Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

জনস্বার্থে সমঝোতা, অনৈতিক আপোষ নয়

অলিক চক্রবর্তী

 

সাক্ষাৎকার : গ্রাউন্ডজিরো

ভাঙড় আন্দোলন একটা রফাসূত্রে পৌঁছেছে। সে নিয়ে বিতর্কও চলছে। এ নিয়ে আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা অলিক চক্রবর্তীর এই সাক্ষাৎকারটি গত ১৬ই আগস্ট গ্রাউন্ডজিরো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গ্রাউন্ডজিরো-র সম্পাদক প্রমোদ গুপ্তের অনুমতিক্রমে আমরা এটি এখানে পুনঃপ্রকাশ করছি। বানান এবং সজ্জা সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রাখা হল।-- স্টেশন মাস্টার, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম

 

ভাঙড় আন্দোলনকারী জমি, জীবিকা, বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ কমিটি ও তৃণমূল সরকারের মধ্যেকার চুক্তি ও তাকে কেন্দ্র করে ওঠা বিতর্ক নিয়ে গ্রাউন্ডজিরোর সাথে কথা বললেন ভাঙড় আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা অলিক চক্রবর্তী

গ্রাউন্ডজিরো: ভাঙড়ের যে চুক্তিটা হল, এটাকে আন্দোলনের জয় হিসেবে দেখানো হচ্ছে কেন? এই চুক্তির মাধ্যমে কি পাওয়া গেল?

অলিক: চুক্তিতে পরিষ্কার লেখা আছে, যে পাওয়ার গ্রিড, যেটা হবার কথা ছিল, হচ্ছে না। এবং এখানে একটা আঞ্চলিক সাবস্টেশনই হচ্ছে। এবং সবচেয়ে যেটা সমস্যার বিষয় ছিল, যে ১৬টা কমিশনড লাইন চারপাশ দিয়ে যাবে, আর টু-বি-কমিশনড ২৪টা লাইন – টোটাল ৪০টা লাইন ঐদিক দিয়ে যাবার অবস্থা ছিল – সেইটা থেকে সরে এসে ওদের একেবারে প্রাথমিক জায়গায় চলে আসতে হয়েছে। জমি-জীবিকা-বাস্তুতন্ত্রের উপর যে প্রভাব পড়ার কথা ছিল – ধরো চারিদিক থেকে যদি ইলেকট্রিকের তার ঐভাবে চলে যেত, তাহলে একটা ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হত। সেই জায়গা থেকে আমরা সরকারকে সরিয়ে দিতে পারলাম। এই মুহূর্তে যে প্রজেক্টটা হচ্ছে, সেটা আর স্পেশাল কোনো প্রজেক্ট হচ্ছে না। আর পাঁচটা প্রজেক্টের মতোই একটা প্রজেক্ট।

তো এখানে আমরা একটা সমঝোতা করেছি। এটা কোনো অনৈতিক সমঝোতা নয়। অন্যান্য সবকিছু হিসেব করে যদি দেখা যায়, আমাদের যতটা শক্তিসামর্থ্য, তার হিসেবে দেখা যাবে, যে সরকারকে আমরা বাধ্য করেছি তার মূল প্রজেক্ট থেকে সরে আসতে। এবং এইটা আমাদের আন্দোলনের একটা প্রাথমিক জয়। আর পুরো চুক্তিটা যদি দেখা যায়, যেভাবে সমস্ত কেস প্রত্যাহারের কথা লিখিত ভাবে এসেছে, যেভাবে আন্দোলনকারীদের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের বিষয়টা এসেছে, যাদের জমির উপর দিয়ে হাই ভোল্টেজ তার গেছে তাদের ক্ষতিপূরণের কথাটা এসেছে, পাশাপাশি উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেভাবে কমিটির স্বীকৃতির জায়গাটা এসেছে, সরকার পক্ষের কমিটমেন্ট এবং আমাদের পক্ষের কমিটমেন্ট – এই দুটো দিক থেকেই যেভাবে কমিটির স্বীকৃতি এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এইটা বিরল ঘটনাই বলা যেতে পারে। এবং ভাঙড় আন্দোলন যে শক্তি নিয়ে এতদিন ধরে লড়াই করেছে, সেই শক্তির বহিঃপ্রকাশ এই চুক্তির মধ্যে দিয়ে ঘটেছে বলে আমাদের মনে হয়।

গ্রা: ভাঙড় আন্দোলনের মূল স্লোগানটা প্রথম থেকেই ছিল, পাওয়ার গ্রিড হটাও তো মানুষ বলছে, আগেও পাওয়ার গ্রিড হবার কথা ছিল, এখনও হচ্ছে…

: পাওয়ার গ্রিড বলতে কি বোঝানো হচ্ছে?

গ্রা: আগেও সাবস্টেশন হচ্ছিলো, এখনও হচ্ছেআগে ৪০টা লাইনের কথা ছিল এখন দু’টো হচ্ছে সেটা অবশ্যই জয় কিন্তু সাবস্টেশন হচ্ছে ফলত, ঐসময় যে কথাটা বলা হয়েছিল, যে পাওয়ার গ্রিড হটাও – ঐ কথাটা তাহলে তখন ভুল বলা হয়েছিল? সেজন্যই আজ সমস্যাটা হচ্ছে? এখন বলতে হচ্ছে, পাওয়ার গ্রিড হচ্ছে না, অন্য কিছু হচ্ছে আসলে পাওয়ার গ্রিড তো একটা কোম্পানির নাম ওরা তখনও এটা তৈরি করছিল, এখনও করছে

: একটা টেকনিকাল শব্দ নিয়ে একটা বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু সব জায়গায় যেটা পাওয়ার গ্রিড বলতে বোঝায়, পাওয়ার গ্রিড জিনিসটার যে কাজ, সেটা তো দেখতে হবে। ধরুন এইখানে যে সেন্টারটা হবার কথা ছিল, সেটা ছিল ‘মেজর লোড সেন্টার’। এবার পাওয়ার গ্রিড কিন্তু নিজে চুক্তিতে লিখেছে, যে এটা ‘পাওয়ার গ্রিড’ হচ্ছে না। তাহলে টেকনিকাল লোকজন গিয়ে পাওয়ার গ্রিডের সাথে ঝামেলা করুক, আমাদের সাথে ঝামেলা করার তো বিষয় নয়। কিন্তু আমাদের যেটা মূল কনসার্ন ছিল, যে চারিদিক থেকে যদি লাইন ঢোকা-বেরোনো করে, তাহলে তো এলাকায় আর কিছুই থাকবে না। মানুষ এর বিরুদ্ধেই লড়েছে, এবং সেই জায়গাটা আমরা অর্জন করেছি। এটা লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে, যে চুক্তিতে যা আছে, তার বাইরে একটা লাইনও ঢুকবে না।

এই প্রসঙ্গে তুষার চক্রবর্তী নির্দিষ্ট ভাবে বলেছিলেন, এটা অক্টোপাসের মতো একটা ব্যাপার – যে মূল জিনিসটার বিভিন্ন শুঁড় বেরোবে। সেই শুঁড়গুলো আমরা কেটে দিয়েছি। টেকনিকাল লোকজন এটা বিচার করবেন, যে পাওয়ার গ্রিড এবং সাবস্টেশনের মধ্যে তফাৎ কি। সেটা নিয়ে আরও আলোচনা-বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু তার মানে এটা নয়, যে আগে যা হচ্ছিল, এখনও তাই হচ্ছে। এটা যদি কেউ বলেন, কথাটা কিন্তু কোনোকিছু না দেখে বলার সামিল। পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন লিমিটেড ১৬ জুলাই নোটিফিকেশন করে যে জিরাট-মেদিনীপুর ট্রান্সমিশনের যতগুলো লাইন, সব ড্রপ করছে। সবকটা লিলো (LILO) ড্রপ হচ্ছে। করতে করতে একটায় এসে ঠেকেছে, জিরাট-সুভাষগ্রামের সাথে কানেক্টেড হচ্ছে যেটা। আর ফরাক্কা থেকে বিদ্যুৎটা আসছে। এই টোটাল সিস্টেমটাকে গ্রিড সিস্টেম বলা হয়। কিন্তু ট্রান্সমিশনের ক্ষেত্রে এই কাজটুকুই সে করবে, এর বাইরে কোনো কাজ করবে না।

