Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পায়ে পড়ি বাঘমামা

তিষ্য দাশগুপ্ত

 

কমলাকান্তকে সবাই পাগল বলিত। নেহাত বঙ্কিম চাটুজ্যে মশাই ছিলেন বলিয়া পাঠক সমাবেশে বাংলার সাহিত্য দরবারে এহেন অফিমখোর পাগল দস্তুরমতো দপ্তরখানা সাজাইয়া রাখিতে পারিয়াছে। আজ এ ঘামে সপসপে নীল সাদা কলিকাতা শহরে সে কমলাকান্তও নাই, আর আফিমও সহজে মিলে না। যুগের সাথে তাল মিলাইয়া চলিতে চলিতে নিও কালচারিজমের গুঁতায় বঙ্কিমি ভাষাও সাধু চলিত মিলিয়া অতীব চণ্ডাল হইয়া উঠিয়াছে। আইটির ভাইটি এইচ আরের ঠেলায় গুরুভাষা ভুলিয়া চোখে সর্ষেফুল দেখিতেছে নিত্যদিন। তবে ইহা সত্য যে পার্কস্ট্রিটের নিয়ন আলোর নিচে সুশোভিত সুসজ্জিত “দ্যা ফরটি টু”-র পদতলে আজও গুটিকয়েক মার্জার মিলে বটে, তবে তাহারা দুগ্ধ পছন্দ করে কিনা জানা নাই, তবে প্রসন্নহস্তে দান করিলে কিংবা না করিলেও আধুনিক শহরের আধুনিক বিড়াল বলিয়া বসে “তোমার ভ্যাট 69 তো খাইয়া বসিয়া আছি, এখন বলো কি?” বলি আর কি, উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করিবার পর দীর্ঘ সপ্ত মাসাধিকাল হইয়া গেল গৃহে নিত্য গঞ্জনা সহ্য করিয়া আপন অসীম অপার ধৈর্যবশে অতিপ্রিয় পাশবালিশখানি জড়াইয়া আপন বিছানায় অধিষ্ঠান করিতেছি, কর্মসংস্থানিক খবর (সুধী শিক্ষিত পাঠক এমপ্লয়মেন্ট নিউজ পড়িবেন, নেশা বেশ চড়িয়াছে — বঙ্গানুবাদ ভুল হইলে মার্জনা করিবেন) প্রথম প্রথম লাল কালির আঁচড়ে রক্তাক্ত হইবার সৌভাগ্য লাভ করিত, এখন উহাতে জড়াইয়া আনা ভ্যাট 69, দীর্ঘদিনের সঞ্চয়ের ফল — তাহা বিড়ালে উদরাস্থ করিয়া বসিয়া আছে — সত্যি কী-ই বা বলি।

এমতবস্থায় কতকটা হয়তো লাঠি না পাইয়া, কতকটা দুঃখে শোকে, হয়তো কতকটা বা বিড়ালের উপর অসীম ক্রোধে, আবার কতকটা বা পরম মিত্রের প্রবল আগ্রহে একখানি ফর্ম ফিলাপ করিয়া বসিলাম — ভারতীয় বন্যজীব সংস্থান ব্যাঘ্র গুনিবার কাজে কর্মঠ শ্রমিক চাহিয়াছে। নেশার ঘোরে ক্রমাগত ভাবিতে থাকি গৃহের মালিকেরা এহেন অকর্মণ্য নেশারুকে দিনের পর দিন পুষিতেছে কেন, মার্জারেরও বোধকরি একই অভিমত, একটি দীর্ঘ লেকচার ঝাড়িতে উদ্যত হইয়াছিল — এক ধমকে তাহাকে নিরস্ত করিয়া কোনওক্রমে ইন্ডিগোর পেটস্থ হইলাম, ঘরের মানুষ নিশ্চিন্ত হইল — উপদ্রব বিদায় হইয়াছে, আড়চোখে দেখিলাম, মার্জার আমার পিছু ছাড়িল না। অতঃপর দীর্ঘ কয়েক মাস অতিক্রান্ত হইয়াছে, কী দুঃখে সুখে গাড়োয়ালের শীতল আশ্রয় ছাড়িয়া এই তপ্ত মধ্যপ্রদেশে আমার দিন অতিক্রান্ত হইতেছে তা বাবা কমলাকান্তই জানেন।

