Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ঈশ্বরের দেশে মহাপ্রলয়

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

মেঘলা আকাশে ছোট্ট ফুটকির মতো কিছু একটা দেখা দিতেই সবক’টা ঘাড় একসঙ্গে ঘুরে গেল সেদিকে। ওইটাই কি? তারপর কয়েকমিনিটের মধ্যেই যখন বোঝা গেল ওটা সত্যিই হেলিকপ্টার, মুহূর্তে হইহই করে উঠল ভিড়টা। ওই আসছে, ওই আসছে। কিন্তু কেন আসছে? আটকে পড়া লোকগুলোকে সরিয়ে নিয়ে যেতে? নাকি, কিছু জল আর চিড়ের প্যাকেট নামিয়ে দিয়েই এ-যাত্রা ফিরে যাবে?

শ’দেড়েক মানুষের ভিড়টা যেখানে জমা হয়ে আছে, ইদুক্কি-কোট্টয়ম-আলাপ্পুঝা রাজ্যসড়কের সেই পঞ্চাশ মিটার মতো এলাকা ছাড়া আপাতত চারদিকে জল ছাড়া কিছু নেই। দূরে কিছু গাছের মাথা দেখা যাচ্ছে। ভিড়ের একপাশে কোলের শিশুকে দুধ খাওয়াতে-খাওয়াতে জয়াম্মা দূরে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছিলেন, ওইখানে তাঁদের গ্রাম। ঘরে জল ঢুকে গিয়েছিল ১৩ তারিখ রাতেই। বৃষ্টি ধরলে জল নেমে যাবে, এই ভরসায় সে রাতটা ভিটে ছেড়ে বেরোননি। কিন্তু কোথায় কী? পরদিন টানা বৃষ্টিতে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে ওঠে। শেষপর্যন্ত সন্ধের মুখে যখন ঘর ছাড়তে বাধ্য হন, তখন গ্রামে বুকসমান জল। বাচ্ছাটাকে ঝুড়িতে শুইয়ে সেই ঝুড়ি মাথায় নিয়ে অন্ধকারে প্রায় তিন কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে-সাঁতরে কোনওক্রমে রাজ্যসড়ক পর্যন্ত পৌঁছন। কতটা জল এখন? জয়াম্মা বোঝাচ্ছিলেন, চেঙ্গান্নুর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে এই জায়গায় রাজ্যসড়ক সবচেয়ে উঁচু – গ্রাম থেকে অন্তত ২৫ ফুট তো বটেই। সেই সড়কও পুরো ডুবে গিয়েছে। চরের মতো জেগে আছে কেবল এই পঞ্চাশ মিটার-খানেক রাস্তা। আর দুটো ঘন্টা বৃষ্টি হলে এটাও থাকবে না। তাই, আপাতত জলের প্যাকেট বা চিড়ে-গুড় নয়, ওঁরা চাইছেন হেলিকপ্টার ওঁদের এখনই এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাক। বা, মেশিন-লাগানো বড় নৌকো নিয়ে আসুক সেনাবাহিনির লোকজন। “না হলে আমরা সবাই একসঙ্গে প্রাণে মারা পড়ব”, ডুকরে উঠছেন বছর চল্লিশের জয়াম্মা।

প্রায় একই ছবি আলাপ্পুঝার পাশের জেলা কোট্টয়মেও। হেলিকপ্টার থেকে দড়ি ঝুলিয়ে তুলে আনা হচ্ছে দুর্গতদের। ৭০ বছরের মুরুগেশ চেরিয়ান তাঁর পরিবারের সাত সদস্যকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন স্থানীয় চার্চে। সেখানে মাথা গুঁজেছিল গ্রামের প্রায় ৪০টি পরিবার। কিন্তু সেখানেও জল ঢুকে যাওয়ায় কার্যত মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন তাঁরা। গত দু’দিনে হেলিকপ্টার ও মোটরবোটের সাহায্যে তাঁদের সবাইকে উদ্ধার করে ১০ কিলোমিটার দূরের রেলস্টেশনে পৌঁছে দিয়েছে নৌসেনার উদ্ধারকারী দল। সেখানকার ত্রাণশিবিরে পৌঁছে চওড়া হাসি মুরুগেশের। “সেনাবাহিনির জন্যই এ-যাত্রা বেঁচে গেলাম”, নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে স্বগতোক্তি প্রৌঢ়ের।

