সুমনা রহমান চৌধুরী
কুলসুমা বিবি, পেশায় ভিক্ষুক। গ্রাম সাদারাশি, জেলা করিমগঞ্জ, রাজ্য অসম। মে মাসের এক সকালে তাঁর বিলাপ শুনে প্রতিবেশীরা হতদন্ত হয়ে ছুটে এল ঘরে। বিলাপের কারণ জিজ্ঞাসা করায় কুলসুমা বিবির বক্তব্য, এন আর সি’র কাগজপত্র ভেরিফিকেশনে তাঁর NSK সেন্টার পড়েছে হোজাই। এবারে সে ভিক্ষা করে পেট চালায়, হোজাই যাওয়ার ট্রেন ভাড়া কোথায় পাবে, থাকবে কোথায় ওখানে গিয়ে আর তাঁকে নিয়েই বা যাবে কে? সে তো কোনওদিন নিজের গ্রাম আর বাপের বাড়ির গ্রামের বাইরে আর কোথাও যায়নি! এহেন অবস্থায় প্রতিবেশীরা হয়তো টুকটাক টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু সাথে কে যাবে সেটা তারা নিজেরাও বুঝতে পারছে না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তারা কুলসুমার বিলাপ শুনে যাচ্ছে।
পাঠকগণ যারা হোজাই করিমগঞ্জের দুরত্ব জানেন না তাদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি করিমগঞ্জ থেকে হোজাই যেতে দশ ঘণ্টা সময় লাগে ট্রেনে। অর্থাৎ দূরত্ব প্রায় ২৫০ কিমি। শুধু একজন কুলসুমা বিবি নয়, এই মুহূর্তে কয়েক হাজার, কয়েক লক্ষ সাধারণ মানুষের একই রকমের সঙ্কট গোটা অসম জুড়ে।
পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরাসহ গোটা দেশ অসমের এন আর সি নিয়ে বেশ চিন্তিত। অসম নিজেও। আপাতত চল্লিশ লক্ষ মানুষের নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত খসড়ায় জায়গা হয়নি! তাদের ভবিষ্যৎ কী সেটা নিয়েও উৎকণ্ঠিত সারা দেশ। তারা নিজেরাও। এবারে তা নিয়ে চলছে পর্যালোচনা, অসমের ইতিহাস, অসম চুক্তি, অসমীয়া-অনঅসমীয়া সম্পর্ক, বিজেপি, কংগ্রেস, আসু-র রাজনীতি ইত্যাদি নতুন করে চর্চা, আলোচনা-সমালোচনা। চলুক। আপত্তি নেই। কিন্তু যে কথাগুলো কেউ বলছে না, সেটা হল এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া চলাকালীন কুলসুমা বিবিদের মতো কয়েক লক্ষ সাধারণ মানুষ, যাদের দিন আনি দিন খাই অবস্থা তারা কী ভয়ঙ্কর সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন, হচ্ছেন এবং সম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ না হওয়া অবধি হবেনও! ব্যক্তিগতভাবে, আমার ভয় এবং আশঙ্কা হচ্ছে নোটবন্দির সময় ভয়ঙ্কর দুর্দশার সম্মুখীন হয়ে যে শতাধিক মানুষ সারা দেশে মারা গিয়েছিলেন, এবং সরকার পরে সেই মৃত্যু অস্বীকার করেছিল, এবারে অসমে ঠিক কতজন এরূপ অবস্থার সম্মুখীন হতে চলেছেন? নিউজ চ্যানেলের রিপোর্ট অনুযায়ী ইতিমধ্যেই লিস্টে নাম না থাকার আশঙ্কায়, ভিটেমাটি হারানোর আশঙ্কায় মানসিক চাপ নিতে না পেতে বেশ কিছু মানুষের মৃত্যু হয়েছে, সেই সংখ্যাটা কত-তে গিয়ে দাঁড়াতে চলেছে?