গতকাল আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম, যে লোড কমছে কিনা। তাতে কোম্পানি জানায়, যে অবশ্যই ১৬টা লাইনের ক্ষেত্রে যা লোড হয়, সে তুলনায় লোড নিশ্চয়ই কমবে। টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় দেখলাম লিখেছে ১০০০ মেগাওয়াটের জায়গায় ৪৫০ হবে। আমার ধারণা সেটা আরও কমবে। ১৬টার মধ্যে ৬টা ৪০০ কেভি-র হবার কথা ছিল, আর ১০টা ২২০ কেভির লাইন। সেই জায়গায় দু’টো লাইন হচ্ছে ৪০০ কেভি-র। একটা শুধু ফরাক্কা থেকে আসছে। আর আরেকটা বেরিয়ে লিলো হিসেবে জিরাট-সুভাষগ্রামের সাথে মিলছে। আর যে দু’টো লাইন, সেগুলো পাওয়ার গ্রিডের লাইনই নয়, ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইলেক্ট্রিসিটি ট্রান্সমিশন কর্পোরেশন লিমিটেডের লাইন। সে নিয়ে তো আর আগে কোনো কথা ছিল না। যাই হোক, ফলে এখন যেটা হচ্ছে, যে পাওয়ার গ্রিড শুধু একটাই লাইন এনে লিলোটাকে নিয়ে যাচ্ছে। আর ডিস্ট্রিবিউশনের বা ট্রান্সমিশনের কাজটা কিন্তু ডব্লিউবিএসইডিসিএল-ই করছে। এই জায়গা থেকে সাবস্টেশনের ক্যারেক্টারও বদলে যাচ্ছে। কিন্তু তার চেয়েও যে বড় কথা, মানুষ তো আর এটা বুঝে লড়ে না, যে ঠিক ওটার নাম কি! তবে হ্যাঁ, এখন নাম বিষয়টাও যুক্ত হয়ে গেছে। চুক্তিতে এটা লেখা আছে, যে এটা গ্রিড হিসেবে থাকছে না।

গ্রা: যাঁরা শহীদ হয়েছেন আন্দোলনে, তাঁদের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের বিষয়টা কি এসেছে?

: এসেছে। আজকেই দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আসলে এটা নিয়ে সরকারের বক্তব্যটা আমরা ভিডিও করে রেখেছি। শহীদদের ক্ষেত্রে ওরা একটা দু’লাখ টাকার সরকারি স্যাংশন পাশ করেছিল। আমরা সেটা মানিনি। অন্যান্য বিদ্যুৎ সাবস্টেশন তৈরি করার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ স্যাংশন করার যে প্রভিশন লীগালি আছে, যেহেতু তার বাইরে গিয়ে সরকারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে – সেটা তো সরকারি স্ট্যাম্প দিয়ে চুক্তি করা যায় না। সেজন্য ক্ষতিপূরণটা বিভিন্ন ভাবে দেওয়া হবে। সেটা লেখা আছে। ভিডিও করে নেওয়া আছে, যে ঠিক কি কি ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এই যে ১২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, যদি জমির ক্ষতির কথা ধরা হয়, যতটুকু জমির উপর দিয়ে তার গেছে আছে ঐ এলাকায়, সেই জমির দামের থেকে অনেক বেশি হয়ে যাবে এই ক্ষতিপূরণ। মানে, জমির রো ধরে যদি হিসেব করা হয়, যে অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে, তাতে তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা একজন মালিককে দিয়ে দেওয়া সম্ভব। এবারে এখানে শহীদ পরিবার শুধু নয়, তার সাথে সাথে যাদের গুলি লেগেছে, বা আহত, যারা পরে অসুখে মারা গেছে, যারা জেল খেটেছে, যারা ক্ষতিগ্রস্ত – বাড়ি পুড়েছে, গাড়ি ভেঙ্গেছে – সবার জন্যই ক্ষতিপূরণ আমরা আদায় করেছি। আজ বিকেল ৪টের সময় শহীদ পরিবারগুলোকে গ্রাম পঞ্চায়েত অফিস থেকে চেক মারফত টাকা দেওয়া হবে। এর পরিমাণটা আমাদের ঠিক করতে বলা হয়েছেল। সেটা ৮ লক্ষ টাকা করে ঠিক করা হয়েছে।

গ্রা: যদি এইটা করা যেত, যে অফিশিয়ালি সরকার ‘রাইট অফ ওয়ে’, তারের নীচে যাঁদের জমি – তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ানো যেত, তাহলে তো এই আন্দোলনটা একটা একজাম্পল হয়ে থাকত…

: সবই কিন্তু অফিশিয়াল। চুক্তিতে সবই দেওয়া আছে। টাওয়ার বসানোর ক্ষেত্রে যে নিয়ম আছে, সেই অনুযায়ীই টাকা পাওয়া যাবে। তারপর সবই কিন্তু ওরা চেকে দিচ্ছে। কিন্তু যেটা আমরা করতে পারিনি, যে জমির মালিকদের অফিশিয়ালি ক্ষতিপূরণটা দিয়ে দিক, ১৫% করে, যেটা নোটিফিকেশনে আছে। সেটা যদি আমরা চাইতাম, হয়তো সেটা আমরা আদায় করতে পারতাম। কিন্তু আন্দোলনের যে ক্যারেক্টার, তাতে যদি খালি জমির মালিকরা ক্ষতিপূরণ পায়, সেটা মানুষের মধ্যে ডিভিশন তৈরি করত। কারণ জমির মালিকরা অনেক জায়গাতেই দেখা যাবে লড়াইতে আসেইনি। এখন লড়ল এক দল, ক্ষতিপূরণ নিয়ে চলে গেল আরেক দল – এটা তো ঠিক নয়। এই জায়গা থেকেই সমস্ত দিক বিবেচনা করে আমরা শুধু জমির মালিকের ক্ষতিপূরণের কথা বলিনি। এবং জমির মালিকের ফর্মাল যে ক্ষতিপূরণ – এখন অব্দি গভর্নমেন্টের যে প্রভিশন আছে, সেটাও পাওয়া যাবে। সেটা হচ্ছে টোটাল এক থেকে দেড় কোটি। এর উপরে আরও দেড় কোটি আছে। সমস্তটা মিলিয়ে ১৫ কোটি টাকা মতো একটা ক্ষতিপূরণ আদায় করা যাচ্ছে। তার মধ্যে ইনফর্মাল হচ্ছে ১২ কোটি। টাওয়ারগুলোর ক্ষতিপূরণ আলাদা, জমির ক্রপ কম্পেন্সেশন আলাদা, তার চলে গেলে পার স্কোয়ার-ফিট দু’টাকা করে দেবে পিজিসিআইএল। এগুলো হচ্ছে নির্দিষ্ট। টাওয়ারেরটা আগে ছিল, অন্যটা ছিল না পশ্চিমবঙ্গে, যদিও অন্য রাজ্যে দেওয়া হত। এবং শুধু এই ইন্সট্যান্সটাই না, এই যে ১২ কোটি টাকা, এটা তো কোনো গোপন ব্যাপার নয়, চেকেই দেবে, গ্রাম পঞ্চায়েত দেখবে, মিডিয়া দেখবে। এটার ভিডিও আছে, সেটা আমরা প্রচার করছি। আন্দোলনকারীরা ক্ষতিপূরণ পাবে এই সমঝোতার মধ্যে দিয়ে, এমনকি জেলে যাবার জন্যও ক্ষতিপূরণ পাবে – এটা তো একটা ইন্সট্যান্স! তো এই ইন্সট্যান্সগুলো ভাঙড়ে তৈরি হচ্ছে।

গ্রা: আন্দোলনে তো একটা নেগোশিয়েশন হবেই

: এই কথাটাই লোকে বুঝতে চাইছে না।

গ্রা: কিন্তু এত তাড়াহুড়ো করে, অর্থাৎ যে মানুষগুলো এতদিন আন্দোলনে ছিল, তাদেরকে নিয়ে, তাদের সাথে কথাবার্তা বলে, ইনভল্ভ করে এটা করা হল না কেন? একটা কথা তো উঠছে, যে রেড স্টার দল হিসেবে এটার নেতৃত্বে ছিল পার্টির একটা ডিসিশন হিসেবে যে এই ডীলটা করা হল, এবং সেটা প্রায় চাপিয়ে দেবার মতো করে তাড়াহুড়োটা করা হল – তাতে এই যে ইম্প্রেশনটা তৈরি হল, যে করে হোক লোককে বুঝিয়ে সইটা করিয়ে নিতে হবে – এটা কেন হল?