যাহা হউক, ফুটবল বিশ্বকাপ হইতে আর্জেন্টিনার মহানিষ্ক্রমণের দুঃখেই হউক অথবা মার্জারের প্রবল দূরদৃষ্টির কারণেই হউক — ইন্ডিগোর উদর হইতে সরাসরি নিষ্কৃত হইলাম দেহরাদুন শহরে, যাহা একদা পর্বত শানুদেশে মনোরম মধুচন্দ্রিমাস্থল রূপে গণ্য হইত। এ পোড়া নীল সাদা শহরে হয়ত আমি আপনি মার্জার আজ শ্বাসগ্রহণ করিতেছি এ পার্বত্যভূমির কল্যাণেই। “দু পেগ ভ্যাট উদরাস্থ করিয়াছ কি অন্তরের বঙ্কিম অনুব্রত মণ্ডলের ন্যায় রাস্তার মোড়ে উপস্থিত হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। ধিক হে স্বল্পবুদ্ধি মনুষ্য, বিড়ালের জন্য কিঞ্চিত দুগ্ধও প্রসন্নচিত্তে রাখিতে পারো না।” মার্জারের মেজাজ এখনও অর্ণব গোস্বামী হইয়া আছে, অতএব উহাকে উহ্য রাখিয়া দেহরাদুনে ফিরিয়া যাই। অতীব ক্ষুদ্র এ জনপদ, তাহাতে অসংখ্য মনুষ্যপদবাচ্য প্রাণী আপন ক্ষুন্নিবৃত্তির নিমিত্ত ভাগ্য অন্বেষণে নিয়োজিত।

অতীতের পথে বেশি অগ্রসর না হইয়া এগিয়ে যাওয়াই জীবনের দাবী। নেশার ঘোরেই হউক কিংবা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ক্ষমতাবলেই হউক, মার্জার নিজেকে মাসাধিককাল-উত্তর আবিষ্কার করিল রাজাজী নামক পার্বত্যবনমালার অভ্যন্তরে, তাহার বোনঝির সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই বটে… তবে তাহার উপস্থিতি পদে পদে অনুভূত হয়। উত্তরাখণ্ডের গভীর গহীন পার্বত্য শানুদেশে এ বনমালার মাঝে অবস্থান করিতেছে মনোরম শহর ঋষিকেশ এবং দেবভূমি হরিদ্বার, গঙ্গা নদীর স্নিগ্ধ স্বচ্ছ জলধারা প্রতিনিয়ত চুম্বন করিয়া যাইতেছে এ অরণ্যভূমিকে। যাযাবর গুজ্জরদের আদি বাসভূমে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম চলে বাঘে মনুষ্যে, তদুপরি হাতির উপদ্রব সর্বত্র। বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ঠেলায় নিজভূমে পরবাসী তাহারা, কদাচ কদাপি তাহাদের অস্থায়ী ডেরা দৃষ্টিগোচর হয় বটে, মহিষের দুগ্ধ, ঘি মাখনের লোভে মার্জার তাহাদের আস্তানার দিকে অগ্রসর হওয়ার পূর্বেই বহু ক্লেশে তাহাকে বগলদাবা করিয়া নিজ ডেরায় অধিষ্ঠিত হওয়া গেল। জোৎস্নালোকিত গঙ্গার তীরে জঙ্গলের অপার রহস্য বুকে লইয়া চৈতালী রাত্রে বৃহদাকার হস্তীযুথের আনাচে কানাচে নির্ভয়ে খেলে বেড়াইতেছে হরিণশাবকেরা, এ দৃশ্য ভাষায় বিবৃত করা আমার পক্ষে নেহাতই অসম্ভব — লবটুলিয়ার জঙ্গলমহালের ম্যানেজারবাবু সাথে থাকিলে হয়ত মার্জারের মনের ভাবখানি সঠিকভাবে ব্যাখ্যান করিতে পারিতেন। যাহা হউক, স্তব্ধবাক বিড়ালের বিস্ময় ভাঙিলে আবার আমার কপালে গালি বরাদ্দ, সে ভয়ে আপাতত কিঞ্চিৎ সংকুচিত হইয়া আছি। জঙ্গলের পথে সকাল বিকেল কাঁটাঝোপের আক্রমণ হইতে কোনওভাবে নিজেকে বাঁচাইতে পারিলেও বিড়ালের পশমের জন্য তাহা মোটেও সুখকর নহে — এ কঠিন জীবনে আমার পশ্চাদানুসরণ করিতে আমি উহাকে বাধ্য করি নাই, স্ব ইচ্ছায় নিজ ভাগ্য অন্বেষণে সে আসিয়াছে এ পার্বত্যভূমিতে, অতএব উহার আক্রমণকে অগ্রাহ্য করিয়াই অকুতোভয়ে ছুটিয়া চলি জঙ্গলের পথে। শিক্ষণীয় মূলত দুইটি বিষয়, সূর্যের প্রথম রশ্মিটি ভূমিষ্ঠ হইবার পূর্বেই যাবতীয় ভয়াল ভীষণ জন্তুদের উপস্থিতি এড়াইয়া বিভিন্ন প্রকারের শাকাহারী জীবজন্তুর গণনা এবং মার্জারের আপন বোনপোর স্থিরচিত্র সংরক্ষণের নিমিত্ত সমগ্র অরণ্যে ক্যামেরা স্থাপন করা। ইহা ব্যতীত প্রতিনিয়ত এ অরণ্যভূমি কিছু না কিছু শিখাইতেছে, প্রকৃতি তাহার বিশাল বিপুল পাঠশালার আগল খুলিয়া দিয়া যেন দু বাহু বাড়াইয়া বসিয়া আছে তার সকল রত্নরাজির সম্ভার সাজাইয়া।