যখন এন আর সি-র প্রথম খসড়া প্রকাশ পেয়েছিল এবং তাতে যাদের নাম আসেনি, যাদের লিগ্যাসি ডাটা, বংশবৃক্ষ এসবে কিছু ভুল হয়েছিল বা এন আর সি কর্মীদের সন্দেহ হয়েছিল তাদের ডকুমেন্ট নিয়ে, তাদের ডাকা হয়েছিল NSK সেন্টারগুলোতে। এবারে সেই ডাকার কিছু নিয়ম ছিল — ধরুন একজনের বাড়ি উত্তর করিমগঞ্জ ব্লকে, তার ডাক পড়েছে আপার অসমের গুয়াহাটি, যোরহাট, হোজাই, শিলচর, হাইলাকান্দি ইত্যাদি কোনও NSK সেন্টারে। আবার আপার অসমের ধুবড়ি, হোজাই, শোণিতপুর ইত্যাদি জায়গার বেশিরভাগ মানুষের সেন্টার পড়েছিল নিম্ন অসম মানে করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, কাছাড়ে। আবার দক্ষিণ করিমগঞ্জের অনেক মানুষের সেন্টার পড়েছিল উত্তর করিমগঞ্জ অথবা বদরপুর অথবা হাইলাকান্দি, কাছাড়। এই জায়গাগুলোর একের অন্যের থেকে দূরত্ব শুনবেন? ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই, করিমগঞ্জ থেকে গুয়াহাটি সদরে যেতে বাসে, ট্রেনে এগারো ঘণ্টা সময় লাগে। রামকৃষ্ণনগর থেকে কালিগঞ্জ আসতে গাড়িতে তিনঘণ্টা সময় লাগে।
এবারে সেন্টারগুলোর কিছুটা ধারণা দেই। নিম্ন অসমের বেশিরভাগ গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসগুলোর কী দুর্দশা সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। জরাজীর্ণ অফিস, ছোট রুম, মানুষ বসার জায়গা নেই, তার উপর এন আর সি-র ভেরিফিকেশনে আসা মানুষদের লাইন ধরে দাঁড়ানোর জন্যে বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড বানানো হয়েছে ওই অকুলান জায়গায়। মানুষজন ঠাঁঠা রোদে লাইন দিয়ে বাইরে দাঁড়ানো আর ভিতরে কর্মীরা ফ্যানের নীচে বসে প্রতিদিন সাত-আটশো মানুষের কাগজ ভেরিফিকেশন করছেন। আর ফ্যান যে সবসময় চলে তাও নয়, কারণ বরাক উপত্যকায় ইলেকট্রিসিটির অবস্থা ভয়াবহ। দিনে-রাতে বেশিরভাগ সময়ই লোডশেডিং থাকে, গড়ে পাঁচঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে সারাদিন-রাত মিলিয়ে। তার উপর মে-জুন-জুলাই-অগাস্ট ভয়াবহ গরম থাকে এদিকে। এবারে এন আর সি যেহেতু প্রচুর মানুষের হচ্ছে তাই শুধু গ্রাম পঞ্চায়েতগুলোতেই এত মানুষের কাজ করা সম্ভব নয় বলে কিছু সরকারি বিদ্যালয়ও ব্যবহার করা হয়েছিল ভেরিফিকেশন সেন্টার হিসেবে। এবারে শুধু করিমগঞ্জ সদর শহর বাদে বৃহত্তর গ্রামগঞ্জের সরকারি বিদ্যালয়ের চেহারা ওই গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসগুলোর মতোই ভয়াবহ।
মোদ্দা কথা, মানুষ সেন্টারগুলোর সামনের বারান্দা থেকে প্রধান রাস্তা অবধি লাইন দিয়ে দাঁড়াতেন কাগজ ভেরিফিকেশন করাতে। অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ পরিবারের কাচ্চা-বাচ্চাকেও হাজির হতে হয়েছে এই কাগজ ভেরিফিকেশন করাতে। এবং সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা অব্দি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। অশীতিপর বৃদ্ধা-বৃদ্ধা কেউ কেউ দাঁড়াতে না পেরে বারান্দার কোণে, সামনের মাঠে বা রাস্তার ধারে শুয়ে থেকে অপেক্ষা করেছেন ডাক আসার।