: এটা তৈরি করা ইম্প্রেশন। এক হচ্ছে ইনফরমেশন গ্যাপ। দুই হচ্ছে, কিছু লোকজন খুবই কনশাসলি এটা বলছে। প্রথমত, হয়তো আমি জেলে থাকার কারণে, বা শর্মিষ্ঠার পক্ষে ঐ এলাকায় যাওয়ার সমস্যা থাকার কারণে হয়তো সমস্ত ইনফরমেশন ঠিক ভাবে কনভেড হয়নি। কিন্তু এই ধরনের একটা আলোচনা ২৩ জুন থেকে চলছে। ৭ অগাস্ট একটা ডিটেইলড প্রোপোজাল পেশ করা হয় সরকারের তরফ থেকে। এইসব মিলিয়ে এগ্রিমেন্ট হল ১১ অগাস্ট। তাহলে প্রায় ৫০ দিন ধরে অন্তত ৫-৬টা মিটিং-এ এই আলোচনাটা হয়েছে। একটাই ডিসপিউট ছিল। সেটা হল, আমরা সাবস্টেশনের বিষয়টাতে এগ্রি করব কি করব না। এই জায়গায় আলোচনাটা ভেঙ্গে গিয়েছিল। আমি বেরনোর পরে প্রথম যে আলোচনাটায় থাকি, তাতে সিদ্ধান্ত হয়, যে সাবস্টেশন আমরা মানছি না। কোনো কিছুই করতে দেওয়া হবে না, এরকম একটা মতামত কমিটির পক্ষ থেকে রাখা হয়েছিল। তার উপর দাঁড়িয়ে আলোচনাটা সেদিন ভেস্তে যায়। ব্যক্তি বা দল বা সংগঠনগত ভাবে যদিও কেউ এটা চাননি যে আলোচনাটা ভেস্তে যাক।

তো আমরা বলি, আপনাদের প্রস্তাবটা নিয়ে আমরা পুরো আলোচনা করতে পারিনি। আমরা শুনলাম। আমাদের সময় দেওয়া হোক। আমরা কথাবার্তা বলবো। বলার পরে আবার আলোচনায় ঢুকব – এই সময়টা দেওয়া হোক।এটা ছিল ২৩ জুলাই। এর পরদিন থেকেই আমাদের আলোচনার প্রক্রিয়াটা শুরু হয় আবার নতুন করে। সর্বস্তরেই আলোচনা হয় – জিবি হয়, সাধারণ পরিষদ হয় – মানে জেনারাল কাউন্সিল, তারপর বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে সভা, তাতে অন্যান্য গ্রাম থেকে মানুষ আসেন, বিভিন্ন সহযোগীদের সবার সাথে কথা বলা হয়। এখানে বলা যেতে পারে, যে হ্যাঁ, এসব জায়গায় বিতর্ক ছিল। কেউ কেউ বলেন, আলোচনা করব, কিন্তু কোনো সমঝোতা মানব না, বা এটা মানার ব্যাপারে আলোচনায় যাব না। এখন এখানে যেটা লক্ষ্য করার, গভর্নমেন্ট কিন্তু তাদের জায়গা থেকে সরে এসেছে। তাহলে তোমরা কোন জায়গাটায় সরছ, যেখান থেকে আলোচনার জায়গাটা ওপেন হতে পারে? সেটা তোমরা বলো?

এবার সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ব্যাপার থাকে – সকলেই যে পূর্ণমাত্রায় ব্যাপারটা বুঝতে পারছে, তা না। তাদেরকে বোঝাবার একটা প্রয়োজন আছে। সেটা নিয়েও একটা বিতর্ক চলছিলো – যে বোঝানো উচিত কি না।আমাদের মনে হয়েছে বোঝানো উচিত। কারণ লড়াইটা কোনো স্পনটেনিয়াস এক দিনের লড়াই না। প্রত্যেকটা ধাপে কোথায় খানা কোথায় খন্দ – সেগুলো দেখে দেখেই আমরা চলেছি বলে আন্দোলনের একটা সাফল্যের জায়গায় আমরা আছি, এবং সরকারকে নতিস্বীকার করতে বাধ্য করতে পেরেছি। হানড্রেড পারসেন্টই আমাদের আদায় করতে হবে, তাছাড়া কোনোরকম কোনো সমঝোতা নয়, এইটা পজিশন হওয়া উচিত নয়। একটা ফ্লেক্সিবিলিটি আমাদের থাকা উচিত। সারা দেশে এবং এই রাজ্যে সংগ্রামী শক্তির যা অবস্থা, মানুষের আন্দোলন করার ক্ষমতা, চিন্তাভাবনা – এটা বিচার করে আমাদের একটা সিদ্ধান্তে আসা উচিত। এবং সেক্ষেত্রে শুধু ভাঙড়ের ঐ ক’টা গ্রামের মানুষ কতটা লড়ছে, তার উপর বিচার করে কিন্তু ভাঙড়ের লড়াইয়ের জয়পরাজয় নির্ধারিত হবে না। আসলে তার পাশে গণতান্ত্রিক শক্তি কীভাবে দাঁড়াচ্ছে? এবং সামগ্রিক ভাবে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি কতটা শক্তিশালী, তার উপরে দাঁড়িয়ে আমাদের কর্মপদ্ধতি স্থির করা উচিত। আমাদের মনে হয়েছে, যাঁরা বুঝতে চাইছেন না, তাঁদের সাথে ধৈর্য ধরে কথাবার্তা বলে আমাদের এটা বোঝানো উচিত। কিন্তু যেটা হয়, এই প্রক্রিয়াটা আমরা যদিও ধরে ধরে চালিয়েছি, তাতেও অনেকে বুঝতে চাননি। বিশেষ করে যে বন্ধুরা এই আন্দোলনে সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁরা বলেছেন যে গ্রামের মানুষ বুঝছেন না।এদিকে কিন্তু তাঁরা নিজেরা যেসব কমেন্ট করছেন, তার ফলেও গ্রামের মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছেন, হচ্ছেন। তাঁরা তখন ফোন করছেন। গ্রামের মানুষ কি ভাবছেন? যে মানুষটা কাল অব্দি আমার সাথে ছিল, সে বলছে একেবারেই চুক্তিটা মানা যায় না। তাহলে কোনটা শুনব? এই যে বিভ্রান্তি…

