Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বস্তারে মাইনিং — চার

উত্তর বস্তারের মাইনিং

অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী

 

(তৃতীয় পর্বের পর)

 

উত্তর বস্তারের চারগাঁও মেটাবোদেলি গ্রামে নিক্কো-জয়সওয়াল কোম্পানি চালিত লৌহখনির বিরুদ্ধে জনরোষ ও গণপ্রতিরোধ – ২০১৬-১৭

উত্তর বস্তারের ঘটনা। কাঙ্কের জেলার পাহাড় জঙ্গলে গায়ে গায়ে লাগা গ্রাম চারগাঁও ও মেটাবোদেলি। নিক্কো-জয়সওয়াল কোম্পানি সেইখানে আকরিক লোহার খাদান চালু করছে। আগের একটা চ্যাপ্টারে এটার কথা লিখেছি। সামনে অক্টোবর মাসে ঐখানে নাম-কা-ওয়াস্তে গণশুনানি হবে — মাইনের ‘কেপাসিটি এনহ্যান্সমেন্ট’ হবে, আরও বেশি লোহা তুলবে নিক্কো জয়সওয়াল। গ্রামদুটোকে সম্পূর্ণ গিলে নিয়ে ব্যাপক বিস্তার হবে তার। ইতিমধ্যে এই সেপ্টেম্বরেরই ১০-১২ তারিখ নাগাদ গ্রামবাসী তথা মাইনের ঠিকে-মজুরদের সাথে বচসা হয়। এর জেরে মাইন-কোম্পানির ম্যানেজারবাবু ক্যাম্পের দ্বারস্থ হয়। ফলত, ২০১৬-র অগাস্টের ১৪ কি ১৫ তারিখ, কিছু গ্রামবাসীকে ক্যাম্পে তুলে মাওবাদীদের ব্যবহৃত কালো পোষাক পরিয়ে ছবি তোলা হয়, খুব সম্ভবত নথিভুক্ত করা হয় ‘সারেন্ডার্ড’ হিসেবে, যদিও এ’বিষয়ে কোনও অফিশিয়াল অ্যানাউন্সমেণ্ট এখনও করা হয়নি। কাঙ্কের জেলার বিষয়ে অতটা খবর হয় না। প্রচুর মাইন মাথা তুলছে এইখানে। অবুজমাড় লাগোয়া রাওঘাট পাহাড়ে গড়ে উঠছে বিরাট আয়রন ওর মাইন। এই পাহাড়ের প্রতিটা গ্রামে বিএসএফ ক্যাম্প। বোড়েনার, এটেবালকা, হুররা পিঞ্জোরি, পাল্লাকসা, আনজ্রেল, বুধিয়ারমাড়হি, ভৈঁসগাঁও প্রভৃতি গ্রামের উপর নেমে আসা রাষ্ট্র ও পুঁজির চরম প্রহারের কথা উপরে লিখেছি। এর সাথে সংযোজন মেটাবোদেলি ও চারগাঁও। এছাড়াও দল্লি রাজহারা থেকে ভানুপ্রতাপপুরগামী রাস্তাটার দুই ধারে, ফৌজি আদরেই, গড়ে উঠেছে অজস্র বক্সাইট ও লোহার খনি। উত্তর বস্তারের পাহাড় জঙ্গল ঢাকা উত্তর মাথাটা যেইখানে জুড়ে গ্যাছে রাজনন্দগাঁও ও বালোদ জেলার সাথে, সেইখানেই, মহামায়া ও দুলকি ছাড়াও, আরও নানান মাইনে মাইনে ছয়লাপ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ, আর সেই সাথে বেড়ে চলেছে ফৌজি তাণ্ডব। গতবছর পাল্লামাড়হি গ্রামে অবস্থিত প্রাইভেট লোহার খনি সারদা মাইন — যারা মূলত লোহা সাপ্লাই দেয় জিন্দালকে — তাদের ম্যানেজারকে মাওবাদীরা পুড়িয়ে মারার পর অঞ্চলে আক্ষরিক অর্থেই যেন রে’ন অব টেরর নেমে এসেছে রাষ্ট্রের। ক্যাম্পগুলো চোখে চোখে রাখছে গ্রামবাসীদের। জনা পঁয়তাল্লিশ লোক পুলিশের হিটলিস্টে রয়েছে। জনা সাতেক অ্যারেস্টেড-ও হয়েছে। মাইনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি আওয়াজ উঠিয়েছিলেন প্যাটেল জয়সিং। তাঁকে তখন পুলিশ, জমির দালাল, খনির দালাল ইত্যবিধ অশুভশক্তির নানান উপদ্রবের সম্মুখীন হতে হল।

তবে কাঙ্কের জেলার মেটাবোদেলি আয়রন ওর মাইন — যেখানে প্রথমে আদিবাসী সমাজ নন-মেকানাইজড কমিউনিটি মাইনিং করতে উদ্যত হলে আদিবাসীদের হাত থেকে মাইন ছিনিয়ে নেয় নিক্কো জয়সওয়াল কোম্পানি এবং যে ছিনিয়ে নেওয়া ও তজ্জনিত অসন্তোষ দমন করতে চারগাঁও-মেটাবোদেলি গ্রামের দুইদিকে বিএসএফ ক্যাম্প বসিয়ে এবং ঘনঘন গ্রামবাসীদের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে নকশাল উর্দি পরিয়ে ছবি তুলিয়ে শাসিয়ে চলা হচ্ছে, সেইখানে শুধু সেপ্টেম্বর নাগাদ মাইন-এক্সটেনশনের জন শুনওয়াইতে প্রতিবাদ করেই ক্ষান্ত থাকেননি মেটাবোদেলির মানুষেরা। সেখানকার ও আশেপাশের গ্রাম থেকে যত স্থানীয় মজদুর নিক্কো-জয়সওয়ালের খনিতে কাজ করতেন, তাঁরা ২০১৭-র একদম শুরু থেকে স্ট্রাইক ডাকলেন, লোডিং না করেই ফিরে যেতে লাগল কোম্পানির ট্রাকগুলো।

কাঙ্কেরের ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর পরিস্থিতি দেখলেই বোঝা যায় যে বস্তারে এই যে বিপুল সামরিক আয়োজন, তার মূলে রয়েছে আদিবাসীদের সরিয়ে লোহা ও বক্সাইট তোলার ধান্দা। নকশাল-দমন বাহানা মাত্র।

সংযোজন : বস্তারের ‘বিকাশ’মূলক প্রকল্প-তালিকা (২০১৬)

২০১৬ সালে বস্তারে গড়ে উঠতে থাকা বিভিন্ন মাইন, কারখানা, বাঁধ, পথ ইত্যাদি তথাকথিত ‘ডেভলপমেন্ট’ প্রকল্পের একটা খসড়া তালিকা দেওয়া হল টেবিল আকারে। এই তালিকা বাংলাপাঠী নন এমন অনেক ব্যক্তির পক্ষেও প্রয়োজনীয় হতে পারে। অতএব, ব্যবহারিক উপযোগিতার কথা ভেবে, টেবিলের কনটেন্ট ইংরাজি ভাষায় দেওয়া হল।

 

বস্তারে মাইনিং সমাপ্ত