এবারে ডাক আসার পর দেখা গেল যে কাগজ এনেছে সেটা অফিসারদের মতে ঠিক নয়, আবার আশঙ্কা উৎকণ্ঠা নিয়ে বাড়ি ফিরে পরেরদিন আবার সেন্টারে হাজির হতে হয়েছে।
আমার মা যিনি উত্তর করিমগঞ্জের বাসিন্দা, ভোটার লিস্ট, রেশন কার্ড ইত্যাদি সব ডকুমেন্টে ঠিকানা রয়েছে — ব্লক উত্তর করিমগঞ্জ, গ্রাম ডিমপুর, গ্রাম পঞ্চায়েত সুতারকান্দি-কুরিখালা। তাঁরও একটা কাগজ জমা না করায় ডাক পড়েছিল দক্ষিণ করিমগঞ্জের অন্য একটা গ্রাম পঞ্চায়েতের NSK সেন্টারে। আমার মা এক গুরুতর কিডনি-রোগী। একটা কিডনি বিকল, অন্যটারও আশি ভাগ বিকল। প্রতি ছয়মাস অন্তর মা’কে ভেলোরে চিকিৎসার জন্যে যেতে হয় এবং সেখানকার ডাক্তার সম্পূর্ণ বেড রেস্ট লিখে দিয়েছেন। এহেন অবস্থায় ওই চুড়ান্ত গরমে সকাল আটটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে সারাদিন সেন্টারে লাইন দিয়ে (যেখানে একটা ভালো বসার জায়গা নেই, ফ্যান নেই, খাওয়ার হোটেল নেই, লোকজন দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ঠাঁঠা রোদে) কাগজ জমা দিয়ে বিকেল পাঁচটায় অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন।
এবারে যাদের মোটামুটি টাকাপয়সা আছে, তারা হয়তো গাড়ি রিজার্ভ করে বা নিজের গাড়িতে চড়ে একদিন পিকনিক এবং কাগজ জমা দুটোই মহানন্দে করে আসতে পারেন, কেউ কেউ করেছেনও। কিন্তু যাদের দিন আনি দিন খাই অবস্থা (বলা বাহুল্য এই সংখ্যাটাই বেশি), তারা এই গাড়িভাড়ার টাকাটা কোথা থেকে যোগাড় করবেন? প্রথম খসড়া বেরোনোর পর NSK সেন্টারে যাদের ডাক পড়েছিল, আমি নিজে সেইরকম কয়েকশো মানুষের সাথে কথা বলেছি, ইন্টারভিউ নিয়েছি। আমার অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। কুলসুমা বিবির কথা শুরুতেই বলেছি। আরেকজন মহিলা, ঠিকা কাজ করেন লোকের ঘরে, তিনি সারাদিনের ঠিকা কাজ ফেলে পাশের বাড়ির থেকে দুশো টাকা ধার নিয়ে কাগজ জমা দিতে এসেছেন, কিন্তু অফিসার বলছে এই কাগজে হবে না, আরেকটা কাগজ নিয়ে কাল আসতে। আশঙ্কা আর বিষাদ নিয়ে বাড়ি ফিরছে সে। আরেকজন লোক, যে মাঠের ধানের কাজ ফেলে কোনওরকমে এসেছে কাগজ জমা দিতে। হাতে ফেরার গাড়িভাড়া নেই। ব্যাগ থেকে একশো টাকা দিয়েছিলাম তাকে। এরকম হাজার হাজার লোকের কাহিনী একই। গরমে দশটাকা দিয়ে এক বোতল ঠান্ডা জল কিনে খাওয়ার ক্ষমতা নাই এদের। আর এই ফাঁকে গাড়িওলাও দশটাকার ভাড়া করে দিয়েছিল পনেরো টাকা। জেরক্স দোকানদার সুযোগ বুঝে এক টাকার জেরক্সের দাম করে দিয়েছিল তিনটাকা। ফোটোওয়ালা এককপি ফোটো প্রিন্টের দাম হাঁকিয়েছিল দশ টাকা, যা কিনা আসলে পাঁচ টাকা। অশিক্ষিত বৃহত্তর গ্রামের লোক নিজের এন আর সি ফর্মটা অবধি ফিল আপ করতে না পেরে অন্য লোককে একশো-দুশো-তিনশো-হাজার টাকা দিয়ে ফর্ম ফিল আপ করিয়েছিল। যাদের