শ্রমিকদের প্রশিক্ষণকেন্দ্রে পরিশ্রম আছে ঠিকই, কিন্তু তাহার পরে ক্ষুধা তৃষ্ণা নিবারণের কোনও খামতি নাই, মার্জারও দেখিতে পাই আজকাল পরিস্থিতির সহিত নিজেকে মানাইয়া নিয়াছে, তাহার দুধ ডিম মাংসের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা দেখিয়া। নানা প্রদেশের নানা রঙের মেলা এই প্রশিক্ষণশালা। পঞ্চনদের তীর হইতে কন্যাকুমারীর সুবাস লইয়া গোটা ভারতবর্ষ যেন উঠিয়া আসিয়াছে এই রাজাজীর অভ্যন্তরে, তার বিচিত্র বৈচিত্রের বিপুল সম্ভার লইয়া। নেহাতই ছাপোষা বঙ্গসন্তান কমলাকান্তের উত্তরসূরি এই অধম, পটল দিয়া সিঙ্গিমাছের ঝোল যার আহার্য — সেই আমি আশ্চর্য হইয়া দেখিতেছি এই বহু রূপের বহু রঙের প্রকাশ! আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে আমার বিড়ালখানিও ইতোমধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করিয়াছে এই বিবিধ প্রদেশের জনস্রোতের কাছে। এমতাবস্থায় বেশ সুখে শান্তিতে দিন গুজরান হইতেছিল, কিন্তু কোনও এক মহান কবি বলিয়া গিয়াছেন সুখ কখনও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সহকর্মীরা যখন অরুণাচল কিংবা অসম প্রদেশের নাম না জানা বনানীতে আস্তানা গাড়িবার প্রস্তুতিতে নিমগ্ন, তখন কোনও এক উড়োচিঠি আমায় জানান দিয়া গেল — “ওহে বাঙালি, প্রস্তুত হও, গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ লইয়া মধ্যপ্রদেশ তোমায় স্বাগত জানাইবার জন্য অপেক্ষা করিতেছে।”

আরও অসহ্য লাগে মার্জারের আচরণ, ভাবখানি এমন — “বেশতো, নাও এবার ঠেলা সামলাও।” অবোধ বিড়াল সময়ে সময়ে ভুলিয়া যায় আমি ব্যতীত উহারও গত্যন্তর নাই — যাহা হউক, যারপরনাই দুঃখিত হইয়া মধ্যপ্রদেশের বান্ধবগড় নামক স্থানে যাত্রার উদ্যোগ করিতে থাকি — তখন কী আর ছাই জানিতাম, কী আশ্চর্য এক অভিজ্ঞতার ডালি সাজাইয়া আমায় জন্য অপেক্ষা করিতেছে এ ভারতবর্ষ যাহা আমাকে কানায় কানায় পরিপূর্ণ করিয়া তুলিবে আগামী পাঁচ মাসে!

মার্জার যদি সম্মতি করে তাহা হইলে এই সাধু চলিত বাংলা ইংরেজি মিশ্রিত চরম চণ্ডাল ভাষায় আপনাদের সে কাহিনী শোনাইতে পারি, কেবল মাঝে মাঝে কয়েক বোতল ভ্যাট 69 ভেট দিয়া যাইবেন আমার এবং আমার বিড়ালের অন্তরাত্মার শান্তির নিমিত্ত, রোজ লিখিব এমন গ্যারান্টি দিতে পারি না — তবে নেশা চড়িলে অবশ্য লিখিব তাহা হলপ করিয়া বলিতে পারি। আপাতত রাত অনেক হইয়াছে, মার্জারের মেজাজ কিঞ্চিত খারাপ — নিদ্রার আয়োজন করি গে যাই, আপনারাও কলিকাতা শহরের মোড়ে মোড়ে উন্নয়নের মুখ দেখিতে দেখিতে আপন অথবা পরের শয্যায় নিদ্রা অথবা অনিদ্রার আয়োজন করুন। ও হ্যাঁ, মাঝে মাঝে ভ্যাট পাঠাইতে ভুলিবেন না যেন গল্প শুনবার আগ্রহ থাকিলে। আবার দেখা হবে আগমনীর গান লইয়া অক্টোবরের প্রথম প্রভাতে, সাথে থাকিব আমি আর আমার মার্জার তাহার বোনপোর সহিত, বান্ধবগড়ের অজানা অচেনা কাহিনী লইয়া। শুভরাত্রি।

ইতি,

(ভুলিয়া গিয়াছি, মনে পড়িলে অবশ্য জানাইয়া দিব)

পুনঃ আবার আসিব। কবে? সেটাও পরে জানাইয়া দিব!