এমন কিন্তু নয়, যে আমরা বলেছিলাম, সবকিছু তুলে ছাড়ব, এবং তারপর তা করতে পারিনি। আন্দোলনের গতিপথে সে জায়গাটা এসে দাঁড়িয়েছিল। আমরা চিরকালই বলেছি – এই হচ্ছে আমাদের দাবি, এগুলোকে শান্তিপূর্ণ ভাবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হোক। আমাদের আলোচনা ভেস্তে দেবার জন্য সরকার পক্ষ সমস্ত ধরনের চেষ্টা করেছে। ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারির সময়কার কথা বলা হোক, বা তার পরবর্তী কালের কথা বলা হোক, আমরা সমস্ত সময় যে কৌশল বা স্ট্র্য়াটেজি অবলম্বন করেছি, সামান্যতম আলোচনার কোনো রেখা দেখা গেলেও আমরা সেটাকে ব্যবহার করেছি, কাজে লাগিয়েছি। এটা নিয়ে অনেকসময়ই আমাদের অনেক কথা শুনতে হয়েছে। বিভিন্ন শক্তিগুলোকে এখানে সমবেত করার সময় শুনতে হয়েছে, যে এই আমরা একটু ডানে ঝুঁকে গেলাম,এই একটু বাঁয়ে ঝুঁকে গেলাম, কখনো আবার সরকারের সাথে আপোষও করে ফেললাম… কখনোই কারুর সাথে আপোষ আমরা করিনি।

গ্রা: ভাঙড় আন্দোলনের সাথে যাঁরা যুক্ত ছিলেন প্রথম দিক থেকে, অর্থাৎ অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি, যেমন – আমি নাম করেই বলছি – এমকেপি বা লিবারেশনের একটা অংশ – তাঁরা চুক্তিতে সই করলেন না এই যে আপনারা একসাথে এতদিন লড়লেন আরেকটু সময় নিয়ে কি নিজেদের মধ্যে এই আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা ডেভেলপ করা যেত না? তাতে যদি আর ১০-১৫টা দিন দেরিই হত? এইটাই কি আন্দোলনের বেশি ক্ষতি করল না? ডেমোক্র্যাটিক রাজনৈতিক শক্তিগুলো এক জায়গায় এসে আজকের দিনে একটা মুভমেন্টকে, লড়াই করে এতদূর অব্দি এগিয়ে নিয়ে গেল… এমন কী তাড়াহুড়ো ছিল, যার জন্য এটাকেও বিসর্জন দিতে হল? যে চুক্তিটা সই হয়েছে, তাতে এমকেপি-র কারুর সই নেই ওঁরা কোনো পাবলিক স্টেটমেন্টও দেননি, যে কেন সই করলেন না এটাকে কীভাবে দেখব? এটা আপনাকে জিজ্ঞেস করছি, কারণ এতে তো সেই সোশ্যাল মুভমেন্টটারই ক্ষতি হল, যেটা আপনারা গড়ে তুলেছিলেন

: ওঁরা কিন্তু আমরা যেদিন ফাইনাল মিটিং-এ যাচ্ছি, সেইদিন মাত্র জানান, যে ওঁরা সই করতে যাবেন না। তবে ওঁরা আমাদের সাথে তারপরেও ছিলেন। এমকেপির যে প্রতিনিধি সই করেননি, তিনি কিন্তু বিজয় মিছিলে ছিলেন। সই করার দায় ওঁরা নিচ্ছেন কিনা, এটা ওঁরাই বলতে পারবেন। আমি এইটুকুই বলতে পারি, যে বিভিন্ন ধরনের ফোর্সকে এক জায়গায় আনার একটা সিন্সিয়ার চেষ্টা করে হয়েছিল। এবারে বিভিন্ন ফোর্সের মধ্যে যদি এইরকম একটা কনফ্লিক্টের জায়গা তৈরি হয়… এমকেপি-র প্রতিনিধি তো প্রত্যেকটা মিটিং-এ উপস্থিত ছিলেন।আমি থাকার আগে থেকেই তাঁরা ছিলেন।

গ্রা: কারণ ওঁরা হয়তো নেগোশিয়েশনের বিরুদ্ধে নন, কিন্তু….

: তাহলে সেদিন ওঁরা কেন গেলেন না, সেটা ওঁদের জিজ্ঞেস করাই ভালো। এটা নিয়ে আমি এই মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করছি না। এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। এমকেপি আন্দোলনের শুরু থেকে এতটাই এই আন্দোলনে জড়িয়ে আছে… এখনও ওঁরা জানিয়েছেন, ওঁরা আন্দোলনের সাথে আছেন। এবার ওঁরা কেন চুক্তির পার্ট হতে চাইলেন না, এটা নিয়ে আলোচনা এখনও হয়নি, ওঁরাও নির্দিষ্টভাবে কিছু জানাননি।

এখন এটা তো একটা লড়াই। ব্যাপারটা তো এরকম নয়, যে সরকারের সাথে আমাদের একটা সমঝোতা হচ্ছে, তার মানে সরকার পক্ষ আমাদের দুর্বল জায়গাটায় আক্রমণ করবে না, বা আমাদের ইচ্ছেমতো সুযোগ দিয়ে যাবে। সেটাও আমাদের সবাইকে মাথায় রাখতে হবে। ধরুন যেদিন এগ্রিমেন্ট হল, তার আগের দিন সমস্ত কিছুই তো সেটল হয়ে গেছে। একটা জায়গা খালি সেটল হয়নি, সেটা হচ্ছে,কম্পেন্সেশনটা ঠিক কি হবে। তো সেদিন তো এমকেপি-র প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। আমরা তো মিনিটসের কপি গোপন করে রাখিনি। কেউ কমেন্ট করতেই পারতেন, যে এই জায়গাগুলো বদলাতে হবে। কেউ তো বলেননি! ওখানে শুধুমাত্র একটা জায়গাতেই ডিসএগ্রিমেন্ট ছিল, সেটাও উল্লেখিত ছিল, যে আমরা বলেছিলাম লিলো লাইনটাকেই রিলোকেট করতে। সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়, টেকনোলজিকালি সেটা সম্ভব না। আমরা তখন বলেছি তাহলে খামারআইটের জন্য স্পেশাল কম্পেন্সেশন দিতে হবে। এই ডিফারেন্সটাও খুব সামান্যই ছিল। এরপর যেদিন এগ্রিমেন্টে সই হবে, সেদিন যদি কেউ না যান… এই অভিযোগটা যে ভিত্তিহীন, সেটা কি বোঝা যাচ্ছে?

গ্রা: সেটা বরং পাঠকের উপরে ছেড়ে রাখি আরেকটা অভিযোগও আছে নাগেরবাজারে একটা জেনারাল বডি মিটিং করা হয় তার আগে রাজারহাটেও একটা জিবি করা হয় তারপর খামারআইটে যে সভাগুলো হয়েছে, সেই প্রসঙ্গেও এই কথাটা উঠেছে  আমি নিজে কোনো মিটিং-এ ছিলাম না যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কথার উপর দাঁড়িয়েই বলছি ফ্যাকচুয়ালি ইনকারেক্ট হলে সেটা বলুন বা ফ্যাকচুয়ালি কারেক্ট হলে তার ব্যাখ্যাটা দিনভাঙড়েরই অধিকাংশ মানুষ এই মিটিংগুলোতে পাওয়ার গ্রিডের এবং এই চুক্তির বিরোধিতা করে সাধারণ মানুষ হয়তো অতো ভালো আর্টিকুলেট করতে পারেন না, কিন্তু তাঁদের কথায় যে সুর ভেসে উঠেছে, তা বিরোধিতার নেতৃত্ব – যেখানে স্বাভাবিক ভাবেই অলীক চক্রবর্তীর নামই বলা হয়েছে – তার নেতৃত্বের বলে প্রায় জোর করে তার মতামতটা মানুষের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে, জবাবের মধ্যে দিয়ে প্রশ্নকর্তাকে দমিয়ে দিয়েছে – এই অভিযোগটা উঠেছে