জমির পাট্টার কাগজ, ভোটার লিস্ট, বা অন্য ডকুমেন্ট নিজের কাছে রাখা নেই, কোনওদিন রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি, তাদের কাগজ বিভিন্ন অফিস (ইলেকশন অফিস, সাব-রেজিস্টার অফিস) থেকে বের করে আনবে বলে কিছু মানুষ দশ-বারো-বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা দাম হাঁকিয়েছে। গরীব মানুষগুলো ঘরের সোনা দানা, জমি বিক্রি, ধার-দেনা করে সে টাকা যোগাড় করেছে। এসবই আমার নিজের চোখে দেখা। এই লেখাটা লেখা অবধি খবর পেলাম গ্রামের মানুষ যাদের নাম এন আর সি লিস্টে আছে, তাদের এই নামসহ লিস্টটা প্রিন্ট আউট করে দিতে বিভিন্ন এন আর সি কর্মী (অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, পঞ্চায়েত প্রতিনিধি) পাঁচশো টাকা রেট ফিক্স করেছে। এক কপি প্রিন্ট আউট পাঁচশো টাকা। আমার নিজের গ্রামের ঘটনা। চূড়ান্ত দুর্নীতিগস্ত একটা ব্যবস্থা গরীব মানুষকে শুষছে। অথচ প্রশাসন, সরকার, জনপ্রতিনিধি, কারও কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই।
যে গরীব মেয়েগুলো অন্য রাজ্য থেকে বিয়ে হয়ে এসেছে এখানে, তাদের অবস্থা আরও ভয়ানক। অনেকের বিয়ের রেজিস্ট্রি নেই, ধর্মমতে বিয়ে হয়েছে। এবারে সে যে ওই লোকটির বউ সেটা প্রমাণ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। অশিক্ষিত। তাই কাগজপত্র এসব এত বোঝে না। আগের যুগের মানুষ যারা, তারা এতসব কাগজপত্রের মারপ্যাঁচ বুঝতেন না। মৌখিকভাবেই গ্রামে জমি কেনাবেচা সহ অন্যান্য সব কাজ চলত। এবারে তাদের অনেকেই হয়তো স্বাধীনতার আগে থেকে এখানকার বাসিন্দা, কিন্তু প্রপার কাগজ নেই, একথা প্রমাণের জন্য তারা পড়েছেন অকুল সমুদ্রে। তারা বলছেন, “যদি জানতাম এই দুহাজার আঠারো সালে এসে নিজের দেশেই নিজেকে নাগরিক প্রমাণ করতে হবে, তবে সব কাগজপত্র জমিয়ে ট্রাঙ্কে ভরে রাখতাম!” এই মানুষগুলোর হাহাকার অসমের আকাশে ঘুরছে।
রবীন্দ্রনাথের কাদম্বরীকে মরে প্রমাণ করতে হয়েছিল সে আসলে মরেনি। আর আমাদের লক্ষ লক্ষ ভারতবাসীকে রোজ একবার করে মরে গিয়ে প্রমাণ করতে হচ্ছে তারা আসলে ভারতীয় নাগরিকই, অনুপ্রবেশকারী নয়, বিদেশি নয়। স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে এর চেয়ে বড় লজ্জা আর কী হতে পারে?? পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের এই রূপ দেখে ‘নাজি’রাও হয়তো লজ্জা পাবে!
আমার খুব আশঙ্কা হচ্ছে ত্রিশ অগাস্ট থেকে হয়তো আবার এই ভয়ানক দুর্দশার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে তাদের সাথে! যে গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে যে পরিবার তার NSK সেন্টার তার গ্রাম পঞ্চায়েতে না হয়ে একশো-দুশো-চারশো কিলোমিটার দূরে ফেলার কারণ বা যুক্তিটা ঠিক কী, এটা আমি আজও বুঝতে পারিনি। মানুষকে এই দুর্বিষহ অবস্থার মাঝে ফেলে কী মজা পেলেন আইন প্রণেতারা, এটাও ঠিক বুঝতে পারছি না!
