আনিসুল হক
উৎকণ্ঠিত, উদগ্রীব বিশ্ববাসীর সামনে আরও একবার দেখিয়ে দিল বাংলাদেশের মানুষ — এবারে স্কুল-কলেজের ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা — প্রতিবাদ, প্রতিরোধ কাকে বলে। এই ধরনের, বিশেষ করে তীব্রতার, প্রতিবাদের নজির সারা পৃথিবীতেই খুব কম দেখা যাচ্ছে আজকাল। এই উপমহাদেশের অন্যান্য দেশে তো একেবারেই দেখা যাচ্ছে না। এ এমন প্রতিবাদ, যাতে নিচু হয়ে আসে শাসকের ঘাড়। অন্তরে প্যাঁচ কষলেও লোকসমক্ষে সে ক্ষমা চেয়ে নিতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশের এই ছাত্র-উত্থান নিয়ে আমাদের মনে প্রশ্নও জাগছে অনেক। হয়তো আমাদের অবিশ্বাসী, ভীরু মানসিকতার জন্যেই এত আকুলতা, আমাদের, এই আন্দোলনকে আমাদের মনীষার মাপে এনে ফেলতে। প্রোক্রাস্টেসের মতন। যে ঘটনার সূত্রপাত পথ দুর্ঘটনায়, সে-ঘটনা এরকম প্রতিবাদের ঘনঘটায় রূপ নেবে, এমন তো আমাদের দেশগুলোতে হয় না মোটেও। আমাদের দেশের সুপারস্টার মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে পিষে দেন পথবাসীদের, আর আমরা দোষ দিই সেই পথবাসীদেরই। শহরের প্রাণকেন্দ্রে গাড়ির রেষারেষিতে প্রাণ হারান বহু মানুষ, মারা যায় শিশুরাও। তাতেও যথেষ্ট অবিচল আমরা স্রেফ দুটো লোকের মৃত্যুতে খুব বেশি আশ্চর্য যে হব না, সেটাই তো স্বাভাবিক। তাই আমাদের মনে প্রধান হয়ে ওঠে আন্দোলনের চালিকাশক্তির কথা, আন্দোলনের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তা।
কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে মাত্র কিছুদিন আগেই ঘটে গেল এমন কিছু ঘটনা, যার জেরে সরকার ছাত্রদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হলেন। মালদহের গনি খান কলেজের ঘটনায় হইচই তুলনায় কম হলেও কেউ কেউ তার খোঁজ রাখছেন বৈকি! বাংলাদেশের ছাত্রদের সহমর্মিতা দেখাল কলকাতাবাসী, এই তো কয়েকদিন আগেই, বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে।
এইসব হয়েও যেটা দেখা গেল না, তা হল আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে প্রতিবেশী বন্ধু দেশে এত বড় মাপের একটা সমস্যা নিয়ে একটিও ধ্বনি উচ্চারণ। Responding first as a leading power — এমন একটা সম্ভাষণে নিজেরাই নিজেদের ভূষিত করার পরেও রা কাড়লেন না আমাদের বিদেশমন্ত্রকের কোনও কর্তাব্যক্তি। বাংলাদেশে গোলমালের সূত্রপাত হয়েছে বিগত ঊনত্রিশে জুলাই। এতগুলো দিন কেটে গেলেও আজকে এই দুপুর পর্যন্ত কোনও একটা স্টেটমেন্ট বিদেশমন্ত্রক থেকে পাওয়া গেল না, যাতে করে এই ঘটনার বিষয়ে আমাদের দেশের মনোভাব সাফ হয়।
এই নীরবতার কারণ হিসাবে অনেকে দেখাচ্ছেন বর্তমান আওয়ামী লিগ সরকারের প্রতি ভারতের পক্ষপাতিত্বকে।
বস্তুত, পক্ষপাতিত্ব বলা হোক বা বন্ধুত্ব, আওয়ামী লিগ সরকারের সঙ্গে বর্তমান ভারত সরকারের যেমন সম্পর্ক, তেমন আগে আর কোনওকালে ছিল কিনা সন্দেহ। ২০০৯ সালে ‘হাসিনা আপা’ ক্ষমতায় আসার পর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতিসাধনের ফল, অন্তত ভারতের পক্ষে, অত্যন্ত সন্তোষজনক। জলবন্টন, তিনবিঘা করিডর, নাশকতাবিরোধী পদক্ষেপ, দ্বিমুখী বাণিজ্য, যানচলাচল চুক্তি, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার-বিষয়ক কথাবার্তা ইত্যাদি বিবিধ বিষয়ে ভারতের ইচ্ছাগুলো যতটা মর্যাদা এই সরকারের আমলে পেয়েছে, ততটা — নির্দ্বিধায় বলা যায় — আর কখনও পায়নি। এ-ছাড়াও, পৃথিবীর এই কোনায় অর্থনৈতিকভাবে আপাতত সবথেকে উল্লেখযোগ্য যে অংশ, অর্থাৎ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, তার