তু মড্যুলারে দুই বছর। একবছর কম সময়টাই সমস্ত গণ্ডগোলের উৎস। এইজন্যই ডিপ্লোমাপ্রাপ্তরাও ডিগ্রিতে কো-ল্যাটারাল এন্ট্রি পাচ্ছেন না, নিয়মে আটকে যাচ্ছে বলে। আবার দুই বছরের ডিগ্রিরও মান্যতা নেই UGCর কাছে। ফলে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ও তাকে স্বীকৃতি দিতে পারছে না।
কেন্দ্রীয় সরকার যখন মড্যুলার পদ্ধতিতে কারিগরি শিক্ষা পদ্ধতির কথা ভাবলেন, তখন প্রথম কাজ ছিল UGCর থেকে এই পদ্ধতিকে স্বীকৃত করিয়ে নেওয়া। সেটা হয়নি। সম্ভবত এমন কোনও প্রস্তাব UGCকে দেওয়াও হয়নি। আর এখন পূর্বতন সরকারের অপদার্থতার অজুহাতে বর্তমান সরকার যে এগিয়ে আসবে না, সেটা বুঝতে খুব পণ্ডিত হবার দরকার নেই। সম্ভবত AICTEর স্বীকৃতি এক্ষেত্রে তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ। এই স্বীকৃতি কলেজের বৈধতা দেয়, ডিগ্রির নয়। মড্যুলার সিস্টেমের স্বীকৃতি ছাড়া পুরনো কোর্সের বৈধ স্বীকৃতি সম্ভব নয়। যে কারণেই MAKAUT চার বছরের রেগুলার ডিগ্রি কোর্সকেই স্বীকৃতি দিয়েছে, দুই বছরের মড্যুলার কোর্সকে নয়।
তাহলে উপায়
আইন তো মানুষের জন্য। যে স্থবির বিধানের জন্য ৮০০ ছেলেমেয়ে আজ পথে বসেছে, তার পরিবর্তন চাই। কিন্তু সেটা করবে কে? একদম প্রথম থেকে যারা কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে মড্যুলার সিস্টেমের দায়িত্বে ছিলেন, কলেজের গভর্নিং বডি, ডিরেক্টর, একজনও তার দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। GKCIET প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যাদের উদ্যোগ ছিল সবথেকে বেশি, গনি খান চৌধুরীর পরিবারের সেই সমস্ত রাজনৈতিক নেতানেত্রীরাও আজ হাত ধুয়ে ফেলতে পারেন না। এদের সকলের বিরুদ্ধেই পুলিশে প্রতারণার অভিযোগ করা যায়। তাতে যদি এদের শাস্তিও হয়, হতভাগ্য ছেলেমেয়েদের লাভ নেই। তাদের দরকার বৈধ সার্টিফিকেট।
ওয়াকিবহাল মহলের মতে একমাত্র হাই কোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টই পারেন এই সমস্যার সমাধান করতে। ২০১০ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত মড্যুলার সিস্টেমের স্বীকৃতি কোর্টের অর্ডারের মাধ্যমেই সম্ভব। যাবতীয় প্রচলিত নিয়ম অক্ষুণ্ণ রেখে UGC মড্যুলার কোর্সের স্বীকৃতি দিতে পারবে না। আর যদি সেই স্বীকৃতি না মেলে, তাহলে দুই বছরের পলিটেকনিক ডিপ্লোমাপ্রাপক হিসাবে ডিগ্রি কোর্সের সেকেন্ড ইয়ারে কো-ল্যাটারাল এন্ট্রি নেওয়াও সম্ভব নয়। আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা যত দ্রুত কোর্টের শরণাপন্ন হন, ততই মঙ্গল।