: অনেকে বলেছেন অজ্ঞাত কারণে নাগেরবাজারে সভা করা হয়েছে! তাঁরা কি এটুকুও জানেন না, যে ভাঙড়ের ঐখানে তিনটে থানার মধ্যে আমরা কোনো ফর্মাল সভা করতে পারি না? ফলে বাইরে করতে হয়েছে, তার জন্য অনেক টাকাপয়সাও খরচা করতে হয়েছে, অনেক সমস্যা পোয়াতে হয়েছে। নাগেরবাজারের সভাটা ছিল ৫ তারিখ। আমরা কাদের ডেকেছিলাম? সংহতির সমস্ত লোকজনকে। কাউকে কাউকে আমি নিজে ফোন করে ডেকেছি। সেখানে এসেছিল সেভ ডেমোক্রেসি, আক্রান্ত আমরা, গণতন্ত্রের ভাষা, সংহতি কমিটির কন্সটিটুয়েন্ট। এপিডিআর আসেনি, যদিও নিশা বিশ্বাস সেইদিন তাদের প্রতিনিধিত্ব করেন, আগে ভাঙড় প্রসঙ্গে কখনো তা না করলেও।

এক, অতিথি বা সহযোগী যাঁরা, সেই সভায় যেমন খুশি তাঁদের বক্তব্য রেখেছেন। দুই, শর্মিষ্ঠা শুধুমাত্র সঞ্চালনা করেছে, আর একটা কোথাও বলেনি। আমি প্রস্তাবটা পড়ে দিয়েছি। তাছাড়া একটা কথাও বলিনি। মির্জা, মোশারফ থেকে শুরু করে আজিজ মল্লিক, বা যাঁরা কমিটির মূল, তাঁরা কেউ কোনো কথা বলেননি। কমিটিতে একজন – আমি নাম করছি না –তিনি ওখানে রাজনৈতিক বা কমিটিগত বোঝাপড়া যা-ই হোক, সমস্ত অস্বীকার করে জনগণের রায় নিজের থেকেই নিতে চান। তা সেটা কেউ চাইতেই পারে। রায় নেওয়া হয়। ওহ্‌, এটা বলতে হবে, যে ঐদিন একজন বিশেষ ব্যক্তিকে আমরা মঞ্চে ডাকিনি। তার কারণ আছে। সে বিষয়টা পরে পরিষ্কার হয়ে যায়। যাই হোক, এটা দেখা যায়, যে ওখানে যাঁরা সরাসরি চুক্তির বিরোধিতা করেন, তাঁরাই কিন্তু আলোচনার পরে, চুক্তিটা সাইন করার পরে, সবচাইতে বেশি ভোকাল হয়েছেন। তাঁরাই বলছেন, এটা কতটা সঠিক কাজ হয়েছে। চাইলে তাঁদের ইন্টার্ভিউ নেওয়া যেতে পারে।

অতএব যদি বলা হয় আমরা বাই ফোর্স কিছু করেছি, মানুষকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। যেমন আহাদ আলি মোল্লা – প্রথম দিকে গ্রেপ্তার হন, সেইদিন সবচেয়ে বেশি ঝামেলা করেছিলেন, পরে আমাকে বলেছেন,আসলে আপনাদের নামে এত খারাপ খারাপ কথা আসছিল, যে আমি বিভ্রান্ত হয়ে গেছিলাম। সেইদিন যখন চুক্তি করে বেরিয়ে আসি, তখন তিনি আমাদের নামে স্লোগান দিচ্ছেন। বলছেন, যে না, এটা না করলে আমি স্বস্তি পাচ্ছি না, কারণ আমি নিজেই এত খারাপ খারাপ কথা ভেবেছিলাম, যে সেইটা এখন আমার একটু পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। যাই হোক, সেদিন লিবারেশনের পক্ষ থেকে যা বক্তব্য রাখা হয়েছিল, তাতে চুক্তির বিরোধিতা করা হয়নি। হ্যাঁ, কেউ কেউ বক্তব্যে বলেছিল যে এক ইঞ্চিও আমাদের ছাড়া উচিত নয়। তো আমি আমার বক্তব্যে বলেছিলাম যে সবসময়ই কিন্তু আমরা এগোনো-পিছনোর মধ্যে দিয়েই লড়াইটা জিইয়ে রেখেছি।

বলা যেতে পারে, যে গ্রামবাসীরা যা বলবে, সেভাবেই কেন চলা হবে না? এটা যাঁরা বলছেন, তাঁরা এতদিন আন্দোলনটা কীভাবে চলেছে, সেটার কি খোঁজ রাখেন? গ্রামবাসীরা তো চেয়েছিল আরাবুলের বাড়িটা ভেঙ্গে পুড়িয়ে দিতে। লিডারশীপ যদি সেটা না আটকাত, তাহলে কি হত? লিডারশীপের কাজ জনগণকে সঠিক দিশায় পরিচালিত করা। জনগণ যাতে সঠিক ভাবে ঐক্যবদ্ধ ভাবে এগোতে পারে, তার দিগদর্শনের কাজ যদি না থাকে, তাহলে আর কি মূল্য থাকল? গরল আমি পান করব না, শুধুমাত্র অমৃতটাই নেব – এটা তো হতে পারে না। হ্যাঁ আমি এটা বলেছি। কেউ যদি বলে আমি প্রভাবিত করছি, হ্যাঁ অবশ্যই করছি, কারণ ঐ আন্দোলনে আমার একটা স্টেক আছে। আজকে যদি এই চুক্তি না হত, আমি তো দেখতে পাচ্ছিলাম – ওরা বিভিন্ন ধরনের রিফর্ম প্ল্যান করে আশেপাশের এলাকাকে মোটামুটি ঘেরার চেষ্টা করছিল। এই যে প্রস্তাব – এটা ওরা একটা ফাঁদ হিসেবেই নিয়ে এসেছিল। যে শুধুমাত্র খামারআইটের পাশ দিয়ে দু’টো লাইন যাবে, আর কোনো লাইন যাবে না।যাঁরা বিভিন্ন দিকে থেকে লাইন যাবে বলে লড়াইতে এসেছিলেন, তাঁরা হয়তো আজকে বুঝতে পারছেন না, যে যখন এরপরে অ্যাটাকটা আসবে, তখন কিন্তু সেই লড়াইতে তাঁরা আর থাকবেন না। যত বেশি লড়াই আইসোলেটেড হবে, ততো বেশি অ্যাটাক বাড়বে। শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন কিন্তু একটা ট্র্যাজিক পরিণতির দিকে যাবে। সেদিন কেউ কেউ বলেছেন, মর্যাদাপূর্ণ হার অনেক ভালো। কেউ বলেছেন, জীবন যায় যাক, জেলে যেতে হয় যাক। কিন্তু মানুষ কতটা তৈরি, এই মুহূর্তে আমাদের শক্তি কতটা সেটা তো দেখতে হবে? শুধুমাত্র হাততালি কুড়োবার জন্য ভাষণ দেওয়াটা তো আমাদের কাজ নয়। আমাদের অনেক দায়িত্ব আছে। সামনে যদি খাদ থাকে,তাহলে আমি যদি লোককে সতর্ক না করি, তাহলে যখন লোকে সেই খাদে পড়বে,তখন বলবে আপনি তো জানতেন! এই বিশ্বাসটা মানুষ আমার উপরে করেছে। আর ব্যক্তিগত ভাবে যদি বলতে হয়, এরকম হয়েছেও, যে একটা কথা প্রায় কোনো গ্রামের কোনো লোকই মানছেন না, কিন্তু একটা ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গা থেকে আমি সেটা তাঁদের মানাতে পেরেছি। এটা শুধু আমি নই, আমাদের যারা সাথীরা – তাঁরাও কিন্তু কমবেশি এইভাবে অনেক দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু মাঝে যেটা হল, যে যখন আন্দোলন একটা নির্ধারক জায়গায় যাচ্ছে, যে কতটা মানব, কতটা ছাড়ব, তখন একটা কনফ্লিক্ট তৈরি হতে থাকে। বিতর্ক তো থাকবেই। আছেও। ব্যক্তিগত ভাবে যাঁরা সীক করেছেন, আমি তাঁদের কাছে গিয়ে কথা বলেছি, টেলিফোনেও কথা বলেছি। অথচ এবারে একটা জিনিস দেখলাম, কেউ মতামত রাখার আগে অন্তত আমার সাথে একবার যোগাযোগ করারও চেষ্টা করল না। আমি চেষ্টা করেছি তাঁদের সংগঠনের সাথেও কথা বলে নিতে। আপনাকেও আমি একটা মেসেজ পাঠিয়েছিলাম, যে বিচারের আগে ফাঁসি দিয়ে দিয়েছেন।