এবারে, আরেকটা চিন্তার বিষয় হচ্ছে “ক্লেইম এন্ড অবজেকশন” বিষয়টি। “ক্লেইম” ঠিক আছে না হয় করা গেল। অসুবিধা নেই। কিন্তু “অবজেকশন” বিষয়টি শঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। ধরুন ‘ক’ আর ‘খ’ দু’জন এক গ্রামের এবং দু’জনের শত্রুতা আছে। এবারে ‘ক’-এর নাম ভারতীয় নাগরিক হিসেবে লিস্টে এসেছে। কিন্তু ‘খ’ শত্রুতা করে অভিযোগ করে বসল ‘ক’ ভারতীয় নয়, ভুল করে নাম এসেছে। যেহেতু আমরা আইনের ভাষায় জানি অভিযোগ যে করে, অভিযোগ প্রমাণের দায়ও তার থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণের দায় যার উপর অভিযোগ করা হবে তার। তাকে আবার কাগজ, ডকুমেন্টস সব নিয়ে দৌড়োতে হবে NSK সেন্টার আর ট্রাইবুন্যালে নিজেকে ভারতীয় প্রমাণ করতে! আর এই কাগজ নিয়ে দৌড় যে কত মারাত্মক সেটা গত একবছরে প্রত্যেকজন অসমবাসী হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন।
তৃতীয় চিন্তার বিষয় যে মানুষগুলো আরও নির্দিষ্ট করে বললে যে কয়েক লক্ষ গরীব মানুষ নিজেকে ভারতীয় প্রমাণ করতে শেষ অবধি ট্রাইবুন্যালে ছুটবে, তারা উকিল ধরার টাকা কোথায় পাবে? মামলা চালানোর টাকা কোথায় পাবে? সরকার কি তাদের মামলার ব্যয়ভার বহন করবেন? কে না জানে উকিলের রাক্ষস ক্ষিদে মেটানোর মতো টাকা, আর মামলা চালিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত মানুষেরই থাকে না, আর এরা তো নিম্নমধ্যবিত্ত! সরকার, রাষ্ট্র কি এদের মামলা চালানোর টাকা দেবে? উকিল দেবে? ওদের আইনি ন্যায় পাইয়ে দিতে সাহায্য করবে? এদিকে আজকের খবরে প্রকাশ, চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি প্রকাশের পর লক্ষ লক্ষ মানুষ যাদের নাম আসবে না তাদের কাছে বিচার চাওয়ার একমাত্র রাস্তা যখন বিদেশি ট্রাইবুন্যাল, তখন রাজ্যের একশোটি ট্রাইবুন্যালের বিচার প্রক্রিয়া প্রশ্নের সম্মুখীন। “নাগরিক অধিকার সুরক্ষা মঞ্চ” নামক শিলচরের এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অভিযোগ “ট্রাইবুন্যালের বিচার প্রক্রিয়ায় সরাসরি সরকারের হস্তক্ষেপ চলছে। পরিস্থিতি এমন যে, বিদেশি ট্রাইবুন্যালের যে সব সদস্য তুলনায় কম মানুষকে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করেছেন, তাদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। ট্রাইবুন্যালের সদস্যদের পারফরম্যান্স খতিয়ে দেখার ভার যেখানে হাইকোর্টের, সেখানে নিয়ম ভেঙে সেই কাজ করছে সরকার। সংগঠনটি সুপ্রিম কোর্টেও স্মারকপত্র পাঠিয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য যে ইতিমধ্যেই যাদের “ডি” মানে ডাউটফুল ভোটার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে গত কয়েকবছরে, সেইসব নব্বই শতাংশ প্রান্তিক মানুষের মামলা চালিয়ে যাওয়ার টাকা নেই। তাই ডিটেনশন ক্যাম্প (যেহেতু প্রাইমারিলি কোনও ডিটেনশন ক্যাম্প নেই, তাই জেলে অন্যান্য কয়েদিদের সাথেই রাখা হচ্ছে) আরও স্পষ্ট করে বললে “কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প” নামক অমানবিক জায়গায় পচে মরছে প্রকৃত ভারতীয় হওয়া