রাজ্যের ১৫টি জেলার মধ্যে একেবারে উত্তরপ্রান্তের কাসারাগোড় জেলায় বন্যার প্রকোপ তেমন নেই। কিছুটা নিরাপদ একেবারে দক্ষিণের তিরুঅনন্তপুরমও। কেরলের বাকি ১৩টি জেলা আক্ষরিক অর্থেই খাবি খাচ্ছে বন্যার জলে। প্রাচীনেরা বলছেন, জীবনে এমন বন্যা দেখেননি। গত ১০০ বছরে রাজ্যে এমন বন্যা হয়নি, তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে বলছে আবহাওয়া দফতর। গত সপ্তাহে স্বাভাবিকের তুলনায় ৩০০ গুণ বেশি বৃষ্টি হয়েছে গোটা রাজ্য জুড়ে। জলস্তর বাড়তে থাকায় বিপদ আঁচ করে মালমপুঝা-ইদুক্কি-চেরুথোনি-পারাম্বিকুলম-মুল্লাপেরিয়ার-সহ রাজ্যের ৩৩টি জলাধার একসঙ্গে জল ছাড়তে শুরু করেছে। রাজ্য সেচ দফতরের ব্যাখ্যা, সময়টা বর্ষার মাঝামাঝি হওয়ায় নদীবাঁধগুলো এমনিতেই জলে ভরে ছিল, ফলে বাড়তি জলের চাপ নিতে পারেনি। ভাসিয়ে দিয়েছে হেক্টরের পর হেক্টর এলাকা। পরিস্থিতি আরও সঙ্গিন হয়েছে জলাধারগুলি থেকে ছাড়া বাড়তি জলের চাপ নিতে তামিলনাডু সরাসরি অস্বীকার করে বসায়। কাবেরীর নিম্ন-অববাহিকায় সে রাজ্যের আটটি জেলাতেও বন্যার ভ্রূকুটি – কাবেরী এবং তার প্রায় প্রতিটি উপনদীর জল কমলা বিপদসঙ্কেত পার হয়ে লালের প্রায় গা ঘেঁষে বইছে। সর্বোচ্চ বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে পেরিয়ার, ভরতপুঝা, পাম্বা-সহ কেরলের প্রায় সমস্ত নদীর জল। জলাধারগুলি জল ছাড়া বন্ধ না-করলে জলস্তর কমার আশু কোনও সম্ভাবনাই নেই।

সবচেয়ে করুণ অবস্থা কোঝিখোড়, মলপ্পুরম, ত্রিশুর, এর্নাকুলম, ইদুক্কি, কোট্টয়ম, আলাপ্পুঝা ও পতনমতিত্তা জেলায়। এরই মধ্যে আবার আলাপ্পুঝা ও পতনমতিত্তার অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। আলাপ্পুঝার চেঙ্গান্নুর, তিরুভাল্লা, কায়মকুলম-সহ প্রতিটি শহর পুরোপুরি জলের তলায়। রেল ও সড়ক পরিবহন পুরো বন্ধ। বন্ধ হাসপাতাল, এমনকী বিদ্যুৎ-স্টেশনগুলিও। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাব-স্টেশনগুলিতে জল ঢুকে যাওয়ায় শর্ট- সার্কিটের ভয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। ফলে সাধারণ মানুষ পড়েছেন ভয়ঙ্কর বিপদে। খাবার ও পানীয় জলের সরবরাহ বন্ধ, ওষুধের আকাল। প্রায় একই অবস্থা লাগোয়া মলপ্পুরম, কোল্লম ও এর্নাকুলম জেলাতেও। উত্তরের কান্নুর, ওয়ায়নাড় ও কোঝিখোড়; তামিলনাডু-লাগোয়া পালাক্কাড় ও ইদুক্কি – অবস্থা সর্বত্রই অত্যন্ত খারাপ। তবে তুলনামূলকভাবে বেশি বিপর্যস্ত মালাবার উপকূলবর্তী এলাকাগুলি। সারা রাজ্যে মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসেবেই সাড়ে তিনশো ছাড়িয়েছে, এখনও পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিনলক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ত্রাণশিবিরগুলিতে। ত্রাণশিবিরের বাইরে খোলা আকাশের নীচে নিরাশ্রয় রাত কাটাচ্ছেন আরও কত মানুষ, কোনও হিসেব নেই। ইদুক্কি, পালাক্কাড় ও ওয়ায়নাড় জেলার বিস্তীর্ণ অরণ্যভূমিতে, কিংবা পেরিয়ার-থেক্কাডি-আট্টাপাডির সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বন্যপ্রাণীরা কী অবস্থায় রয়েছে, কেউ জানে না।

বায়ুসেনা, নৌসেনা, উপকূলরক্ষী বাহিনি ও বিপর্যয়-মোকাবিলা বাহিনি একযোগে হেলিকপ্টার ও মোটরবোট নিয়ে যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে মানুষজনকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে আনার কাজ শুরু করলেও, এখনও অনেক জায়গায় তারা পৌঁছতেই পারেনি বলে অভিযোগ। মৎস্যজীবীরাও তাঁদের নৌকো নিয়ে ত্রাণের কাজ শুরু করেছেন। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই সামান্য। ত্রিশুর, এর্নাকুলম, কোট্টয়ম ও আলাপ্পুঝার বিস্তীর্ণ এলাকায় ন্যূনতম ত্রাণসাহায্য পৌঁছে দেওয়া তো দূরের কথা, এখনও পৌঁছতেই পারেননি বলে স্বীকার করে নিয়েছেন উদ্ধারকারী দলের সদস্যরাই। খাস তিরুঅনন্তপুরম শহরেই টানা পাঁচদিন বিমানবন্দর ও রেল-পরিষেবা বন্ধ থাকায় দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়াও কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহরের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়তে শুরু করেছে, কোথাও-কোথাও অমিল হতে শুরু করেছে পানীয় জল থেকে শুরু করে জীবনদায়ী ওষুধও।