এখন ঘটনা হচ্ছে, আমার জেলে থাকাকালীন বেলভিউ হসপিটালে চিকিৎসা থেকে আরম্ভ করে – অনেকে অনেক রকম প্রচার-টচার করেছিলেন। তাতেও মানুষ বিভ্রান্ত হয়। আমাদের অনুপস্থিতির সুযোগে এই বিভ্রান্তি আরও বেড়েছিল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাঁদের সাথে আবার কমিউনিকেট করতে হয়েছে। তার ৯০% লোককে আমরা কিন্তু আমাদের মতামত বোঝাতে পেরেছি। সবাই শান্তি চায় – সবাই বলছে, আলোচনা যেন ভেস্তে না যায়। এটা ইউন্যানিমাস। কিন্তু আলোচনাও ভেস্তে দেওয়া চলবে না, কিছু মেনে নেওয়াও চলবে না – এ দুটোর একটাই হবে। দুটোই একসাথে হবে না। কোনটা করব?

ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকা

গ্রা: এপিডিআর একটা অভিযোগ তুলেছে আমি অভিযোগে যাচ্ছি না মূল প্রশ্নটা হচ্ছে কেন গণভোট করা হল না।

: পৃথিবীতে কখনো দুইপক্ষের আলোচনায় এগ্রিমেন্ট হয়েছে গণভোটের মধ্যে দিয়ে? আমরা তো বলেছিলাম সরকারকে গণভোট করতে। তখন তো সেটা আর আলোচনার বিষয় থাকে না। গণভোটের একটা রায় হবে – সেটা আইদার একজিকিউটেড হবে, নয় রিজেক্টেড হবে – এই তো।

গ্রা: চুক্তিটা তৈরির আগে ওরা যখন প্রোপোজালটা পাঠিয়েছিল

: আমরা তো সমস্ত গ্রামে পাঠিয়েছি সেটা, সমস্ত জায়গায় আলোচনা হয়েছে,সমস্ত মিটিং-এ কথা হয়েছে। আমি সেসব মিটিং-এ ব্যক্তিগত ভাবে ছিলাম, কারণ সেখানে কমিটি যে সিস্টেমে চলেছে, তাতে তেমনই দাবি উঠেছিল। আসলে গণভোটের মধ্যে দিয়ে একটা চুক্তি র‍্যাটিফায়েড কোথায় হতে পারে? একটা ফর্মাল আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্রে। কিন্তু সময়টাও তো দেখতে হবে। কখন মানুষের মতামত কীরকম ভাবে আসবে… যখন সন্ত্রাসের সময়, তখন মানুষ যেভাবে মতামত দেবে, আপাত শান্তির সময় তো মানুষ মতামত অন্য ভাবে দেবে। আর এই ধরনের প্রস্তাব আসছে কখন? না যখন আমরা চুক্তিটা করছি। এই ব্যাপারে কমিটির সাথে কোনো আলোচনা করার দরকার এপিডিআর মনে করেনি। একটা চিঠি পাঠিয়ে দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ।শুধু তা নয়,কিছু অভিযোগ করা হয়েছে। যেমন, পুলিশ নাকি গ্রামে আন্দোলনকারীদের উপর প্রেশারাইজ করছে, আর কমিটি চুপ। তার মানে কি? আসলে একটা ঘটনা হয়েছিল। হঠাৎ করে আমরা দেখলাম, যে এপিডিআর-এর পক্ষ থেকে পোস্ট করা হয়েছে, যে কোনো এক ব্যক্তিকে এলাকা থেকে তুলে নিয়ে গেছে লালবাজার থেকে। তুলে নিয়ে গিয়ে তাকে নাকি খুব শাসিয়েছে, ধমক টমক দিয়েছে। তো সেই ব্যক্তি সম্পর্কেও আমাদের কিছু ধারণা-টারনা আছে। পরে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, যে না, তার সাথে আমাদের কমিটির লোকের কথা হয়েছে, সে কিছুই কমিটিকে বলেনি, টেলিফোনে অব্দি না। আদতে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়াই হয়নি। তো এই ধরনের সব অভিযোগ আসছে…

এগ্রিমেন্টটা যখন সাইনড হয়েছে, সেটা না পড়েই কালো দিন ঘোষণা করে দেওয়া হল – এটার পিছনে কি কোনোরকম বায়াস কাজ করেনি? সংহতির মধ্যে যারা আছেন, তাঁদের একটা অংশ, যারা এতদিন নীতিগত ভাবে এটার পক্ষে ছিলেন…

গ্রা: এটায় আসব আমরা এটা আন্দোলনটা কোন পলিটিকাল কালচারে বিলং করছে, তার একটা রিফ্লেকশন। এর দায়টা তো আন্দোলনকেই নিতে হবে এর দায় তো আর রাষ্ট্র নিতে আসবে না

: কথাটা তো সেইখানেই…

গ্রা: পলিটিকাল ফোর্সকেই নিতে হবে সেই দায়িত্ব আমার প্রশ্নটায় আসি প্রসেস অফ নেগোশিয়েশন যেটা সরকারের সাথে শুরু হল, তাতে শুধু রেড স্টার না, রেড স্টার, এমকেপি – যারা মুভমেন্টটাকে লিড করছে, সেই পার্টিগুলোর দ্বারা ডমিনেটেড হয়েছে এই জায়গাটায় আমার মনে হয় – গোটা লেফট মুভমেন্টের যা হিস্ট্রি, তাতে দেখা যাচ্ছে, পার্টির নেতারা, যারা লিড করছে, তারা যদি সৎ হয়, তো ভালো না হলে আমরা দেখেছি কি ঘটে এই প্রসেসটা নিয়েই কি ভাবা উচিত নয়? ধরুন একটা মুভমেন্ট – সে ট্রেড ইউনিয়ন মুভমেন্টই হোক, বা এরকম কোনো মাস মুভমেন্ট। অবশ্যই কোনো কনশাস পলিটিকাল শক্তিই তার নেতৃত্বে থাকবে। আজকের যা রিয়েলিটি, তাতে একাধিক শক্তিই থাকবে তাহলে মুভমেন্টের যখন একটা ক্রুশিয়াল টাইম আসবে ডিসিশন মেকিং-এর, সেটা কিভাবে মেক হবে? লিডিং পার্টির ডিসিশনই ডমিনেট করবে? পার্টির দিক থেকে আমি মনে করছি, যে আমি অ্যাডভান্স পীপল ডিসিশন নিতে পারবে না বা তারা সমগ্রটা দেখতে পারে না আমি পার্টির লোক, ফলে অনেকটা দেখতে পাই… এই সমগ্রটা দেখতে পারা, বা ভাবা যে পার্টিই আসলে পারবে – তার ফলটাও তো আমরা দেখেছি হিস্ট্রিতে সেই জায়গা থেকেএটা একটু অন্যরকম ভাবে কি করা যেত না?

: কীরকম?