সঙ্গে স্থলপথে সুসংযোগ রাখতে ও বাণিজ্য বাড়াতে মায়ানমার ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গত ভারতের পক্ষে একান্ত জরুরি। বর্তমান সরকার, সুতরাং, ভারতের পক্ষে আসলে মঙ্গলদায়ক, এ-কথা অস্বীকার করলে ঢাকাইয়া কুট্টির ‘ঘুড়ায় হাসব’। এমতাবস্থায় এ-দেশের সরকারের পক্ষ থেকে ওদেশের সরকারের প্রতি সমর্থন থাকবে এবং সমালোচনা থাকবে না, এই সত্যকে স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। স্বীকার করতে হবে এই কথাও, যে কোন বিষয় প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার যোগ্য আর কোন বিষয় নয়, তা স্থির করে দেয় রাজনীতি, বা ‘রাজনৈতিক বাস্তবতা’। কোনও দায়িত্ববোধ নয়।
ব্যাপারটা এতটা সরল হতেই পারত। কিন্তু এখানে বাদ সাধছে কিঞ্চিৎ সমস্যা, যার মূলে রয়েছে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলকে ঘিরে তৈরি হওয়া একগুচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা। স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যার অংশ হয়ে পড়েছে এই অঞ্চলের দেশগুলি। আর শুধু তাও তো নয়। এই অঞ্চলের দেশগুলি ছাড়াও আর যে দুটি দেশ এই অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে চাইছে, তাদের নাম যথাক্রমে আমেরিকা ও চিন।
এখানে দেখার বিষয় হল, পশ্চিমে পাকিস্তান, উত্তরে নেপাল এবং গোটা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া চিনের সঙ্গে হৃদ্যতা বাড়াতে, বা বেড়ে-ওঠা হৃদ্যতাকে যত্নে রাখতে উৎসুক। এদিকে আমেরিকার বন্ধু হয়ে আছে পূর্ব এশিয়ার জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া, এবং দক্ষিণ পূর্বের একেবারে শেষ দেশ অস্ট্রেলিয়া। অর্থাৎ, এই অঞ্চলে আমেরিকা যদি নিজের প্রভাব বিস্তার করতে চায়, তবে তাকে ভারতের হাত ধরতেই হবে, এবং সঙ্গে দেখতে হবে কোন কোন প্রকারে চিনের দক্ষিণের অগ্রগতিকে আটকানো যায়। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশে চিনের প্রভাব যথেষ্ট, এবং সেই প্রভাব যে ক্রমবর্ধমান সে নিয়ে কোনও সংশয় নেই।
সমস্যার শুরু এখানেই। ঐতিহাসিকভাবে আমেরিকা বিএনপিকে বেশি ভরসা করে। এই ভরসার শুরু অনেক আগে হলেও বন্ধুত্ব দানা বাঁধে কিসিঞ্জারসাহেবের আমলে। সেই কারণেই লোকে বলে এই কিসিঞ্জারসাহেবের হাতে রক্ত লেগে আছে অগুনতি বাঙালির, ১৯৭১-এর বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে। এদিকে আমেরিকা ও ভারত — ওপর-ওপর দোস্তি দেখা গেলেও তাতে চিড় ধরেছে কিছুদিন হল। ফলে ভারত হাসিনাকে সমর্থন করলেও আমেরিকার সমর্থন থাকবে বেগমসাহেবার প্রতি। ভারতের সঙ্গে চিনেরও সমর্থন পেয়ে যেতে পারেন শেখ হাসিনা ওয়াজেদ। এর ফলে একটা রক্তক্ষয়ী নির্বাচনের পর শত সমালোচনা সত্ত্বেও ক্ষমতায় তাঁরই ফিরে আসাটা কিছুই বিচিত্র নয়।
সব মিলিয়ে মনে হয়, আগামী পাঁচ বছরের স্থিতাবস্থার পর দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় তাদের উপস্থিতি আরও স্পষ্ট করে জানান দেবে চিন। ভারত ধীরে ধীরে আমেরিকার তাঁব থেকে বেরিয়ে এসে সেই প্রতিপত্তির একটা অংশ ভাগ করে নিতে চাইবে। আর ততদিনে নেপাল, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত আর মায়ানমারের মধ্যে যানচলাচলের চুক্তি — যা কিনা আদতে আমেরিকার মদতপুষ্ট — বাস্তবায়িত হয়ে যায়, তবে সেই যোগাযোগব্যবস্থার সুবিধা নিতে একটা মরণকামড় দেবার চেষ্টা করবে আমেরিকা।
পুবের হাওয়ায় তরীখানি তার, এই ভাঙা ঘাট কবে হবে পার… অপেক্ষা এখন তারই।