ভয়াবহ মার খেয়েছে ঈশ্বরের দেশের (‘গডস ওন কান্ট্রি’, এই নামেই কেরলকে ডাকেন পর্যটকেরা) পর্যটনও। পশ্চিমঘাটের মুন্নার-পালানি-থেক্কাডির পাহাড়ে নীলাকুরিঞ্জি নামে বিরল এক ধরনের বেগনি রঙের ফুল ফোটে ১২ বছরে মাত্র একবার – ২০০৬-এর পর এবারই ছিল সেই ফুল ফোটার সময়। পাহাড় ভরেও গিয়েছিল সেই ফুলে। দেশবিদেশের পর্যটকেরা আসতে শুরু করেছিলেন দলে-দলে। দুর্দান্ত ব্যবসা হবে, এই ভরসায় ঝাঁপিয়েছিল রাজ্য পর্যটনবিভাগ থেকে শুরু করে নামী-অনামী অসংখ্য পর্যটনসংস্থা। আপাতত পুরো পরিকল্পনাই বিশ বাঁও জলে। পরিস্থিতি এতটাই সঙ্গিন যে, বিদেশি দূতাবাসগুলি নিজেদের দেশের ভ্রমণার্থীদের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানাচ্ছে, বেড়ানোর পক্ষে কেরল এখন সুবিধের নয়, প্রোগ্রাম বাতিল করুন। মাথায় হাত বুকিং নিয়ে বসে থাকা ট্যুরিজ্‌ম সংস্থাগুলোর।

উত্তর-কেরলে গত ৪৮ ঘন্টায় বৃষ্টি না-হওয়ায় রাজ্য প্রশাসন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল, কিন্তু তাদের কপালে নতুন করে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে শনিবার সন্ধ্যায় আবহাওয়া দফতরের ঘোষণা। রবিবারের পর থেকে মধ্য ও দক্ষিণ-কেরলের উপকূলবর্তী অঞ্চলে নতুন করে নিম্নচাপের আশঙ্কার কথা শুনিয়েছে আবহাওয়া দফতর। বৃষ্টি অবিলম্বে বন্ধ না-হলে পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন সেনাবাহিনির উদ্ধারকারী দলের কর্তারা। উদ্ধারকার্যে সমন্বয়কারী জাতীয় বিপর্যয়-মোকাবিলা বাহিনির মতে, বৃষ্টি বাড়লে জলাধারগুলিকে বাঁধ বাঁচাতে আরও জল ছাড়তেই হবে। তা না-হলে প্রলয় ঘটবে। ফলে, পরিস্থিতির ওপর নজর রাখতে আপাতত সব পক্ষই আকাশের দিকে তাকিয়ে।

প্রাথমিক হিসেব যেটুকু করা গিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দু’হাজার কোটি টাকা। জল নামতে শুরু করলে বিপর্যয়ের পুরো চেহারাটা যখন সামনে আসবে, এই পরিমাণ আরও অনেকগুণ বাড়বে। ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে দু’হাজার কোটি টাকার সাহায্য চেয়েছেন কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন। আকাশপথে বিপর্যয় খতিয়ে দেখে পাঁচশো কোটি টাকা সাহায্য ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এই সামান্য টাকায় কী হবে, তা নিয়ে ক্ষোভও রয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। চেন্নাইয়ের সাম্প্রতিক বন্যাকে মুহূর্তের মধ্যে জাতীয় বিপর্যয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে, অথচ রাজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা জলের তলায় চলে গেলেও কেরলের বন্যাকে এখনও জাতীয় বিপর্যয় আখ্যা না-দেওয়ার পেছনে রাজনৈতিক বৈষম্যকেই দায়ী করছেন সাধারণ মানুষ ও বিরোধীরা। তাঁদের অভিযোগ, বিজেপি-এডিএমকে গলাগলির সুবাদেই পলানিস্বামীর কপালে শিকে ছিঁড়েছে, আর অন্যদিকে কেরলের বাম সরকারকে শিকার হতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ঔদাসীন্যের।

এরই মধ্যে বিচিত্র এক টুইটবার্তায় নয়া বিতর্ক তৈরি করেছেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নবনিযুক্ত ডিরেক্টর এস গুরুমূর্তি। তাঁর দাবি, শবরীমালা মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশের দাবিতে নাকি রুষ্ট হয়েছেন ভগবান আয়াপ্পা। ভয়াবহ এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় নাকি ভগবানের সেই রোষেরই প্রকাশ। সেই টুইটবার্তা সামনে আসতেই শুরু হয়েছে বিতর্কের ঝড়। সুপ্রিম কোর্টে শবরীমালা মামলার অন্যতম আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহর অভিযোগ, যখন সকলে মিলে একযোগে বিপর্যয় মোকাবিলার প্রয়োজন, তখন ধর্মের নামে মানুষকে ক্ষেপানোর রাস্তা নিয়েছেন গুরুমূর্তি।