গ্রা: সেটা আপনি আমার চেয়ে অনেক ভালো বলতে পারবেন আমার মনে হয়েছে গোটা নেগোশিয়েশন প্রসেসটা পার্টি ডমিনেট করেছে

: নেগোশিয়েশনের আগে কিন্তু এই কথাটা ওঠেনি। টোটাল প্রসেসটা কথাই তো ভাবতে হবে। প্রত্যেকে যেভাবে এটায় ভূমিকা রাখতে রাখতে গেছে, তাই দিয়েই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে। ভাঙড়বাসীরা নিশ্চয়ই একটা হিরোয়িক স্ট্রাগল করেছেন। কিন্তু সেখানে কনশাস ফোর্সের রোলটাকে আমি যদি অস্বীকার করি, তাহলে এতদিন ধরে কি লড়াইটা টিঁকত? এটা হচ্ছে প্রথম কথা। দুই হচ্ছে, আসলে কনশাস ফোর্সের দায়িত্ব হচ্ছে, যে জায়গাগুলোতে সমস্যা থাকতে পারে, সেই বিষয়ে গাইড করা। পার্টির ডমিনেশন বলতে… তার একটা গাইডেন্সের দায়িত্ব থাকে তো, সেই জায়গাটাতে জনগণের স্বার্থ পার্টির স্বার্থ হওয়া উচিত। যদি ব্যাপারটা উল্টে যায়, যে পার্টির স্বার্থ অনুযায়ী জনগণের স্বার্থকে নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে… আমরা কিন্তু সেটা করিনি।এবং এই যে জায়গাটা, ধরা যাক, আজ যদি এই মীমাংসা না হত, আরও কিছু শহীদ হতে পারত। চারিদিক থেকে আইসোলেটেড হয়ে তাদের উপর একটা বড় ধরনের পুলিশি অ্যাটাক হতে পারত। মানুষের হার না মানা মনোভাবকে আরও উস্কে দিয়ে আমরা কিছু একটা করলাম – হ্যাঁ, আল্টিমেটলি তাতে পার্টির লাভ হয় না – এটা ঠিক। কারণ জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে যদি পার্টি কাজ করে, তাহলে জনগণের স্বার্থ পূর্ণ না হলে পার্টির স্বার্থ পূর্ণ হয় না। যাই হোক, সিঙ্গুরে আমরা তো একটা কথা বলেছিলাম, যে অনিচ্ছুক চাষিদের জমি ফিরিয়ে দেওয়া হোক। এই জায়গায় একটা ডিম্যান্ডকে নিয়ে আসা হোক, আলোচনার দাবিটা করা হোক। তৎকালীন যে তৃণমূল কংগ্রেস, তারা তো তাদের পার্টি ইন্টারেস্ট অনুযায়ী এই জায়গাটায় আসতেই দেয়নি। অর্থাৎ কারখানাটা তুলে নিতেই হবে, তাছাড়া কোনো আলোচনা নয় – এইভাবে মুভমেন্টটা এগোয়নি। ওটা ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের একদম শেষের অবস্থান। তার ফলে কি হল? সরকার পাল্টানোর পরেও কিন্তু কারখানা উঠে গেল না। পরে সুপ্রিম কোর্ট কিভাবে রায় দিল, সেটা একটা অন্য প্রশ্ন। কিন্তু যদি সেটা না-ও দিতো, তাহলে সেখানে যেভাবে পীপল সাফার করছিল, বা করতো, সেটা কিন্তু একটা অভাবনীয় জায়গায় থাকতো, এবং মুভমেন্টের প্রতি মানুষের একটা নেগেটিভ জায়গায় চলে আসার সম্ভাবনা ছিল। নন্দীগ্রামের ক্ষেত্রে তো কোনো নোটিফিকেশন আসার আগেই বড় ঘটনাটা হবার ফলে ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তারপরেও যেভাবে ব্যাপারটা টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে… ধরো গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বিরোধী পক্ষকে। যার ফলে ম্যাসাকার, পীপলের সাফারিং। লালগড়ের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা প্রায় তাই। দেখা গেল মাওবাদী আর তৃণমূল ছাড়া আর কেই সেখানে সংগঠনই করতে পারবে না। ভাঙড়ের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই কিন্তু কেউ কোনো একটা পার্টি করে বলে তাকে আইসোলেট করে দেওয়া হয়েছে, এই জায়গাটা আসেনি। এমনকি তৃণমূল কংগ্রেসও ছিল – তারা লিডার হয়েও, পাওয়ার গ্রিডের প্রকল্পের পক্ষে থেকেও বসবাস করছিল। একটা সময় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু সেটা শুধুমাত্র যখন তারা আক্রমণ করেছে, তখন। আজও পর্যন্ত ওখানে রেড স্টারের কোনো মেম্বার কিন্তু কাউকে করা হয়নি। অনেক সময় বিভিন্ন পার্টি ওখানে পোস্টারিং করতে চেয়েছে, কিছু পার্টি মিটিং-এ,মিছিলে অমুক তমুক নিয়ে গেছে। রেড স্টারের কোনো প্রোগ্রামে আজ অব্দি একটা লোকও যায়নি। ভাঙড়ের অন্তত একটা লোকও যায়নি। এবার তার মানে কি এটা যে রেড স্টারের ইনফ্লুয়েন্স নেই? অবশ্যই আছে।

এবারে কমিটির যে প্রতিনিধিত্ব এই সই-এর ব্যাপারে, তাতে ৫২জন লোকাল প্রতিনিধি ছিল। শুধু সই না, আলোচনার প্রক্রিয়াতেও ছিল। আমরা প্রথম যখন এসডিওর সাথে মিটিং-এ যাই, কয়েকজন গ্রামবাসীকে নিয়ে গিয়েছিলাম। এসডিও সেখানে একজনকে বলেছিল, চাবকে সোজা করে দেব। আর এই যে ৫২ জন প্রতিনিধি, তারা ডিএম-কে যা খুশি বলছে। এই যে ডিফারেন্সটা… যদি তারা ব্যাপারটা না মানত, মানে আমরা একটা এগ্রিমেন্ট চাপিয়ে দিলাম, এটা কি সম্ভব? এটা কীভাবে সম্ভব হয়? আইসোলেট করে দিয়ে। যে আমরা পাঁচজন গেলাম,একটা এগ্রিমেন্ট করে দিয়ে এলাম। পুলিশ এবার গিয়ে ব্যাপারটা টেক আপ করল। কিন্তু এই যে টোটালি একটা ডেমোক্র্যাটিক প্রসেসকে মেন্টেইন করা হচ্ছে… অবশ্য তার মানে কি আমরা সম্পূর্ণ রূপে ডেমোক্রেসি রাখতে পারছি? আপত্তি না করলে এখানে আমি লেনিনেরই স্মরণাপন্ন হব। যে একটা ফ্রি সোসাইটি ছাড়া আমরা ফুল ডেমোক্রেসি প্র্যাকটিস করতে পারব না।

যাই হোক,পীপল আছে,যে পীপলের মতামতটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডিফারেন্স হয়। একেবারে জরুরি ক্ষেত্র ছাড়া কোথাও কোনো মতামত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, এটা হয় না। শুধু তো কমিটির লোক নয়, বাইরে থেকে কেউ গেছেন, তাঁরাও আলোচনায় উপস্থিত থেকেছেন। এবং একটা জিনিস বলতে পারি যে, কোনো গ্রামে যে কেউ গিয়ে থেকে যাওয়ার ব্যাপারে, কোনোরকম বাধা কখনো তৈরি করা হয়েছে, এটা কেউ দেখাতে পারবে না। ব্যক্তিগত ভাবে আমার নামে কুৎসা করে, যে গ্রামে আমি প্রায় দেড় বছর ধরে আত্মগোপন করেছিলাম, সেই গ্রামে গিয়ে তিন-চার দিন ধরে কন্সট্যান্ট আমাদেরই সমর্থকের বাড়িতে বসে থেকে, বাড়ি-বাড়ি ঘুরে কুৎসা করারও অধিকার তাঁদের দেওয়া ছিল। এই সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়েও কিন্তু এই এগ্রিমেন্ট হয়েছে।

গ্রা: তাহলে ভাঙড় আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কি?