সত্ত্বেও। কিছু সংখ্যক মানুষ যারা মামলা চালিয়ে মহামান্য আদালতে আগে প্রমাণও করেছে তারা সন্দেহযুক্ত ভোটার নয়, তাদের বেশিরভাগের নামও এন আর সি-তে আসেনি। মানুষের ঘরে ঢুকে, চ্যাংদোলা করে পুলিশ তাদের ডিটেনশন ক্যাম্প নামক জেলে নিয়ে গেছে। পিছনে বাচ্চারা হাপুস নয়নে কাঁদছে। বউ পুলিশের পা জড়িয়ে ধরছে নিয়ে না যাওয়ার জন্যে। ডান্ডা মেরে পুলিশ পা ছাড়াচ্ছে। ডিটেনশন ক্যাম্প বলে যা চালানো হচ্ছে সেটা আসলে জেল। সেখানে চোর, ডাকাত, খুনী, ধর্ষকসহ অন্যান্য ক্রিমিন্যালদের সাথে রাখা হচ্ছে এই মানুষগুলোকে। মেয়েদের কোনও নিরাপত্তা নেই সেখানে। এত ভয়াবহ এবং আমানবিক জায়গা সেটা, বোধহয় সেখান থেকে খোলা আকাশের নীচ কিংবা রেলের প্ল্যাটফর্মও অনেক বেশি নিরাপদ, অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর। পর্যাপ্ত খাওয়ার নেই, বাচ্চাগুলোর স্কুলে যাওয়া নেই, কাজ নেই, শিক্ষা নেই, চিকিৎসা নেই, ওষুধ নেই, রিক্সা চালানোর অব্দি লাইসেন্স নেই, কারণ ভারতীয় বলেই তো রাষ্ট্র তাদের মানছে না, লাইসেন্স দেবে কেন! সর্বদা আশঙ্কিত এই মানুষগুলো। সর্বদা ভয়ার্ত। সরকার, সাধারণ মানুষ তাদের ‘বাংলাদেশি’ বলে দাগিয়ে দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলছেন এদের গুলি করে উড়িয়ে দিয়ে দেশকে বিদেশিমুক্ত করতে। রাতারাতি নিজের জন্মভিটে, কাজ, আশ্রয় ছেড়ে দেশহীন, সমাজহীন, রাষ্ট্রহীন তারা। নিজেরাও জানে না তাদের ভবিষ্যৎ কী, তাদের ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ কী!
একজন মানুষের নিজের সম্মান এবং ডিগনিটি বজায় রাখার দায় যেরকম তার নিজের উপর, ঠিক সেরকম রাষ্ট্রেরও দায় থাকে তার প্রত্যেকজন নাগরিকের সম্মান বজায় রাখা। তাহলে এই যে এতগুলো লোকের রোজদিন সম্মানহানি হচ্ছে, বিদেশি, অনুপ্রবেশকারী ইত্যাদি তকমায়, হয়রানি হচ্ছে, মরছে অপমানে আশঙ্কায়, এখানে কি রাষ্ট্রের কোনও দায় নেই? রাষ্ট্র কি তবে তার নাগরিকদের ডিগনিটি বজায় রাখতে ব্যর্থ? প্রশ্ন জাগে।
প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের এহেন দুর্দশাময় অবস্থা দেখেও যারা হিন্দু মুসলমান করে যাচ্ছেন, করুণা হয় তাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে। এবং যেসব ছেলে-মেয়ে, বুড়ো-জোয়ানদের সকাল বিকেল গেলানো হচ্ছে, এন আর সি আসলে মুসলমান খেদানো, এবং মুসলমান খেদালেই চল্লিশ লক্ষ চাকরি এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধে তাদের, তাদের ছোট্ট করে জানিয়ে রাখি এই চল্লিশ লাখে (চূড়ান্ত তালিকায় আরও বাড়তে পারে) শুধু মুসলমান নেই, হিন্দুরাও আছেন। এবং শুধু চল্লিশ লাখ নয়, ভারতবর্ষ থেকে সব মুসলমান খেদিয়ে দিলেও তারা চাকরি পাবে না, কারণ চাকরির কোনও ক্ষেত্রই তৈরি হয়নি গত কয়েক বছরে, বরং যা আছে সেটাও কর্পোরেটদের হাতে চলে গেছে ইতিমধ্যেই। তাই ভারতবর্ষকে হিন্দু-স্থান বানানোর বেলুন আসলে চুপসেই আছে, কিন্তু ভারতবাসী “রামরাজ্য সিনড্রোম”-এ আক্রান্ত হয়ে নিজের বসা ডালেই ক্রমাগত কুঠারাঘাত করে চলেছে! এটাই সর্বকালের সেরা আয়রনি।