স্টেশন মাস্টার
মাত্রই দু’দিন আগে, ৩০ অগস্ট, আমরা প্রায় নিঃশব্দে পেরিয়ে এলাম ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে অফ এনফোর্সড ডিজ্যাপিয়ারেন্সেস’। প্রায় নিঃশব্দে, কেননা রাষ্ট্রপুঞ্জের ওয়েবসাইটে এ নিয়ে সামান্য কথাবার্তা থাকলেও, এবং গ্রিনপিস বা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো হাতে গোনা কয়েকটি সংস্থা এ নিয়ে খানিক হইচই করলেও বিশ্বের বাকি অংশে দিনটির অস্তিত্ব সম্পর্কেই আদৌ কেউ সচেতন ছিলেন এমন কথা বলা যাবে না।
এর মাত্র মাসদুয়েক আগেই, ২০ জুন, আমরা পেরিয়ে এসেছি আরও একটি দিন, ‘ওয়র্ল্ড ডে ফর দ্য রেফিউজিস’। তখন অবশ্য উদ্বাস্তু সমস্যা ও শরণার্থী সঙ্কট নিয়ে এখানে ওখানে খানিক কথাবার্তা শোনা গিয়েছিল, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের ফিডবাহিত আমাদের মিডিয়াতেও এ নিয়ে কিছু লেখাপত্র চোখে পড়েছিল। কিন্তু, ওই পর্যন্তই। তার মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই, সেই আন্তর্জাতিক সংবাদের ফিড মারফতই আমাদের নজরে আসে, সিরিয়ার শরণার্থী-বোঝাই নৌকো যাতে কোনওমতেই গ্রিসের মাটিতে ভিড়তে না পারে, তার জন্য বিশেষ উপকূলরক্ষী বাহিনি মোতায়েন করেছে সে দেশের সরকার। আমাদের এখানেও দেখি মায়ানমার থেকে তাড়া খেয়ে বাংলাদেশ হয়ে ভারতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফের মায়ানমারে ঠেলে পাঠাবার জন্য ধারাবাহিকভাবে সক্রিয় কেন্দ্রীয় সরকার। তার কয়েকদিন যেতে না-যেতেই অসমে নাগরিক পঞ্জীকরণের দ্বিতীয় দফার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, দেখা যায় ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার এপার-ওপার জুড়ে প্রায় চল্লিশ লক্ষ মানুষ বাদ পড়েছেন সেই তালিকা থেকে। এইভাবেই, একদিকে রাষ্ট্রপুঞ্জের ক্যালেন্ডারে সারা পৃথিবীকে একটিই দেশ হিসেবে দেখতে চাওয়ার অঙ্গীকার, ও অন্যদিকে দিনের পর দিন রাষ্ট্রপুঞ্জের সদস্য দেশগুলির হাতেই শরণার্থীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য খবরের মধ্যে ঠোকাঠুকি খেতে-খেতে গড়ে উঠতে থাকে বিশ্বব্যাপী উদ্বাস্তু সমস্যার পরস্পরবিরোধী বহুস্তর এক ভাষ্য।
এরই মধ্যে চোখে পড়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের রেফিউজি এজেন্সির হিসেব, যা জানায় এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছেন প্রায় সাড়ে ছ’কোটি উদ্বাস্তু। এঁদের মধ্যে চারকোটি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুহারা, দু’কোটি সীমান্ত-পেরনো উদ্বাস্তু, আর একত্রিশ লক্ষ শরণার্থী। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে শতকরা সাতান্ন ভাগ আদতে দক্ষিণ সুদান, আফঘানিস্তান এবং সিরিয়ার মানুষ। সারা বিশ্বের স্থানচ্যুত মানুষদের মধ্যে শতকরা পঁচাশি ভাগের আশ্রয়দাতা ইরান, লেবানন, পাকিস্তান, উগান্ডা এবং তুরস্কের মতো উন্নয়নশীল দেশ। ওই রিপোর্ট আরও জানায়, প্রতিদিন যুদ্ধ ও সন্ত্রাসের ফলে গৃহহীন হচ্ছেন চুয়াল্লিশ হাজার চারশো মানুষ, আর প্রতি দু’সেকেন্ডে স্থানচ্যুত হচ্ছেন একজন। ‘দ্য আপরুটেড’ শীর্ষক ইউনিসেফ-এর সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সারা বিশ্বে এই মুহূর্তে বাস্তুহারা শিশুর সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি, যাদের একটা বড় অংশেরই দিন কাটছে অসংখ্য ত্রাণশিবিরে।
উদ্বাস্তু ও শরণার্থী সমস্যা-বিষয়ক এমনই নানা তথ্য ও ভাবনা থেকে গড়ে উঠেছে চারনম্বর প্ল্যাটফর্মের দ্বিতীয় বর্ষ পঞ্চম যাত্রার মূল বিষয়ভাবনার অভিমুখ। এর মধ্যে দিয়ে আমরা একদিকে যেমন তত্ত্বগতভাবে বুঝতে চেয়েছি সমস্যার স্তরগুলিকে, তেমনই ধরতে চেয়েছি সেইসব অসংখ্য মানুষের মুখের রেখাও, ভিটেমাটি হারিয়ে যাঁরা হয় নিজভূমে পরবাসী, অথবা পরভূমে অনভিপ্রেত। ঘরেও নেই পারেও নেই – অতীত ও ভবিষ্যৎ দুইই হারিয়ে আক্ষরিক অর্থেই আত্মপরিচয় ও অপরিচয়ের মাঝখানে থাকা এই বিপুল জনগোষ্ঠীই আমাদের এবারের সংখ্যার কেন্দ্রীয় চরিত্র। আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু সমস্যার বিভিন্ন দিকগুলি নিয়ে লিখেছেন ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য, সুশোভন ধর, মধুময় পাল, সৌমিত্র দস্তিদার, মোহাম্মদ ইরফান ও মৃণাল চক্রবর্তী।
এইসঙ্গে উল্লেখ করার মতো আরও একটি বিষয়, চারনম্বর প্ল্যাটফর্ম ওয়েব-পত্রিকা এবার আত্মপ্রকাশ করছে ইউটিউবেও। অসমের সাম্প্রতিক নাগরিক পঞ্জীকরণ বিতর্কের কেন্দ্রে বসবাসকারী মানুষদের নিয়ে সৌমিত্র দস্তিদারের গবেষণাধর্মী ডকুমেন্টারি ছবি ‘সীমান্ত আখ্যান’-এর শুভমুক্তি ঘটছে আজই, চারনম্বর প্ল্যাটফর্মের ইউটিউব চ্যানেলে। ছবিটির লিঙ্ক পাবেন সৌমিত্র দস্তিদারের লেখা নিবন্ধটির মধ্যেই।
মূল বিষয়ভাবনার বাইরে আরও যে কথাগুলি বলার, এবারের অগস্ট মাসটি আক্ষরিক অর্থেই ছিল নক্ষত্রপতনের। আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন দ্রাবিড় রাজনীতির অন্যতম পুরোধাপুরুষ করুণানিধি, সংসদীয় বাম রাজনীতির বহু-আলোচিত প্রতিনিধি সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। এবারের স্মরণ বিভাগে রইল প্রতীপ নাগ, প্রদীপ ভট্টাচার্য ও সব্যসাচী দাসের কলমে তাঁদের স্মৃতিচারণ ও মূল্যায়নের সশ্রদ্ধ প্রয়াস। তারই সঙ্গে রইল বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম বিতর্কিত মোহিক্যান, সদ্যোপ্রয়াত ভি এস নয়পল ওরফে স্যার ভিদিয়াকে নিয়ে নিরুপম চক্রবর্তীর, এবং সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পরিচিত নাম, আমাদের একান্ত আপনার আফসার আমেদের প্রতি স্বপ্নময় চক্রবর্তীর স্মৃতিতর্পণ। বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তক এবং অর্থনীতিবিদ সামীর আমিনও চলে গেলেন, তাঁকে নিয়ে লিখলেন পার্থসারথি চৌধুরী। রইল ভারতীয় ক্রিকেটের বর্ণময় ব্যক্তিত্ব, সদ্যোপ্রয়াত প্রাক্তন অধিনায়ক অজিত ওয়াড়েকরকে নিয়ে শুভাশিস রায়চৌধুরীর একটি লেখাও।
কবি ভারভারা রাও, আইনজীবী সুধা ভরদ্বাজ-সহ পাঁচ ফ্যাসিবিরোধী মানবাধিকার কর্মী ও সাহিত্যিককে গ্রেফতার ও গৃহবন্দি করে রাখার খবর ও তার প্রেক্ষিতে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীমহলের তীব্র সমবেত প্রতিক্রিয়া গত কয়েকদিনে সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে উঠে এসেছে। আমাদের প্রবন্ধ বিভাগে, অন্যান্য লেখার সঙ্গে, রইল এ-বিষয়ে আশীষ লাহিড়ী ও কৌশিক দত্তের দুটি মূল্যবান নিবন্ধ।
এই সংখ্যা থেকে শুরু হল পীযূষ ভট্টাচার্যের নতুন ধারাবাহিক উপন্যাস ‘অন্তেবাসী’। একইসঙ্গে, শুরু হল অনুবাদ-সাহিত্য নিয়ে একটি নিয়মিত নতুন বিভাগ। অনুবাদকের সঙ্কট ও সাফল্য নিয়ে তৃষ্ণা বসাকের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ, ও জিললুর রহমানের করা কার্ল স্যান্ডবার্গের কয়েকটি কবিতার অনুবাদ থাকছে এই সংখ্যায়। এই বিভাগে আমাদের চেষ্টা থাকবে প্রতি সংখ্যায় সমকালীন অনুবাদ-সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা ও প্রতিনিধিত্বমূলক কিছু অনুবাদ রাখার। পাশাপাশি, আপনাদের দাবি মেনে, অনেকদিন পর, ফিরিয়ে আনা হল পুরনো বিভাগ ‘কেবিন গ্রাফিত্তি’। এবার রইল চিত্রসাংবাদিক তন্ময় ভাদুড়ি ও প্রবন্ধকার তথা আলোকচিত্রী কৌশিক মজুমদারের দুটি ফোটো-ফিচার। এই বিভাগে সমকালীন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ফোটো-এসে ও ফোটো-ফিচার নিয়মিত প্রকাশ করব আমরা। এ-ছাড়াও রইল গল্প, অণুগল্প, প্রবন্ধ, অন্যগদ্য, কবিতা, ভালো খবর, হুইলার্স স্টল, স্টিম ইঞ্জিন-সহ অন্যান্য সমস্ত নিয়মিত ও ধারাবাহিক বিভাগ।
প্রতিবারের মতোই এবারও, পরিশেষে জানাই, আপনাদের মতামত ও পরামর্শ আমাদের কাছে মূল্যবান, কারণ সেখান থেকে আমরা আমাদের ভবিষ্যতের পরিক্রমার পাথেয় যেমন, তেমনই উৎসাহও, অর্জন করে থাকি। কাজেই, পত্রিকাটি কেমন লাগছে, এটি আপনাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে কি না এবং পত্রিকার কাছে আপনারা আর কী-কী ধরনের লেখা আশা করেন, আমাদের জানান। খুব অল্প সময়ে, অত্যন্ত স্বল্প লোকবল ও প্রায় বিনা অর্থবলে কাগজটি করতে গিয়ে আমাদের তরফে অনবধানবশে কোথাও কোনও ত্রুটি রয়ে গেলে, ধরিয়ে দিন তা-ও।
ভালো থাকুন। পাশে থাকুন।