: চুক্তিটাকে রূপায়িত করা একটা টাস্ক। সরকার যদি চুক্তির সামান্যতম এদিক ওদিকও করে, তাহলে কিন্তু আমরা ছাড়ব না। চুক্তিতে একটা পয়েন্ট আছে, যে সেখানকার ডেভেলপমেন্ট-এর ক্ষেত্রে ডিএম-এর সভাপতিত্বে একটা সাবকমিটি তৈরি হবে। সেই সাবকমিটিতে পিজিসিআইএল থাকবে, ডব্লিউবিএসইডিসিএল থাকবে, পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি থাকবে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিরা থাকবে, আর জমি কমিটির প্রতিনিধিরা থাকবে। তো গতকাল যে জেনারাল মিটিং করেছি, সেখান থেকে ঠিক হয়েছে যে তাতে আমরা ৬ জন নির্বাচিত প্রতিনিধি পাঠাচ্ছি। আর আরেকটা টাস্ক হচ্ছে ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে – কে কত ক্ষতিপূরণ পাবে, সেটা তো আমাদের ঠিক করতে হবে, তার সার্ভে করার জন্য একটা কমিটি গতকাল ঠিক করা হয়েছে। সার্ভে করে রিপোর্ট দেবে, সেই সার্ভের উপর জেনারাল মিটিং হবে। সেই মিটিং-এ এগুলো পাশ হবে। সেগুলো এবার গভর্নমেন্টের কাছে যাবে। সেই অনুযায়ী চেক ডিস্ট্রিবিউটেড হবে। সমস্ত হিসেব রাখা হবে। তার পরবর্তী কালে এই ১২ কোটি টাকার হিসেব জনসমক্ষে পেশ করা হবে। এইটা – এবং ডেভেলপমেন্টের যে সমস্ত প্রজেক্ট আছে, সেই প্রজেক্টগুলোকে নিয়ে কাজ করা হবে। পঞ্চায়েতের যে দুর্নীতি, বা পঞ্চায়েতের যে সমস্যাগুলি আছে… আজ সুপ্রিম কোর্টের কি রায় হবে জানি না, কিন্তু যদি ভোট হয়, জমি কমিটি কি আগের বারের মতো ফাইট করবে? হ্যাঁ। এবং ডেমোক্র্যাটাইজ করার জন্য, আরও এক্সপ্যান্ড করার জন্য যে সমস্ত কাজ – তাতে কমিটি যা উদ্যোগ নেবে, পাশাপাশি কমিটি এই লড়াই করতে করতে যে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছে, সেই রাজনৈতিক অবস্থানের ভেতর থেকেও সে অটুট থাকবে। এইটা আমরা আশা করি। এই মুহূর্তে জনগণের যে ঐক্যের জায়গাটা আছে, তাতে আমার ব্যক্তিগত ভাবে বিশ্বাস রয়েছে।

গ্রা: লার্জার সোসাইটির কাছে কিছু বলবেন?

: যেদিন চুক্তিটা হয়ে গেল, তার পরেও যেটা বলেছি, সেটা হচ্ছে – হ্যাঁ, এই চুক্তিটা যে রূপায়িত হল, শেষ পর্যন্ত সরকার অন্ততপক্ষে কিছু সদর্থক ভূমিকা চুক্তিটা রূপায়ন করার ক্ষেত্রে নিয়েছে। আমরা আশা করছি – এটা আবার রিপিট করছি – সেটা হচ্ছে ভাবাদিঘীর ক্ষেত্রে এবং অন্যান্য জায়গায় যেখানে আন্দোলন চলছে – সমস্ত জায়গায় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে মর্যাদা দিয়ে,আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সমাধানের ব্যবস্থা সরকার করুক, এবং যে গণতন্ত্রহীনতা আজকের সমাজে অনেকটাই পরিব্যাপ্ত, মানে প্রচলিত সমাজের ক্ষেত্রেই বলছি, সেই জায়গায় একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ যাতে ফিরিয়ে আনা যায়, তার জন্য যে সংগ্রাম, সেই সংগ্রামে আমরা আছি। সরকারের কাছেও সেই বার্তাই গেছে, যখন চুক্তিটা হচ্ছে, এবং তার পরে। এবং এই পরিবেশকে রক্ষা করার দায়িত্বও সরকারকে নিতে হবে। এই সমস্ত লড়াইয়ের পাশে আমরা আছি। আরও ঐক্যবদ্ধ ভাবে যাতে এই গণতান্ত্রিক লড়াইগুলো এগিয়ে যেতে পারে, তার চেষ্টা আমাদের করতে হবে।

ডায়ালগ আমরা কখনই বন্ধ করিনি। ডায়ালগ চালাচ্ছি, যাঁরা হয়তো ভুল বুঝেছেন, তাঁদের সাথেও। তবে আমি গতকাল যেটা ঐ নিউজ টাইমে স্টেটমেন্টে বলেছিলাম, ঐ যে খেলোয়াড়রা অনেকসময় খেলে না, যে ব্যাটসম্যান খেলতে নেমেই সেঞ্চুরি হাঁকাচ্ছে, পরপর সেঞ্চুরি করে যাচ্ছে। এবার দেখা গেল কোনো একটা ম্যাচে নব্বই করেছে। তখন সমর্থকরা রেগে গেল। ঘটনা হচ্ছে, যারা এখন বুঝতে পারছেন না, কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝতে পারবেন।আমরা বারবার করে বলছি, চুক্তির জায়গাটা দেখা হোক, তাতে কোথায় ফাঁক আছে সেইটা দেখা হোক। এক হচ্ছে, কেস কি সত্যিই উইথড্র করবে? তো চুক্তি যারা করেছে, কেসটা তো তাদের ওপরেই।তাহলে যদি কেস উইথড্র না করে, ডুববে তো তারাই। অতএব সেখানে জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার প্রশ্ন আসছে না। অন্য কাউকে অ্যারেস্ট করে ফাঁসিয়ে দেবে, অবস্থাটা এটা নয়। দুই হচ্ছে ক্ষতিপূরণের ব্যাপারটা। ক্ষতিপূরণ এর মধ্যেই দেওয়া শুরু হয়ে গেছে।

চুক্তিটাকে কীভাবে রূপায়িত করা হবে? এটা রূপায়িত যত হতে থাকবে, এবং জনগণের ঐক্য যত তীব্র থাকবে, এবং জনগণের যে সক্রিয়তা গড়ে উঠবে – এটা আমার মনে হয় – বাইরে থেকে যারা দেখছেন, তাঁদের মধ্যে যে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ তৈরি হয়েছে, সেটা এমনিই কেটে যাবে, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই। যে জায়গায় আমরা ছিলাম সেই জায়গাতেই আছি। অন্য জায়গায় আমরা যাইনি, বা নীতিবহির্ভূত কোনো কম্প্রোভাইজ আমরা করিনি। একটা গণ-আন্দোলনের জায়গা থেকে তার একটা লজিকাল কনক্লুশন যেখানে হবার, সেখানেই সেটা ঘটেছে। এবং আরও যে অন্যান্য দিকে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার অবস্থা এর মধ্যে দিয়ে তৈরি হবে, এটা ক্রমশ বোঝা যাবে। যতটুকু ঐক্যে ফাটল ধরার অবস্থা তৈরি হয়েছে, আমাদের চেষ্টা আর দায়িত্ব থাকবে, যাতে সেটা না থাকে। সেই চেষ্টার কিছু ফলাফল আমরা এর মধ্যেই পেয়েছি। ইমিডিয়েটলি যা রিঅ্যাকশন ছিল, দু’দিন পরে সেটা অনেকটা কম। অনেক ক্ষেত্রেই আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে কিছু কিছু ফোন করেছি, যতটা কমিউনিকেট করা সম্ভব। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছি, কোথাও সাফল্য পেয়েছি। তো সাফল্য-ব্যর্থতা এর মধ্যে দিয়েই চলতে হবে, এটাই জীবন। এভাবেই চলবে। আশা করছি, ভাঙড় আন্দোলন যে জায়গায় পৌঁছেছে, তাতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্পেস আরও বাড়বে।